দীপান্বিতা
আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন
স্টালিনের রাশিয়ায় বাধ্যতামূলক শ্রমিকদের ক্যাম্পের নাম ছিল গুলাগ । লেখক নিজেও বন্দী ছিলেন এই ক্যাম্পে। এখানে থাকার অভিজ্ঞতা এক বিভীষিকা। এই ক্যাম্পে বন্দী শ্রমিকদের ওপর যে অমানবিক অত্যাচার চালাত স্টালিনের অনুচররা তাকে ভিত্তি করেই তিন খন্ডের ঐতিহাসিক কাহিনী গুলাগ আরকিপেলাগো। এভাবে বিশ্ববাসী তাঁর লেখা থেকে জানতে পারে, ভালোমানুষ মুখোশের ছদ্মবেশে স্টালিন রাশিয়ার লেবার ক্যাম্পগুলিতে কী সন্ত্রাস চালাতেন ও তাঁর আসল চেহারা কেমন ছিল। এই বই সলঝেনিৎসিন-এর জন্য একদিকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়,অন্যদিকে জন্মভূমি রাশিয়া থেকে এই বইয়ের জন্যই তাঁকে বহিষ্কৃত হতে হয়।
বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায় বিদ্রোহী হিসেবে যে ক’জন সাহিত্যিকের নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হবে আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছিল স্টালিনের অত্যাচারে বিধ্বস্ত রাশিয়ার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার আইসেভিচ সলঝেনিৎসিন-এর জন্ম রাশিয়ার কিসলোভদস্কে ১৯১৮ সালের ১১ই ডিসেম্বর। সেই সময়কার অবিভক্ত সোভিয়েত রাশিয়ার স্বৈরাচারী শাসক জোসেফ স্টালিনের অত্যাচার এবং দিনমজুর ও শ্রমিক শ্রেণীর অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট কলমের ডগায় এনে বিপদে পড়েন সলঝেনিৎসিন এবং ১৯৭৪ সালের রাশিয়া থেকে বিতাড়িত হন। কুড়ি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে কাটিয়ে প্রিয় স্বদেশভূমিতে ১৯৯৪ সালে তাঁর পুনরাগমন ঘটে।
![](https://prativasmagazine.com/wp-content/uploads/2025/01/Aleksandr-Solzhenitsyn.webp)
চরম অপমান ও লাঞ্ছনা ভোগ করেও লেখক ভুলে যাননি নিজ জন্মভূমি রাশিয়া এবং তার সাধারণ মানুষজনকে। ১৯৭০ সালে নোবেল প্রাইজ পেয়েও পুরস্কার নিতে সুইডেনে যাননি এই ভয়ে পাছে ওখানে গেলে কমিউনিস্ট সরকার তাঁকে তাঁর প্রিয় রাশিয়াতে ঢুকতে না দেয়। নিজের দেশকে এতটাই ভালোবাসেন এই লেখক যে সন্তান-সন্ততিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেও নিজে মস্কোতে থাকতেন। স্ত্রী নাতালিয়া তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন। আলেকজান্ডারের পান্ডুলিপি পরিমার্জন থেকে শুরু করে প্রকাশকের কাছে দরবার করা বা বই প্রকাশ করা ইত্যাদি সমস্ত কিছুই সুষ্ঠুহাতে সামলাতে এই তেজস্বিনী মহিলা সিদ্ধহস্ত। নাতালিয়া হলেন আলেকজান্ডারের ভাষায়, তাঁর পাবলিক ফেস, আবার আলেকজান্ডার প্রতিষ্ঠিত একটি রুশ সামাজিক তহবিলের সর্বময় কর্তা। লেখকের প্রকাশিত লেখা এবং বই থেকে প্রাপ্ত রয়ালিটি ওই তহবিলে জমা পড়ে। স্টালিনের আমলে অত্যাচারিত যেসব ব্যক্তি এখনো জীবিত তাঁদের ওই অর্থ থেকে পেনশন দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ককেশাস পর্বতমালার উত্তরাংশে আলেকজান্ডারের দাদু ছিলেন বিশাল এস্টেট-এর মালিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর মা তাইসিয়া পড়াশোনা করতে মস্কো আসেন ও যুবক সৈনিক অফিসার আইজাকির সঙ্গে পরিচিত হন। পরে তাঁদের বিয়ে হয় কিন্তু লেখক যখন মাতৃগর্ভে তখন বাবা আইজাকি শিকারে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর মা তাঁকে সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষায় যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন। মা ও মাসি মিলে তাঁকে বড় করে তোলেন। তাঁর ২২ বছর বয়সের সময় মা মারা যান।
বিশ্ববিদ্যালযয়ে তিনি অংক নিয়ে পড়লেও দর্শন-সাহিত্য-ইতিহাস শিখেছিলেন করেসপন্ডেন্স কোর্স হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রেড আর্মির হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সরাসরি যুদ্ধও করেছিলেন। এ সময়েই জনৈক বন্ধুকে তিনি স্টালিনের সমালোচনা করে চিঠি লেখেন। সেই চিঠি যেভাবেই হোক প্রকাশ পেয়ে যায় আর সলঝেনিৎসিনকে লেবার ক্যাম্পে আট বছরের বন্দীদশায় পাঠানো হয়। অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে আট বছর কাটার পর তিনি লেবার ক্যাম্প থেকে ছাড়া পান। এবার বাকি জীবন গৃহবন্দী হয়ে থাকার শাস্তি জোটে তাঁর কপালে। এ সময়েই ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মরণাপন্ন হলে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এইসব অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করেই তাঁর উপন্যাস ক্যান্সার ওয়ার্ড ।
লেবার ক্যাম্পের বীভৎস অত্যাচার নিয়ে গুলাগ আর্কিপেলাগো ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন অবিস্মরণীয় উপন্যাস ওয়ানডে ইন দা লাইফ অফ আইভান ডেনিসোভিচ । এই বইটিও তাঁকে রাশিয়ান স্বৈরাচারী শাসকদের কাছে বিরাগভাজন করে তোলে। স্টালিনের লেবার ক্যাম্পে নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে আর তিনি লিখেছেন দ্য ফার্স্ট সার্কেল । তাদের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রাশিয়ান বিপ্লবকে ভিত্তি করে রচিত দা রেড হুইল বেশ বিখ্যাত। এছাড়া আছে রিবিল্ডিং রাশিয়া এবং রাশিয়া ইন দা অ্যাবিস্।রাশিয়ান ও ইহুদি সম্পর্ক নিয়ে লেখা এই শতাব্দীর আরম্ভে তাঁর টু সেঞ্চুরিজ টুগেদার বইটি প্রকাশিত হয়।