সুতপন চট্টোপাধ্যায়

  বোকেন

হাট বসন্তপুরে রাজরাজেশ্বরী পুজোর ধুমধামই আলাদা। গ্রামের  দুর্গা পুজোর  আকর্ষণের চেয়ে এই পুজোর দিকে তাকিয়ে থাকে সবাই সারা বছর । এটা তো পুজো নয়, মেলা, নানান খেলা আর জিলিপী ও জিভে গজার চার দিনের মহোৎসব। কে না আসে? দশ মাইল দূর থেকে গ্রামের মানুষজন কে দেখতে পাওয়া যায় এই মেলায়। এখানে হিন্দু মুসলমানের  কোন ভেদাভেদ নেই। এক কোনে খাসির মাংসের দোকান দেয় হোসেন। কী বিক্রি তার দোকানের। দিনে তিন চারটে  ছাগল সাবার করে দেয়। এক সময় সমরেশ মুখুজ্জের পুর্ব পুরুষ জমিদার, এখন সে কোলকাতায় থাকে। সপরিবারে এই পূজোর সময় তাদের আসা নিয়ম মাফিক। তাদেরি বাড়িতে এই সময় আসে তাঁর ছেলে, ছেলের বউরা ও চাকরবাকর। তারাই দিনের বেলায় বারবার মেলাতলায় গিয়ে খবর নিয়ে জানায় সমরেশ মুকুজ্জে কে। । পুজোর ফল নৈবেদ্য যায় সমরেশ মুকুজ্জের বাড়ি থেকে। তাই তাদের বাড়িতেও এক উৎসবের ঘনঘটা। জমিদারি নেই। কিন্তু তার ঠাট বাট  আছে। শীতের শেষে মাঘ মাসের প্রথমে রাজ  রাজেশ্বরীর  পুজো। লোকে বলে এটি মা দুর্গার ষোড়শী রূপ। এই পুজো জাতি, ধর্ম  নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতিরক্ষা প্রার্থনার পুজো। 

এই মেলায় আমার সঙ্গে দেখা হয় সমরেশ মুকুজ্জের ছেলে বোকেনের। বোকেনের গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গায়ের রঙ ফর্সা,সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরে সে পুজো তলায় ঘুরে  বেড়াচ্ছিল। আমাকে দেখে কাছে এসে বলল, এবার তেলে ভাজার দোকান দেখছি না তো?

-আছে তো। বিকেলে বসবে। সকালে আর গরম গরম পাঁপড় কে খাবে? 

-আমি আজ জিবে গজা খাব, পাঁপড় খাব, ডালের ফুলুড়ি খাব। তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না। বাবা শুনলে রক্ষে রাখবে না।

-ঠিক আছে। বলে আমরা দু জনে মেলায় ঘুরে বেড়াছি। এমন সময় সনাতন বলল, দাদাবাবু তোমায় খুঁজছে। আর তুমি এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছো। তাড়াতাড়ি যাও। না হলে বকুনি খাবে। অনেকক্ষণ ধরে তোমায় খুঁজছে। বলে সনাতন চলে গেলে বোকেন বলল, জানো তো আমার হার্টে একটা ফুটো আছে। আমি খুব বেশী দিন বাঁচবো  না। খুব জোর মেরে কেটে আর দশ বছর। তারপর পটল তুলব। 

কী করে জানলে?

-ডাক্তারকে বলতে শুনেছি। ওরা ভাবে আমি জানি না। জানি সব জানি। সব জানি তাই সব খাবার টেস্ট করে নিতে চাই। 

আমি অবাক হয়ে বোকেনকে দেখি। নিজের মৃত্যু সম্বন্ধে এতটা  জেনেও সে নিজেকে নিয়ে রসিকতা করছে?

-কী অবাক হচ্ছো? বোকেন প্রশ্ন করল।

-আমি কোন উত্তর দিচ্ছি না দেখে বোকেন বলল, ওই হার্টের ফুটোটা সেলাই করার অনেক চেষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু করা যায় নি। কবে হবে কেউ জানে না। হঠাৎই একদিন আমি আর নিশ্বাস নিতে পারব না।  

আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। বোকেন বাড়ি যেতে যেতে বলল, বিকেলে এসো কিন্তু। দুজনে পাঁপড় খাব।

সেদিন বোকেন আর আসে নি। হয়ত শরীর খারাপ হয়েছে। পরের দিন বিকেলে দেখি একটি মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর মেয়েটি আপন মনে বাঁশী বাজাচ্ছে। একটু পরে সে  কিছুটা দূরে বসে  চোখ বুঝে বাঁশী শুনছে। আমার ডাকে ধ্যান ভাঙল । তকিয়ে বলল, কী দারুন বাজায় মেয়েটি। শুনেছ কখনো?

-শুনেছি। ভগবানের দেওয়া গুন। খুব ছোটবেলা থেকে বাজায়। এবার মেলায় এসেছে।

কী নাম মেয়েটির?

নাহিদা।

নাহিদার সামনে একটা কাপড় পাতা, সেখানেই যে যার মত করে পয়সা ফেলছে। বোকেন পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বলল, তুমি রোজ আসো?

নাহিদা মাথা নেড়ে বলল, আসি। বিকেলের দিকে। 

সকালে আসতে পারে না নাহিদা। বুড়ো বাবার খাবার করতে হয়, তাকে চান করিয়ে দিতে হয়, গোয়ালে জাবনা দিতে হয়, মুরগিগুলোকে খোল দিতে হয়। এমনি সব কাজ সারা সকাল । তারপর তার ভিতর ভর করে সুর। সে একমনে বাজাতে থাকে পুকুর পাড়ে বসে। কখন জমির আলে বসে। পেয়ারা গাছের ডালে বসে। আমি অনেক দিন দেখেছি।

কেউ তাকে বাঁশী শেখানোর নেই। হাটবসন্তপুরের প্রবেশের মুখে এক ছোট জনপদে নাহিদাদের ক’ ঘর বাস  । তাদের লোকের জমি ভাগে চাষ করে দিন যায়। দু’বেলা পেটের ভাত জোটে,। তাদের মধ্যে এই বাঁশী বাজানো কেউই ভালো চোখে দেখে না। পাড়ার মোড়লরা অনেক বার তার বাবা কে বলেছে, মেয়েকে এই সব না করে ঘর কন্নায় মন দিতে বল। বাবা শামসের ও অনেক বুঝিয়েছে নাহিদা কে। বোঝেনি সে। সে কেবল লোকের কথা শুনেছে। কোন কথার উত্তর দেয় নি। মা মারা গেছে সে অনেক  কাল। তাই তার পৃথিবীটা সে নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে বলেই বাঁশী তার নিত্য সঙ্গি। সে যেখানেই যায়, বাঁশী তাঁর সঙ্গে  থাকে। কোনদিন সে পয়সার জন্য বাঁশী বাজায়নি। এবার করেছে, কারণ শামসেরের চিকিৎসার খরচ  বাড়ছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে শামসের কে ডাক্তার দেখানোর সময় টের পেয়েছে নাহিদা। অনেক ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়।

দশ টাকা দেখে ডাগর চোখে তাকাল নাহিদা। দু হাত জুড়ে নমস্কার করল। তারপর বলল, আপনি জমিদারবাবুর ছেলে?

বোকেন বলল, হাঁ। কেন বলত?

-না। এত টাকা দিলেন। সহজে তো কেউ এত টাকা দেয় না। আপনার ভালো হবে। বলে আবার বাঁশী তে ফুঁ দিল নাহিদা। বোকেন আমার দিকে তাকাল একবার। কথা বলল না। আমি বুঝতে পারি বোকেনের এই কথাটা পরিহাসের মত ঠেকেছে। আমরা মেলায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তেলেভাজার দোকানে এসে দাঁড়ালাম। 

তেলেভাজার দোকানের বিশেষ আকর্ষণ আলুর চপ। চপের মধ্যে এক ফলা নারকোলের ছিলা চপ কে এত মুখোরোচক করে যে থালায় পড়তে পারে না। একটা উনুনে ভেজে শেষ করতে পারে না পবন। বোকেন কে দেখে পবন বলল, দাদাবাবু এবার তোমার জন্য ডবল ডিমের চপ করেছি। আগের বারে বলেছিলে না? ডিমের ডেভিল খাবে?

বোকেন বলল, বলেছিলাম নাকি? হবে বা। তা তাতে কি আছে? 

খেয়েই দেখ না দাদাবাবু। রোজ খেতে ইচ্ছে করবে।

আমি বললাম,তুমি চপ খেলে রাতে আর কিচ্ছু খেতে পারবে না। এক একটা চপ বোমার মত। তোমার আবার শরীর খারাপ না?

-তা ঠিক। তবে কত দিন আর বাঁচব? খেয়ে নিই। না খেয়ে মরার কোন মানেই হয় না। 

কথাটা ভালো লাগল না আমার। বললাম, আরে কী আজে বাজে বকছো? আচ্ছা খেতে চাইলে খাও।  আমি একটু ঘুরে আসি। 

ফিরে এসে দেখি বোকেন সেখানে নেই। পবন বলল, দুটো চপ নিয়ে নাহিদার কাছে গেছে।  

নাহিদার কাছে?

আমি দুর থেকে দেখলাম নাহিদার কাছে  বোকেন দাঁড়িয়ে । নাহিদা কে সাধাসাধি করছে চপ খেতে। নাহিদা খাচ্ছে না। আমি গিয়ে পৌঁছতেই নাহিদা বলল, দাদাবাবুকে বোঝাও তো। আমি চপ খেলে বাঁশী বাজাতে পারব না। আমার কাজ তো এখন বাঁশী বাজান। না বাজালে কে পয়সা দেবে? 

আমি একটু পাশে ডেকে বোকেন কে বোঝালাম। বললাম, এখন নাই বা খাওয়ালে? 

বিষন্ন হল বোকেন। তারপর বলল আমি বলেছি ওকে, ওর বাঁশী বাজানো এত সুন্দর, আমি  ওকে কলকাতায় নিয়ে যাব। আমার গানের মাস্টার রেডিওতে গান করে। ওখানে অডিশন দেওয়াব। ও খুব বড় শিল্পী হবে।ওকে ভিক্ষে করতে হবে না। 

সব বুঝলাম। কিন্তু সে তো একদিনের কথা নয়। রাজ রাজেশ্বরী পুজোটা শেষ হোক। তারপর ওকে  ডেকে কথা বলা যাবে। বলে আমি কিছুটা সান্তনা দিলাম বোকেন কে। 

বোকেন মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না। আমরা সে দিন মেলায় অনেক রাত অব্দি ঘুরেছি, নানান মুখোরোচক খাবার খেয়েছি। রাতে সিরাজদুৌল্লা যাত্রা দেখেছি। সিরাজের কিশোর বয়সের চরিত্রটা তেমন ফুটিয়ে তুলতে পারে নি পরেশ। তাই বোকেন বাড়ি যাবার সময় বলল, পরের বার এমন রোল থাকলে আমি করব। বলে রেখো গ্রামের যাত্রা পাটিকে।

রাজ রাজেশ্বরী পুজো শেষ । এবার যে যার গন্তবে ফেরার পালা। সমরেশ মুকুজ্জে সপরিবারে ফিরে যাবে কলকাতা। আমি যাবার আগের দিন বোকেনের বাড়িতে ঢোকার সময় কানে এল  ভিতরে তুমুল চ্যাঁচামেচি। সমরেশ মুকুজ্জে বলছে, না, তুমি যেটা চাইবে,  তা হবে না।

বোকেনের গলা। কেন হবে না? আমি তো কোন অন্যায় কথা বলছি না।

-তুমি যেটা বলছ সেটা সম্ভব নয়।

-কেন সম্ভব নয়? যার প্রতিভা আছে সে কেন পরে থাকবে এই গন্ডগ্রামে?

-এটা গন্ডগ্রাম নয়। এখানে মেয়েটার অনেক দায়িত্ব আছে। সে একা গিয়ে থাকতে পারবে না। ওর বাবা আছে। আবার ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। কে নেবে সেই সব ঝামেলা?

বোকেনের মায়ের গলা, ছেলে হলে কথা ছিল, মেয়ে । কোথায় কী হয়ে যায়।  ওর বাবাকে কে দেখবে? 

-সে ব্যবস্থা করে তবেই নিয়ে যাব। বোকেনের ঝাঁঝাল গলা।

বোকেনের মার এবার নীচু গলা, আমাদের বাড়িতে রাখা যাবে কী করে? ওর তো ধর্ম আলাদা। 

এবার বোকেন বলল, মা, ও যেটা বাজায় সেটা সুর। তার সঙ্গে ধর্মের কোন যোগ নেই।

এবার আমার বুঝতে অসুবিধা হল না, মেয়েটি নাহিদা। 

কিন্তু তাকে নিয়ে বোকেনের  ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানাতে নাহিদা এক কথায় নাকচ করে বলল, না। আব্বাকে ফেলে যেতে পারব না। দাদা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *