তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
অধ্যায়: সাত
রঙ পাল্টানোর কথা বলছিলাম।
ইদানীং রিক্তর কল্যাণে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে দেখেছি, সব মানুষরাই কমবেশি রঙ পাল্টায়। রঙ পাল্টানোই মানুষের ধর্ম। সেইসঙ্গে আমার মনে পড়ল, মানুষরা যে রঙ পাল্টায় সেটা আমি আগেই জানতাম, কিন্তু বুঝতাম না। ছোটবেলা থেকেই তো দেখে আসছি বিষয়টা। এখন গভীরভাবে ভাবলাম এই জীবনে দেখা পরিচিত সব মানুষের মুখগুলো। এমন একজনকেও খুঁজে পেলাম না যাকে রঙ পাল্টাতে দেখিনি। রোজ রাস্তাঘাটে, স্টেশনে, বাজারে, বাসে, ট্রেনে যাদের সঙ্গে দেখা হয় তারা সবাই কি রঙ পাল্টায় ? এই শহরে ঘুরতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষকে দেখি। তারা সবাই রঙ পাল্টায় কিনা বা পাল্টালেও কখন কিভাবে পাল্টায় তা তো বলতে পারব না। তাহলে লেগে থাকতে হয় সবার পিছনে। সে কি সম্ভব ? চেনা লোকদের কথা তবুও বলা যায়। অচেনা লোকেদের কথা কী বলব ? অহরহ যেসব মানুষ দেখছি তার প্রায় সবই অচেনা। কোনদিন সারা শহরে টৈ-টৈ করে ঘুরলে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের ক’টা পরিচিত মুখ ? দু’-পাঁচটা হবে বড়জোর। রোজই শ’য়ে-শ’য়ে এমন মানুষ দেখি যাদের আগে কখনও দেখিনি। গড়ে রোজ যদি এক হাজার মানুষের সঙ্গে দেখা হয় ধরে নিই তো পঞ্চাশ বছরের জীবনে কেউ সর্বমোট এক-দেড় কোটি মানুষের দেখা পাবে। তার এক শতাংশও চেনা মুখ নয়। এই এত এত অচেনা লোকের রঙ পাল্টানোর গল্প কার পক্ষে জানা সম্ভব ? মুষ্টিমেয় যে ক’জন পরিচিত মুখ রয়েছে তাদের বারবার দেখি, আর তাই তাদের চরিত্রও কিছুটা জানি। তারা সবাই যে বিভিন্ন সময়ে রঙ পাল্টায় তাতে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।
আমি নিজে কখন রঙ পাল্টাতে শুরু করেছিলাম ?
উত্তরটা আমার নিজেরই জানা নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে রঙ পাল্টানোর ব্যাপারটা আমার মা পছন্দ করত না। মা আমাকে ডেকে প্রায়ই বলত,
‘রঙ পাল্টে ফেলার বদভ্যাসটা আবার কী ? যার যেমন রঙ সেটা থাকলেই তো চলে। রঙে কী আসে-যায় ? তুমি কী করছ সেটাই আসল। সাদা লোকরাও কাজ করে, কালো লোকরাও কাজ করে। তাহলে খামোখা কেন রঙ পাল্টাপাল্টি ? তুমি যদি ঠিক হও, আর ঠিকঠাক কাজ কর তো রঙ পাল্টাবার প্রশ্নই থাকবে না।’
আমাকে নিয়ে মায়ের খুব দুশ্চিন্তা ছিল—- আমিও যদি অন্যদের মত রঙ পাল্টাপাল্টি করতে থাকি। আমাকে বলত,
‘নিজেকে সবসময় মানুষ ভাববি। মানুষ হলে তার রঙ পাল্টাবার দরকার নেই। গিরগিটির ঘন ঘন রঙ পাল্টায়। তুই গিরগিটি নোস্, এটা সবসময় মনে রাখবি। তোকে ঈশ্বর একটা মাথা দিয়েছেন, সেটা গিরগিটিদের মাথা নয়। গিরগিটি কেন, মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণি এই মাথাটা পায়নি। মানুষের মাথাটা একেবারেই মানুষের, কপিরাইট মানুষেরই হাতে। এমন মাথা যার আছে তার গিরগিটি হওয়ার প্রয়োজন নেই।’
মায়ের কথাগুলো শুনতাম আর মাথাটায় হাত বুলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করতাম কী এর বিশেষত্ব। আমাকে মা চোখে চোখে রাখতে, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছি জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিত। ওই বয়সেই আমি দেখতাম আমার অনেক সহপাঠী বা সঙ্গী রঙ পাল্টাবার কৌশল শিখে গেছে। কারো কারো রঙ এমনি এমনিই পাল্টে যায়, কেউবা নিজের ইচ্ছ্যেতে রঙ পাল্টায়। মা আমাকে ঐসব বন্ধুর সঙ্গে একেবারেই মিশতে দিত না।
আমার এক বন্ধু ছিল কৌলিক। সে আমার খুব প্রিয়। অনেক গোপন রহস্য জানত সে। বর্ষাকালে পিঁপড়েরা কোথায় লুকিয়ে থাকে, কোন্ কোন্ বাদুড় ভ্যাম্পায়ার গোত্রভুক্ত হতে পারে, মাছেদের ঘরবাড়ি কেমন হয়, প্রেতাত্মারা পঞ্চমাত্রিক কোন জগতের বাসিন্দা কিনা—- এমনই সব আকর্ষণীয় বিষয়ে তার ছিল প্রভূত জ্ঞান। আমাকে নিয়ে নানা রহস্য সমাধানের চেষ্টায় ঘুরে বেড়াত সে আজব আজব জায়গায়। হুঁশিয়ারি মাজার ছিল তেমন এক উদাহরণ। ইলাক্কাস মিঞার কবর। কোমরসমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা চারধার। প্রচুর ইঁদুর গর্ত করে থাকত সেখানে। তার মধ্যে একটা ইঁদুরের ছিল সাদা দাড়ি। সে আসলে ইলাক্কাস মিঞা। তাকে কেউ দেখতে পেত না। ইঁদুরের গোঁফ হতে পারে, দাড়ি ব্যাপারটা বেমানান। কিন্তু দাড়িওয়ালা ইলাক্কাস যেহেতু মরার পর ইঁদুর হয়ে গিয়েছিল তাই তার দাড়িটাও ছিল গোঁফের পাশাপাশি। দাড়িওয়ালা ইঁদুরটার দেখা না পেলেও সবাই জানত সে আছে। কৌলিক আমাকে নিয়ে সেই ইঁদুর খুঁজতে গিয়েছিল। খোঁজাখুঁজি চলছিল বিস্তর, কোন সমস্যা ছিল না। দাড়িওয়ালা ইঁদুরটার দেখা পেয়েই যাব ভাবছিলাম। বাদ সাধল মগা। সে আমার মাকে গিয়ে নালিশ করল,
‘কী বলব মাসিমা, বললে বিস্যেস করবেন না। কৌলিকটার পাল্লায় পড়ে ও গোল্লায় যাচ্ছে। হুঁশিয়ারি মাজারে গিয়ে ইলাক্কাস মিঞার খোঁজ করে বেড়ায়। সাদা দাড়িওয়ালা ইঁদুর খোঁজে। ওই ইঁদুরের সাক্ষাৎ পেলে রক্ষে আছে !’
মা আমার বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল। হুঁশিয়ারি মাজার এক নিষিদ্ধ স্থান। নানা দুর্নাম আছে তার, এমনই রটনা সর্বত্র, নাকি জিন-পরী-অপদেবতা আর আপদ-বিপদের আস্তানা। যদিও লোকেরা মুশকিল আসানের জন্য যায় সেখানে। তবে যাওয়ার সময়-অসময় আছে। মগাটার কোন্ পাকা ধানে মই দিয়েছিলাম জানিনা। গোপন ব্যাপারটা মাকে জানিয়ে দেওয়ার মধ্যে কী আনন্দ পেল কেজানে ! মা আমাকে ধরে জিজ্ঞেস করল একদিন,
‘তুই কৌলিকের সঙ্গে হুঁশিয়ারি মাজারে যাস ?’
অস্বীকার করতে যাচ্ছিলাম এই বলার চেষ্টায়,
‘ন্-না তো….’
মা তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। বলল,
‘তোর কিন্তু রঙ পাল্টিয়ে যাচ্ছে।’
অতএব আর অস্বীকার করতে পারলাম না। মা হুকুম জারি করল,
‘আর যাবি না ওখানে।’
মহা মুশকিল। সেদিনই সন্ধেবেলা কৌলিকের সঙ্গে হুঁশিয়ারি মাজারে যাওয়ার কথা ছিল। সাদা দাড়িওয়ালা ইঁদুরটা হয়তো সেদিনই দেখা দেবে। কিন্তু মা যেমন আদেশ জানাল তা অমান্য করি কী করে ?
চিন্তায় চিন্তায় একবেলাতেই চিবুকের তিলটা সাইজে ডবল হয়ে গেল। তারপর ভাবলাম, যা হয় হবে, মাকে লুকিয়ে বেরোতেই হবে। কৌলিকের সঙ্গ ছাড়তে পারব না। সন্ধের একটু আগে বাড়ি থেকে বেরোতে যাচ্ছি, মা ডেকে আচমকা জিজ্ঞেস করল,
‘কোথায় যাচ্ছিস ?’
‘সুনীত স্যারের বাড়ি। ম্যাথস্-এর কয়েকটা প্রব্লেম ছিল দেখাবার।’
মা আমার দিকে তাকিয়েছিল স্বাভাবিক দৃষ্টিতে, হঠাৎ দেখি তার চোখ গোল গোল হয়ে গেল। এগিয়ে এসে গভীরভাবে তাকাল মা আমার দিকে। বলল,
‘তোর রঙ পাল্টে গেছে।’
‘কী যা-তা বলছ ! চোখটা নির্ঘাৎ খারাপ হয়েছে।’
কথাগুলি বলেই পালিয়ে গেলাম। ফিরলাম রাত আটটা নাগাদ। হুঁশিয়ারি মাজারে আমি আর কৌলিক অনেক খুঁজেও সাদা দাড়িওয়ালা ইঁদুরটার পাত্তা পেলাম না। বাঁশঝাড় আর ঝোপড়া গাছের পটভূমিকায় গা-ছমছমে পরিবেশে কাটালাম প্রায় দেড়-দু’ঘন্টা। পেঁচার ডাকে আর জোনাকির জ্বলা-নেভায় বুক কাঁপছিল ধুপুস-ধুপুস। কোথায় ইঁদুররুপী ইলাক্কাস মিঞা ? দেখা পেলে অনেক গোপন রহস্যের চাবিকাঠি পাওয়া যেত। হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। মা অপেক্ষা করছিল। দেখেই জিজ্ঞেস করল,
‘হুঁশিয়ারি মাজারে গিয়েছিলিস ?’
চমকে গেলেও সামলে নিলাম। বললাম,
‘দুর্, কী যে বলনা ! সুনীত স্যারের কাছে অঙ্ক করছিলাম…..’
‘তোর রঙ কিন্তু আবার পাল্টে যাচ্ছে।’
মা গম্ভীরভাবে জানাল। আমি উত্তর খুঁজে পেলাম না।
আমার যে রঙ পাল্টে যায় সেটা এভাবেই প্রথম জেনেছিলাম কিনা বলতে পারব না। কবে রঙ পাল্টানোর পালা শুরু হয়েছিল আমার তাও স্পষ্ট জানিনা। তবে সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে প্রায়ই যে আমার রঙ পাল্টায় তা মায়ের চোখে ধরা পড়েছিল। আমি উড়িয়ে দিতাম, বিশ্বাস করতে চাইতাম না, কিন্তু মা আমাকে নিয়মিত নানা পরিস্থিতিতে জানাত যে আর দশটা লোকের মত আমারও রঙ পাল্টে পাল্টে যায়।
হুঁশিয়ারি মাজারে যাওয়ার মিথ্যেটা বলে রঙ পাল্টানোর ঘটনাটির পর মা আমাকে বারণ করে দিল যাতে কৌলিকের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখি। এতে খুব মুশকিল হয়ে গেল। কৌলিক তখন আমার প্রাণের বন্ধু, তার সঙ্গে না মিশে থাকা যায় ? রোজ বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মা বলত,
‘কৌলিকটার সঙ্গে মিশবি না কিন্তু।’
আমি বলতাম, ‘আচ্ছা’। রোজ বাড়ি ফিরলে মা প্রথমেই জিজ্ঞেস করত,
‘কৌলিকের সঙ্গে যাস নি তো কোথাও ? কথা বলিসনি তো ওর সঙ্গে ?’
আমি গলায় জোর এনে জবাব দিতাম,
‘পাগল ! তুমি বারণ করে দিয়েছ, আর মিশি ওর সঙ্গে ?’
এবং ওই কথা বলতেই আমার রঙ পাল্টে যেত বুঝতাম আর তাই বলার আগে যে করেই হোক মায়ের চোখের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যেতাম।
গল্পের বইয়ের নেশাটা প্রবল হয়েছিল স্কুলে পড়ার সময়। রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ আর ভূতের গল্প পেয়ে বসেছিল আমাকে। অদম্য নেশা। বইগুলো জুটেও যেত যেভাবেই হোক। স্কুলের ব্যাগে রক্তমাখা ছুড়িহাতে মর্কটমার্কা একটা লোকের ছবিওয়ালা ওইরকম একটা বই ছিল, ধরা পরে গেলাম সত্যস্যারের হাতে। বই তো বাজেয়াপ্ত হলোই, উপরন্তু মাকে ডেকে নালিশ জানালেন স্যার,
‘ট্যালেন্ট ছিল, প্রসপেক্টও ছিল, কিন্তু রেজাল্টটা খারাপ হচ্ছে। এইসব ছাইভস্ম পড়লে এমনটাই হবে। নজরে রাখবেন।’
মা আমাকে বকাবকি করল, ভাল কথায়ও বোঝাল। অনুতাপও হল আমার খুব। মাকে কথা দিলাম, আর ছোঁব না ওইসব রদ্দি বই। দু’দিন কাটল, তিনদিন কাটল। নেশা যে কী বস্তু ! লোভ সামলাতে পারছিলাম না। বাড়িতে থাকলেই মা চোখে চোখে রাখত। পড়তে বসছি কিনা আর বসলেই বা কী বই পড়ছি। পড়ার বই নিয়ে বসে থাকলেও লোভ আর নেশা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকত। আমার ঘন ঘন রঙ পাল্টে যেত। মা সন্দেহের চোখে তাকাত। বুঝতে পারত আমার মনোভাব। তবে রঙ পাল্টালেও স্থায়ী হত না বলে তেমন কিছু বলত না। কেবল সুযোগ পেলে বোঝাত যাতে আমার সুবুদ্ধি হয়। সুবোধ ছেলের মত ঘাড় কাৎ করে মায়ের কথা শুনতাম। তারপর লোভের কাছে হার মানলাম। কুবুদ্ধি চাপল মাথায়। পড়ার বই নিয়ে বসতাম, তলায় রাখতাম গল্পের বই। মা আমার ছলনাটা বুঝতে পারত না। মাকে এইভাবে ফাঁকি দিয়ে চুরি করে দিব্বি পরে যেতাম রহস্য-রোমাঞ্চ আর ভূতের গল্প। মা সামনে থাকলে বা আড়ালে গেলে যা পড়তাম চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তা আসলে আগে থেকেই মুখস্থ করে রাখা পড়া। মা ভাবত, আমি বোধহয় সত্যিই পড়ছি। কিন্তু আমার রঙ পাল্টানোর বহর দেখে সন্দেহও করত। মায়ের চোখে সেই সন্দেহ অনবরত দেখতে পেতাম। আমার রঙ পাল্টানো চলতেই থাকত। সন্দেহ করলেও মা কিছুই বুঝতে পারত না।
এই ছলনা আর ফাঁকিবাজির ফল ফলতে দেরি হল না। পড়াশুনায় ছিলাম ক্লাশে একনম্বর, এখন অত্রি সে জায়গাটা দখল করে নিল। সব বিষয়েই আমার নম্বর কমতে লাগল। অত্রি ছাড়াও সরোজ, পুলকরা পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে আমার তুলনায় বেশি বেশি নম্বর পেয়ে গেল। ক্লাশটিচার সুধীরবাবু স্যার একদিন সবার সামনে দাঁড় করিয়ে আমাকে বললেন,
‘দ্যাখ্, তোর কী অধঃপতন ! অংকে আর ইংরেজিতে তুই এবার ক্লাসে সবচেয়ে কম মার্কস্ পেয়েছিস। ভাবতে পারছিস ?’
আমার খুব রাগ হল। কার ওপর জানিনা। হয়তো নিজের ওপর অথবা বিশ্বসংসারের সবার ওপর। আমার রঙ পাল্টাতে লাগল। স্যাররা সবাই অত্রির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আগে এই প্রশংসা পেতাম কেবল আমি। অত্রি কেন কী আক্কেলে আমার চেয়ে ভাল হবে ? আমি অত্রিকে হিংসে করতে লাগলাম। আমার আবার রঙ পাল্টে গেল। একা অত্রি কেন, সরোজ আর পুলকের ওপরও আমার খুব রাগ হল। সবাইকে আমি বিদ্বেষের চোখে দেখতে লাগলাম। মনে হল, ওরা সবাই আমার শত্রু। রঙ কেবলই পাল্টে যাচ্ছিল আমার। অত্রি, সরোজ আর পুলকের অমঙ্গলের চিন্তা এখন আমার মাথায়। কেবলই ভাবি, ওদের বড় কোন ক্ষতি হোক। এসব কথা যত ভাবি তত আমার রঙ পাল্টাতে থাকে।
এসব ব্যাপার ঘটেছিল সেই কোন্ কালে। মনে ছিল না আমার। তেমনভাবে তলিয়েও ভাবিনি ব্যাপারগুলো। রঙ পাল্টানোর কথাটা তখন মাথাতেও ছিল না। বলছি এখন রঙ পাল্টানো, তখন বলা হত অন্যরকম। মা-ও ঠিক রঙ পাল্টানো বলত না, বলত অন্যকিছু। এখনও কেউ বলে না রঙ পাল্টানো। বলছি কেবল আমি, আর অবশ্যই রিক্ত। অন্যেরা যে যা-ই বলুক, আমি রঙ পাল্টানোই বলে যেতে থাকব। আর এই রঙ পাল্টানোর অভিজ্ঞতাটা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। রঙ পাল্টে যেত আমার আগে, রঙ পাল্টে যায় আমার সবসময়। প্রশ্ন হল, রঙটা কি নিজে নিজে পাল্টায় নাকি রঙ পাল্টাই আমি আমার ইচ্ছেমত। আগে সন্দেহ ছিল। ভাবতাম, রঙ পাল্টানোর ওপর আমার কোন হাত নেই। আমি চাই বা না চাই, পরিস্থিতি অনুযায়ী আমার রঙ আপনা থেকেই পাল্টে যাবে। কথাটা একশ’ ভাগ সত্যি। তবে অন্য এক অভিজ্ঞতাও হচ্ছে ইদানীং। দেখছি আজকাল, আমি ইচ্ছে করলে যেমন চাই তেমন রঙ ধরে ফেলতে পারছি। অর্থাৎ রঙ পাল্টানোটা এখন কেবল নিজে নিজেই ঘটছে না, ঘটছে আমার ইচ্ছে বা পছন্দ বা প্রয়োজন অনুযায়ী। অন্যকথায় বলতে গেলে বলতে হয় যে দু’টো ব্যাপারই সত্যি। রঙ পাল্টায় তার নিজের নিয়মে, আবার রঙ পাল্টানো রয়েছে আমার নিজেরই নিয়ন্ত্রণে। আমাকে না জানিয়ে যেমন আমার রঙ পাল্টে যেতে পারে তেমনি আমি যখন খুশি আমার রঙ যেমন খুশি পাল্টে ফেলতে পারি।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে বাচ্চাদের আমি একেবারেই পছন্দ করি না। সবাই বাচ্চা দেখলে গলে জল হয়ে যায়, মুখেচোখে বিকৃতি এনে বাচ্চাদের আদর করতে থাকে। এসব আদিখ্যেতা আমার একেবারেই সহ্য হয় না। আমি পারতে কোন বাচ্চার কাছাকাছি যাই না। আসলে বাচ্চা বা শিশুদের নিয়ে আমার তিক্ত কিছু অভিজ্ঞতা আছে। যতবার আমি কোন বাচ্চার সংস্পর্শে গেছি ততবারই একটা না একটা অঘটন ঘটেছে। একবার একটা বাচ্চা আমার কান কামড়ে দিয়েছিল। আমার কান বেশ কয়েকবার বিভিন্ন বাচ্চার আক্রমণের শিকার হয়েছে। একবার ট্রেনে চেপে যাচ্ছিলাম কোথাও। বসার জায়গা পেয়ে গিয়েছিলাম, জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম অন্যমনস্কভাবে। হঠাৎ আমার একটা কান কিসে যেন খাবলে ধরল। চমকে তাকিয়ে দেখি একটা দুধের বাচ্চা, আমার পিছনে বসা তার বাবা বা মায়ের কাঁধে চাপা অবস্থায় কানটাকে আমার পাকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। আরেকবার একটা বাচ্চা আমার নাক এমন আঁচড়ে দিয়েছিল যে ডাক্তার দেখিয়ে ও মলম লাগিয়ে তা সারাতে লেগেছিল দশদিন। আমি যেখানে থাকি তার পাশের ফ্ল্যাটবাড়ির বিভিন্ন ফ্ল্যাটে দুর্ভাগ্যক্রমে প্রত্যেক বছর একটা করে নতুন বাচ্চা জন্ম নেয়। তাতে আমাকে কী যে ভোগান্তি পোহাতে হয় তা কাউকে প্রাণ খুলে বলারও উপায় নেই, কারণ বলতে গেলেই সবাই ভাববে যে আমি একটা পাষণ্ড আর তাই বাচ্চাতে এত অরুচি। কিন্তু এটা তো সত্যিকথা যে গত কয়েকবছর ধরে যখনই রাতে আমি ঘুমোতে যাই কোন না কোন ফ্ল্যাটের কোন না কোন বাচ্চা চিলচিৎকার জুড়ে দেয় আর আমার ঘুমের দফারফা হয়ে যায়। বাচ্চাদের সত্যি বলছি, আমি দু’চোখে দেখতে পারি না। মুশকিলে পড়ে যাই যদি কেউ তার বাচ্চার অন্নপ্রাশনে বা জন্মদিনে আমাকে নেমন্তন্ন করে। আপ্রাণ চেষ্টা করি না যাওয়ার, আর যেতেই যদি হয় তো আমার দুর্দশা দেখে আমারই চোখে জল চলে আসে। গোবদা-গোবদা বাচ্চাগুলোর হাত-টাত ধরতে হয়, গালে আলতো টিপ দিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বলতে হয়, ‘উতু-পুতু-মুতু ছোনাটা আমাল’ ! আবার অন্যদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে হয় ডাহা মিথ্যেকথাটা, ‘কী মিষ্টি ! আমি বাচ্চাদের খুব ভালবাসি’। এইসব কথা বলতে বলতে বুঝতে পারি যে আমি নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী গায়ের রঙ পাল্টিয়ে ফেলছি। সবার সামনে বাধ্য হয়ে যে বাচ্চাটাকে অত আদর করলাম একটু সুযোগ পেলেই গোপনে এমন এক রামচিমটি দেব না ! এমন কাণ্ড করি আমি হামেশাই। আড়ালে পেয়ে কত বাচ্চাকে যে চোরা চিমটি কেটেছি তার কোন হিসেবে আছে ? কেন যে অনেক বাচ্চাই অকারণে হঠাৎ-হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে বোঝে না তাদের মা-বাবারা। আসলে আমার মত লোক কি কিছু কম আছে জগতে ? অবস্থা বুঝে রঙ পাল্টাতে পারে সবাই ইচ্ছে অনুযায়ী।
ছিলাম এমনই, বাচ্চাদের যথাসম্ভব এড়িয়ে। তাদের নিয়ে কিছু বলিও না, কাছাকাছিও হই না। আড়াল থেকে সুযোগ পেলেই চোরাচিমটি চালাই। বাচ্চারা কাঁদে, তাদের মা-বাবারা বুঝতে হিমশিম খেয়ে যায় কী হল ভেবে ভেবে। গবা আমাকে বেশ বিপদে ফেলে দিল। গবার একটা ভাল নাম আছে, গৌরবানন্দ আচার্য। সে নানারকম জনহিতকর কাজকর্ম করে বেড়ায়। কী সব এনজিও-টেনজিও চালায়। সে কার কাছে কুবুদ্ধি পেল, আয়োজন করল এক শিশুমেলার। করুক, তাতে কোন সমস্যা ছিল না। শিশুমেলা-পশুমেলা যার যা খুশি করতে পারে, আমার কী আসে-যায় ? আমাকে না জড়ালেই হল। কিন্তু গবা আমাকেও ফাঁসিয়ে দিল। আমার নামটা জুড়ে দিয়ে করে দিল শিশুমেলার সভাপতি। আপত্তি জানালে হাড়বিচ্ছু গবাটা গম্ভীরভাবে বলল,
‘তোমার নামটা বাদ দিতে পারি। কিন্তু শিশুদের তুমি পছন্দ কর না ব্যাপারটা প্রচার হলে খুব কি মঙ্গল হবে তোমার ? সমাজে শিশুদরদী হিসেবে সুনাম অর্জন করার একটা সুযোগ পেয়েছ, ছেড়ে দেবে ? আমি অন্তত জানি, তুমি গোপনে শিশুদের চোরাচিমটি কেটে বেড়াও।’
কী আর করি, রাজি হতেই হল। এলাহি আয়োজন করল গবা। জগতে এত শিশু ছিল কে জানত ? সবাই এসে হাজির হল ময়দানে। সঙ্গে তাদের বাবা-মা। আর সংবাদমাধ্যম, বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ ও লোকজন। সেই আসরে আমাকে বক্তব্য রাখতে হল। রঙ পাল্টে নিয়ে আমি বললাম,
‘শিশুরা নির্মল, পবিত্র। তারা ভগবানের দূত। আমি শিশুদের খুব ভালবাসি। শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। যারা শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে আড়ালে-আবডালে চোরাচিমটি কেটে বা খোঁচা মেরে তাদের কান্নার কারণ ঘটায় সেইসব দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করতে হবে। ওইসব দুর্জন ব্যক্তিরা সমাজের কলঙ্ক।’
জোর হাততালি পেলাম। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। কথাগুলি বলার সময় আমার গায়ের কালো রঙ যে গাঢ় হলুদ হয়ে গেল কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাল না।
সেবার এক কাণ্ড হল। কোথাও যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে রাস্তায় এক জায়গায় জটলা দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। উত্তেজিত জনতা। একদল দুষ্কৃতীকে ধরে সবাই গণপ্রহার চালাচ্ছিল। নাকি ওরা পাচারকারী, এলাকায় এসেছিল সেই উদ্দেশ্যে। সবাই পেটাচ্ছিল, আমিও দলে ভিড়ে গেলাম। প্রচুর পেটালাম লোকগুলিকে। তাদের কোন কথা বলতে দেওয়া হল না। পুলিশ এল শেষপর্যন্ত। ভিড় তখন পাতলা। হাসপাতালে নিয়ে গেলে মার খাওয়া লোকগুলি সব মারা গেল। তদন্ত শুরু হল। জানা গেল, লোকগুলি মোটেই পাচারকারী নয়। এই নিয়ে খুব হৈ-চৈ শুরু হল। ধরপাকড় চলল। প্রতিবাদে আবার সেই একই জনতা, যাদের অধিকাংশই ছিল সেদিন পেটানোর দলে। বেগতিক দেখে আমিও তাদের দলেই ভিড়ে গেলাম। এখানে-ওখানে জনসভায় হাজির হতে লাগলাম, নিন্দে করলাম হিংস্র জনতার আক্রোশকে। নিরীহ মৃত মানুষগুলির স্মৃতিতে শোকসভা হতে লাগল, সব জায়গায় গিয়ে হাজির হলাম। নিজের উদ্যোগে আমি মোমবাতি মিছিলের আয়োজন করলাম। নাগরিকরা আমার নেতৃত্বে সন্ধেবেলা মোমবাতি হাতে দশ কিলোমিটার হাঁটল। আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে সবাই বলল,
‘এই ভুল আর না।’
রাতের অন্ধকারে মোমবাতির আলোয় কেউ বুঝতেই পারল না যে আমি আমার রঙ পাল্টে নিয়েছি।
আমার মায়ের কথায় ফিরে আসা যাক। আমারও রঙ অন্যদের মত পাল্টে পাল্টে যাক এটা মা অন্তর থেকে মানতে পারত না। সে কথা বলা হয়ে গেছে। মা ছিল খুব ভক্তিমতী। ভগবানে মায়ের ছিল অগাধ বিশ্বাস। দু’বেলা নিয়ম করে নানা স্তবস্তুতি করত। মা আজ নেই আমার জগতে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। সেইসব স্তবস্তুতি, যেসব মা তার ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিয়মিত নিবেদন করত আজও তার অনেক কিছু ভুলে যাইনি। মনে পড়ে, মা তার ভগবানকে উদ্দেশ্য করে প্রায়ই বলত,
‘সর্প হয়ে দংশ তুমি ওঝা হয়ে ঝাড়ো।’
তার মানে কি এই যে ভগবানও স্বয়ং রঙ পাল্টায় ? মা আজ নেই। থাকলে এই কথাটা মাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতাম।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)