সৌমিতা রায় চৌধুরী
পর্ব – ৭
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অপরাজিত’। ‘পথের পাঁচালী’-র অপুর কাহিনীর সম্প্রসারিত অংশই ‘অপরাজিত’। বাংলার ১৩৩৬ সালের পৌষ থেকে আশ্বিন মাসিক পত্রিকা ‘প্রবাসী’-তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘পথের পাঁচালী’ যেখানে শেষ ‘অপরাজিত’ সেখান থেকেই শুরু। ছোট্টো অজ পাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা অপুর যৌবনের আশা আকাঙ্খার গল্প ‘অপরাজিত’। বিভূতিভূষণের লেখায় প্রকৃতির বর্ণনা একটু বেশিই থাকে। গ্রাম থেকে শহরে আসা অপুর জীবনের পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশের যেমন বদল ঘটে তেমনই কলেজ জীবন, বন্ধুত্ব, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে নতুন নতুন চমক আসে অপুর জীবনে।
‘অপরাজিত’ উপন্যাসকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি ‘অপরাজিত’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। যদিও ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করার সময় ‘অপরাজিত’ নির্মাণ করার পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। কিন্তু ‘পথের পাঁচালী’-র বাণিজ্যিক সাফল্য এবং কিশোর অপুর ভবিষ্যৎ নিয়ে চলচ্চিত্র প্রেমীদের কৌতূহল তাঁকে ‘অপরাজিত’ চলচ্চিত্র নির্মাণে প্ররোচনা দিয়েছিল। ১৯৫৬ সালে ‘অপরাজিত’ মুক্তি পায়। এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, পিনাকী সেনগুপ্ত, রমণীরঞ্জন সেনগুপ্ত, চরপ্রকাশ ঘোষ, স্মরণ ঘোষাল এবং সুবোধ গাঙ্গুলী। চলচ্চিত্রটিতে সিনেমাটোগ্রাফি করেছিলেন সুব্রত মিত্র। সম্পাদনা করেছিলেন দুলাল দত্ত। সংগীত পরিবেশনায় ছিলেন রবিশঙ্কর।
অপুর শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ, গ্রাম থেকে শহুরে কায়দায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, নতুন বন্ধু পাওয়া, বিভিন্ন বই পড়ার দিকে ঝোঁক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়গুলি এই চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত হয়েছে। ছবিটি এগারোটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করে। যার মধ্যে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘স্বর্ণ সিংহ’ পুরস্কার অন্যতম।
অপু ত্রয়ীর শেষ পর্ব ‘অপুর সংসার’। তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক অপুর আকস্মিকভাবে সংসার জীবনে প্রবেশ প্রেম এবং বিরহ নিয়ে ‘অপুর সংসার’ দর্শকাসনে এক আলাদা শ্রেষ্ঠত্ব পেয়েছে। এই চলচ্চিত্রে অপুর ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অপুর স্ত্রী অপর্নার চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর প্রথমবার অভিনয় করেন। এছাড়াও অলক চক্রবর্তী ও স্বপন মুখার্জী অভিনয় করেন। একশো সাত মিনিটের এই চলচ্চিত্রের সুরকার ছিলেন রবিশঙ্কর এবং চিত্রগ্রাহক ছিলেন সুব্রত মিত্র। ১৯৫৯ সালের ১ মে চলচ্চিত্রটি মুক্তিলাভ করে এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। লণ্ডন চলচ্চিত্র উৎসবে ১৯৬০ সালে ‘সাদারল্যান্ড’ ট্রফি, এডিনবরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ডিপ্লোমা অফ মেরিট’ পুরস্কার লাভ করে। ব্রিটিশ আকাদেমি চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার পায়।
অপু আই এ পাশ করে চাকরির সন্ধানে কলকাতার ভাড়া বাড়িতে থেকে টিউশন করে নিজের খরচ চালাতে শুরু করে। বাড়িওয়ালা বকেয়া ভাড়া চাইতে এলে পাকা শহুরে লোকের মত ঝগড়া করে অপু। বাড়িওয়ালা ভাড়া না পেয়ে অপুকে তুলে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চলে যাওয়ার সময় ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে গেলে অপু সেটা ও সঙ্গে বাইরের আলো সঙ্গে সঙ্গে জ্বালিয়ে দেয় এবং দাঁড়ি কামানোয় মন দেয়। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় নিশ্চিন্তপুরের সরল গ্রাম্য বালক এখন পুরোপুরি কলকাতার নাগরিক।
কয়েকবছর বাদে কলেজের প্রাণের বন্ধু পুলুর সাথে দেখা হয় অপুর। পুলু অপুকে ভাল রেস্টুরেন্টে খাওয়ায় এবং একটি চাকরিতে যোগদানের কথা বলে। অপু জানায় সে চাকরি করবে না। আত্মজীবনীমূলক একটা উপন্যাস তখন লিখছে অপু। পুলু বলে, অপু কিছুতেই একটা সফল উপন্যাস লিখে উঠতে পারবে না। কারণ সেই উপন্যাসে যেহেতু প্রেমের বিষয়বস্তু রয়েছে তা কল্পনা করে অপুর পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। যেহেতু অপুর প্রেমের কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। যদিও একটি দৃশ্যে দেখা যায় এক প্রতিবেশিনী অপুর বাঁশি শোনার জন্য জানলার ধারে এসে দাঁড়ালে অপু তাকে দেখে লুকিয়ে পড়ে।
পুলু অপুকে তার মাসির মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করে। ঘটনাচক্রে পুলুর মাসতুতো বোন অপর্নাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় অপু। বিয়ের আগে অপু পুলুকে যে চাকরিটা নেবে না বলেছিল, সেই চাকরিটা পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে বিয়েতে রাজি হয় অপু। অপর্না শহুরে দরিদ্র জীবনে স্বামীর সাথে ভাড়া বাড়িতে মানিয়ে নেয়। স্বামী অফিস থেকে ফিরলে মশকরা করে কাগজের ঠোঙা ফাটায়। সিগারেটের প্যাকেটে একটি মাত্র সিগারেট খাওয়ার অনুরোধ লিখে রাখে। বাড়তি টিউশন ছেড়ে দিয়ে অফিসের পরে বাড়িতে ফিরে এসে তার সাথে সময় কাটানোর কথা বলে অপর্না। আবার অপর্না খেতে বসলে অপু পাশে বসে তাকে বাতাস করে। এইভাবে তাদের দাম্পত্য প্রেম মধুর হয়ে ওঠে।
পরবর্তী পর্যায়ে তাদের সন্তান কাজলের জন্ম দিতে গিয়ে অপর্নার মৃত্যু হয়। এই আঘাত অপুকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করলেও অপু তা পারে না। কিন্তু সন্তান কাজলকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। কারণ অপুর মনে হয়, কাজল রয়েছে বলেই অপর্না পৃথিবীতে নেই।
সত্যজিৎ রায় বেশ কয়েকটি কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। যেগুলি তাঁকে চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘অস্কার’ এনে দিয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ ব্যক্তি মানুষের ধারাবাহিক জীবনের যে মূল্যমান চিত্রায়িত করেছে, তা দর্শকের মনে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার হিসেবে সত্যজিৎ রায়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)