পাঠক মিত্র
বিরহান– পৃথক সত্ত্বার নিঃসঙ্গতা
আমরা যে সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি, এই সময়ে নিজেই নিজের বিজ্ঞাপন দিতে পারছি । লেখক, শিল্পী, খেলোয়াড়, ছাত্র, গৃহবধূ থেকে পেশাদার, অপেশাদার সকলেই তা করে চলেছে । হাতের মুঠোর মাধ্যমে । সমাজমাধ্যম নামক এই মাধ্যম সমাজের মধ্যে কতটা আর বাইরে কতটা তা বলা মুশকিল । তবে হুজুগ প্রিয় বাঙালির কাছে কোনটি বেশি উপাদেয় তা এখানে চর্চার বিষয় নয়। এ চর্চার বাইরে বলতে গেলে বলতে হয়, প্রতিনিয়ত স্বরচিত কবিতা ও গল্প সহ মনের কথা বহু লেখকবৃন্দ নিজেই প্রকাশ করে চলেছেন এই মাধ্যমে । এই মাধ্যমের প্রকাশকের কাছে সবার জন্য দরজা খোলা তাঁদের সৃষ্টি প্রকাশে । সেই সৃষ্টির সবই-যে সাহিত্য তা বলাই যায় না । তবুও নিজেদের এক একটি গন্ডি বা গোষ্ঠীর কাছে তার প্রকাশে সৃষ্টিকর্তার একটা ভালোলাগা থাকে । সেই ভালোলাগা থেকে ‘পছন্দ’ ও ‘মন্তব্যে’ র সংখ্যায় সৃষ্টির বিচার যেন বেশ স্বাভাবিক । আবার মুদ্রিত অক্ষরে প্রকাশিত পত্রিকার জন্য লেখার আবেদনে এখন বলা হচ্ছে যে সমাজমাধ্যম সহ কোন মাধ্যমেই প্রকাশিত লেখা গ্রহণযোগ্য নয় । তাহলে বলতে হয় সমাজমাধ্যম প্রকাশনা জগতে স্বীকৃতি লাভ করেছে । সেই স্বীকৃতি থেকেই ই-বই, ই-পত্রিকা ক্রমশ পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবুও এখন সমাজমাধ্যমে প্রকাশিত লেখা নিয়ে মুদ্রিত অক্ষরে সংকলিত বইও প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে । সেই সব সংকলনের কথামুখে বা কভার পেজে লিখতে হচ্ছে ‘ফেসবুকের ওয়াল থেকে’ ইত্যাদি ইত্যাদি । তাহলে বলা যায় ই-পত্রিকা বা ই-বই পাঠকপ্রিয় হলেও ছাপা অক্ষরে প্রকাশিত বইয়ের গুরুত্ব এখনো কোনোভাবেই হ্রাস হয়নি।
ছাপা অক্ষরে প্রকাশিত বই লেখক ও পাঠক স্পর্শ করতে পারে বলেই লেখক তাঁর সৃষ্টি সুখের এক তৃপ্তি অনুভব করেন, আর পাঠকের কাছেও তার আলাদা আকর্ষণ থাকে । লেখকের সৃষ্টিশীলতার সিঁড়ির শৈল্পিক নিদর্শনে পাঠকের মুগ্ধতার নামই সেই আকর্ষণ। লেখকের সৃষ্টি মাত্রই বা কোন লেখকের সব সৃষ্টিতে সেই আকর্ষণ থাকে তা নয়। আবার সকল পাঠকের কাছে কোন সৃষ্টির সমান আকর্ষণ থাকবে এমনও নয় । সমান আকর্ষণ না থাকলেও কোন সৃষ্টি লেখকের পৃথক সত্ত্বার পরিচয় বহন করে । পৃথক সত্ত্বার পরিচিত লেখকবৃত্তের বাইরে লেখকদের সৃষ্টি পাঠকের হাতে পৌঁছে গেলেই বিচক্ষণ পাঠক তার সঠিক মূল্যায়ন করতে এতটুকুও কার্পণ্য করে না।
এই সময়ের বৃত্তে পৃথক সত্ত্বার পরিচিতির বাইরে যে সকল উদীয়মান লেখক তাঁর রচনার সম্ভার নিয়ে পাঠকের দরবারে উপস্থিত করছেন, যাঁদের সত্ত্বার ভিত পৃথকভাবে গড়ে উঠছে বলে সমঝদার পাঠকের চোখে ধরা না পড়ে পারে না । তেমনই এক উদীয়মান কথাকার বনমালী মাল । ‘বিরহান’ গল্পগ্রন্থ তাঁর সত্ত্বার পরিচয়েয় সূচনা দিয়েছে বলেই মনে হয় । ছকে বাঁধা পথে তাঁর কাহিনী যেমন এগিয়ে চলেনি, তেমনই আবার একেবারেই ছক ভেঙে দিয়ে অন্য পথ তৈরি করে চলেছে তা ও নয় । তবে তাঁর এই গল্পগ্রন্থের গল্পগুলি অন্য মাত্রায় নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করেছে । মাত্র নয়টি গল্পের সমাহারে এই গল্পগ্রন্থ । সংকলনটি ছোট্ট, অথচ কথাকারের পরিচয়ের ব্যপ্তিকে স্পষ্ট করে দিয়েছে তার এই ছোট্ট পরিসরে । যে পরিচয় সমাজমাধ্যমে কখনোই গড়ে ওঠে না । সমাজ ও ব্যক্তি চরিত্রের টানাপোড়েনের চিত্র আলাদাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর গল্পে । কেবল সময়ের স্রোতে তাঁর কাহিনীর চরিত্ররা ভেসে যায়নি । কল্পনার জাল ভেদ করে যেন সময়ের স্রোতকে বয়ে নিয়ে গেছে । তাই সংসারে সন্তানদের কাছে বাবা কখন যেন জাদুকর হয়ে ওঠে । সংসারের এমন কিছু নেই যা বাবা জানে না, বা দেখেনি বলেই মনে করে সন্তানেরা। একটা অভাবের সংসার কেমন করে টেনে নিয়ে চলে, জাদুকর না হলে তা কি করেই বা একজন বাবার পক্ষে সম্ভব। অদ্ভুত ক্লান্তি নিয়ে নিঃসঙ্গ অর্জুন গাছের মত ঋজু থেকে দৃঢ়তার সাথে মাথা উঁচু করে তবেই থাকতে পারে। এভাবেই সমস্ত অভাবকে উপেক্ষা করে মানচিত্র, মানুষ, মাটির সম্পর্ক নিয়ে সন্তানদের অনুভূতি তৈরি করে দিতে পারে অনায়াসে । সেই অনুভূতি বাবার ফেলে রাখা বা লুকিয়ে রাখা অর্থহীন সম্পদ নিয়ে প্রশ্নের জাল বুনতে পারে, তার পিছনে লুকিয়ে রাখা কোন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারে । ‘বিরহান’ গল্পগ্রন্থের প্রথম তিনটি গল্প যেন একই সূত্রে গাঁথা। ‘আমাদের জাদুকর বাবা’, ‘জাদুকর বাবার মৃত্যু’, ‘বাবার চিঠি ও গাভীন শস্যের কথা’ । শুধু নামের সূত্রে বাবা শব্দটি আছে বলেই তার সূত্র এক নয়। কাহিনী যখন বাস্তব ও কল্পনার চড়াই উতরাই পথে নেমে একই সূত্র ও বিস্তারের সঙ্গমে মিশে যায় তখন এই তিনটি গল্প ‘ট্রিলজি’-ভুক্ত করা যেতে পারে। যদিও ‘ট্রিলজি’ শব্দটি সাহিত্যের আঙিনায় সাধারণত সমগোত্রীয় তিনটি বই বা নাটকের সমাহারকে উল্লেখ করে, সেক্ষেত্রে এই তিনটি গল্প তিনটি পৃথক বই হিসেবে অস্তিত্ব প্রকাশের উপযোগী নয়। তাহলে ‘ট্রিলজি’ শব্দটি এখানে সাহিত্যের ভাষায় বেমানান বা সে সম্পর্কে তর্কযুক্ত হতে পারে । তবুও গল্প তিনটির সমাহারে এই শব্দটির ব্যবহার পাঠকের কাছে মাত্রাতিরিক্ত হতে পারে না বলে বলা যায়।
অভাবের সংসার বাবার জাদুতে যেমন চলে, তেমন সেই চলার পথকে এগিয়ে নিয়ে যায় মা। মায়ের স্বপ্নে সন্তান যেমন বেড়ে ওঠে, আর সন্তানের স্বপ্নে মায়ের উপস্থিতি বয়ে আনে এক আলোকবর্তিকা। যে আলোকবর্তিকায় ধেয়ে আসা সকল সংকট অনায়াসে দূর হতে পারে। দিন যত যায় স্পষ্ট হয়ে যায় মায়ের অব্যক্ত কথা। ‘স্বপ্নের স্রোত ও মায়েরা’ গল্পটি মায়ের অব্যক্ত কথার স্বপ্নে ডুবে থাকার, যা পারিপার্শ্বিক সকল সংকটময় পরিবেশকে অতিক্রম করার সাহস দিতে পারে তাঁর সন্তানদের।
এই গল্পগ্রন্থের আর পাঁচটি গল্পে এক একটি মানুষের জীবনের পাঁচালি ভিন্ন বিন্যাসে পরিবেশিত হয়েছে। সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি বেষ্টিত এক একটি জীবনের সেই পাঁচালি বৈচিত্র্যহীন হলেও ‘সঞ্জয় কহিলেন..’, ‘দাশায়’, ‘দুই দুই চার দুই ছয়’ গল্পের চরিত্রের কাছে বোধগম্য নয়। ‘সঞ্জয় কহিলেন..’ গল্পে মহাভারতের যুদ্ধের দৃশ্য পর্বে তারা উৎসাহ বোধ করতে পারে, কিন্তু তাদের ভাগ্য চক্রের একই নিয়মে ঘুরে চলা নিয়ে কোন ক্ষোভ নেই। কোথায় ভোট লুট হল, কে চুরি করলো তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। ‘শনিবার আসে’ গল্পের প্রধান চরিত্র খুঁজে পায় মানুষের সেই নিয়েই চক্র। যে মানুষগুলো ধানগাছ রোপণের হিসেব বুঝতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিটা সময় যে আদতে এক, তারা তা শিখতে পারেনি। প্রতিদিনের খবর তার কাছে একই । সে কারণে তাকে এক ভয় ক্রমশ গ্রাস করতে চায়। যে ভয় দিয়ে পরিবার পাড়া রাষ্ট্রের খবর নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারেন বলেই সে ক্রমশ একা হয়ে পড়ছে । তার একাকীত্ব দেখিয়ে দেয় মানুষগুলোও কেমন যেন একা হয়ে পড়ছে । এমনকি মৃত্যুর পরে একা হয়ে পড়ে মানুষ যদি সে দলহীন হয়ে থাকে। যে দল মানুষের কথা বলে রাষ্ট্রের কথা বলে, আবার তাদের কাছে মানুষ আবার দলহীন বলে বিবেচিত হয়। আজকের সময়ে এ এক রাজনৈতিক অন্ধকার যার ব্যঙ্গাত্মক ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়েছে এই গল্পে।
‘বিরহান’ গল্পগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থ বিরহ । এই বিরহ নর নারীর সাপেক্ষে নয়। সমাজ সংসারের পারিপার্শ্বিক পরিবেশে মানুষের নিজস্বতায় একা হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাই তো বিরহ। তাই অভাবের সংসারে জাদুকর বাবার যন্ত্রণা, মায়ের স্বপ্ন, ‘শনিবার আসে’ গল্পের মুখ্য চরিত্রের নিখুঁত খবরে নিঃসঙ্গতার যন্ত্র থেকে ‘ভাসান’ গল্পের নিবারণ, ‘দাশায়’ গল্পের অটম্বর, ‘দুই দুই চার দুই ছয়’ গল্পের লবা তাদের সমাজ সংসার থেকে পৃথক সত্তার যন্ত্রণায় একা হয়ে ওঠে। বাস্তবের মাটি আর কল্পনার আকাশে নামা ওঠার রেখার বিন্যাসে ‘বিরহান’ গ্রন্থের গল্পমালায় কথাকার তাদের একাকীত্বের কাহিনীর ঘোড়া জীবনের রোজনামচার মধ্য দিয়েই আর এক পথে ছুটিয়েছেন। শব্দছন্দে চলা ঘোড়ার এই গতি বাংলা সাহিত্যের মাঠে নিজস্ব সত্ত্বার দাবি রাখবে একদিন।
বিরহান
বনমালী মাল
আপন পাঠ, কলকাতা-১০