প্রীতন্বিতা

মহাকাশে শ্যামদেশীয় যমজ

কিছুদিন আগে মহাকাশে আবিষ্কৃত হয়েছে একটি বিস্ময়। জেমিনি অবজারভেটরির মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ভার্গো নক্ষত্রমন্ডলীতে দু’টি সর্পিলাকার বা স্পাইরাল গ্যালাক্সির খোঁজ পেয়েছেন। এদের নাম রাখা হয়েছে এনজিসি ৫৪২৭ এবং এনজিসি ৫৪২৬ । পৃথিবী থেকে ন’ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই দুটি গ্যালাক্সিকে দেখলে মনে হবে যেন তারা পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ। বিখ্যাত সায়ামিজ টোয়াইনদের কথা আমরা জানি। এই দুটি গ্যালাক্সি যেন মহাকাশে সেই শ্যামদেশীয় যমজ। 

জেমিনি অবজারভেটরির অবস্থান দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে। এই অবজারভেটরি এক আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সফল ক্ষেত্র। পৃথিবীর অনেকগুলি সদস্য দেশের মহাকাশবিজ্ঞানী গোষ্ঠীর সম্মেলন ঘটেছে এখানে। সদস্য দেশগুলি আর্থিক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সাহায্য দিয়ে গড়ে তুলেছে এই গবেষণাকেন্দ্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডা, চিলি, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার জাতীয় গবেষণা সংস্থার নাম এখানে উল্লেখযোগ্য। সংশ্লিষ্ট কোন দেশের বিজ্ঞানীরা সেই দেশ গবেষণাগারটিতে কত পরিমাণ সাহায্য দিয়েছে তার আনুপাতিক হারে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়ে থাকেন।

অত্যাধুনিক দুটি একই মাপের ৮ মিটার দূরবীন রয়েছে এই অবজারভেটরিতে। দূরবীন দুটির নাম জেমিনি নর্থ ও জেমিনি সাউথ। তারা একসঙ্গে মহাকাশের দুটি গোলার্ধ পুরোপুরি দেখাতে সক্ষম। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অবদান এই দুটি দূরবীন মহাকাশে দৃশ্য-অদৃশ্য রশ্মিগুলিকে সাফল্যের সঙ্গে বিশ্লেষণ করতে পারে। 

যমজ গ্যালাক্সিদের নতুন ছবি পাওয়া গেছে জেমিনি সাউথ দূরবীনে, আর এর জন্য সাহায্য নেওয়া হয়েছে জেমিনি মাল্টি-অবজেক্ট বর্ণালিবীক্ষণের। দুটি গ্যাল্যাক্সির মধ্যে এনজিসি ৫৪২৭-এর অবস্থান বাঁ দিকে একটু নিচ ঘেঁষে আর এটি অনেকটাই দৃশ্যমান। অন্যদিকে দ্বিতীয় গ্যালাক্সি এনজিসি৫৪২৬ বেশ অস্পষ্ট এবং এর অবস্থান ডানদিকে ওপর ঘেঁষে। দুটি গ্যালাক্সির আলিঙ্গনাবদ্ধ চেহারা দেখে মনে হয় যেন পাশ দিয়ে দু’জন দু’দিকে চলে যেতে যেতে হঠাৎ হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে গেছে বা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছে। দুটি গ্যালাক্সির এই পারস্পরিক আলিঙ্গন কিন্তু তেমন বিশেষ মধুর নয়, মিলনস্থলে সৃষ্টি হয়েছে এক বিক্ষুব্ধ পরিবেশ এবং আশা করা যায় যে এই অশান্ত অবস্থা সুস্থির হতে সময় নেবে অন্তত ১০ কোটি বছর। ওপর থেকে দেখে কিন্তু মনে হয় না এদের মধ্যে কোন অস্থিরতা আছে। একসঙ্গে এদের বলা হয় এআরপি ২৭১ এবং গাঠনিক কাঠামো, ভর ও আকৃতিগত দিক থেকে এরা প্রায় এক। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে এদের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক অভিকর্ষজ আকর্ষণ এবং এই কারণেই গ্যালাক্সি দুটির বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ও বিকৃতি ঘটতে শুরু করেছে।

মহাকাশে এই দুটি গালাক্সির মিলনজনিত সংঘাতে সৃষ্টি হয়েছে এক নৈসর্গিক সেতু। এই আন্তর্গ্যালাক্সি সেতু আদলে যেন একটি ফাঁপা নল, যে নল আসলে পারস্পরিক বস্তুসমূহের আদান-প্রদানের মাধ্যম। এই নল বা ফাঁপা টিউবের মধ্য দিয়ে ষাট হাজার আলোকবর্ষব্যাপী অঞ্চল জুড়ে দুটি গ্যালাক্সি নিজেদের মধ্যে গ্যাস ও ধূলিকণা দেওয়া-নেওয়া করে। সেতু নির্মিত হয়েছে এন জি সি ৫৪২৬ গ্যালাক্সিটির পশ্চিমে অবস্থিত উর্ধাংশের দুটি সর্পিল বাহু লম্বাকারে অন্য গ্যালাক্সিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে।। 

গ্যালাক্সি সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া ভালো। মহাকাশে গ্রহ, উপগ্রহ, তারকা, ধূমকেতু, গ্যাস, ধূলিকণা ইত্যাদি বস্তুগুলি একসঙ্গে পুঞ্জীভূত হয়ে একেকটি দ্বীপসদৃশ্য আয়তনের সৃষ্টি করে। এই দ্বীপটিকেই বলা হয় গ্যালাক্সি। এরকম একেকটি দ্বীপে সূর্যের মতো বা সূর্যের চেয়ে বড় হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ তারকা থাকে। গ্যালাক্সিগুলির আয়তন বিশাল। আলো সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার গতিবেগে চলে। কোন গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে আলোরই হয়তো লেগে যাবে একশ বা হাজার বছর। আমাদের সূর্যও এরকম একটি গ্যালাক্সির এক সাধারণ তারা। গ্যালাক্সিটির নাম মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথ। হাজার হাজার তারা ও অন্যান্য মহাকাশীয় বস্তু নিয়ে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির পরিবার। যমজ এন জি সি গ্যালাক্সি দুটিও আসলে এমনই একেকটি বস্তুসমূহের সমন্বয়।

প্রত্যেকটি গ্যালাক্সিতে নানা রকম প্রতিক্রিয়াজনিত কারণে গ্যাস ও ধূলিকণার মধ্যে সংঘর্ষ চলে প্রায় সবসময় আর এখান থেকেই নতুন তারকার জন্ম-সূচনা ঘটে যাকে বলে স্টারবার্স্ট। কোন গ্যালাক্সির যে এলাকায় তারকার জন্ম হয় সেই জায়গাটাকে দেখায় একটি উত্তপ্ত গোলাপী গিঁটের মত। এই গিঁটের চেহারা দেখেই গ্যালাক্সির সর্পিলাকার বোঝা যায়। সর্পিলাকার বা কুণ্ডলীপাকানো প্রত্যেকটি গ্যালাক্সির মধ্যেই তারকা জন্মের অঞ্চলটি দেখা যাবে। এরকম অঞ্চল এন জি সি গ্যালাক্সি দুটিতেও আছে। তবে এন জি সি ৫৪২৬-এর এই অঞ্চল একটু অদ্ভুতভাবে জট পাকানো এবং আয়তনে বিশাল। মজার কথা এই যে দুটি গ্যালাক্সির সংযোগ রক্ষাকারী সেতুটিতেও স্টারবার্স্ট বা তারকার জন্মের ঘটনা ঘটে চলেছে। অন্যদিকে এনজিসি৫৪২৭ গ্যালাক্সিটিতেও বিপুল আয়তন স্টারবার্স্ট অঞ্চল গড়ে উঠছে খুবই দ্রুত হারে। একটি-দুটি নয়, প্রচুর। এরকম একটি অঞ্চল রয়েছে গ্যালাক্সিটির পশ্চিমাংশের সর্পিল বাহুর শীর্ষদেশে। বাহুটি অস্বাভাবিক বড় এবং খুবই বিক্ষুব্ধ। দেখলে মনে হবে যেন প্রচন্ড এক ঝড়ে বাহুটি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

দুটি গ্যাল্যাক্সির মধ্যে আমাদের কাছাকাছি এনজিসি ৫৪২৬, এর পশ্চিমাংশের শীর্ষবাহুটি সবচেয়ে কাছে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এনজিসি৫৪২৭ উপবৃত্তাকার পথে পরিক্রমা চালিয়ে যাচ্ছে এবং অন্য গ্যালাক্সিটির পিছন থেকে সম্মুখভাগে উঠে আসছে। যদি এনজিসি৫৪২৭ গ্যালাক্সির কোন গ্রহে কাল্পনিক কোন বাসিন্দা থাকে তো সে দেখতে পাবে অন্য গ্যালাক্সিটি এগিয়ে যাচ্ছে মোটামুটি লম্বাকার পথ ধরে। 

কয়েকটি ঘন সন্নিবিষ্ট দ্বীপ নিয়ে যেমন একটি দ্বীপপুঞ্জ তেমনি কাছাকাছি অবস্থিত বেশ কিছু গ্যালাক্সি নিয়ে মহাকাশে রয়েছে একেকটি গ্যালাক্সি ক্লাস্টার বা গ্যালাক্সিগুচ্ছ। আসলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এ এক মজার নিয়ম, গ্যালাক্সিগুলি মহাকাশে ছড়িয়ে রয়েছে দলবদ্ধভাবে, দেখলে মনে হবে একেকটি যেন গ্যালাক্সি-গ্রাম। সমাজবদ্ধতার ইঙ্গিত বোধহয় মহাকাশীয় বস্তুদের মধ্যেও রয়েছে। ইদানিং জানা গেছে যে কাছাকাছি গ্যালাক্সিগুলির মধ্যে রয়েছে মহাকর্ষজনিত পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যা নতুন গ্যালাক্সির জন্ম দিতে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিগ ব্যাং-এর সূচনাকাল থেকেই গ্যালাক্সিগুলির মধ্যে এরকম পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলে আসছে। আমাদের মিল্কি ওয়ে বা ছায়াপথ গ্যালাক্সিও এভাবে কাছাকাছি বামনাকার লার্জ ম্যাগেলানিক ক্লাউড গ্যালাক্সির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং ভাবা যাচ্ছে যে ভবিষ্যতে ২৬ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের এম থ্রি ওয়ান বা অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির সঙ্গে নিজস্ব এক সম্পর্ক গড়ে তুলবে। গ্যালাক্সিগুলির এরকম পারস্পরিক আকর্ষণজনিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মনে করা হচ্ছে ভবিষ্যতে সবাইকে খুবই কাছে টেনে আনবে, এত কাছে যে কাউকে আর আলাদা মনে হবে না এবং এভাবেই সবাই মিলে গড়ে তুলবে এক সুবিশাল উপবৃত্তাকার মহাগ্যালাক্সি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *