তপোপ্রিয়
স্বদেশচেতনা
শেষবেলায় মা বোধবুদ্ধি হারিয়ে যত স্থবির হয়ে যাচ্ছিল ততই আমার কাছে তাকে অপরিহার্য মনে হচ্ছিল। আমি কেবলই উদ্ধার করার আপ্রাণ চেষ্টায় হাবুডুবু খাচ্ছিলাম আমার পুরনো দিনের মাকে হেলাফেলায় যাকে ফেলে এসেছি পুরনো দিনেই। ক্রমশ মায়ের মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলাম আমার স্বদেশকে, আমার জগতকে।
স্বদেশ চেতনা কবে আমার মধ্যে ভোর হয়েছিল খেয়াল নেই। কবে যে জাতীয়তাবোধ উদ্বুদ্ধ করেছিল প্রথম তাও আজ খুঁজে পাই না। আর আমি এও জানিনা মা আমার জীবনে কবে এমন অনিবার্য-অপরিহার্য হয়ে উঠতে শুরু করেছিল।
জীবনকে বিছিয়ে ফেলে রাখি নিরুত্তাপ ছায়ার মত কোন এক সমতল মাঠের সবুজ স্বাভাবিকতায়, যেখানে ফড়িং ওড়ে না, কোন পাখির সাড়া মেলে না। ছায়া পড়ে থাকে নিশ্চল হয়ে, অথর্ব ছায়া, ঘাসের বুকে পাথরচাপা। আমি গতিহীন, সাড়হীন—- মগ্ন থাকি কেবল আপন গভীরে। বহিরঙ্গের এই নিস্পৃহ ঢাকনার অন্তরে কিলিবিলি করে ছোট ছোট চিন্তাগুলি—- আমার মায়ের মুখ, দেশ, জাতীয়তা, আরো কত কী!
বোধ হয় আমার-তোমার বোধ জেগেছিল যখন থেকে স্বদেশচেতনার আরম্ভ সেই বেলায়, আর একই সঙ্গে জাতীয়তাবোধের অনুপ্রেরণা। মা নিশ্চয় তারও আগে থেকে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। কেবল এই অপরিহার্যতার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে শিখিনি।
কবে এই উপলব্ধি জেগেছিল যদিও তা আজ পরিষ্কার বলতে পারবো না কিন্তু মনে আছে কবে থেকে স্বদেশচেতনা আর জাতীয়তাবোধ আমার মধ্যে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছিল। তখন বাংলাদেশে চলছে স্বাধীনতার যুদ্ধ। উদ্বাস্তুরা ওপার থেকে এপারের লাগোয়া রাজ্যগুলিতে এসে জমছে এর বাড়িতে ওর বাড়িতে। আমরা থাকি ত্রিপুরাতে। যেখানে থাকতাম রাতারাতি সেই অঞ্চলের জনসংখ্যা লাফিয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল। যারা এসেছিল ওপার থেকে তারা সবাই যে অচেনা এমন নয়, অনেকের সঙ্গেই চেনাজানা ছিল। অনেকদিন পর আবার তাদের দেখা পেয়ে মনে হল যেন স্বদেশকে ফিরে পেলাম।
অবশ্য আমার মনে হওয়া না-হওয়ার কোন প্রশ্ন ছিল না তখন। বয়স আমার অনেক কম আর আমি ফেলে আসা দেশটির কাউকে চিনতামও না। স্বদেশচেতনা কাকে বলে ধারণায় ছিল না। রবীন্দ্র বলে একটি ছেলে আসত আমাদের বাড়ি, আমার দাদার বয়সী। তার বাবা-মা ভাই-বোনদের নিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিল এ-দেশে। মায়ের সঙ্গে চেনা তাদের। মা বলত তার বাবার কথা, কে ছিল বা কিভাবে চেনা ছিল তাদের সঙ্গে। আজও চোখ বুজলে দেখি মায়ের কথা বলতে থাকা মুখ। কাজের ফাঁকে মা শোনাচ্ছে রবীন্দ্রের বাবার পরিচয়। খুব যে তাতে সমীহের্ ছাপ এমন নয়। মনে হয় না ভদ্রলোক গণ্যমান্য কেউ ছিলেন। আমি ভাবি আর ভাবি কেবল ভাবি মায়ের সেই সেদিনকার মুখ। পুনরুদ্ধারের তোলপার চেষ্টা চলে আমার মধ্যে। বর্ণহীন মনে হয় অন্তরপ্রদেশের দেয়াল। কী লেখা আছে কিছুতেই পড়তে পারি না।
সে সময় ক্রিকেট খেলা চলছিল, ভারতের সঙ্গে বোধ হয় ইংল্যান্ডের। এদেশেরই মাটিতে খেলা হচ্ছিল। টিভি ছিল না তখন, রেডিও ভরসা। সবে শিখেছি ক্রিকেট কী। ধারাভাষ্য শুনতে শিখেছি। ভারতের খেলা থাকলে বুকের মধ্যে বিশেষ সাড়া জাগতে শুরু করেছে। কেন জানিনা, অনেক অনেক দিন পর আজ বুঝতে পারছি সেটাই ছিল আমার স্বদেশচেতনার সূত্রপাত।
রবীন্দ্র যখন তখন আসত আমাদের বাড়ি। তার আবার দাদার সঙ্গে কিছুটা ভাব জমে গিয়েছিল। দু’জনেই সমবয়সী। কিন্তু মা রবীন্দ্রের সঙ্গে দাদার মেলামেশা পছন্দ করত না। মায়ের আমার পছন্দ-অপছন্দ দশজনের তুলনায় আলাদা ছিল। ভিতরে লালিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এর উৎস। বাবা চলে যাওয়ার পর দাদাকে ঘিরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত মা। দাদাকে হোস্টেলে রেখে পড়াচ্ছে মা, মায়ের ধ্যানজ্ঞান সেখানেই। আর রবীন্দ্র বা তার পরিবার গ্রামের অন্য দশজনের মত। পড়াশুনা শিখে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাকে একমাত্র লক্ষ্য বলে ভাবতে অভ্যস্ত নয়।
সন্ধেবেলা সেদিন আমাদের ঘরে এসেছে রবীন্দ্র। দাদাও আছে। বাংলাদেশের যুদ্ধ তখন ঘোরতর আকারে চলছে। মনে হয় দাদার কলেজ আর হোস্টেল সেই কারণেই ছুটি।
যে ঘরে বসবাস ছিল সেসময় আমাদের এখন এক আবছা ছবির মত মনে ভাসে। কোন রকমে মাথা গোজার মত একটা ঘর, দেয়াল তৈরি বেড়া দিয়ে আর চালায় উলুখড়ের ছাউনি। বললাম বটে উলুখড়, সন্দেহ আছে। ত্রিপুরায় গ্রামাঞ্চলের দিকে বাড়িঘরের চালায় টালি থাকত না টিন থাকত না, থাকত এই ঘাস জাতীয় উলুখর। কথ্য ভাষায় বলা হত ছন । জলাজমি বা নদীর পাড়ে প্রচুর জন্মায় এই ঘাস। কেটে শুকিয়ে বাজারে বিক্রি হয় আটি.আটি। নব্বই শতাংশ ঘরের চালা তৈরি হয় এই ছন দিয়ে।
সদ্য সদ্য আমরা আবার উদ্বাস্তু হয়েছি। পূর্ববঙ্গ থেকে যে বাড়ি বদল করে আনা হয়েছিল, যেখানে বাবার মৃত্যু ঘটেছিল সেই বসতবাড়ি আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। আমাদেরই কিছু নিকট-স্বজন তাদের ভাগ নিতে এসেছিল কলকাতা থেকে। তাদেরই ভাগে পড়ল বাস্তুভিটে। মায়ের অনেক অনুরোধ আর কাকুতিমিনতি উপেক্ষা করে তারা তাদের ভাগ বিক্রি করে দিল অন্য লোককে। আমাদের বাধ্য হয়েই গৃহহীন হতে হয়েছিল। মায়ের তখন সাধ্য ছিল না ভালো বাড়ি তৈরি করার। তাই এই কোন রকমের আস্তানা।
সেই বেড়ার ঘরের প্রায় তিন পাশ জুড়ে মেঠো জমি যেখানে বর্ষাকালে পাট গাছের জঙ্গল চালা সমান উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আমার যে কিভাবে মনে পড়ে সেই সব নিথর রাতের কথা যখন চাঁদের আবছা জ্যোৎস্নায় ভেসে যেত সুবিশাল পাটজমির পটভূমিকায় আমাদের কুঁড়েঘর, অন্যপাশে জমাট-জমাট অন্ধকার গাছগাছালির ভিড়। সেই সুন্দর চাঁদ আর তো ফিরে আসবেনা কোনদিন। মা আমার এমনই জোৎস্না উদ্ভাসিত রাতে লক্ষ্মীপূজার আয়োজন করত। পুরুতের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত বাড়তে থাকত আর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের বিরক্তি।
আমাদের ওই ঘরের পাশেই সৈন্যদের ছাউনি তৈরি হয়েছিল। বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে তখন দিনরাত মিলিটারি কনভয় যাতায়াত করে। যুদ্ধ সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ ঘটেছিল সেই সময়ে। যুদ্ধ যে কী হৃদয়বিদারক তার ধারণাও আমার তৈরি হয়েছিল তারই কাছাকাছি কোন এক সময়ে একটি বই পড়ে। বইটির নাম আজও আমার মনে আছে, মরণযুদ্ধে সিঙ্গাপুর । যুদ্ধবন্দীদের কিভাবে অত্যাচার করা হত সেই বর্ণনা ছিল বইটিতে। কাউকে হয়তো জোর করে এক বস্তা চাল খাইয়ে দেওয়া হল, তারপর তার মুখ সেলাই করা হল। বিমান বাহিনী আগুনে বোমা ফেলে যাওয়ার পর জনপদ কিভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল তারও বিবরণ পড়েছিলাম ওখানে। আমার ছোট্ট মাথার বুদ্ধি দিয়ে এসব কর্মকাণ্ডের কোন যুক্তি খুঁজে পাইনি। ঘুমোতে পারিনি রাতের পর রাত বিভীষিকার স্বপ্নে।
রাতদিন মিলিটারিরা যাতায়াত করত রাস্তা দিয়ে। তখন একটা খেলা চালু হয়েছিল আমাদের মধ্যে। একেকবার একেকটা কনভয়ে ক’টা গাড়ি থাকে তা গোনা। কুড়ি-পঁচিশটা গাড়ি থাকতই, কখনো কখনো একশ-দেড়শ পেরিয়ে যেত। শক্তিমান, নিশান, গঙ্গা ইত্যাদি কত যে মিলিটারি গাড়ির নাম শিখেছিলাম !
কখনো বা বিকট আওয়াজ তুলে বীভৎসদর্শন ট্যাংক সারি বেঁধে যেতে থাকত একের পর এক। সৈন্যদের সাজ পোশাক আর রক্তহিম চেহারা দেখে মনে হত না তারা এই গ্রহের জীব। একদিন দুপুরবেলা এক কান্ড। বলা নেই-কওয়া নেই হঠাৎ এক ঝাঁক ট্যাংক রাস্তা থেকে উঠে এলো আমাদের বাড়ির পাশে মাঠে। তারপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় পঞ্চাশটা তাঁবু গজিয়ে গেল। আমাদের ঘর থেকে মাত্র দশ-পনের হাত দূরে গড়ে উঠল একটা সৈন্য ছাউনি। কয়েকশ সৈন্য, ত্রিশ-চল্লিশটা ট্যাংক আর একশ-দুশ সাঁজোয়া গাড়ি। সৈন্যগুলোর প্রায় সবারই মাথায় পাগড়ি। তারা ঘুরে বেড়ায় মাঠ জুড়ে, কুচকাওয়াজ করে, সন্ধ্যেবেলা হাউমাউ শব্দে কী এক উদ্ভট ভাষায় গান জুড়ে দেয় সম্মিলিত কন্ঠে। এলাকার লোকজন, বিশেষ করে ছোটরা ভিড় করে তাদের দেখে। তারা আবার সবাইকে ডেকে ডেকে দিস্তা-দিস্তা চাপাটি আর ডাল বিলিয়ে দেয়, বাড়তি খাবার। আমার সঙ্গী-সাথীরা প্রায় সবাই সেসব খাবার খেয়েছিল। আমারও খুব লোভ হয়েছিল ওদের ডাল-রুটি খাওয়ার কিন্তু মায়ের চোখ এড়িয়ে সৈন্যদের ধারেকাছে যাওয়ার উপায় ছিল না। তবে আমিও যাইনি কারণ ওই বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম যে মা ওরকম হ্যাংলামি পছন্দ করবে না।
আমাদের তখন বড়ই দুশ্চিন্তা। ঘাড়ের কাছে সৈন্যদের বসবাস খুবই আতঙ্কের কারণ হয়েছিল। কত যে ভয়জাগানো ঘটনাবলী সবসময় তৈরি হত সৈন্যদের নিয়ে। একদিন একটা ব্যাপার ঘটল। দিদি গিয়েছিল স্নান করতে কুয়োতলায়। বাড়ি আমাদের টিলার ওপর, হাত-পঞ্চাশেক গিয়ে ঢাল নেমে গেছে তিনতলা-চারতলা। ওই নিচু জায়গাতেই কুয়ো, চারধারে বুনো ঝোপঝাড় আর নানা বর্ণের গাছগাছালি। তখন দুপুর। একটু পরেই দিদি হুড়মুড় করে দৌড়ে চলে এলো ঘরে, স্নানটান ফেলে। একটা দীর্ঘদেহী শিখ সৈন্য নাকি হঠাৎ গিয়ে হাজির কুয়ো তলায় আর দিদিকে দেখে বলল, ‘বাকেট দে না’ । দিদি শুনেই দুরদার করে পালিয়ে চলে এল। এমনই ঘাবড়ে গিয়েছিল।
দিন পাঁচ- সাত দিন পরই ওই সৈন্যরা যেমন এসেছিল তেমনি আবার চলেও গেল আচমকা। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম।
সৈন্যরা চলে গেল ঠিক, যুদ্ধের পরিবেশটা কিন্তু থেকে গেল আরও অনেক দিন। সত্তর দশকের গোড়ার দিকের কথা, যুদ্ধ অবসান হল বাংলাদেশের জন্ম দিয়ে। ওপার থেকে আসা লোকগুলি প্রায় সবাই ফিরে গেল আবার স্বাধীন দেশে। অনেকে থেকেও গেল। শরণার্থী শব্দটার প্রয়োগ তখন মুখে মুখে, সবাই বলত শরণাত্থি। আর উৎপত্তি ঘটেছিল চোখ লাল অসুখের, যার চলতি নাম ছিল জয়-বাংলা।
বাংলাদেশ জন্মের পর রবীন্দ্ররাও ফিরে গিয়েছিল। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমি আজও রবীন্দ্রকে ভুলতে পারিনি। একটু গোলগাল চ্যাপ্টা ধাঁচের বেঁটে চেহারা, ফর্সা, চওড়া মুখ, গেঞ্জি আর ভাঁজ করা লুঙ্গি পরনে। হাঁটত তড়িঘড়ি, একটু বোধহয় দুলে দুলে। রবীন্দ্রকে আমি ভুলতে পারবো না কারণ সে প্রথম আমার স্বদেশচেতনা চুরমার করে দিয়েছিল।
সন্ধেবেলা রবীন্দ্র আমাদের ঘরে এলে কথা হচ্ছিল ক্রিকেট খেলা নিয়ে। ইংল্যান্ডের টিম এসেছিল জবরদস্ত, ভারতকে খুব নাস্তানাবুদ করছিল। তবে সেদিনের খেলাটা বোধহয় ভারতের কিছুটা অনুকূলেই ছিল। আমি খুব উৎসাহ নিয়ে বলছিলাম যে এবার ইংল্যান্ডকে আমরা হারিয়ে দেবো। ‘আমরা’ কথাটাই আমি ভারতের পরিবর্তে ব্যবহার করছিলাম বারবার আর তাই শুনে রবীন্দ্র মুখ বেঁকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেছিল, ‘আমরা, হ্যঃ, যেন তুই খেলছিস ! তোকে কে পোছে রে
সেই প্রচন্ড বিদ্রুপের ধাক্কা আমাকে হঠাৎ বুঝিয়ে দিয়েছিল ভারতবর্ষ মানে আমরা নয় আমি এদেশে থাকলেও দিল্লি বা গুজরাটে বসবাসকারী কোন একজনকে স্বজন ভাবা নিছক বোকামি।