পাঠক মিত্র
‘মহারণ’ সুবিধাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে মহারণ
মহারণ অর্থে মহাযুদ্ধ । আর উপন্যাসের নাম ‘মহারণ’ হলে, প্রথমেই মহাযুদ্ধের কথাই মনে আসে । কিন্তু সোহারাব হোসেনের ‘মহারণ’ উপন্যাস তথাকথিত সেই যুদ্ধের কথা বলে না । তবে প্রান্তিক মানুষের জীবনযুদ্ধ স্বার্থ-রাজনীতির পাকে পড়ে আঁকুপাঁকু করার এক আখ্যান । এই আখ্যানে কথাকার হোসেন প্রান্তিক মানুষের জীবনের সমস্যার জটিলতাকে লোককথা-রূপকথার বিন্যাসে দেশজ ও লোকজ শব্দের ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন । হাতিপোতা-আঁধারমানিক নামক একটি অঞ্চলের জমিকেন্দ্রিক আন্দোলনের ভোটমুখি সমাধানে রাজনীতিকে ব্যাক্তিস্বার্থের চক্রান্ত থেকে কেয়ামত-রহিমবক্সের লড়াই জয়ী হলেও সুবিধাবাদী রাজনীতির কাছে অবশেষে তাঁর পরাজয় হয়েছে । কেয়ামত তাঁর দলের প্রতি বিশ্বাস ও ভরসা রেখেও তা হারিয়েছে ক্রমশ । এমনকি তাঁর লড়াই যাঁর উপর ভর করে গড়ে উঠেছিল, যাঁর প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও ভরসা সেই রহিম চাচা সুবিধাবাদী রাজনীতির রঙে তাঁকেও শেষে ভুল বুঝেছে। লালপরী পার্টির আদর্শচ্যুত নেতার নীলপরী দলের সাথে ভোটকেন্দ্রিক ব্যাক্তিস্বার্থ আঞ্চলিক ক্ষমতার বোঝাপড়ায় কেয়ামতের চারপাশে রাজনীতির রঙে, ধর্মের রঙে ক্ষমতার গহ্বরে চেনা মানুষ কেমন অচেনা হয়ে পড়ে । ক্ষমতা বোঝাপড়া রাজনীতির এই কৌশল অবশ্যই দলের আদর্শকে বাদ রেখে । যার কালো ছায়া মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দেয় । যে অন্ধকারে চেনা মানুষ অচেনা হয়ে ওঠে । কথাকারের কথা ধরেই বলতে হয়, ‘মহারণ’ সেই অচিন মানুষের, মানুষগুলোর রূপকথা-মাত্র । এদের জীবনচর্যা, বাঁচা-মরা, সাধন-ভজন, প্রতিবাদ-পরাজয়, জন্ম-মৃত্যু, প্রেম-পিরিতিময় উড়ান যেন এক বিকল্প সভ্যতা বলে বিশ্বাস । ‘মহারণ’ সেই বিশ্বাসের আখ্যান।’ আর এই আখ্যান জুড়ে সেই বিশ্বাসে অন্ধকারের বিরুদ্ধে কেয়ামতের চরিত্রে ফকির-বাউলের বস্তুরক্ষার সাধনা ও বামপন্থী রাজনীতির নির্যাতিত মানুষের মুক্তিকেন্দ্রিক আন্দোলনের মিলনের চালচিত্র কথাকারের রূপকধর্মী প্রতিবাদ তাঁর এই ক্যানভাসে । এই আখ্যানের ভূমিকায় কথাকার বলেছেন,’এই আখ্যান আমার মধ্যে ঘনিয়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে । মার্ক্সীয় বস্তুবাদের গলি-ঘুঁজি দেশীয় কোনো মতবাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে কিনা–তার অন্বেষণের বীজ ভাবনায় উপ্ত হয় । শেষতক ফকির-বাউলের গূহ্যবাদী যাপন-পদ্ধতিতে তার ইশারা পাই । সেই বীজ অঙ্কুরিত, বিকশিত হয়েছে ও পরিণতি পেয়েছে খন্ডে খন্ডে লেখা কাহিনীতে ।’ তিনটি পর্বের এই আখ্যানে কথাকার সময়ের রাজনীতির ঘূর্ণিকে তাঁর এই অন্বেষণের গলি-ঘুঁজির পথে কেয়ামতের চেতনায় ধাক্কা দিয়ে ফকির বিদ্রোহের আলোয় সুনিপুণভাবে উদ্ভাসিত করেছেন । তাহলে এ আখ্যানকে পুরোপুরি রাজনৈতিক আখ্যান বলা যাবে তা কিন্তু নয় । তবে এক আলোচকের কথা ধরে বলা যায়, এ আখ্যান গ্রামীণ রূপকথা থেকে তা ক্রমশ রাজনীতির রূপকথায় পরিবর্তিত হয়ে যায় । ঠিক কথাই । গ্রামীণ সব সমস্যা (লোককথা, উপকথা, রাজনীতি থেকে প্রেম-পিরিতি) কেয়ামতের দাদি নূরবুড়ির শ্লোকে রূপকথার মত সহজ সমাধান পেয়ে যায় । নূরবুড়ির এক একটি শ্লোক দিয়ে কাহিনীর একটি প্রসঙ্গ থেকে আর একটি প্রসঙ্গে যাওয়া এতটা সাবলীল যা বাংলা সাহিত্যে এমন বিন্যাস একপ্রকার মৌলিক বলেই মনে হয় । শুধু তাই নয় কথাকার পাঠককেও এক একটি প্রসঙ্গান্তরে জড়িয়ে নেন তাঁর এই আখ্যানে।
গ্রামীণ রূপকথা থেকে রাজনীতি রূপকথার বিন্যাসে কেয়ামত মার্ক্সের তত্ত্ব আর মজনু শা’র পথে পথ খুঁজে চলে । সেই পথ-যে কি তা রাসেকের সাথে কথোপকথনে উঠে আসে ।
রাসেকের সাথে কথোপকথনে কেয়ামত বলে মার্ক্সবাদে যেমন ধর্মের কোনো জায়গা নেই, তেমন ফকিরি পথও কোনো ধর্মের কথা বলে না । এই কথোপকথনে রাসেককে আরো বলে, মার্ক্সে যেমন বস্তুর কথা বলে যা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ । জগৎকে ঐ বস্তুবাদ দিয়েই ব্যাখ্যা করে । মানুষের মুক্তির কথা বলে । পুঁজিবাদী ভোগবিলাসের বিরুদ্ধচারণ করে । সাম্যের কথা বলে । ফকিরিবাদও তাই বলে । এতে তামাম মানুষের একক যে মানুষ তার মুক্তির কথা বলে । কাম-কামনা-লোভ-মোহ পুঁজিপাঁজি থেকে মুক্ত হতে বলে । এই কথোপকথনে সে আরো বলে যায়, দুটো পথেরই কারবার বস্তু নিয়ে । মানুষের লোভ-লালসার মুক্তি নিয়ে । আগে বস্তুরক্ষার সাধনায় মানুষকে মুক্ত করতে হবে । পরে তোমার বড় বস্তুবাদের পথে মানুষকে ঠেলতে হবে । নইলে দখল হওয়া ঘেরিতে ভিন্নরূপে মালিক বসবে । শুধু বিপ্লব বিপ্লব করে চেঁচালে হবে না । দেশকে তৈরি করতে হয় দশকে তৈরি করতে হয় । দেশের ইতিহাস জানতে হয় ।
সাঁঁই সাধনার যানে চেপে কেয়ামত দেশের অবস্থা মানুষের অবস্থা দেখে এসে বলে, দেশকালের মানুষ-মনিষ্যির অবস্থা গতিক ভালো নয় । ভূ-ভারতে ঘুরে এলুম । সব স্থানে পোকা লেগে গেছে । পোকা লাগা পুতুল হয়ে নাচছে সবাই। অদৃশ্য পুতুলনাচ সুতোর টানে । ওরা ব্যওসাদার । ভূ-ভারতের বাজার-হাটে ওরা নতুন পোকার দল । ওরগা হাতেই রয়েছে লাটাই । ওরাই পুতুল নাচায়। আমারে নাচায়। তোমারে নাচায়। সবাইরে।
কথোপকথনে কেয়ামতের সঙ্গী বকরূপী মজনু শা তাকে বলে, ‘দুনিয়া জুড়ে নীলপরীরা ওত পেতে থাকে । ওরা সব এক একটা বড়সড় পুতুলনাচের দলের মালিক । দুনিয়া জুড়ে পুতুল নাচায় । সরকারে পুতুল বসায় । সুতোর টানে দাঙ্গা বাধায় । ব্যাঙ্কের আমানত কেনে, পুতুল নাচিয়ে জনতার স্বল্প-সঞ্চয়ে সুদের হার কমায়, যাতে তাদের অনুগৃহীত পুতুলরা সরকার থেকে কম সুদে ঋণ পেতে পারে । সে ঋণ তারা কখনো শোধ করে না । বিনিময়ে নিজেদের ঝোলা থেকে সামান্য দানা ছড়িয়ে গাঁ-গ্রামের আরো ক্ষুদ্র সব জোতদার-ব্যওসাদার পুতুলগুলোর সামাজিক কর্তৃত্ব বজায় রাখে । এমনকি লালপরীরাও ঐ একই সুত্র টানে নাচছে ।
রাক্ষসবাদের পুতুল হয়ে । দুনিয়া জুড়ে এর চাষ হয় । তোমরা লালপরীরা যখন হাতে কোনো বিষ প্রতিষেধক না নিয়ে, মানে শ্রেণী এবং শ্রেণী লাইন বিসর্জন দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশীদার হও তখন তোমরা রাক্ষসবাদের পুনরুত্থানের অনুঘটক হয়ে পড় । এক সময়কার পরাজিত শোষককে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য কর । রাষ্ট্রের পোকা তখন তোমাদের লালপরীদেরকেও আক্রমণ করে ।
এ পোকার চার রূপ– ক্ষমতালিপ্সা, প্রভুত্বকামিতা, আত্মস্বার্থ আর ভোগবাদী জীবন ।’
আসলে কথাকারের এই আখ্যান রচনার সময় এই কথাগুলিই বলে । কথোপকথনে রাশিয়ার পতনের কথা এসেছে । কেয়ামতের সাঁই হতে না পারার আক্ষেপের কথার প্রেক্ষিতে বকরূপী সঙ্গী মার্ক্স বলে সেও পারেনি । তার প্রমাণে বলে, রাশিয়ার পতন , আর তোমার আঁধারমানিক, কেশপুর, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ।
আর বাংলায় লালপরী বকলমে তথাকথিত বামদলের আদর্শ বলতে মানুষের কাছে যে বিশ্বাস ও ভরসা তা ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে তখন । ‘মহারণ’ প্রকাশের সময় 2003 সাল ধরলে, বাংলার বুকে পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে সুবিধাবাদের ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষমতা রাজনীতির দূষণ ক্ষমতাশালী দলের শিরায় শিরায় মজ্জায় মজ্জায় তখন ছড়িয়ে পড়েছে । এর শুরু হয়েছে আরও দশ বছর আগে । রাশিয়ার পতনও হয়ে গেছে তখন । কথাকার হোসেনের এই ‘মহারণ’-এর জন্ম তখনই । ভূমিকায় কথাকারের ‘কথার কথা’ তাই বলে ।
সময় যখন ক্ষমতালিপ্সা, প্রভুত্বকামিতা, আত্মস্বার্থ আর ভোগবাদী জীবন নিয়ে রাক্ষসবাদের কক্ষে ঢুকে পড়েছে তখন কেয়ামত মজনু শা’র সাথে কথা বলে জানতে চায়, সমস্ত ঘোরালো পরিস্থিতি কাটিয়ে সাঁই হতে পারে কিনা । দরবেশ বলে, পারবি, ছদ্মবেশ নাও ! হোজরা গড় ! মানুষ গড় !
কেয়ামত দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর রাসেককে সে-কথাই বলেছিল যে যতদিন বাঁচবে সে মানুষ তৈরি করবে । লড়াই করার মানুষ । তা নাহলে ঘেরি দখলের মতোন অবস্থা হবে । দখল হওয়া ঘেরি মানুষদের বিলি করেও পরে তার মালিকানা চলে যায় ভিন্নরূপে ।
তাই রাসেককে বলেছে, তোমার ও বড় বস্তুবাদের জায়গা এখনো এদেশে হয়নি । মানুষ তৈরি না । আগে বস্তুরক্ষার সাধনায় মানুষকে মুক্ত করতে হবে । পরে তোমার বড় বস্তুবাদের পথে মানুষকে ঠেলতে হবে ।
কেয়ামত এ কথা শুধু কথার কথা বলেনি । সে বস্তুরক্ষার সাধনায় নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করেছে । কাম-কামনা-লোভ-মোহ পুঁজিপাঁজি থেকে মুক্ত করেছে নিজেকে । মুক্ত পুরুষ হয়েই মানুষ গড়ার কাজে সে বেরিয়ে পড়ে । একমাত্র এমন মুক্ত পুরুষই মানুষকে মুক্ত করতে পারে । ঠিক এই জায়গাতে কথাকার ঘা দিতে চেয়েছেন সমাজের তথাকথিত হোমরাচোমরাদের, বিশেষ করে যাঁরা বস্তুবাদের কথা বলে। বস্তুবাদ সম্পর্কে মার্ক্সের রচনার একটু অংশ বলা যেতে পারে–‘মানুষ যদি তার সমস্ত জ্ঞান, সংবেদন ইত্যাদি এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ আহরিত অভিজ্ঞতা থেকে সংগ্রহ করে তাহলে এই স্থূল জগৎকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে এর মধ্যে সত্যিই মানবিক যা কিছু আছে তা মানুষ বুঝতে পারে এবং জানতে পারে এবং মানুষ যেন মানুষ হিসেবে নিজের সম্পর্কে সচেতন হতে পারে । যদি স্বার্থ সম্পর্কে সত্যিকারের উপলব্ধিই সমস্ত নৈতিকতার নীতি হয় তাহলে মানুষের ব্যাক্তিস্বার্থকে মানবজাতির স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতেই হবে । বস্তুতান্ত্রিক অর্থে মানুষ যদি মুক্ত হয় অর্থাত একে তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার নেতিবাচক ক্ষমতার অর্থে মুক্ত নয়, মুক্ত ইতিবাচক অর্থে…’
বস্তুতান্ত্রিক অর্থে মানুষের মুক্তির এই ইতিবাচক অর্থে নিয়ে যেতে ফকিরিবাদে বস্তুরক্ষার সাধনায় মানুষকে মুক্ত করার যাত্রায় কেয়ামতের পথচলা সুবিধাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সত্যই এ এক মহারণ ।
মহারণ
সোহারাব হোসেন
করুণা প্রকাশনী, কলকাতা- নয়