দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

সাগর সরকারের বাষট্টি –তেষট্টি  বছর বয়স। সংসারে  লোক বলতে দুজন। তিনি ও অমৃতা। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। নাতি-নাতনি হব হব করছে। অমৃতা দিব্যি ঠাকুর-দেবতা নিয়ে আছেন। একটা গোপাল আছে তাঁর। সকাল-বিকেল সেবা করেন।  মাঝেমধ্যে  মেয়ের বাড়ি ঘুরে আসেন। 

সাগর একজন ছোটখাট গায়ক। অফিসে গাইতেন। পাড়াতেও । তবে এসব এখন  অতীত। অফিসও নেই।  রিটায়ার করেছেন। পাড়ার ফাংশানও উঠে গেছে। তাতে  অসুবিধে নেই। তিনি নিয়ম মেনে রোজই  রেওয়াজ  করেন।

প্রথম প্রথম  দু-চারজন গানবাজনা করা লোক বাড়িতে আসত। সেই আসরে  অমৃতা সামান্য জলখাবারের  ব্যবস্থা করতেন। কিছুদিন পর  সাগর বুঝলেন লোকজন সব সেকারনেই আসছে। তাই  তিনি অমৃতাকে জলখাবার বন্ধ করে দিতে বললেন। অমৃতা  অবাক হয়ে বললেন “ওমা। বন্ধ করব কেন? সবাই মিলে একটু মুড়ি খায়। বন্ধ করে দেব?”

  সাগর মুখ ভেংচে বললেন “শুধু মুড়ি নয়। মাঝে মাঝে  লুচিও করে দাও। সেটা বল?”

 “তা বাপু। লোকজন এলে এসব একটু করতে হয়।“

 সাগর  বললেন, “সে ঠিক আছে। ওসব এখন বন্ধ কর। স্রেফ চা দেবে।  দেখব গান শুনতে কজন আসে!”

 দু-তিন ঘন্টায় মোটে শুধু  চা!  কদিনেই লোক কমে গেল। সাগর  রাগের মাথায় চা-টাও বন্ধ করে দিলেন। তিনচারদিন পর থেকে গান শুনতে আর কেউ এল না। সাগর সারা সন্ধ্যে একাই  প্র্যাকটিশ করেন। শুধু   শ্রোতা একজন। অমৃতা।  কিছুদিন পর  গানের সময়ে অমৃতারও  পেট ব্যথা, মাথা ব্যাথা, জ্বর-জ্বর লাগতে শুরু করল। 

 কিন্তু আজ বিকেলে  হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটল। সাগর যথারীতি গান গাইছিলেন। অমৃতা সামনে বসে। তিনি কিছুক্ষন গান শোনার পর বললেন “অসহ্য!”

 সাগর  গান থামালেন। তিনি ভাবলেন অমৃতা বোধহয় পেটের ব্যথার কথা বলছেন। দুদিন আগে খুব ভুগেছিলেন। তিনি  বললেন, “হু। ব্যথা হলে তাই হয়। আমার একবার হয়েছিল। উফ! কি ব্যথা! এক কাজ কর বালিশ পেটের তলায় রেখে শুয়ে পড়। কমে যাবে।“

“সে কথা বলছি না।“

“তাহলে?”

“অসহ্য মানে তোমার গান আর সহ্য হচ্ছে না।“

সাগর বললেন, “গান?”

 “হ্যাঁ। সারাদিন সকাল বিকেল ওই এক প্যা প্যা সহ্য হচ্ছে না।“

  সাগর  একটা গানের সুর মনে মনে ভাঁজছিলেন। তিনি অবাক হয়ে  বললেন  “এ কি বলছ?”

“ ঠিকই বলছি। থামো তো।“

  এরপর থেমে যাওয়ার কথা। তবু  তিনি থামেন নি। কাঁধ ঝাঁকিয়েছিলেন। ওমন কথা  বলে  অমৃতা। তাঁর পেছনে লাগে। তা নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই।  তিনি তাই বললেন “আরে বসো তো চুপ করে। শোনো না।“

  অমৃতা থামলেন না। বরং এরপর তিনি  যা বললেন তা শুনে সাগর স্তম্ভিত হলেন। অমৃতা ফিক করে হেসে বললেন, “থামো তো বাপু। দিনদিন যেন  পরেশ হয়ে যাচ্ছ।“ 

 পরেশ! নিজের কানকে সাগর যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি আর কথা বললেন না ।  মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরোল না।  পরেশের সঙ্গে তার তুলনা! পরেশ মানে পাড়ার ওই খামখেয়ালী পাগলাটে টাইপের ছেলেটা! সে নাকি সারাক্ষণ  একা একা গান গেয়ে যায়। তাঁর মাথা হেঁট হয়ে গেল।  চোখ নামিয়ে  হারমোনিয়ামের দিকে চেয়ে রইলেন। এ লাঞ্ছনার কথা কারুকে বলা যাবে না। গান গাইতে আর ইচ্ছে করল না তাঁর । তৎক্ষনাৎ  একটা জামা পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

 অমৃতা তাড়াতাড়ি  সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন  “এই? কোথায় চললে?”

 “জানি না।“

“আহা। আমি  তো ইয়ার্কি মারলাম। যেও না।“

সাগর উত্তর দিলেন না । রাগে তাঁর গা জ্বলছে।

 রাস্তার এক কোনে  নিমাই-এর চায়ের দোকান। সাগর হনহন করে হেঁটে  ফাঁকা একটা  বেঞ্চে টুক করে বসে পড়লেন। উল্টোদিকে  একটা মন্দির।  চারপাশে সাদা রক ঘেরা। কয়েকটা ছেলেছোকরা আড্ডা মারছে। ওখানেই প্রায়দিন  পরেশ আসে। গান গায়। পাড়ার ছেলেরা তাকে ঘিরে হইহুল্লোড় করে। সন্ধ্যে পড়তে না পড়তেই  তিনি পরেশকে আসতে   দেখলেন । সে আসতেই  পাড়ার  ছেলেছোকরারা তাকে ঘিরে ধরে গুরু গুরু বলে চিৎকার শুরু করল।

  সাগর চা খেতে খেতে সেদিকেই  তাকালেন। 

নিমাই চা দিয়ে  বলল “মাথাটা একবারে গেছে ছেলেটার!”

“গেছে?”

“হু। আগে যাও বা ভাল ছিল  এখন শুধু সারাদিন গান আর গান। সহ্য করা যায় না।“

  অমৃতার কথা অজান্তে মনে পড়ল তার। তিনি গম্ভীরস্বরে বললেন, “ভাল তো। গান করে।“

 “সে গান যদি শোনেন। হেসে মরবেন। নিজেই গায়। নিজেই মুখে মিউজিক দেয়।“

এখনো গান শুরু হয় নি।  ওদের পরিবারটা সম্পর্কে সামান্য জানেন তিনি। তিন  ভাই ওরা। সবাই এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। কেউ খুব একটা  কাজটাজ করে না। কিভাবে চলে কে জানে? তার উপর সবাই কেমন যেন গরীব  গরীব চেহারার। তার উপর পরেশ কেমন ছিটিয়াল প্রকৃতির।  তিনি বলেছিলেন, “কই গাইছে না তো?”

“গাইবে। সব ছেলেরা আসুক। ছেলেগুলোও সব জুটেছে। ওর গান তুলে নাকি ফেসবুকে  ছাড়বে।“

“তাই?”

“হ্যাঁ।

একটু পরে গান শুরু হল  পরেশের।  দুর থেকে গান ভেসে এল। ছেলেগুলো মাঝেমাঝে আহা উহু করছে।  খালি গলায় গান। মিউজিক দেবার সময় গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। নানারকম আওয়াজ করছে  পরেশ। ছেলেগুলোও হইহই করে উঠছে। 

  কি মনে হতে সাগর উঠে পড়লেন। কোনদিন ওর গান শোনেন নি আজ একটু শুনতে ইচ্ছে হল। দোকান থেকে ভাল করে গান শোনা যাচ্ছে না। রকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ছেলেগুলো তাকে দেখে  হাসল। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “বেশ আড্ডা চলছে দেখছি।“

“ হু। কাকা। শুনবেন নাকি পরেশের গান। আসুন আসুন।“

সাগর দ্বিধায় পড়লেন। এখানে বসে গান শোনা কি ঠিক হবে? তারপর দ্বিধা কাটিয়ে রকে উঠে বসলেন।

 পরেশের দিকে চেয়ে একজন বলল, “কাকাকে চিনিস তো তুই। ভাল করে একটা গান শোনা তো।“

  পরেশ মাথা নাড়িয়ে  বলল, “হ্যাঁ। খুব চিনি। কাকা তো  গানেরই লোক। 

সাগর  বললেন, “ও কিছু না। তুমি গাও শুনি।“

 পরেশ  আবার গান শুরু করল। সাগর বুঝতে পারলেন পরেশ  অদ্ভুতভাবে গাইছে। গানের কথা মিলছে না। সুরগুলোও উল্টোপাল্টা। তার সঙ্গে মুখে মিউজিক। তাই জন্যই চারধারে একটা হাস্যরোল হচ্ছে। সাগর তবু কষ্ট করে শোনেন। দুচারটে গান করার পরই  পরেশ শুরু করল  সাগরের প্রিয় গান । মান্না দের কফি হাউস। 

গানটা শোনার পরই মেজাজ হারালেন সাগর। ওর দিকে রাগী চোখে তাকালেন।  ইচ্ছে হল  ঠাস করে ওর গালে একটা চড় মারতে। গানটাকে এত বিচ্ছিরিভাবে গাইল যেন সে গানটাকে খুন করল! পরেশের অঙ্গভঙ্গী দেখে ছেলেগুলো অবশ্য খুব খুশী। কিন্তু  তিনি আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। রীতিমত ধমকের সুরে   বললেন, “এটা কি গান?  কথা উল্টোপাল্টা বলছ। সুরের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। মাঝে মাঝে তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছ। ছি! ছি!”

রোগা, কুঁজো পরেশ একবার তার দিকে তাকাল। কিন্তু তাকে  পাত্তা দিল না। একটা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেল। সেসময়  একটা ছেলে  একটু চাপা স্বরে বলল, “ও ঠিক আছে কাকা। বাদ দিন।“

  “বাদ দেব! কেন? এমন একটা গান। মান্না দে কে নিয়ে মজা?”

 আসরটা কেমন যেন থম মেরে গেল। কিছুক্ষন নীররতা। একটু পরে  ছেলেগুলোর মধ্যে কে একজন চাপা স্বরে  বলল,  “আপনি আসুন কাকা।“

কে বলল সাগর বুঝতে পারলেন না। কথাটা আঁতে লাগল। ওদের বলার উদ্দেশ্য একটাই। শুধু শুধু রসের ব্যাঘাত ঘটানও কেন?  তিনি বুঝলেন তাঁর এখানে বসা ঠিক হয় নি।

 চুপিসারে তিনি উঠে পড়লেন। পরেশের উপর আরো রেগে ওঠেন তিনি। ও কেন এমন  বিকৃতি করে গাইছে কে জানে?  ছেলেগুলো যে তাকে নিয়ে মজা করছে তাও ও বুঝছে না!

দুচারদিন পরে বিকেল বিকেল সাগর আবার গানবাজনা নিয়ে বসলেন। সেদিনই   অমৃতার সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ে গেছে। তাকে সে নিজেই আবার গানে বসিয়েছে। গান করার সময়  মেয়ের হঠাৎ ফোন এল। মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর মেয়ে তাকে চাইল। সে এটাসেটা বলার পর বলল, “বাবা। পরেশ তো বিখ্যাত হয়ে গেল!”

“কে?”

“ওই যে খ্যাপা পরেশ। কেন তুমিও তো ছিলে সেদিন! ফেসবুকে  দেখলাম।  পরেশ গাইছে তুমি পাশে বসে আছ। ওর গান শুনে সবাই হেসে মরছি। তুমি কি করে ছিলে গো?”

  সাগর বুঝলেন  এসব ছেলেগুলোরই কাজ। তিনি বললেন “লোকে কি বলছে?”

 “কি আর বলবে? হাসছে। কি বিচ্ছিরি গান। দেখলাম তো। মুখটা বেঁকিয়েচুরিয়ে, হাত কানে রেখে গান করছে, তার উপর মুখে মিউজিক। পরেশকে  দেখলেই হাসি  পাচ্ছে।“

 সাগর বিরক্ত হলেন। পরেশের কথা তিনি আর শুনতে চান না। তিনি বললেন, “বাদ দে ওসব কথা। তোরা আছিস কেমন বল?”

মেয়ের সঙ্গে আরো দুচারটে কথা বলে  সাগর ফোন রাখলেন। তারপর গানে ফিরে এলেন।  কিন্তু গান শুরু করতে না করতে আবার ব্যাঘাত ঘটল। বাইরে থেকে এসময় কে যেন কাকা বলে ডাক দিল।

  সাগর বিরক্ত হলেন। অমৃতাকে দেখতে বললেন। অমৃতা উঠে দেখতে গেলেন। ফিরে এসে চাপা স্বরে বললেন,  “ওই যে পরেশ বলে ছেলেটা এসেছে। তোমায় খুঁজছে। কি বলব?”

পরেশ! অবাক হলেন সাগর। হঠাৎ কি কারণে ও এসেছে? নিশ্চয় কোন ধান্ধায়। টাকাপয়সা চাইতে পারে। কেন যে সেদিন ওর গান শুনতে গেলেন! তিনি বললেন, “আচ্ছা। ডেকে দাও।“

 একটু পরে  পরেশ এল। রোগা-কাংলা চেহারা। মুখে হাসি। শরীরটা খুব দোলে। সাগর গম্ভীর স্বরে বললেন, “কি ব্যাপার?”

 “এই এলাম। গানে বসেছেন? ভাবি আসব আসা হয় না।“

সাগর চরম বিরক্তিতে মুখ ঘোরালেন। সেদিন ওর গান শুনেছেন বলে পেয়ে বসেছে। ওকে তাঁর ঘরে ঢুকতে দেওয়াই উচিত হয় নি। তিনি মুখে বললেন “হুম”

 পরেশ  হারমোনিয়ামের দিকে তাকাল। একবার ষ্পর্শ করল। তারপর বলল,” কি গান গাইছিলেন?“

 “এখনো শুরু করি নি। “

“আমার একটা গান শুনবেন?”

সাগর আঁতকে উঠলেন।  আবার! তাঁর কি মাথা খারাপ! পরেশ  চলে যাবার পর অমৃতা আবার  পেছনে লাগবে!  তিনি বললেন, “ইয়ে। সেদিন শুনলাম তো। এখন থাক। পরে না হয়!“

“না। না। একটা শুনুন।“

সাগরকে কিছু বলার সুযোগ দিল না  পরেশ। একটু পেছনে সরে গেল। ধুপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। চোখ বন্ধ করল। সাগর বিরক্তও হচ্ছেন। একটু দুরে  অমৃতা ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়েছেন।

 পরেশ শুরু করল।  কফি হাউস গানটাই। যা শুনেই তিনি চলে এসেছিলেন। মেজাজটা গরম হয়ে উঠছে তাঁর। বাড়িতে এমন ফাজলামি তিনি সহ্য করবেন না। ছেলেটার ঘাড়  ধরে বার করে দেবেন।

কিন্তু  সাগর তা পারলেন না। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন  পরেশ গানটা একদম ঠিকঠাক গাইছে। কথা ভুল নেই। সুরও ঠিকঠাক। মুখেও কোন মিউজিক নেই। সেদিনের মতো মুখেচোখে হাবভাবে কোন বিকৃতি নেই। শুনতে বেশ ভাল লাগছে তাঁর। অমৃতাও অবাক চোখে দেখছে। 

 গান হওয়ার পর  পরেশ দুহাত সামনে জড়ো করে বলল, “আমাকে ক্ষমা করবেন কাকা। সেদিনের জন্য।“

  সাগর অবাক। ছেলেটা ক্ষ্যাপা নয় তো। বেশ বুদ্ধিমান। তিনি বললেন, “সেদিন খারাপ ভাবে গাইছিলে কেন  তুমি? এখন তো ভালই গাইলে।“

 পরেশ বলল, “ওমন  ভাবে না গাইলে  ওরা  মজা পায় না। আমি গাইব ওরা হেসে গড়াবে ওইজন্যই গাই।“

“ওমা। সেকি! গান জান অথচ ওমন ভাবে গাইবে? কেন?”

“ওরা মজা পায়। মজা পায় বলে আমাকে সন্ধ্যেবেলায় চা জলখাবার দেয়। ভাল করে গাইলে কেউ মজা পাবে না। আমি জানি।“ বলে  পরেশ  উঠল।

 পরেশ বেরিয়ে যাচ্ছিল।

সাগর কিছু একটা ভাবলেন। অনেকদিন তিনি লোকজনকে  চা -জলখাবার খাওয়ান বন্ধ করে দিয়েছেন। অমৃতা কি রাগ করবে আবার? একজনের জন্য চা জলখাবারের কথা বললে? না মনে হয়। বরং খুশী হবে।

তিনি বললেন, “ আরে। যাচ্চ কেন? আর কি গান জান? শোনাও দেখি। তুমি গাও আমি হারমোনিয়াম ধরছি।“

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *