শরদিন্দু সাহা
লেখক পরিচিতি
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
বিষয় পরিচিতি
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘দেশের গর্ভে স্বদেশ ‘ উপন্যাস।)
দ্যাশের মইদ্যে লাইগ্ছে গজব
বাঁইচ্বার হুযুগ নাই
হশ্চিমাগ হাঁদে হড়ি
হরান চলি যায়
ভোটের হল্ ত বার অইল, আওয়ামী লীগ জিতিও গেল। কিন্তু শতান হশ্চিমারা বঙ্গবন্ধুরে জিত্তে কী দিল! ইয়াহিয়া হান সভা ডাইক্ল, জুলফিকার আলী ভুট্টো উল্টা কতা কইল। বেকে কইল, এত দুষ্টু বুদ্দি যদি মনে আছিল, হুদা হুদা ভোট করানোর কী দরকার আছিল! লোকে ত হাঁচা কতাই কইছে। হশ্চিমারা ভাবে হ্যাতারাই চালাক, আঁঙ্গ দ্যাশের মাইন্ষ্যে কিছু বুজে না। আসলে হ্যাতারা কল্পনাও কইর্ত হারে ন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঠিক কতা অই মাইন্ষ্যের মনের মইদ্যে হাঁদাই গেছে, দিনরাইত খালি জইপ্ছে কহ্ন বাঙালিরা নিজের ক্ষমতা হাইব। গৌরিনাথ মাষ্টর ত কইছে, ‘দেয়েন ত হশ্চিমারা কী চালাকের চালাক কবিগুরু আর বিদ্রোহী কবিরে লই হিন্দু মোছলমান শিবিরে টানাটানি করে, কী মূরুখ্যের মুরুখ্য, কবি ভালা থাইক্লে নিজেও শরম হাইত। এতই যদি হ্যাতাগ ধম্ম হিরিত, তাইলে বঙ্গদেশেরে এত চোষে কিয়ের লাই, বৈষম্য কিয়ের লাই, গরীব অশিক্ষিত বানাই রাইখ্ছে কোন দুহে? মাথা মুড়াই খাইতে সুবিধা অইব বুজি।’ অন্ দেইখ্ছি মাষ্টর ঠিকই কইছে। হুইন্ছিলাম্ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হ্যাতাগ আইনমন্ত্রী থাই আপোষ করি হালাইছে। বঙ্গবন্ধু ত গুরুর কতা হুনে ন। হ্যাতাগ চালাকিহান ধরি হালাইছে। যতই চাপ দিক, বঙ্গবন্ধু মাথা নোয়ায় ন। গ্ৰামের বেক্ মাইন্ষ্যে চাই রইছে দ্যাশের হরিস্থিতি কোন মুই গড়ায়। হেই ব্যাডাগ ঠিক নাই যা খুশি তাই কইর্ত হারে। সৈয়দ আহমদ বলে একসময় কইছিল হিন্দু মোছলমান এই দুই জাত কহ্নও এক লগে থাইক্ত হাইর্ত ন। দ্যাশডা ভাগও অইছে হেই ধারণা লই। মারামারি কাডাকাডি অইছে ঠিকই, অনেক মানুষ চলিও গেছে অনের ভারতে কিন্তু এদ্দিন ত আমরা এই দ্যাশে আপন ভাবি এক লগে আছিলাম। হিয়ের লাই ত কইছি আঁঙ্গ বেকের সামনে এক বড় হরীক্ষা। ভোটের হরীক্ষায় ত আমরা হাশ কইর্ছি, সামনের দিনে এইডাই প্রমান অই যাইব আসলে দ্যাশডারে আমরা কেরুম দেইখ্তে চাই। কত লোক ত আই কত কতা কই যার, আঁই ত কোনও কতাতেই কান দি ন। মাডে আমন ধান হাইকছে। বদইল্লারা ধান কাডি আনি এক প্রস্ত হুয়াই বোজা বাঁধি আনি উডানে জমা করের। হ্যাতাগ গাত তুন্ দরদর করি ঘাম ঝরে, হাশ দি হাঁডি গেলে গা’র গন্দে ভুত হলায়। মাথায় গামছা জড়াই হাগড়ি বাঁধে, ফুক ফুক করি বিড়ি ফুঁকে। এত খাড্নি খাডে, হরিশ্রম অই যায়, কয়, মা এট্টুহান গুড় আর এক গেলাস হানি দিবেন। খালি গার মুই চাইলে হাড়গোড় ছাড়া আর কিচ্ছু দ্যায়া যায় না। হেই যে বেয়ানে মরিচ আর হান্তা ভাত মাই খাই আইছে আর কিছু হ্যাডে হড়ে ন। গরুগোতানগুন এরুম জোরে জোরে হাম্বা হাম্বা করি ডাক দেয়, আঁই ঘর তুন্ হেই ডাক হুনি। ঘাস খাইছে, হ্যাড্ ভরে না। করিম হেগুনের স্বভাব চরিত্র বুঝে, খের খল্লি দি খাইত দেয়। হুরমতির মা এই কড়া রইদের মইদ্যেও গড়ের হাশে জঙ্গল তুন্ ঢেঁইর হাগ, মাচার তুন্ হলই হাগ, কচুর লতি তুলি আনি ঘরে ঘরে ভাগ ভাগ করি দেয়। বেক্গুনেরে ডাকে, আঁই হাগ তুলি আইন্ছি গ দিদি, এক্কান ভান্ড দেন। বেকে হেতির আঁচল ভর্তি করি যার ঘরে যা আছে হেই মত খইমুড়ি দেয়। মনের আনন্দে টু্ক্ টুক্ করি খায়, খাওন অই গেলে ঢক্ ঢক্ করি জল গিলি ঘরের দিগে আঁডা দেয়। ঘর বইলতে মুলি বাঁশের বেড়া দি খেরের চাল, এক ঝড়েই কাইত, আবার বেক্গুনের তুন্ চাই চিন্তি হত্যেক বছর ঘর বানায়।
মুজিবর রহমান দ্যাশের মাইন্ষ্যের লাই লড়াই করের, এইডা বুইজ্তে সময় লাগে নি। হুরমতির মা হেইডা আর কতডা বুঝে। তয় হেতিও ভালবাসি হালাইছে কিয়ের টানে য্যান্। কী জানি বঙ্গবন্ধুর কতা হুনি হুনি বুজি হালাইছে যে কতাগাইন কর হেতিগ মনের কতা, হরানের কতা, টানডা আরও বাড়ি গেছে হেই কারণে। দ্যাশের মইদ্যে ঘূর্ণি আই ইয়ানে হিয়ানে থাবা মারের, মাইন্ষ্যে দিশাহারা অই যার। চাইর মুই হাহাকার, রাক্ষুইস্যা ঝড়ে ঘরবাড়ি ভাঙিচুরি একসার, চাইল ডাইল তৈল বাজার তুন্ উধাও। ভোলা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া তুন্ আধা নেংডা, অভুক্ত মানুষজন ক্যাম্নে ক্যাম্নে আঁঙ্গ গ্ৰামে আই হইড়ছে বাঁইচ্বার আশায়। হশ্চিমা সরকার হিরেও চায় ন। লক্ষ লক্ষ মাইন্ষ্যের লাশ দেই বেকে হুঁশ আরাই হালাইছে। হিয়ের লাই আরও ক্ষেপি গেছে মানুষ। মুয়ে মুয়ে হিরে ‘যেরুম করি হোক, মরি আর বাঁচি হশ্চিমাগ দ্যাশ তুন্ দৌড়াই ছাড়ুম।’ আঁঙ্গ গ্রামের মাইন্ষ্যের চিন্তা গেছে বাড়ি, নানাজনে নানা কতা কয়। এইডা বুইজ্তাম হারিয়ের আগের মত বেক্ কিছু চইল্ত ন। আঁর হোলা অন্ আর সদরে যাইবার সাহস করে না। আঁর স্বামীরে কইলাম, কোটে আর যাওন লাইগ্ত ন, আম্নে ঘরে চলি আইয়েন। আদালতের কামকাইজও আগের মত নাই, মক্কল আর মামলা মোকদ্দমায় ঢিলামি আইছে। আঁর স্বামীর মুহে চিন্তার ভাঁজ অইড়ছে। বিপদ ঘনাই আইয়ের। ভুট্টোর লগে বঙ্গবন্ধুর মিটিং ভেস্তে গেছে। আঁর স্বামী ঘাব্ড়াই গেল, ডাকে আঁরে, তুঁই হুইনছনি ইয়াহিয়া খানের ডাকা জাতীয় হরিষদের বৈঠক ভুট্টো বয়কট কইর্ছে, হ্যাতেনে দুই হদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলেরে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাইছে। বঙ্গবন্ধু কইছে হেই দাবি হুরাডা অযৌক্তিক। আওয়ামী লীগের কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর কইর্ত অইব, ক্ষমতার মালিক অন্ হুব বাংলার জনগণ। বঙ্গবন্ধু ত দ্যাশের মাইন্ষ্যের মনের কতাই কইছে। আঁঙ্গ গ্ৰামের আওয়ামী লীগ সমর্থনকারীরা এক্কান মিছিল বার কইরছে। জামাতিরা হেইডা হছন্দ করে ন। গোলমাল এক্কান যে অইব বুজাই যার। হোলাডা আই কইল, হুইনছেন নি মা, ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দিছে জাতীয় হরিষদের বৈঠক বলে অনির্দিষ্টকালের লাই বন্দ। কী অইব গ!
বাড়ির মাইন্ষ্যের চয়ে মুয়ে আতঙ্ক দ্যায়া দিছে। হরতাল শুরু অই গেছে হুরা দ্যাশে, বেকে ঘরে হাঁদাই গেছে। আঁর মাইয়া গেছে মন্দিরে হুজা দিবার লাই। ঘন্টা আর শঙ্খের শব্দ হুনি বুইজ্লাম আর বেশি বাঁই নাই। মাইয়ারে কত করি কইলাম অন্ ঘরের বার অইচ্ না, হুইন্ল না আঁর কতা। ভয়ে ভয়ে কাডে আঁঙ্গ দিন। আইজ্ রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিব। কান খাড়া করি বেকে হুনের – এবারের সংগ্ৰাম আমাদের মুক্তির সংগ্ৰাম, এবারের সংগ্ৰাম স্বাধীনতার সংগ্ৰাম, জয় বাংলা… প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল…রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। হুনি ত বেক্গুনের রক্ত গরম অই গেছে, য্যান্ হশ্চিমাগ আতের কাছে হাইলে চিবায় খাই হালাইব। বাজার গরম অই যার। বাঙালি অন্ আর হশ্চিমা সরকারের কতা মানে না, বঙ্গবন্ধুরেই অন্ দ্যাশের জনগণ হত্তাকত্তা মানে। লোম খাড়া অই গেছে যহ্ন হুইন্লাম হরে হরে হ্যাতাগ লগে কতাবাত্তা কোন কামে আইয়ে ন, হাকিস্তানি বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করি দিছে। অবস্থা বুজি মাইজ্ রাইতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করি দিছে বঙ্গবন্ধু। হ্যাতেনরে ধানমন্ডির বাড়িত্ তুন্ সেনারা গ্ৰেফতার করি লই চলি গেছে। আঁই ত হুনি আকাশ তুন্ অইড়লাইম এইবার বড় রকমের কিছু এক্কান অইব। দ্যাশের মাইন্ষ্যের উপ্রে বিপদের খাড়া নামি আইয়ের বুজা যার। চাইরদিক তুন্ খবর আইয়ের শয়ে শয়ে নিরীহ মাইন্ষ্যেরে গুল্লি করি মাইরছে হাঞ্জাবীরা। হ্যাতারা যে এবার হুরা দ্যাশে কব্জা কইরবার লাই লঙ্কাকাণ্ড চালাইব, ভাব দেই বুজা যার। আঁঙ্গ গ্ৰামের জোয়ান হোলারা জোড বাঁধের, জামাতিরা ছাড়া বেক্ হিন্দু মোছলমান এক অই গেছে। আঁর হোলাও বায়না ধইর্ছে হ্যাতাগ লগে যোগ দিব। আঁই মানা করি ক্যাম্নে।
দ্যাশে হশ্চিমারা বলে অনেক অস্ত্র আনি জড় করের। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আঁঙ্গ দ্যাশের হোলারাও দলে দলে মরণহন করি ঝাঁপাই হড়ের, দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে হাঞ্জাবী সেনাগ অইত্যাচার তুন্ বাঁচাইত অইব ত। কেউ আর হিছের দিগে হিরি চায় না। এরুম অইছে রাস্তাঘাডে জোয়ান হোলাপইনরে আর দ্যায়নই যায় না। কী যে অইব! হাঞ্জাবীগ গুল্লি খাই কত তরতাজা হোলাগ যে হরান চলি যার। মা-রা ঘরের মইদ্যে বই বুক চাপ্ড়ায়, কে আর দিব সান্ত্বনা। বাজারের দোয়ান আট বেক্গাইন বন্দ করি দিছে, কহ্ন আই লুটহাট করি লই যাইব, অরাজকতা চইল্ছে। আনাজহাতি তৈল নুন সাবান কিচ্ছুই হাওন যায় না, বেকে হেনেভাতে খাই জীবন কাডায়। এরুম এক্কান দিন যে আইব, কেউ কল্পনাও কইর্ত হারে ন। ঢাকা চাঁটগা ময়মনসিংহ সিলেট কুমিল্লায় কী অর জাইন্বার লাই একজন আরেকজনের ঘরের মুই ছোডে। জিলা শহরে অনেকের হোলারা কাম কাইজ্ করে ত। কোনরমে ঘুরহঁতে চাইর হাঁচ দিন ধরি কেউ বাড়ি হৌঁছাইল ত চাঁদ আতে হাইল। হ্যাতেরে ঘিরি চাইর বাড়ির মানুষ জড় অই নানা কতা জিগ্গায় – ক্যাম্নে আইছ?… সৈন্যগ গুল্লিগালা চইলছে হুইনলাম। … ধরি ধরি হিচমোড়া করি বাঁশের খুঁডিত্ ঝুলাই বন্দুকের নল দি হিডায়।…কতাগাইন হাঁচা নি।…বৌঝিরে হেনস্থা করের বুজি অসইভ্য হাক সেনারা? ভূপতি কয়, সেনারা খালি নয়, লগে আঁঙ্গ দ্যাশের রাজাকাররাও ছাড়ের না, আর হিন্দুর মাইয়া হাইলে ত কতাই নাই, শরীল ত খাবলাই খুবলাই খার, শ্যাষমেশ জাতধম্মও রসাতলে যার। বেকে গালে আত রাই কতাগাইন গিলে আর ডরে চখমুখ চিমসাই যায়। আঁঙ্গ দ্যাশের আলাভোলা মাইন্ষ্যের উপ্রে এত অইত্যাচার চালার দুষ্টরা! এর বিচার একদিন অইব। আইজ্ না হয় শহর তছ্ন্ছ্ কইর্চে, কাইল যে গ্ৰামে আই থাবা বয়াইত ন, কে কইত হারে। কইত হারে কীগ বদি, সৈন্যরা হেনি, লাকসাম, চৌমুহনী হইয্যন্ত ঢুকি গেছে। ব্যবসা বাণিজ্য ছত্রছান করি দিছে, কারবারিগ গাছে বাঁধি গুল্লি করি মাইরছে, মাথার খুলি উড়াই দিছে। মাইন্ষ্যে হাগলের মত হরান বাঁচাইবার লাই ছুডি বেড়ার। এই আঁচ আঁঙ্গ ঘরে আই হইরতে বেশিক্ষণ লাইগ্ত ন।
বেকের চয়েমুয়ে এক আতঙ্ক, কহ্ন কী অইব, কেউ কইত হারের না, খালি হায় হুতাশ করে। হাঞ্জাবীরা চাইর দিগের তুন্ ঝাঁপাই হড়ের। এরুম কতগুন মাইন্ষ্যের মুখ দেয়ন যার, আশেহাশে আগে কহ্নও দেয়ন যায় ন। হ্যাতারা কত কতার হ্যাঁচাল হাড়ে। হেগুনের খাইচ্চত এত খারাপ আঁঙ্গ বাড়ির করিম আই কয়, কী কইয়ুম জেডি, এরুম গাইল দেয়, হালা হমন্দি ছাড়া মুয়ে কোন কতা নাই, খালি বঙ্গবন্ধুর গুষ্টির তুষ্টি করে। খালি আম্নেগ চইদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করের, আঁঙ্গরেও ধম্কায় আর কয়, ‘মালাওনেগ লগে মিলামিশা করবি ত তোগরেও দেই লইয়ুম, অন্ও সাবধান অই যা।’ বিপদ আইয়ের গ জেডি, আম্নেগ আর এই দ্যাশে থাইক্ত দিত ন। আঁর বড় জা কয়, কী কছ্ রে করিম সব অলক্ষুণে কতা! তাইলে আমরা যাইয়ুম কন্নাই? আর এক জা জিভ ভ্যাঙায় কয়, যমের দুয়ারে। কতাডা যে হেতি ভুল কর্, হেইডাই বা ক্যাম্নে কই। ওমা কিছুক্ষণ বাদে দেই অনন্তহুর তুন্ আঁর ননদের দুই হোলা আর হেতির জামাই গাট্টি বোঁচকা লই হাজির। আঁই ত দেই আকাশ তুন্ অইড়লাইম। কীরে ক্যাম্নে অইল তোগ এরুম দশা! আর কইয়েন না বদিগ কোনরমে হরানে বাঁচি আইছি। রাজাকাররা লাডিসোডা লই আই আঁঙ্গ বাড়ি ঘিরি হালাইছে মাইজ রাইতে। হুরুষ মাইন্ষ্যের হ্যাডে হিডে কিল চড় থাপ্পর লাত্থি গুঁতা। যে যেমুই হাইর্ছে হলাইছে। আমরা রাত বিরাইতে আর কিঅরুম, ধানক্ষেত হাটক্ষেত দি জল ভাঙি ভাঙি আইছি। বয় বয়, আগে জিরাই ল, তোগরে আগে জল দি। তোর মাইয়াগুনরে কন্নাই রাই আইছচ্? হেগুনের কোন খবর নাই গ বদি।
আঁর ননদ ত উত্লাই উত্লাই কাঁদে। হেতির কাঁদা থামাইতাম্ না হারি মাথাডা আঁজা করি বুয়ের মইদ্যে চাপি ধরি। আঁর কাহড় ভিজি যায়, হেতির কাঁদন্ কী আর থামে! বাড়ির বেক্গুনে চাই থায়। কারও মুয়ে কোন কতা নাই। কী অইতেছে আর কী অইব, কেউ বুইজ্ত হারেন না। বিপদ যে আঁঙ্গ বাড়ির কাছে আইতে আর বেশিক্ষণ লাইগ্ত ন, বেকে টের হাই গেছে। রেডিওত্ কান হাইত্লেও কোন খবর নাই। আওয়ামী লীগের নেতারা খবর কয়, আম্নেরা ঘাবড়াইয়েন না। আঁঙ্গ দ্যাশের শয়ে শয়ে জোয়ান হোলারা মুক্তি বাহিনীতে যোগ দের। ইনশাল্লাহ হেগুনে জোর লড়াই করি জয় ছিনাই আইন্ব। ভারতীয় সেনারা বডারের ওপারে প্রশিক্ষণ দেওন শুরু করি দিছে। ডরাইয়েন না, মোডেই ডরাইয়েন না, স্বাধীনতা হাওনের দিন আর বেশি দূরে ন।
চয়ের নিমিষে সময়ডা হাল্টাই গেছে। দিন দুইন্নাই আর আগের মত নাই। আগুন জ্বইলছে ত জ্বইলছেই। হেই আগুনে হুড়ি মইর্ছে হুব হাকিস্তানের বাঙালিরা। জ্যান্ত বাঙালিগ মইদ্যে ভেদাভেদ থাইক্লেও থাইক্ত হারে, মরা বাঙালিগ মইদ্যে এক্কানই হরিচয়, বাঙালি হরান দিছে, বাঙালিরে গুল্লি করি মাইরছে হাঞ্জাবীরা, হেই অমানুষগ শাগরেদ অইছে আঁঙ্গ দ্যাশের বেঈমানরা যেগুনে ভাইয়ের রক্তে নিজের আত রাঙায়, কিয়ের লাই করের হেগুনে নিজেরাও জানে না। হিংসার আগুন লক্লক্ করি আইয়ের। আরে, ধম্মের দোহাই দি সীমানা দখল কইর্তে হাইর্লেও মন দখল করন যায় না। আগুন দিও এত বাড়ি ঘরদোর হোড়ান যায় না। কত জলা, কত হুইর, কত খাল, কত বিল কত নদীর কত জল থাওনের হরেও নিবাই ত হারে ন। মনের মইদ্যে আঁর কত কতা যে হুডের ভট্ ভট্ করি, আঁই ধইর্তাম হারিয়েন না, হুরুত হারুত করি হলাই যায়। মনের কতা আর কারে কমু। বাড়ি ত আর বাড়ি নাই, বেকের আত্মীয়স্বজন আই হুরা বাড়ি ভর্তি অই বাড়ির চেহারাহান অইন্যরকম অই গেছে। বদলের মইদ্যে এক অইছে আঁঙ্গ জাম্বুরা গাছে এবার এত এত জাম্বুরা ধইর্ছে, আমলকি গাছে এত হল্ ধইর্ছে, ঠাইল হুদ্দা ভাঙি হড়ি যার। হড়ি আর কী যাইব, আবার ঝারিঝুরি উডি খাড়াইব। আঁর হৌড়ি কর, বৌ এবার স্বাদ করি আঁচার বানাইচ্, ভাত দি খামু। হ্যাতেনের কতাগাইন হুনি চখ দি জল বার অই যার। বুড়িমানুষডা জাইন্তই হারেন না, দ্যাশডা যে হুড়ি ছাই অই যার, মাইন্ষ্যের লাশ হিয়াল কুত্তা টানি টানি ছিঁড়ি খার, কত মার কোল খালি অই যার। সময় আঁর হৌড়ির কাছে এক হাও আগায় ন, থম্কাই আছে হ্যাতেনের ঘরে, মানুষজন বাড়িঘরের চেহারা সুরত একমই ঘুরি হিরি থায়। আঁই যদি দ্যাশের চেহারাহান এরুম করি দেইখ্তাম হাইর্তাম। আঁর দ্যাশ, স্বপ্নের দ্যাশ, বঙ্গবন্ধুর দ্যাশ এক রম থাইক্ত। এই মানুষডারে লই কতজনে কত কতা কয়, দ্যাশের লাই হরান দিবার হতিজ্ঞা ত মিছা কতা ন। না জানি ইয়াহিয়া আর ভুট্টো যুক্তি করি জেলের মইদ্যে রাই না মারে। হায় হায় রে মানুষডার কতা হুইনলে মনডা জুড়াই যায়। হুইন্লাম হ্যাতেনরে রাষ্ট্রপতি করি সরকার বানাইছে আওয়ামী লীগ। কী জানি কতাহান হাঁচা কিনা। তাইলে কী আঁঙ্গ দ্যাশ স্বাধীন অই গেছে, আহারে স্বপ্ন!
ঘরে ঘরে কতা কাডাকাডি, বোঁচকা বুঁচকি লই লাড়াচাড়া শুরু অই গেছে। ভাবহান এরুম য্যান্ বিপদ দ্যাইলেই ছুডি হলাইত হারে, গ্যাঁতি গুষ্টির আওন যাওন আর থামে না। কত ত শলা হরামর্শ, বেক্ কতার মইদ্যে ডরভয় মিশি রইছে, কতা কইতে গেলে জিভ হুয়াই যায়, এক কতা কয় ত আর এক কতা বার অই আইয়ে। হুনা যায় কাঁশ পিতলের ঠন্ঠনাঠন্ ঠন্। টঙের তুন্ নামাইবার সময় ধুম্ করি হড়ে, হাঁড়গোড় ভাইঙলেও ভাইঙত হারে, আঁডু আর গোড়ালির ব্যথায় উঃ আঃ করে বুড়াবুড়ি। বিপদটা আগাম আঁচ কইর্ত হারি ঘরের বউঝিরা বিলাপও করে – কী উপায় অইব গ আঁঙ্গ দিদি, এই চোট্টারা ত হাঁড়ি হাতিল, হোনাদানা লুট করি লই যাইব। যিয়ান হুনিয়ের হাঞ্জাবীরা খুনখারাবি গুল্লিগালা তুন্ শুরু করি কোনডাই বাদ দেয় না, মাইয়া মাইন্ষ্যের ইজ্জত লই খেলের। যদি একবার খাল হার করি করিমগঞ্জ থানা হার অই বাজারের রাস্তাহান চিন্ত হারে তাইলে আঁঙ্গ মরণ ত অইবই অইব। শ্মশানের মঠ রাজাকাররা চিনাই দিলে ত কোন কতা নাই, হিন্দুর বাড়ি বুজি যাইব। এত ভাবাভাবির মাইজহানে রমজান আলি আই খবর দিল, বাবু আম্নেরা তাড়াতাড়ি হলাই চলি যান আরও ভিত্রের গ্ৰামে, আঁই নৌকাত্ করি জীবনহুর হৌঁচাই দিমু, ইয়ার হরে আম্নেরা যুক্তি করি যেইডা ভালা মনে কইর্বেন, কইর্বেন, আঁর কিছু কওনের নাই। আন্দাজ করি আঁর সেজ দেয়র কয়, রমজান আঁঙ্গ বাড়িঘর ক্যাম্নে রক্ষা অইব। আরে বাবু, আগে ত জান বাঁচান, বাড়িঘরের কতা হরে ভাবিয়েন। দরকার অইলে ত আমরা হারা দিমু দিনরাইত। হ্যাতের কতা হুনি হুরুষ মাইন্ষ্যেরা চখ চাওয়া চাওয়ি কইর্ল। রমজানের কতা উড়াই দেওন যায় না। হ্যাতেরে আবার আওয়ামী লীগ তদবীর করি চাষাগ নেতা বানাইছে, মিছা কতা কইত ন। আঁর এক খুড়াহৌর কয়, হুন, আমরা বাড়িঘর হালাই কোনহানে যাইতাম্ ন, আঁঙ্গরে যদি মারিকাডি হালায়, হালাক্। রমজান এবার গালের চোয়াল শক্ত করি কয়, হুনেন বাবু, আসল কতা কই, আঁর কাছে খবর আইছে, আম্নেগ চাইর হিন্দু বাড়ি আইজ্ রাইতে আক্রমণ অইব। আজীবন আম্নেগ নুন খাইছি, চয়ের সামনে গ্ৰামের মাইন্ষ্যেরে কচুকাডা কইর্ব, এইডা সইতে হাইরতাম্ ন, হিয়ের লাই সাবধান করি দিতাম্ আইছি। বিশ্বাস কইর্বেন কি কইর্বেন না, হেইডা আম্নেগ মর্জি। যেগুনে এতক্ষণ মাথা ঘুরাই ঘুরাই খাইজ্জাইতেছিল, হ্যাতের কতায় বিশ্বাস অইল, কতাডার ওজন আছে, চালাকি না।
কুত্তাগুন ঘেউ ঘেউ করে, বিলাইয়ের কান্দন সইয্য করন যায় না, মনে অর মাইন্ষ্যের বাইচ্চা কাঁদের। হোলামাইয়াগুনের মুয়ের দিগে চায়ন কী যায়, আতঙ্ক আর ভয় আই হেগুনেরে ঘিরি ধইর্ছে, আঁঙ্গ মুয়ের দিগে চাই থায়, কোন কতা কয় না, খেইলত যায় না, মুয়ে খানা রচে না। হেগুনেও কী বুজি হালাইছে ভয়ানক কিছু এক্কান অইব, হিয়ান তুন্ রেহাই হায়ন এত সহজ অইত ন। আগের মত ঘাডে আই নৌকাও ভিড়ে না, মাইন্ষ্যের কোনও সাড়াশব্দও নাই, দেয়র ভাইয়ুররা দোয়ানেও যায় না, বেজার মুয়ে গালে আত দি ঘর দুয়ারে বই থায়। আগে ত ভালামন্দ জিনিস আনি আতে দিত, নাইচ্তে নাইচ্তে খাইত। হেই দিন আর নাই। মাইন্ষ্যের মনে কোনও সুখ নাই, বেক্ আনন্দ রসাতলে গেছে। জীবন যে কোনওদিন এরুম শিক্ষা দিব, কে জাইন্ত। গুম মারি আছে চাইরদিক। হুইরের জলও লড়ে না। গাছের হাতাগুন নিজের খেয়ালে ঘুইরতে ঘুইরতে জলে হড়ি হাড়ে আই জড় অইত, জলের হোকারা লাফাই লাফাই উইঠ্ত, ঝুপঝাপ হেই শব্দও হুনা যায় না। ব্যাঙেরা ঘ্যোঁতঘাঁত করি নিজের মনে, হাপেরা কহ্ন যে খপাৎ করি গিলি হালাইব টের হায় না। মাইয়ার ঘরের নাতি আই আঁর কাহড়ের আঁচল ধরি টানি ইনাই বিনাই কত কতা কয়, হিয়ানের মাথামুন্ডু বুজি না। আসলে হ্যাতের রাগ অইছে মা বাপের চলি যাইবার লাই তোড়জোড় করের। আপন ঘর ছাড়ি কেউ কহ্নও যাইত চায় নি। এট্টু্ক্ ছুটকিয়া ক্যাম্নে বুইজ্ব দ্যাশের মইদ্যে কী কাণ্ড চলের। এই ঝড়ের দাপট যে আঁঙ্গ বাড়ি আইতে বেশি দেরি নাই, হেই চিন্তায় বেকে দিশাহারা। কন্নাই গেলে হরানে বাঁইচ্ব হেইডাই বুইজ্ত হারেন না। এই বিপদের তুন্ কেই বা উদ্দার কইরব কেউ কইত হারেন না। বেকে বেকের চয়ের দিগে চায়। কী অইব উপায়! রাত বিরাইতে কীয়ের য্যান্ দড়াম্ দড়াম্ আবাজ হুনা যায়। কারা য্যান্ টিনের চালে ইডা মেলা মারে, ঝন্ঝন্ করি উডে। এই বুজি রাজাকাররা আই হইড়্ছে। হরানডা ধু্ক্ ধুক্ করি ওডে। গাছের হাতা ঢুলি হড়ি যায়, কোনরমে রাইত কাডে। বেয়ান না অইতেই দেই আঁর খুড়া হৌড়ের মেজ হোলা বাক্সহোট্লা লই বাড়ি ছাড়ি চলি যার। হ্যাতাগ ঘরে আঁঙ্গ এম্নেই আওন যাওন নাই, ভিন্ন অই গেছে ত কম দিন অয় ন। হেই কারণে কোন শলা হরামর্শ নাই। তবুও মনের টান ত যায় না, নিজে যাই জিগ্গাইলাম ঠাউরপো কন্নাই যাও। মন তুন্ বার অয় ন, মুয়ের তুন্ যে কতাগাইন ছুড়ি দিল – যে দিগে দুই চখ যায়, চলি যামু, এম্নেও মরুম, হেম্নেও মরুম, মরণ যহ্ন কোয়ালে লেয়া আছে, যা অইবার তা অইব। বুইজ্লাম হ্যাতে রাই ঢাই কতা কর। আঁর বাপের বাড়ির দ্যাশ তুন্ রাধানগর ত বেশি দূরে ন, হিয়ান দি ত্রিপুরা চলি যাইব। ইয়ার হরে এক্কান ব্যবস্থা অইব। ঐহাড়ে আত্মীয় হজন আছে, না খাই মইর্ত ন। আঁর হৌড়ি কয়, কে যায় রে বউ? বরেন ঠাউরপো গ মা। ও বরু, হ্যাতে শ্যাষমেশ দ্যাশ ছাড়ি, বাড়ি ছাড়ি, আঁঙ্গরে হালাই চলি যার! কী অইব রে বউ, বেক্ যদি এম্নে চলি যায় আঁঙ্গ কী দশা অইব! আরে বেকে ত যার না, আরও ত বাড়ির লোক আছে, এত চিন্তা করেন কিয়ের লাই?
এরুম দিন যে কোনদিন আইব, ভাইব্তাইম্ও হারি ন। এক ঘর তুন্ দুই ঘর, দুই ঘর তুন্ তিন ঘর, তিন ঘর তুন্ চাইর ঘর, চলি গেছে ভারতে এক এক করি। কারোগরে কিছু কইবার নাই। বাঁইরাও হা বাড়াই রইছে। দ্যাশগ্ৰামের মাইন্ষ্যের চয়ের সামনে দি চলি যার, কারও মাথাব্যথা নাই, হ্যাতারা ত রক্ষা কইর্ত হাইর্ত ন। যেই জালিমরা তৈরি অইছে, এক কোপে সব সাবাড় করি দিব, ভিডামাডির লাই মায়া করি শ্যাষে কী হোলামাইয়া লই নিজেগ হরান দিমু! হেগুনে কয়, যদি বাঁচি থাই, ভাইগ্যে যদি লেয়া থায়, একদিন না একদিন দ্যাশে হেরত আমু আর যদি হঁতেঘাডে মরি যাই, হিয়াল কুত্তায় টানি ছিঁড়ি লই যাইব। মাইয়াবউরে কইছি, শতানরা ইজ্জত লুইট্ত আইলে, হুট্লির মইদ্যে ধুতরা হল্ হুল্ আছে, খাই মরবি। বেক্গুনে হেই কতা হুনি ঝরঝরাই কাঁদে, বউ মাইয়ারে বুয়ে জড়াই ধরে। হুনিয়ের আঁঙ্গ হাশের বাড়িঘরও খালি অই যার। হ্যাতাগ বাড়ির ক্রিয়াকম্মে আমরা অসজ হালন করি না, ছয় হাত হিঁড়ি আগের কিনা, গ্যাঁতির মইদ্যে অন্ আর হড়ে না কিন্তু সম্পর্কের জোর কেবল কম ন, আপদে বিপদে ছুডি আইয়ে, ঝগড়া বিবাদ অইলে আপষে মিমাংসার লাই ডাক হড়ে। কীর্তনে, হালা হার্বণে, মোচ্ছবে, মুয়েভাতে, বিয়াশাদিতে নিমন্তন্নও করে, ডাকখোঁজের অন্ত নাই কিন্তু এরুম অশান্তির দিনে ক্যাম্নে যে মুখ হিরাই লইল কি জানি, যার যার তার তার হঁত দ্যায়। বেক্গুনের এই অবস্থা দেই মনডা ভাঙিই গেল। আবার ভাইব্লাম, ঠিকই কইরছে। এতগুন মানুষ, নানা মুনির নানা মত, কেই বা কার কতা হুইন্ত। কার লগে কার আত্মার সম্পর্ক আছে কে কইত হারে। বড় সংসারডা কহ্ন যে লম্বা অই যায়, আবার কহ্ন যে ছোড অই যায়, বেক্গাইন ত মনেরই খেলা। আঁর স্বামীর মা’র হ্যাডের ভাইগ মইদ্যেও নানা রমের ভাবনাচিন্তা চলে। আঁর ননদরাও কেউ নরোত্তমপুর, কেউ আবার হতাপহুর। কত কতা আচম্বিত্ কানে হুনি। হ্যাতারাও যার যার মত ছড়াই ছিডাই গেছে। বড় ননদেগ করিমগঞ্জে ধান চালের ব্যবসা, আর ছোড ননদেগ হেনী শহরে তেজারতির কারবার, ট্যায়াহইসা, মালহত্র বেক্ কিছু লুটপাট অই গেছে, আগুন দি জ্বালাই দিছে দোয়ানহাট। হ্যাতারা বিলইন্না বডার দি হার অই গেছে কিনা, তাও জানি না। মরণ যদি অয়ও, রুইখ্ব কে?
মনস্থির করি হালাইলাম্, যে যার খুশি যাক, হাঞ্জাবীগ গুল্লি খাইলে খাইয়ুম, নিজের দ্যাশ ছাড়ি যাইতাম্ ন, আঁর স্বামীও আঁর লগে এক মত অইল। আঁর মেঝ, সেঝ, নোয়া, ছোড দেয়ররা আঁর সুরে সুর মিলাইতে রাজি অইল না। হইলা দোটানা কইর্লেও হ্যাতারা বাড়িঘর ছাড়ি হাঁডা ধইরল ঘুরহঁতে, আপন হরান বাঁচাইতে কে আর না চায়। হোলাহাইনগুন আঙ্গঁরে একলা রাই যাওনের লাই দুখ্ কইরল, শ্যাষে বাবা মার যুক্তির কাছে হার মাইনল। এইডা ত হাঁচা কতা ভিডামাডির মায়া করি হড়ি থাইক্লে চইল্বনি। হেইডা যে বোকামির কাম অইব, হেইডা আঁইও বুজি। যাইবার কতা মনে অইলেই ভিতরডা কেরুম করি উইঠ্ল। একবার শ্যাষ চেষ্টা করি দেই না যদি ধন হরান দোনডাই বাঁচাইতাম হারি। গ্ৰাম কে গ্ৰাম উজাড় অই যার, দলে দলে মানুষ দ্যাশের মায়া ছাড়ের। হতিবেশী মোছলমান ভাইরা কেউ কেউ যে দুখ্ করে কয় ন এরুমডা ন, ‘আম্নেরা চলি গেলে আমরা বাঁচুম ক্যাম্নে!’ কিন্তু ভরসাও ত জোগাইত হারে ন। আঁর স্বামী সেজ জামাইরে কইল, ‘তোঁঙ্গ গ্ৰামে ত অন্ও এত উৎপাত শুরু অয় ন, এক হাঁকে তোঁর হালা হালীগরে ঐহাড়ে বড় মাইয়ার কাছে যদি রাই আইতে হার, একটু নিশ্চিন্ত অই। জামাই আঁর ডাকাবুকা মানুষ, এক কতায় রাজি। দিন দশেক বাদে মঙ্গলমত হেগুনেরে রাই আই জামাই হেরত আইছে। হিগার মুখহান দেই ত আঁই চম্কাই উইঠ্লাম।
কিয়া কাইয়ুম মা, যা দেই আইলাম, নরক ছাড়া আর কিছু ন। জলা জঙ্গল হার অই মাইন্ষ্যে বডার হার অই যার, মাঝেমইদ্যেই দড়াম করি মাথা ঘুরি হড়ে। খানা নাই, দানা নাই, এক গেলাস খাওনের জলও নাই, ঝর্নার জল দুই আতে কোশ করি খায়, কে কারে দিব, এক্কান মানুষ নাই যে আগাই আইয়ে। বউঝিগ কাহড় চোহড় ছিঁড়িভিড়ি এরুম দশা, চয়ে দেয়ন যায় না। কও কী! আরও হুইন্লে ত আম্নে ভীমরতি খাইবেন। তাঁবুত্ হুতি হেনেভাতে খাই দিন কাডায়। হ্যাডের অসুয়ে কাত্রায়। হ্যাতাগ সরকার খানাও দের, যত আঁঙ্গ দ্যাশের মানুষ ঢুকের, আশ্রয়ও দের, ইয়ার তুন্ বেশি আর কী কইর্ব। আঁঙ্গরে হেই দ্যাশে কয় শরণার্থী। কোনরমে মাথা খুঁজি রইছে গাদাগাদি করি। কী যে হঁচা গন্দ, হায়খানা হেচ্ছাবের মইদ্যে বউরা সন্তান হসব করের গ মা। লেংডা হোলাগুন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে। কারও দয়া অইলে দুমুডা দেয়, না হয় মুখ হিরাই লয়। লাজ শরম বেক্গাইন মাথায় উইঠ্ছে। হিগাইন দেই আঁর হেই দ্যাশে যাইবার মন উডি গ্যাছে।
তোঁগ গ্ৰামহান ত অনেক ভিত্রে, মানুষগুন ভালা, আঁঙ্গ ইয়ানের মত এত অইত্যাচার কইর্ত ন। দ্যাশের অবস্থা যে কোনদিগে গড়াইব কিছুই অনুমান কইর্তাম হারিয়েন্ না। খান সেনারা আঁঙ্গরে কী মারিই হালাইব। হ্যাতারা যদি মুক্তিযুদ্ধে জিতিও যায় হোড়া দ্যাশ আর মরা মানুষ লই দ্যাশ শাসন কইরব ক্যাম্নে। আঁর জামাই কয়, আম্নের এই কতার উত্তর মা অন্ কেউ দিত হাইর্ত ন। লাশ আর রক্তের দাগ মাড়াই মাড়াই অন্ আঁঙ্গরে ঘরে হিরতে অইব। না জানি বাড়ির অবস্থা কী অই রইছে, আর আম্নের মাইয়ারাও কে কেরুম আছে। হেরুম বুইজ্লে কই আইছি জঙ্গল ঘিরা এক্কান হুরান বাড়ি আছে, হাপখোপের বাসা, মাইন্ষ্যের চয়ের আড়ালে থায়, খাল হার অই হিয়ানে য্যান্ যাই মাথা গোঁজে।
আনন্দ আর ক্যামনে ধরি রাই
দ্যাশ আঁঙ্গ স্বাধীন অইছে
মনের কষ্ট ভুলি যাই
ক্যাম্নে আর থাইয়ুম এত্ত বড় বাড়িত্। ঘরের মইদ্যে একলা বই কাঁদে আঁর হৌড়ি। হ্যাতেনের মনের মইদ্যে বড় দুখ্। বাড়িডা খাঁ খাঁ করে। হুতি বই থাইক্লেও হারাদিন কত বক্বকানি আই কান ঝালাহালা করি দিত। অন্ কোনও কোন্দল নাই, হাওনা গণ্ডার ইসাব নাই, হ্যাডের ভাত জোগানোর কোনও তোড়জোড় নাই, জায়ে জায়ে কোনও ঝগড়া নাই। তহ্ন ঘরের মইদ্যে হড়ি থাইক্লেও মনে অইত, কত আত্মীয়স্বজনরা আই গিজ্গিজ্ করে। এমুই হেমুইর তুন্ হিস্হিস্ হুশ্হাশ্ শব্দ বাতাসের লগে ভাইসতে ভাইসতে আই ঘরে হাঁদাই যাইত, রোগে ভুগি ভুগি শরীলডা লাড়াইত চাড়াইত না হাইর্লেও কী ভালা যে লাইগ্ত হ্যাতেনের, মুয়ের উপ্রে আঁসির ঝলক দেখলেই আঁঙ্গ হরানহান জুড়াই যাইত। মনে বড় কষ্ট লই বেজার মনে অন্ বকবক করে। মুশকিলডা হর অইন্য জাগায়। চাইরদিগে হুড়মুড় করি শুধু কী ঘরবাড়ি ভাঙের, মাইন্ষ্যের মনও ভাঙি যার, কারও কোনও ক্ষমতা নাই যে এই অবস্থাডারে আঁট্কাইব। আঁই আঁর হৌড়িরে কইলাম, মা এইবার যাইত অইব। হ্যাতেনে কইল, কিয়ের লাই যামু, কন্নাই যামু? তোরা কী আঁরে মারি হালাইতে চা? আঁর কাছে হেই কতার কোনও জবাব নাই। তয় যাইত যে অইব হেইডা হুরাহুরি ঠিক। দুই এক হান ট্রাঙ্কে আঁর বিয়ার হিতল কাঁসার থালা গেলাস, হাঁচ হুরুষের নাম ঠিকানার ঠিকুজি কুষ্টি ভরি আর এক বোঁচকাত্ চিড়া খই মুড়ি গুড় লই ঘরের এক কোনায় রাইখ্লাম, বাঁই ঘরদোরে তালা মারা। গমগম করা বাড়িহান এইরম যে শুনশান অই যাইব, কল্পনাও ত কইর্তাম্ হারি ন। আঁর স্বামীরে কইলাম আর মায়া বাড়াইয়েন না। আঁর স্বামী কইল, বুইজ্লা না, মনের দুঃখে বনে যাইত অইব আর কি। এই কাঁচারি বাড়িত্ চেয়ার টেবিলে বই কত মুসাবিদা কইর্ছি, গ্ৰামের কত মাইন্ষ্যের দুহের কতা হুইনছি। ভাইবছি, এইডা আঁঙ্গ গ্ৰাম, ইয়ানের মানুষ কত দুখি, সামান্য জমিজমা লই চাষবাস করি খায়, হ্যাতাগরে লই আঁঙ্গরে বাঁইচ্ত অইব, আলাদা করি কহ্নও ত ভাবিন, ক্যাম্নে এরুম অইল কও ত।
কে আম্নের মনের কতা হুইন্ব? হশ্চিমারা আই চালাকি করি বেকের মনের মইদ্যে আরও বিষ ভরি দিছে হ্যাতাগ সুবিধার লাই, আম্নে কী মনে করেন, আর কোনদিন জোড়া লাইগ্ব। হুনেনের না কীরম রক্ত লই দোল খেলের? মানুষ আর মানুষ আছেনি অন্, হশু অই গেছে দিন দিন। হুরান দিন আর ফেরত আইত ন, হেই আশা আম্নে ছাড়ান দেন। চলেন ঘর ছাড়ি বার অই হড়ি, কোয়ালে যদি লেয়া থায় একদিন হেরত আইয়ু্ম্, আর না হয় ভাইগ্যে যা আছে অইব। করিমরে কইছি মারে কাঁধে করি যদি আঁঙ্গ লগে লগে যাইত হারে। অন্ কই বলি ঘোষ বাড়িত্ রাই দিমু, জানাহুনা বাড়ি, আঁঙ্গ বাড়ি তুন্ মাইল পনের ভিত্রে, ডরভয় এট্টু কম। যদি সময় বুজি আর কোন ব্যবস্থা কইর্তাম্ হারি আর যদি মা’র আয়ু থায়, তয় মা’র লগে দ্যায়া অইব, ভগবান ভরসা।
আঁর হৌড়িরে কাঁধে লই করিম হাঁডে, আমরাও হাঁডি। হাঁডার আর বিরাম নাই। যাইতে যাইতে মাইজ্হানে দুই এক্কান মোছলমান গ্ৰাম হড়ে। হ্যাতেরা আঁঙ্গ দিগে চায়। জিগ্গায়, কোন গ্ৰাম তুন্ আইছি। রাস্তার হাশে আম গাছ, অশ্বত্থ গাছ, বাদি গাছ হড়ে, দুই অগ্গা দিঘিও হড়ে। গাছের ছায়ার নিচে এক্কানা আরাম করনের লাই জিরাই লই। জলের তৃষ্ণা লাইগ্লে হাড় ভাঙি নীচে নামি ঘডি ভরি জল লই নিজেরাও খাই, হৌড়িরে করিম কাঁধের তুন্ নামাই দিলে খাওয়াই। হ্যাতেনের কষ্ট সইহ্য অয় না, চুপ করি থায়। বুইজ্ত হাইর্ছে কিচ্ছু করার নাই। হায় হায় রে এইত এক্কান জীবন, নিজের বাড়িঘর ছাড়ি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি মরি। দুহের কতা কারে কইয়ুম্, গা দি দরদর করি ঘাম ঝরে। হৌড়িরে ঘাম মোছাই দিলে করিম কাঁধে উডাই লয়। করিমের কষ্টও কী কম, হ্যাতের মইদ্যে হিন্দু মোছলমান আই অন্ও কচ্লাকচ্লি করে ন। হিগাইন ভাইব্বার মত হ্যাতের মনের মইদ্যে কোনও হুযুগও অয় ন। কত ত খোঁচাখুঁচি অইছে, হ্যাতে আঁসি উড়াই দিছে। মনের সম্পর্ক অস্বীকার কইর্ব এরুম সাহস হ্যাতের নাই। আঁর স্বামীর মনেও কত ত খচ্খচানি। এসব রাস্তা মাড়াইব কোনদিন ভাবেও ন, আইজ্ য্যান্ বিপাকে হড়ি এই ঠাঁডা মাইরা রইদে, রাইতের ঘুড্ঘুইড্যা আঁন্দারে হা চালাইতে অর। মনডা উথ্লাই উডি জাইনবার ইচ্ছা অয় কোনওদিন ত সজ্ঞানে কারও কোনও ক্ষতি করে ন, এরুম হল্ ভোগ করের কিয়ের লাই তয়? অনেক হশ্নের উত্তর মাইন্ষ্যে খুঁজি বেড়ায়, মিলে না ত, মিলব ক্যাম্নে! মাইন্ষ্যের হাপে যিয়ানে মাইন্ষ্যে দগ্ধ অয়, হেইডার কারণ খুঁইজ্ত চাওন বোকামি ছাড়া আর কি। বরঞ্চ চুপ করি অপেক্ষা কইর্লে এক্কান রাস্তা বার অইত হারে। হাপখোপ কত আছে। মাইন্ষ্যের কামড়ের তুন্ বাঁইচ্তে হলাই যাইয়ের, হাপের কামড়ের তুন্ নিস্তার হাইলে তয় নয় আবার বাঁইচ্বার কতা ভাবুম। মাইন্ষ্যের মনে যে বিষের থলি আছে হেইডা ত কম বিষাক্ত ন, জ্বালাই হোড়াই শ্যাষ করি দেয়। করিম আঁঙ্গরে তাগাদা দেয় – বাবু, হা চালা, হত্তুর ত অভাব নাই, কোনহানে ঘাপটি মারি বই রইছে। হ্যাতের কষ্ট দেই কইলাম্, করিম, এট্টু জল মুড়ি খাও, গায়ে বল হাইবা। অত ভাবি কাজ নাই, আঁঙ্গরে মারি হ্যাতাগ যদি মনের শান্তি হয়, অইব। হাঞ্জাবীগ গুল্লি খাই না মইরলেই অইল, দ্যাশের মাইন্ষ্যের আতে মইরলে ভাবুম্ হেগুনের মাথায় খুন চাইপছে, হত্ মিত্র চিন্ত হারে ন। কইতে না কইতেই এক দল মানুষ আই আঁঙ্গ উপ্রে ঝাঁপাই হইড়ল, করিমের দিগে আঙুল তুলি কয়, বেডা, মোছলমান অই তুই মালাওনরে কাঁধে তুইলছচ্, তুই নিজের আতে এই বুড়িরে খতম করবি। করিম কয়, আম্নেগরে কে কইছে আঁই মোছলমান, হিঁদুর হোলা আঁই, নরহরি দাস, বলরামহুর গ্ৰাম। রেজাউল করিম সাবের দ্যাশের মানুষ। যাছ্ কন্নাই? আত্মীয়র বাড়ি। কী মনে অইল ছাড়ি দিল, এই যাত্রায় রক্ষা হাইলাম। সামনে কী বিপদ অপেক্ষা করি আছে কী জানি।
হাঁ চালাই চইল্লাম। করিম কয়, বাবু, এক্কারে ভয় হাইয়েন না। আঁই আছি ত। আঁর যতক্ষণ জান আছে, কেউ আম্নেগরে কিছু কইর্ত হাইর্ত ন। হায়ে হায়ে চইল্তে চইল্তে মেঘনার বড় খাল আই হইড়ল আঁঙ্গ সামনে। এই খাল পার অই ঐ হাড়ে যামু ক্যাম্নে। ঘাডে একহান নৌকা আছে কিন্তু মাঝি নাই, ঝাঁপ বন্দ। খুঁডিত্ নৌকা বাঁধি ঘরে চলি গেছে। আঁর স্বামী মাথাত্ আত দি বই হইড়ল। করিমরে কইলাম, খালের হাড়ে কী রাইত কাডাইতে অইব করিম ? হ্যাতে মাথা খাউজ্জায়। অনেক দূরে গ্ৰামে মিট্ মিট্ করি আলো জ্বলে। নিজের গ্ৰামের কতা মনে হড়ি গেল। আঁর স্বামী কয়, দ্যায় চাইন, হ্যাতারা নিজেগ ঘরে কেরুম ঘুমায়, আর আমরা রাস্তায় রাস্তায় এই আঁন্দার রাইতে নিজেগ ঠিকানা খুঁজি মরি। হুরা রাস্তায় আঁর হৌড়ি এক্কান কতাও কয় ন। মিন্মিন্ করি কিছু কইত চায়, ক্যাম্নে কতা কইব, শরীলহান হুকনা অই গেছে, চয়ের কোনায় কালি হইড়ছে, চুলে চুলে জট লাগি গেছে। মাথায় আত বুলাই দিলে আর নিজেরে ধরি রাইখ্ত না হারি কয়, আঁই আর বাঁইচতাম্ ন রে বৌ। নিজেরে নিজে বুজাইলাম্ নরম অইলে চইল্ত ন, শক্ত অইত অইব। সান্ত্বনা দি কইলাম্, আম্নের হোলা আছে, বউ আছে, মরার কতা ভাবেন কিয়ের লাই! এতক্ষণ চয়ে হড়ে ন আঁন্দারের লাই, বালুর উপ্রে এক্কান মাছ ধরার নৌকা কারা য্যান্ উবুড় করি রাইখছে। করিম কইল, আজ রাইতটা হিয়ানেই কাডাই দিমু। হ্যাতের কতাডা মন্দ লাইগ্ল না। হোট্লা তুন্ কাঁথা বার করি হৌড়িরে গাত দি হোতাই দিলাম। খালের ধারের ফিন্ফিন্ বাতাসে হ্যাতেনে ঘুমাই হইড়ল। আমরা দূরে চুপ করি বই রইলাম। করিম রাত জাগি হরা দেয়। বিপদডা আইল মাইঝ রাইতে। রাজাকাররা ক্যাম্নে টের হাইল বুইজ্তাম হাইর্লাম্ না। হেগুনে হা টিপি টিপি আই রাইক্ষসের মত দাঁত বার করি শাঁসাইলো। এত রাইতে ধানসিঁড়ি গ্ৰামে কিয়ের লাই? তোগ মতলবহান কী। করিম কইল, ভাই, বিপদে হড়ি আইছি, নদীর ঐপারে যামু আত্মীয়র বাড়ি। নৌকাহান উল্টাইছচ্ কার অনুমতি লই। ইয়ানে কে হুতি রইছে, তোর বাপ। বাপ নয় গ, ঠাম্মা। তয় ত বাঁচি রাওন যাইত না। হিন্দুর বুড়ি, দে খতম্ করি, অনেক জ্বালান জ্বালাইছে মোছলমানরে। করিম হা জড়াই কইল, ভাই, গোঁস্যা করিয়েন না, এবারকার মত মাপ করি দ্যান। শ্যাষে আঁর স্বামী আই আত জোড় করি মাপ চাইল, হ্যাতাগ গোঁস্যা চাইরগুন বাড়ি গেল। আঁর বুক ত ধুক্ ধুক্ করে। দিল বড় দাহান দি এক কোপ বইয়ায় আঁর হৌড়ির গলায়। ঘুমাই আছে আর হৌড়ি য্যামনে আছিল, খালি ওয়াক করি শব্দ অইলে আঁর স্বামী অজ্ঞান অই হড়ি গেল খালের হাড়ে। বুইজ্লাম আত্মা খাঁচা ছাড়ি চলি গেছে। রাজাকাররা গামছায় আত মুইছ্তে মুইছ্তে আঁন্দারের মইদ্যে মিশি গেল। দম বন্দ অই যার আঁর। আঁন্দার হ্যাতাগরে ছাড়ি আঁরে ঘিরি ধরি দলা হাঁকাই গেল। যাইবার সময় কই গেল, তোগরে ছাড়ি দিলাম। রাইত তহ্ন অনেক, কন্নাই আর হোড়াইয়ুম মরা মানুষডারে। করিম কইল, মাডির নীচে চাপা দি দেন জেডি। আঁর স্বামীর মুয়ের দিগে চাইতাম্ হারিয়েন না। হ্যাতেনরে ত আর ধরি রাওন যার না। আঁই চিল্লাই চিল্লাই কাঁইন্লাম্। কে হুনে আঁর কাঁদা। সূর্যের আলো গাছের হাঁক দি আই ঘাসের উপ্রে হইড়লে আঁন্দার মুছি গেল, আঁর হৌড়ির মুখহান হেই আলোতে আর দেয়া গেল না। মাঝি ঘাডে আইলে করিমরে কইলাম্, তুঁই হিরি যাও। আঁই আর তোঁর জেডা খাল হার অই চলি যাইয়ুম্। বাড়িঘরের দিগে খেয়াল রাইও। করিমের মন ত কিছুতেই মাইন্ত চায় না। কয়, আম্নেরা যাইতে হাইরবেন ত? হারুম্ হারুম্। তুঁই যাও, হিচুটান থাইক্তে নাই। ঘরে তোঁর বালবাইচ্চা আছে, বউ আছে, চিন্তা করের। গরুগোতান গুনরে খাওয়াইও। অবলা জীব খালি হ্যাডে থাইক্লে অমঙ্গল অইব।
খালের জল নদীত্ গা ভাসাইতে ভাসাইতে কহ্ন যাই সাগরে মিশ্ব আঁই জানি না। মাঝি ত হার করি দিল। আঁর হৌড়ি হুতি রইল মাডির নীচে। এত সাধের ঘরে হ্যাতেনের আর হিরা অইল না। চিনা কোন মাইন্ষ্যেরে আর দেই না। মন্ডারে সাত্বনা দি একদিন না একদিন হুদিন আইব। কত মানুষই ত হাঁডি চলি যার নিজের মনে, আঁর কিয়ের লাই একলা লাগের। কত কতা আই মনের মইদ্যে ঘাঁই মারের। আঁর স্বামী চলের আবার চলেরও না। কইলাম্, দুখ্ করি মন ভার করিয়েন না। চুপ করি থাইক্ল কিছুক্ষণ। ভয় অইল কতা কয় না কিয়ের লাই। শ্যাষে ভালামন্দ কিছু অইলে হাম্লাইয়ুম্ ক্যাম্নে। এই অচিনা জাগাত্ আই একলা মাইয়া মানুষ কী করুম। অনেক ক্ষণ হরে কতা কইল, ডরাইও না, শোকে আঁই হাথর অইছি ঠিক কতা, অন্ও জ্ঞান আরাই ন। এক চিন্তা দূর অইল, আর এক চিন্তা আই চাপি বইল। চাইর মাথার মোড়ে আই এরুম অবস্থার মইদ্যে হড়ি গেলাম যা আঁই চিন্তাও কইর্তাম্ হারি ন। এক মুইর তুন্ এক দল মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়ি আঁর মত রাস্তা খুঁজি বেড়ার, আর এক রাস্তা ধরি আইয়ের আডার ঊন্নিশ বছরের জোয়ান হোলারা, কাঁধে বন্দুক, চয়েমুয়ে কোনও ডরভয় নাই। আশ্চর্য এক ভাব তৈয়ার অইছে হুরা শইরল্যে। কারা এগুন, কন্নাই যার, খান সেনা ত নয়! কার ঘরের হোলারা ঘর তুন্ বার অইছে যুদ্ধে যাইবার লাই এরুম বেশভূষা লইছে। হেগুনের মইদ্যে একজন আই কইল, খুন করি হালাইছে রাজাকাররা ত, হেই খবর আঁঙ্গ কাছে আছে, হেগুনেরে আমরা খতম করি দিমু। হাঞ্জাবীগ লগে আত মিলাই দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে মারের, দ্যাশের লগে বেইমানি করের, এই বেইমানি আমরা সইহ্য কইর্তাম্ ন। আম্নেরা আগাই যান, আর কিছু কইর্ত হাইর্ত ন, আমরা হরায় আছি। হেগুনে সেনাগ মত লেফ্ট রাইট্ লেফ্ট কইর্তে কইর্তে চলি গেল। অনেক দূর তুন্ হুনা যার্ হেগুনের মুয়ের কতা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা। দ্যাশডা কেরুম দেইখ্তে দেইখ্তে হাল্টি গেল। স্বপ্নের মত মনে অইতে লাইগ্ল, এরুমও হয়! কী অইতে আছে, কিয়ের লাই অইতে আছে, ইগাইনের শ্যাষ কন্নাই, আমরা কী এরুম করি ভাঁই ভাঁই বেড়াইয়ুম্? এরুম অরাজকতা জম্মে দেই ন। দুই একজন মানুষ খেরের চালের বাড়ি তুন্ বার অই আই আত ধরি টানি লই যাই কয়, ‘বইয়েন, এট্টু জিরাই লন, কতদূর তুন্ আইছেন’। জলের গেলাসটা দি কয়, ‘হানি খান।’ আমরা ঢক্ ঢক্ করি দুজনেই জল খাইলাম্। অইন্য সময় অইলে মোছলমান বাড়িত্ জল খাইলে জাত যাইবার ভয় হাইতাম্। অন্ বেক্ আচার বিচার য্যান্ চুলায় উইঠ্ছে। এই মানুষগুনরে মনে অইল আপনের আপন। দুইন্নাইত্ ভেদাভেদ করিই যে আমরা মইর্ছি এই কতাহান আঁরে কুঁরি কুঁরি খার। এদ্দিন কী ভুলডাই না কইর্ছি, শইল্যের ভার বইছি, মনের ভার দূর করি ন। হ্যাতারা কইল, বইয়েন না, ভালা করি বইয়েন, এত হর হর ভাবেন কিয়ের লাই, আমরা বেক্গুন ত এক দ্যাশের মানুষ। হ্যাতাগ কতা হুনি ভাইব্লাম আমরা এক্কারে আস্তা মুরুখ্য। যাইবার সময় কইলাম্, ভালা থাইয়েন্। কয়, সাবধানে যাইয়েন্। কোনও অসুবিধা অইত ন। সামনের মোড়ে মুক্তি বাহিনী আছে, আম্নেগ রাস্তা দ্যায়াই দিব। বেডা কয়, দ্যাশরে স্বাধীন কইর্বার লাই হরান দিওম্। ঘরের বার অই না আইলে বুইজ্তাম হাইর্তাম্ না দ্যাশের চেহারাহান আসলে কেরুম। এই মুক্তিযুদ্দ আই আঁঙ্গরে মাইন্ষ্যের মত মানুষ করি দিছে।
কত আর আঁডুম, আঁইড্তে আঁইড্তে হাহান ব্যাথা অই গেল। আঁর স্বামীরে কইলাম, আর বেশি দূর আঁডন লাইগ্ত ন, আর এট্টু কষ্ট করেন। আঁর বাপের বাড়ির দ্যাশের গন্দ হাইয়ের। হ্যাতেন রাগিমাগি করি কয়, তোঁর মাথা খারাপ অইছে? আরও এক দিন এক রাইতের হঁত পার অইলে তয় যদি হৌঁচাইতাম্ হারি। কতাডা হুনি আঁর মাথায় য্যান্ বাজ ভাঙি হইড়ল। না জানি আরও কত বিপদ অপেক্ষা করি রইছে। আদবেলা ঠাঁডা রইদে আঁইড্বার হর এক্কান মাড হইড়ল, মাডের কিনারে গাছের তলে বই রইছে এক মাইয়া ভাইয়ের আত ধরি, টুক্টুইক্কা চেহারা হেতির, আঁর মাইয়াডার কতা মনে হাড়ি গেল, কেরুম যে আছে, হোলাডাইবা কেরুম আছে। মাস ছয় আগে বড় হোলার চিঁডি আইছিল। হ্যাতে এক্কান কামে যোগ দিছে। এই গণ্ডগোলের মইদ্যে হ্যাতের আর কোন খোঁজ খবর হাই ন। মাইয়াডা আঁর দিগে রেনি আঁইসল, আঁই জোর করি অইলেও আঁইসলাম। হেতির বাবা বর্গাদারের কাম করে, ক্ষেতে ধানের চারা লাগাইত গেছে, গত সন হেতির চাচা বড় ঝরে ঠাঁডা হড়ি মরি গেছে। আগে কাহড়ে হ্যাঁচাই দুইজনের লাই ভাত লই আইত, অন্ আব্বার লাই আনে। হারাদিনে ওই একবার হান্তা ভাত নুন, হোড়া মরিচ আর কাঁচা হিঁয়াজ দি মাই খায়। করিমের লাই মনডা কাঁদি উইঠ্ল। মাইয়াডার বাপ আজিজুল মিঞা হারা শইর্ল্যে ঘাম লই আই গাছের তলে বইছে। বয়স অইছে, তবুও খাডি খার, চুরি ত করেন না। জিগ্গায়, কন্নাই যান আম্নেরা এই ভর দুহরে। হ্যাতে কিয়ের লাই এত খবর লর? কাউরে গোপনে হাচার কইরবার চোরা বুদ্দি ন ত। হ্যাতে আঁর মনের কতা বুইজ্ত হারি কয়, বিশ্বাস কইর্ত হারেন ন বুজি। হুনেন ভালা করি, আর আগাইয়েন না এট্টুও। জোর লড়াই চইল্ছে ছদ্রি বাড়ির নাট মন্দিরের কাছে মুক্তি বাহিনীর লগে খান সেনাগ। মুক্তিযোদ্দারা কম যায় না। ভারতের সেনার কাছের তুন্ টেনিং, অশ্র গুল্লি বন্দুক লই আইছে। খালের জল রক্তে লাল অই গেছে। কার হোলা শহীদ অইছে কে কইব। আঁর হোলা আই কর, জাগায় জাগায় গুল্লিগালা চলের। যুবতী মাইয়াগ ইজ্জ্বত লই টানাটানি করের, আঁঙ্গ দ্যাশের মাইন্ষ্যে ক্যাম্নে চুপ করি থাইক্ব কন্ ত। আঁই ত এসব কতা হুনি আর আগাইবার সাহস কর্ইলাম না। আজিজুল মিঞা কয়, হুনেন বাবু আম্নেগ মাইঝ রাইতে হাট ক্ষেতের ভিত্রে দি হানি টপ্কাই নসিহুরের জঙ্গল হার করি দিমু, ইয়ার হরে হঁত হরিষ্কার। হ্যাতের কতা ত হালাই দেওনের মত না। হাট ক্ষেতের পর হাট ক্ষেত। আঁডু হমান জল ভাঙি চইল্ছি ত চইল্ছিই, রাস্তা কী আর হুরায়। একে ত আঁই মাইয়া মানুষ আর আঁর স্বামীরও বয়স অইছে, কোয়রের জোর গেছি কমি। আঁই নিজেও চইল্তাম্ হারিয়েন্ না, হ্যাতেনেরে ক্যাম্নে টানি আনি। আজিজুল মিঞারে কইলাম্, ভাইসাব, এট্টু না জিরাইলে অইত না। বদি, আজানের সময় অই গেলে বড় বিপদ। ইয়ানে বাঁইচ্তেন ন। হানির মইদ্যে খাড়াই থাইক্বেন ক্যাম্নে! হানির হোকগুন মাইন্ষ্যের গন্দ হাইলে মুশকিল অই যাইব। অবস্থা বেগতিক দেই জল কাডিই চইল্লাম। মনেরে বুইঝালাইম্ যেই করি হোক যাইত অইব, বাপের বাড়ি না হৌঁচাইতে হাইর্লে নিস্তার নাই। হ্যাতেনেরে কইলাম্, আঁর কাঁধে ভর দি চলেন। ওরে বাপরে সামনে ত ভারি সংকট। আজিজুল মিঞা আঁঙ্গ দুইজনেরেই হামলায়। লম্বা অই হাঁচ ছয় আত কী য্যান্ হাট গাছে হেঁচাই হুতি রইছে। মনে মনে কইলাম্ আস্তিক মুনি, আস্তিক মুনি। ডাঙায় মানুষ ছোলায় আর জলে মা মনসার ছোবলের ভয়, কোন মুই যাই?
ভোর রাইতে হাট গাছ হরাই যেই না মুখ বাড়াইছি দেই আঁন্দার রাইতের ছম্ ছম্ আবাজ আকাশ আর মাডিরে জড়াই কেরুম বোবা অই আছে। আল্গা আল্গা অই ঘিরি ধরি রইছে ঝোঁপঝাড় জঙ্গল আর গাছগাছালির ভুতুরে ছায়ারা। কাউরে কিছু কইবার নাই, হ্যাতেনে আঁর মুই চায়, আঁই হ্যাতেনের মুই চাই। আজিজুল মিঞা কয়, আম্নেগরে আগেই কইছিলাম্ ইয়ানের ভাবসাবহান কিন্তু অইন্যরম। তবুও জলের মইদ্যে আর কতক্ষণ খাড়াই থাইয়ুম। এক ঝাঁক হোনা কৈমাছ আর টেমবৈচা হা’র কাছে আই কামড়ায়। মাইয়া মানুষ, লাজশরম আছে ত, কাপড় তুইল্তাম্ ত হারি না, হ্যাতেনের লাই চিন্তা বাড়ি যার। আজিজুল মিঞা কয়, আঁন্দার থাইক্তেই মাইল খানেক হঁত হার অই যাইত অইব। হাট ক্ষেত তুন্ বার অই আই অইড়লাম ধান ক্ষেতের আইলে। আজিজুল মিঞা আর আঁঙ্গ লগে আইবার সাহস কইর্ল না। কারণডা বুইজ্লাম্ একটু হরে। তবুও কইলাম্, আম্নে এত কষ্ট কইর্ছেন, আম্নের লগে চিনা নাই, জানা নাই, তবুও আম্নে নিজের মনে করি এত উপকার কইর্ছেন। হ্যাতেনে কয়, আঁই কিচ্ছু উপকার করি ন। আঁঙ্গ জাত ভাইরা আম্নেগ যা ক্ষতি কইর্ছে, হের কিছুডা শোধ দিলাম। হ্যাতেনের কতা হুনি ত আঁই আকাশ তুন্ অইড়্লাইম, এ কী কতা কয়! এই মানুষডার ছিঁডাহোঁডাও যদি ওই শতানগুনের মইদ্যে থাইক্ত, আর হৌড়ির জীবনডা এভাবে চলি যাইত না। ভাইসাব, আম্নেরে সালাম। হ্যাতেনে কোয়ালে আত ঠেঁয়াই সেলাম কই চলি গেল। আজিজুল মিঞা আঁর আর স্বামীর মনের মইদ্যে হেই যে ঢুকি গেল, আর বার অইল না। কিন্তু আঁঙ্গরে ত বার অইতে অইল। দনিয়া গ্ৰামের হঁতে উইঠ্লাম। উডি কী দেইখ্লাম। যত গ্ৰামের হঁত দি হাঁডি, খাঁ খাঁ করের ঘরের হর ঘর। মানুষ ত নাই, বেক্গুনে গ্ৰাম ছাড়া অইছে। হা’র মইদ্যে কী য্যান্ ঠেইক্ল, মাইন্ষ্যের মাথা। আমরা আর এট্টু আগাই গেলাম, মিলল কাডা আতের হাশে জ্যান্ত অগ্গা মানুষ হড়ি ছট্ফটায়, হরানডা বার অইবার লাই ধু্ক্ধুক্ কইর্ছে। এক বড় হুইর, হুইরের হাশে গর্ত খোঁড়া, মাডি এরুম করি হড়ি রইছে, য্যান্ মাডির উপ্রে রাগ করি মাডি মেলাই মেলাই রাইখ্ছে। আঁঙ্গ গা ইগাইন দেই থরথর করি কাঁপে। কাওরে জ্যান্ত কবর দেওনের কতা আছিল, হারে ন। কন্ মুই যাইয়ুম্, যাইবার রাস্তা ত নাই, ছুডি হলাইতে হাইর্লে বাঁচি। আঁর স্বামীরে কইলাম্ কী করুম কন্? হ্যাতেনে কইল, হিছনে যাওনের উপায় নাই, আগাই চল। এক্কানা আগাইলে দেইখ্লাম এক মন্দিরের চাতালে কারা য্যান্ বন্দুক কাঁধে লই বই রইছে, আর এক দল হায়চারি করের, খিলান অলা দালানবাড়ি, হইসাকড়ি আছে, ব্যবসাবাণিজ্য কইর্ত, না অয় অঢেল জমিজমার মালিক আছিল। যেই মানুষগুনেরে দেইয়ের, হেগুনে কী রাজাকার! আঁর স্বামী বাঁচার আশা ছাড়ি দিছে। কয়, ইষ্টনাম জপ কমলের মা। আঁঙ্গরে দেই হেগুনে বন্দুক তাক্ করে। ইয়ার পরে আঁঙ্গ অবস্থা দেই বন্দুক নামাই হালায়। কয়, হরু রাইতে এই গ্ৰামে রাজাকারেরা হামলা কইর্ছে, কচুকাডা কইর্ছে, য্যাতারা হাইর্ছে হরান লই হলাইছে, আমরা মুক্তি বাহিনী, রাজাকারেগ খোঁজে আইছি। হালার বেডারা বাঙালি জাতের কলঙ্ক, খান সেনাগ লগে যাই ভিড়্ছে, হশ্চিমাগ চর। আঁঙ্গ কতার মাইজ্হান দি হুইন্লাম এক বাইচ্চা হোলার কাদন্। আঁঙ্গ কতা হুনি ভরসা অইছে। মুক্তিযোদ্ধারা দৌড়ি যাই দরজা ঠেলি বার করি আইন্ছে। কাঁইন্দ না, মাইর্তাইম্ ন আমরা, হোলাডারে হানি দে। বাপ মা হোলাডারে লই যাইত হারে ন। হোলাডা চখ কচ্লায় আর কয়, আঁর বাপ মা ভিত্রে হুতি রইছে, দুই দিন ধরি কত ডাইক্ছি, কতা কয় না। বুইজ্লাইম, গুল্লি করি মারি হালাইছে।
বাপের বাড়ি আই উইঠ্লাম্, লগে হোলাডারে লই আইলাম্। বাড়িহানের হিছনে এক বিল। বিলের মাইজ্হানে হিলার গাঁথি দুই দ্যাশের সীমানা বানাইছে। ভারতের মাইন্ষ্যের খাওন দাওন, উডন বইয়ন, বাজার আঁড, ইস্কুল বেক্গাইন এহাড় তুন্ দেয়া যায়। মজার কতা অইল, আঁঙ্গরে হ্যাতারা বাঙাল কয়, বাঙালরা হেই দ্যাশে যাই বাঙালি অইছে, আর হশ্চিমা কুত্তাগুনরে দৌড়াই বাঙালি অইবার লাই আঁঙ্গ হোলারা হরান দের, আঁঙ্গ মাইয়ারা ইজ্জ্বত খোয়ার। হিয়ানে টিব্রারাও থায়। আঁর বাপেগ ব্যবসাহাতি আছে, করিকম্মি খায়, হিয়ানে যাই কী কইরব, চাইলে ত যহ্ন তহ্ন যাইত হারে। বাপ ত চুয়ান্ন সালেই গত অইছে। আঁর কোয়াল ভালা বুড়ি থুরথরি অইও মা আঁর বাঁচি আছে, ঈশ্বর আঁরে চয়ের দ্যায়া দ্যায়াইছে। সংসারের জ্বালায় আইতাম্ হারি ন, এত বড় সংসারের বড় বউ ক্যাম্নে আই, ঘরে বয়ষ্কা হৌড়ি আছিল। হেই হৌড়িরে ত জালিমগ আতে খোয়াই আইছি। মা এই ঘটনা হুনি ত মুচ্ছা যায়। বিয়ার হরে এত বছর অইল এবার লই তিনবার আইছি, শ্যাষ আইছি মহামারীর বছর, মার হেইবার যায় যায় অবস্থা। হ্যাঁ, ইয়ান আঁঙ্গ দ্যাশ, দেই না কে আঁঙ্গরে দৌড়ায়। ইয়ান এরুম এক্কান জাগা হিন্দু মোছলমান বেক্ বেকেরে চিনে। চিন্ত ন বা কিয়ের লাই! আঁর জন্ম যহ্ন অইছে, বড় যহ্ন অইছি, হেই গ্ৰামের হোলারা আঁঙ্গ মাডে ফুটবল খেইল্ত, কুস্তি লইড়ত, বিয়াসাদি অইত। আমরা ভারতের মানুষ হেই হরিচয়ের তুন্ এই গ্ৰামের মানুষ হেইভাবেই চিনত, দ্যাশ এক্কান আছে ত আছে, ত কী অইছে। ভাগ বাডোয়ারা অইবার হরই ত দ্যাশের হরিচয়ের দরকার অইল, খুনাখুনি অইল। হশ্চিমারা হেই কতা ভালা করি বুজাই দিল। যেই হঁতে আঁর হোলামাইয়া ভারতে গেছে, হেই হঁতহান সেনাগ দখলে, অন্ হেই দ্যাশে। আঁঙ্গ কাছে অন্ও বেক্ হমান। বাপের বাড়ির দ্যাশে আই হিয়ের লাই স্বস্তি হাইলাম্। ভাগাভাগির যন্তনার তুন্ রেহাই ত হাইলাম। আওনের হর তুন্ ভাইয়ের বৌরা আঁরে কোন কামকাইজ কইর্ত দেয় না। কী যে করি, আতের কাম ত কাড়ি লইতাম হারি না। তয় এইবার উডিহড়ি লাইগ্লাম্ বেকে মিলি হৌড়ির শ্রাদ্দশান্তি কইর্তে। কত কামকাইজ দিনরাইত। কত মাইন্ষ্যের নিমন্তন্ন, মসজিদ হাড়ার বুড়াবুড়িরা নিমন্তন্নে আইছে। আঁর মাইয়াকালের বন্দু গৌরীও আইছে। হেতি বালবিধবা, বাপের বাড়িতেই থায় ভাইগ সংসারে, আঁরে দেই ত গলা জড়াই ধরে, আর ছাইড়্তেই চায় না। কত কতা দুখ্ করি কইল। হরের সংসারে থাওনের কষ্ট ত আছে, বেকে ত হমান ন। আঁর ভাইয়ের বউ ট্রাঙ্ক তুন্ বার করি দুইহান নোয়া কাহড় দিছে, ছায়া ব্লাউজ দিছে। কইল, যদ্দিন দ্যাশের অবস্থাহান ভালা না হয়, ইয়ানে থাইক্বা, কহ্নও হর মনে করিও না।
কত ঘটনাই ত ঘডি যার দ্যাশে, আঁঙ্গ বাপের বাড়ির গ্ৰামে এসবের বিন্দু বিসর্গও বুজা যার না । যাইবই বা ক্যাম্নে, কোন আঁচই ত লাগে ন। এদ্দিন বাদে খবর আইছে এই গ্ৰামের দুগা হোলা মিজানুর রহমান আর পরিমল দাস হুরান ঢাকার চকবাজারের কাছে সেনাগ লগে লইড়্ত যাই গুল্লি খাইছে। হেই লই গ্ৰামে শোকে ভাঙি হইরছে বেকে। সঙ্গী সাথীরা অনেক চেষ্টা চরিত্র করিও লাশ উদ্দার কইর্ত হারে ন। হুনা যার বুড়িগঙ্গার জলে মেলা মারি হালাই দিছে আরও অনেকগুনের লগে হেগুনের হঁচাগলা শরীল । হ্যাতাগ বাড়ির কেউ জানেনা ক্যাম্নে ক্যাম্নে হেগুনে মুক্তি বাহিনীত্ নাম লেয়াইছে। হাড়ার ইস্কুলেই নাইনে এক লগে হইড়ত। রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা হুনি হেগুন দুগা মিলি গাছতলা বই বই গুজুর গুজুর কইর্ত, ইয়ার হরে ত উদাও অই গেছে, অনেক খোঁজখবর করিও লাভ অয় ন। অন্ হুনা যার দুগাই ভারতে যাই অশ্র চালাইবার ট্রেনিং নিছিল গোপনে। গ্ৰামের মাইন্ষ্যে কাঁদিকাডি করি বুক চাপড়ার। কে কারে দিব শান্তনা। দুই দিন ধরি গ্ৰামের কোন ঘরে চুলা জ্বলে ন, এক গ্লাস জলও কেউ মুয়ে দেয় ন, ঘুমান ত দূরের কতা। অবস্থাহান এরুম অইছে মানুষরা বাজারআঁডও হেরুম করে না। মালহত্র যে কিনি আইনব হেরুম সুবিধাও নাই। কাঁচামালেরও আকাল। আঁর ভাইগ মহাজনরা বাঁইতে মাল দেয় না, কামকারবারও লাডে উইঠ্ছে। গাট্টি গাট্টি কাহড় আইত নৌকাত্ করি, অন্ আর আইয়ে না। আঁর বাপেগ হইসাকড়ি আছে, ইয়ের লাই চাইর গ্ৰামে ধনী বলি নাম ডাক আছে, বিপদে আপদে গরীব মাইন্ষ্যেগরে সাইয্যসান্তিও করে। অন্ এরুম এক্কান সময়, নিজেগ অবস্থাও দিনকে দিন খারাপের দিগে চলি যার, অইন্যগুনের মুয়ের দিগে আর কত চাইব। য্যাতাগরে কোনদিন আত হাইত্লে হিরায় ন, হ্যাতারাও নিরাশ অই হিরি যার। বাপের বাড়ি যে হড়ি আছি, নিজেরে অন্ অপরাধী লাগে। রোজ হাতে আগে রুই, কাতলা, তৈল কই, না হয় ইলিশ হইড়ত, অন্ হপ্তাহে দুই দিন হড়ে। আঁর ছোড ভাইয়ের বউ অমৃতা কয়, দিদি, আম্নে কিচ্ছু ভাবিয়েন না, ব্যবসায় মন্দা আইয়ে, আবার চলিও যায়, বিয়া অই যেদিন তুন্ আইছি, এরমই দেইয়ের, ঠিক অই যাইব। অমৃতা বুজের না, এই অবস্থার লগে অইন্য সময়ের তুলনা চলে না। হুরা দ্যাশে এখন হাহাকার চলের। এভাবে বেশিদিন চইল্লে মাইন্ষ্যের চামড়া মাইন্ষ্যে খাইব। আঁর ভাইয়ের বন্দু রতন হন্তদন্ত অই খবর দিছে, হুইনছেন নি আম্নেরা, যতন খুড়া হ্যাতেনের গোয়ালের গাঁই গরু আঁডে বেচি হালাইছে দেনা শোধ কইর্বার লাই। মহাজন তুন্ ট্যাঁয়া ধার লই বর্গায় চাষ কইর্ছে, হসলের দাম হায় ন। য্যাতারাই বর্গায় চাষ কইর্ছে, বেক্গুনের একই অবস্থা। মদন জেডার মেঝ হোলা শহর তুন্ হেরত চলি আইছে। হ্যাতের মালিকের চডের ব্যাগের কারবার, হ্যাতে ইসাবহত্র দেইখ্ত। খান সেনারা ধরি ধরি বেক্গুনেরে মারি হালার, হিয়ের লাই হলাই চলি আইছে, অন্ ত না খাই মরি যাইব। আমরা সংসারে আইছি বলি বাড়তি বোজা। খাইতে বই ভাইয়েরা মাথা নিচু করি থায়, শুধু ডাইল, আলুভাজা আর কাঁচা মরিচ মাই ভাত খাওন যায়! ভাত হাতেই খবর আইল মুকবুল চাঁচা দুই দিন হোলামাইয়ার মুয়ে খাওন না দিত হারনের জ্বালায় গলায় দড়ি দিছে। আঁর ভাই ত ভাতের থালা হালাই উডি মসজিদের হাশে হ্যাতাগ ঘরে দৌড়ি গেল। আঁর মা ডাকি কয়, আরে হুন, খালি আতে যাইছ্ না, লগে কিছু চাইল ডাইল আর হইসাকড়ি লই যা, হেগুনের কামে লাইগ্ব। দুইন্নাইদারি দেইখ্তে দেইখ্তে কেরুম য্যান্ অই যার। রক্তের হলি খেলা চলের। বঙ্গবন্ধু কইছে রক্ত দিতে, হিয়াল কুত্তার মত হঁতেঘাডে গুল্লি খাই মানুষ হড়ি কাত্রাইতে কাত্রাইতে লাশের উপ্রে লাশ অই যার। বাঙালির এ কী দশা! হায়নারা এই হাপের হল্ একদিন হাইবই হাইব। হেই দিন বেশি দূরে ন।
মুক্তিফৌজের গেরিলারা স্টেনগান, পিস্তল, হ্যান্ড গ্ৰেনেড লই এই গ্ৰামে অ্যাকশন্ চালাইবার লাই এক বেড়ার ভাঙাচোরা ঘরে আই জড় অইছে। গ্ৰামের লোক দেই ত অবাক। ঠান্ডা শান্ত গ্ৰামে এরুম ভেজাল অইলে মাইন্ষ্যে টিক্ব কেরুম করি। এদ্দিন হুইন্লাম হত্যেক দিন মিলিটারির লগে যুদ্দ অর ঢাকা শহরের ধানমন্ডিতে, রংপুরে, দিনাজপুরে, যশোরে, কুষ্টিয়ায়, হেনীতে, লাকসামে, ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়, কুমিল্লা টাউনে। স্বাধীন বাংলা বেতার আর আকাশবাণীত্ হেই সংবাদ হুনি ত শিউরি উডি। ইয়ানে অন্ গেরিলারা হুইরের হাড়ে, গাছতলায়, মাডের কিনারে ঘুর ঘুর করের। হেগুনে এত অশ্র যোগার কইর্ছে কত্তুন। মেলাঘরে নাকি ক্যাম্প বানাই ট্রেনিং দের টিলার উপ্রে। আর এক বিপদে বেকে দিশাহারা। এক নতুন রোগ আই হইড়ছে, চখ লাল অই যার। কেউ জানে নি ক্যাম্নে এই রোগ ভালা অইব। মাইন্ষ্যে চয়ে জল মারে। হরে হুনা গেল এই রোগের নাম দিছে মাইন্ষ্যে ‘জয় বাংলা’। হোমিও ডাক্তর যতিনের কাছে হুরা গ্ৰামের মানুষ লাইন দিছে। এই রোগের একমাত্র ওষুধ নাকি ‘বেলেডোনা সিকস্’। হেই ত গেল। হুনা যার, শহরে নাকি বিচ্ছুগ দাপাদাপি শুরু অইছে, বোমা মারি, শেল ছুঁড়ি খান সেনাগ খতম্ কইর্ছে হেগুনে। মিলিটারিরা ডরাই যাই রাজাকারেগ আতে দামি দামি ভারি ভারি অস্ত্র তুলি দের। জোয়ান হোলাগুনের শরীল তুন্ রক্ত বার করি হরান চলি গেলে খালের জলে ভাসাই দের। হ্যাতাগ বলে সৈন্যগ বাঁচাইবার লাই মেলা রক্ত দরকার, হিয়ের লাই গা’র হশম খাড়া করি দেওনের মত কাণ্ড ঘডার। গেরিলারাও হতিশোধ লইবার লাই ঝাঁপাই হইড়ছে, সহজে ছাড়ি দিত ন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোলারা, চৌকস্ খেলুড়েরা, যুদ্দ কইরবার লাই গেরিলা হর। আবার রক্তচোষা হশ্চিমারা হচার করের ভারত নাকি হত্রুতামি করি হামলা করের, মুক্তিযোদ্ধারা নাকি ‘গাদ্দার বাঙালি’ হাঁজি সাহায্য করের, হিয়ের লাই হেগুনে ভারত দমনের খেলায় নাইম্ছে, বাছি বাছি হিন্দুগ গলা কাডের। বেডারা যেই যুক্তি খাড়া করায়, মিছা কতা! হিগাইন বেক্গাইন বাঙালিগ হেনস্থা কইর্বার লাই ইয়াহিয়া খানের কারসাজি, যাতে করি আঁঙ্গ দ্যাশ স্বাধীন অইত না হারে। অন্ নাকি আল-শামস, আলবদর বানাইছে, হেগুনে কী কম নষ্টের গোড়া! বিহারীরা নাকি হ্যাতাগ সঙ্গ দি বাঙালি খেদার। গেরিলারা নৌকাত্ করি বস্তা বস্তা কী য্যান্ আনি জমা করের, বোমা অইত হারে। কোমর বাঁধি নাইম্ছে, হ্যাতাগ জয় ঠেয়াইব কে! দিন চলি যায়, রাইতও চলি যায়, বোমা গুল্লিগালার শব্দ বাড়তেই থায়। এদ্দিন বাদে মুক্তিযুদ্ধের জের আই অইড়ছে আঁঙ্গ ঘরের কাছে, না অইলে কী বুইজ্বার কোনও উপায় আছিল আঁঙ্গ দ্যাশ নিজের দ্যাশ হাইবার লাই লড়ের। মুক্তিবাহিনীর বন্দুক যুদ্দ যে এরম জোরদার অইত হারে, কেউ কোনওদিন ভাইব্ছে নি। হুরা দুইন্নাই ভাইব্ত আঁঙ্গরে ছা হোষা বাঙালি, হাকিস্তানিগ অধীনে হরাধিন অই বাঁচে, হেগুনের কতা আর কে হুনে। অন্ মনে অর, হুইন্ত অইব। আঁঙ্গ বাপের বাড়ির দ্যাশের নিরীহ মানুষ, চাষবাস করি খায়, ব্যবসাহাতি করে, মন্দির মসজিদ লই কাইজ্জা কহ্নও করে না, হেগুনে যে এরম করি জাগি যাইব, কে জাইন্ত। খবর ত আইয়ের, খনসেনাগ খবর। জোয়ান হোলারা কর, আইয়ক দেই মিলিটারি, দ্যাইযুম্ কেরুম জব্দ করে। বুক চিতাই খাড়াইয়ুম, গুল্লি খাইয়ুম, গ্ৰামে হাঁদাইতাম দিতাম ন। ঐপারে ভারতের সেনারা টহল দের, এক্কান এস্পার ওস্পার অইবই। ১৯৬৫ সালে ইন্ডিয়া হাকিস্তান যুদ্দ অইছে, এবার নতুন্ করি যুদ্দ অইব, বাংলাদেশ স্বাধীন কইর্বার যুদ্দ। মুক্তিযোদ্দারা এক লগে গান ধইর্ছে – এ তরী বাইতে হবে, আমি যে সাগর মাঝিরে। মাঝেমাঝে হেগুনে এক লগে গলা কাঁপাই কয় – জ……য় বাংলা।
ওমারে যুদ্দ বলে যুদ্দ, এরুম যুদ্দ কোন কালে দেই ন। আকাশ বাতাস হাডাই গুল্লির লড়াই, গ্ৰেনেডের শেল আই হড়ের যিয়ানে হিয়ানে, মন্দির মসজিদ কিছুই মানেন না। ভারত হাকিস্তান যুদ্দ তাইলে লাগিই গেছে। জোর লড়াই করের মুক্তি বাহিনী। মিলিটারিরা যাতে জিপে করি গ্ৰামে হাঁদাইত না হারে চাইর মুই তুন্ আগেভাগেই গেরিলারা তাগড়া হোলাগ লগে লই হাথালি করি রাস্তা কাডি দিছে। বোমার আক্রমণ তুন্ গ্ৰামবাসীগ রক্ষা কইর্বার লাই বড় বড় সুড়ঙ্গ বানাইছে। আমরা হেই সুড়ঙ্গেই হাঁদাই রইছি। ভারতের সেনা আর গেরিলাদ গোলার সামনে খান সেনারা কাবু অই গেছে, খাড়াইত হারের না। হ্যাতারা ভাইব্ছিল সহজে জিতি যাইব, এরুম ফাইট্ দিব ক্যাম্নে বুইজ্ত হারে ন। হেগুনে ব্যাদিশা অই হিছনে হইঠ্ছে। বাংলার মাডি ত চিনে ন, হাঞ্জাবে থাই গোঁপে তা দি ভাইব্ছে, যাইব আর বোকাসোকা বাঙালিগ মাথা মুড়াই খাইব। আরে বাঙালিরা খাডি খাইবার জাত, ঘাম ঝরাই লড়াই করি বাঁচে, মাইর্তেও জানে, মইর্তেও হারে। হেগুনেরে রাস্তাঘাড চিনাই আইন্ছে রাজাকাররা। দৌড়ানি খাই রাস্তাঘাড না চিনি খানাখন্দে হড়ি খান সেনাগ অবস্থা অইছে জঙ্গলে বাঘের সামনে হরিণছানার মত, আর লইড়ত চইড়ত হারে না। এরুম এক্কান অবস্থা যে দেইখ্ব, কল্পনা করুম ক্যাম্নে। খান সেনারা যে এক এক্কান চামার, আগে হেই কতা কত হুইনছি, এবার হচক্ষে দেইখ্লাম। মানুষ ত ন, জন্তু, নামাজিগরেও ছাড়ে ন, হ্যাতেরা ধম্ম লই বড়াই করে, এইডা নাকি হ্যাতাগ ধম্ম, মা, বইন, দাদি, নানিগ ইজ্জত নষ্ট কইর্তে শরম করে ন। এই হশ্চিমারা কোনদিন টিক্ব! কোয়ালে দুখ্ আছে। নিজের দ্যাশের জনগণের কাছে ভালা হাঁইজ্লেও, তোরা আঁঙ্গ বাঙালিগ কাছে সম্মানের যুগ্গি ন, কুত্তার তুন্ও অধম। টেরও হাই ন, কহ্ন যে সুবলের সামনে হ্যাতের মার ইজ্জত লুইট্ছে, কাফের কই গাইল দিছচ্, ছি। বুন্দকের আগা দি মুক্তিফৌজের দুইজনেরে খোঁচাই খোঁচাই মাইর্ছচ্। গলা উঁচা করি কচ্ হাকিস্তান। খাবাই দিব, বঙ্গবন্ধু হিরি আইলে, কদ্দিন আর গারদে আটকাই রাইখ্বি। হিন্দুর ঘরের মাইয়া, কাফের ন, আঁই এই দ্যাশে জন্মাইছি, এই দ্যাশেই মরুম, কোনহানেও হলাই যাইতাম্ ন। এই দ্যাশ, আঁর দ্যাশ, বাংলাদেশ।
আনন্দে আর বাঁচি না, ভয়ডাও খিঁচি ধরে – কী অইব! কী অইব! আঁর মা বুড়া অইছে, আবাজ্ হুইন্লেই কাঁপি কাঁপি উডে। এক্কান উড়াজাহাজ আর এক্কান উড়াজাহাজরে দৌড়ানি দিছে এত জোরে যে কান হাডি যায়। আঁঙ্গ ঘরের কাছে যুদ্দ অইছে। অন্ আকাশে যুদ্দ শুরু অই গেছে। লক্ষণডা ভালা ঠেকের না, যা কিছু ঘডি যাইত হারে। যদি বোমা এক্কান হালায়, সুড়ঙ্গে হাঁদাই যামু লগে লগে। একে ত শনির দশা, ইয়ার উপ্রে রাহু আই গ্ৰাস কইর্ছে। চাষীরা মাডে যায় না, আঁড্বাজারও নম নম করি খোলে, হোলাগরে জানি হুনি কে আর ইস্কুলে হাঁডায়। শহরের তুন্ বেকে চাকরিবাকরি ছাড়ি ঘরে চলি আইছে, ডরে ডরে। হিঁন্দুর হোলা অইলে ত কতা নাই, চিবাই খাইব আল বদর আর রাজাকাররা। ভারতের সেনারা কী হাইর্ব এই হাকিস্তানি ডাকাইতগুনের লগে। আঁঙ্গ ইয়ান তুন্ ত দাব্ড়ি খাইছে কিন্তু শহর যদি চুরমার অই যায়, দ্যাশের কী অইব। আকাশবাণী খবর কইছে, ভারত বাংলাদেশেরে স্বাধীন জাতি বলি স্বীকৃতি দিছে। এদ্দিন বাদে এক্কান সুখবর আইল। আঁর মার কানেও গেছে রেডিওর ঘোষণা। মা আনন্দে লাফাই উইঠ্ছে, খবরহান হাঁচা ত, না মিছা কতা। হ্যাঁগ মা, হাঁচা খবর। মারে ক্যাম্নে কই, স্বীকৃতি ত দিছে, কিন্তু তছ্নচ্ অই যার সব। মুক্তি বাহিনী ঢাকা টাউনে হাঁদার, কিন্তু কারফিউ, ব্ল্যাকআউট কীসব কয়, এতদিনে দ্যাশডা আস্ত থাইক্লে অয়। বেকে যে অতিষ্ট অই যার। ক্যাম্নে যে দিন গুজরান অর, ঈশ্বর জানে। লক্ষ লক্ষ মাইন্ষ্যের হরান চলি যার, সরকার জোর করি ইস্কুল কলেজ অফিস আদালত খুলি দি দুইন্নাইর মাইন্ষ্যেরে দেয়াইত চায় বেক্গাইন ঠিক চলের, এভাবে কদ্দিন চইল্ব। যা চাইল ডাইল আছিল, হুরাই গেছে। মুক্তিফৌজরা ত ঘাঁডি গাঁইড়্ছে, ভারতের সেনাগ গাড়ি ভোঁ ভোঁ করি আই ঐপার তুন্ হাঁদার। আঁঙ্গ ঘরের হাঁক দি তোড়জোড় বেক্ দেয়া যায়। আঁর ভাই যাই কোনরমে বাজার তুন্ যা হাইছে, লই আইছে। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করি হিছনে হাকের ঘরে চুলা ধরাই হাকশাক করি হোলাহাইনের মুয়ে খাওন দেয়। আমরা বড়রা এক বেলা খাই, এক বেলা উবাস করি। সইন্দ্যা অইতে না অইতেই ঘরের মইদ্যে হারিকেন, কুপি কিচ্ছু না জ্বালাই চুপ করি বই থাই। বুক ঢিপ্ঢিপ্ করে। বোমের শব্দ হুইনলে হোলাগুন কাঁদি উডে, মুয়ে চাপি ধরি থামাই। আর ত থাওন যায় না, কোন মুই আর যামু। গুল্লিগোলা চইল্ছে দিনরাইত, বিরাম আর কন্নাই, হইকেরাও সাড়াশব্দ করে না, মানুষ ত কোন ছাড়। জলে ডুবি মরণ ছাড়া আর কোন রাস্তা নাই। আট নয় দিন আঁঙ্গ চয়ে ঘুম নাই। হুনিয়ের বেক্ বডার এলাকায় জোর লড়াই চইল্ছে। আমার মা টের হাই কর, বেক্গাইন ছারখার অই যাইব। আঁর স্বামী কয়, ইয়ানে সাত সমুদ্দুর তের নদী হার করি নিরাপদ ভাবি আইছি, এই ত উল্টা হুরাণ। আঁঙ্গ গ্ৰামে কী অবস্থা চইল্ছে কী জানি। আঁর কালুডা কেরুম আছে ত কিচ্ছু জানি না, হিগা ত না খাইত হাই মরি যাইব। আঁর স্বামীর চয়েমুয়ে আতঙ্ক দেই আঁই নিজেরে হামলাইতাম্ হারিয়েন না। মরণের ভয় আই জাপটাই ধইর্ছে। কয়, চল বেক্গুনে মিলি ভারতে চলি যাই। আঁই কইলাম, আমরা কী দ্যাশে একলা, এত মানুষ আছে, যা অইবার তা অইব, এত চিন্তা করেন কিয়ের লাই, দ্যাশের অবস্থা কী কোন দিন হিরত ন? কয়, তুঁই হেই আশা লই বই থাও, খবরে কী কর হুইন্ছ না। আমেরিকা হাকিস্তানেরে সমর্থন দের, লগে জুইট্ছে চীন। আমেরিকা সপ্তম নৌবহর হাঁডার আর সোভিয়েত ইউনিয়ন হাঁডার ষষ্ঠ নৌবহর বঙ্গোপসাগরে। সব্বনাশ অই যাইব গ, মানুষ মরি ছাপ অই যাইব। আম্নে খালি দুশ্চিন্তা করেন। অন্ও হাঁডায় ন। ভারত অত বড় দ্যাশ, ছাড়ি কতা কইব নি, এক্কান ব্যবস্থা নিশ্চয়ই কইর্ব। আঁর ভাইয়ের বউ অত চেঁচায় কিয়ের লাই। ও দিদি হুইন্ছেন নি, আফজল চাচার ছোড হোলা হেণীতে কাম কইর্ত না হোনার দোয়ানে, হ্যাতেরে খান সেনারা এরুম মাইর মাইর্চ্ছে রাইফেলের বাঁট দি, মাজা ভাঙি দিছে, ঠ্যাং আত আর আস্ত রায় ন, হ্যাতের বন্দু ইনাই বিনাই কয়, আর বাঁইচ্ত ন মনে হয়, চাচা কী কাঁদন কাঁদের। হালারা মরেনা কিয়ের লাই। গেরিলারাও ছাড়ে ন, চাইর জন খান সেনারে খতম করি দিছে। বোমা মারি হ্যাতাগ জিপ উড়াই দিছে। আঁর স্বামী কয়, হুইন্ছনিগ, ভালা খবর আছে। ভারতের সেনা আর মুক্তিফৌজেরা মিলি খান সেনাগর্ তুন্ বলে ২৫,০০০ বর্গমাইল জাগা মুক্ত কইর্ছে। ধরা আরও খাইব। হরের জমি দখল করি রাওন এত সোজা কতা ন, বাপেরও বাপ আছে। আম্নের মুয়ে হুল চন্দন হড়ুক, এদ্দিন বাদে এক্কান খবরের মত খবর হুইনলাম, এবার কিছু এক্কান অইব। দিন যায় রাইত হোয়ায়। ভারতের সেনারা আঁঙ্গ দ্যাশে হাঁদাইছে, বার তের দিন ত অই গেল। ওমা, আঁর ভাইয়ের হোলা চন্দন খুশিতে ডগ্মগ্। কীরে কী অইছে, নাচনের কি অইল? আরে বাংলাদেশ স্বাধীন অইছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা দিছে। নিয়াজী নব্বই হাজার সেনা লই আত্মসমর্পণ কইর্ছে। আরে তুই কী কছ্ রে, আঁঙ্গ দ্যাশ স্বাধীন অই গেছে, হাঁচা কতা নি। মিছা কতা আঁই কই না কহ্নও। হুইন্ছেন নি, চলেন্ কাইলই আমরা আঁঙ্গ গ্ৰামে রওনা দি।
স্বাধীন অওনের মর্ম বুজা দায়
কারা এরুম দ্যাশের হানে চায়
গ্ৰামে আইলাম্ হিরি, ভয় ডর কন্নাই উড়ি চলি গেল। সদর দরজা তুন্ হাঁডি হাঁডি ঢুইক্তে না ঢুইক্তেই করিম আই সেলাম ঠুকি জিগ্গাইল, কেরুম আছেন জেডা? উত্তর দিমু কী, তার আগেই ঝরঝর করি কাঁইনতে আরম্ভ কইর্ল। হ্যাতের কাঁদার কারণডা টের হাইলাম আরও হরে। আঁঙ্গ হিছে হিছে খালের হাড়ের গ্ৰামের অনেক মোছলমানরাও আইল। এদ্দিন বাদে আঁঙ্গরে দেই হেগুনে অবাক অই চাই রইল। ভাইব্ল এদ্দিন কন্নাই আছিলাম, কন্ তুন্ আইছি, এরুম কত কতা জিগ্গাইবার ইচ্ছা অইল। আত্মীয় হজনেরে অনেককাল না দেইখ্লে যা মনের অবস্থা অয়, হেগুনে আঁঙ্গ গা ঘেঁষি খাড়াইল। আরও কত কতা জিগ্গাইতে মন চায়, গুছাই কইত হারে না। আর একটু আগাই যাইবার হর আমরা আকাশ তুন্ অইড়লাইম। এই আমরা কন্নাই আইলাম। আঁঙ্গ বাড়িঘর কন্নাই গেল, খালি ভিডাহান হড়ি রইছে, আর কতগাইন হোড়া কাঠ, জ্বলিহুড়ি যাওনের হর রইদে হুড়ি, বিষ্টিতে ভিজি থাইক্লে যেরম লাগে, বাশ গন্দ কিচ্ছু নাই, ঘরের খুঁডিগুন ঠুন্ডা অই খাড়াই রইছে। বিদ্যাসাগর,রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের হোড়া হোড়া ছবিগাইন এক কোণায় উল্টাই হড়ি রইছে। যেই ভিডাহানরে এতকাইল লেয়াহোচা কইর্ছি, গোবর ছিডাইছি, যেই এত্তবড় ঘরহানরে যত্ন আত্তী করি রাইখ্ছিলাম্, যেই ভিডায় আঁর হোলামাইয়ারা খেইল্ছে বেড়াইছে, জালিমরা এত নিষ্ঠুর যে ঘরবাড়ি হোড়াই নিশ্চিন্ন করি দিল। হ্যাতাগ ধম্মে সইল! আঁর হৌড়হৌড়ির ঘরহান মাডিতে মিশাই দিল। হ্যাতাগ দেহা হাইলে জিগ্গাইতাম হেগুনে কী মাইন্ষ্যের বাইচ্চা না হশু! অন্ কন্নাই যাই গা ঢাকা দিছে। আঁর স্বামী কয়, বুক চাপ্ড়াইলে কী হিরি হাইবা। অন্ ভাব থাইক্বা কন্নাই! কত কইছি ইন্ডিয়া চলি যাই, এগুনে আঁঙ্গরে থাইক্ত দিত ন এই দ্যাশে, হুইন্লা না। অন্ নিজের চয়ে দেহ কী অবস্থা কইর্ছে, বাসের অযোগ্য করি রাইখ্ছে। বাঁই গ্যাঁতিগুষ্টিরা যহ্ন দ্যাশে হিরি আইব, কন্নাই থাইক্ব, কী খাইব। বেক্গুনে খাড়াই খাড়াই চাই রইছে, কোন জবাব আছে নি হ্যাতাগ কাছে?
ঘরদোর চুলায় গেছে, অন্ কার দূয়ারে যাই ঘুরি মরুম, নিজের ভিডাতেই হর্মুলের বেড়া দি গোবর লেপি ছনের ঘর করি হড়ি রইলাম। এক বেলা খানা জোডে কোনরমে, আর এক বেলা জল খাই থাই। ওই হোলাডারে লই তের মুশকিলে অইড়ছি। দিনরাইত মা বাপের লাই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করি কাঁদে। ক্যাম্নে হ্যাতেরে বাড়িঘরে হৌঁচাই দি। আত্মীয় স্বজন কে বাঁচি আছে, আর কে বাঁচি নাই, খবর লইয়ুম ক্যাম্নে। আঁর স্বামী ইস্কুল ঘরে লাইন দি ছাতু জোগাড় করি আইন্ছে, মাই মাই খাই। রেডক্রস তুন্ সাহায্য আইছে। বাড়িঘর দোর বানাইবার লাই টিন দের। লিষ্টে আঁঙ্গ বলে নাম উইঠ্ছে। আঁর হোলামাইয়ারা ভারত তুন্ হেরত আইছে। আঁঙ্গরে জড়াই ধরি হেগুনের কী কান্দন। কত কই কান্দছ্ কিয়ের লাই? হেগুনের কান্না কী আর থামে! বাড়িঘর দোরের এইরম অবস্থা দেই আরও মন খারাপ অই গেছে। আঁঙ্গ বাড়ির মানুষ, অইন্য বাড়ির মানুষরাও যে যিয়ানে আছিল হিয়ান তুন্ এক এক করি হেরত আওন শুরু করি দিছে। যেই গাঁট্টি লই অইয়ে, এক প্রস্ত হাউমাউ করি কাঁদে – দিদিগ, যেই কষ্টে দিন কাইট্ছে, আম্নেরে কী কমু, নরকের দূয়ার তুন্ হেরত আইলাম। এক এক জনের এক এক রমের ঘটনা, কয়, কত জনরে যে কচুকাডা কইর্ছে, কত মাইয়ারে চয়ের সামনে ইজ্জত নিছে আর কী কইয়ুম, এই দৃশ্য মনে হইড়লে অন্ও গা কাঁপাই উডে। হিছনের বাড়ির অপূর্বর মাইয়া গর্ভবতী অই গেলে লোক শরমের ভয়ে গলায় দড়ি দিল। হায় হায় রে, ঐটুক্ মাইয়া, হবে ঋতুস্রাব অইছে, হেই মাইয়ার এরুম সব্বনাশ করি দিল, হেগুনে কী মাইন্ষ্যের বাইচ্চা, জানোয়ার, ঘরে মা বইন নাই। বঙ্গবন্ধু ত দ্যাশে হিরি আইছে, দেই অন্ কী বিচার করে জালিমেগ। মেলেটারিরা ত আত্মসমর্পণ করি ছাড়্ হাই গেছে, হেগুনের ত কোন বিচার অইত ন। দ্যাশে যাই ভালা মাইন্ষ্যের হোষাক হরি বুক হুলাই ঘুরি বেড়াইব। আঙ্গ দ্যাশের যেগুন দ্যাশের লগে গাদ্যারি কইর্ছে, হেগুনের বিচার করনের লাই হ্যাতেনে দালাল আইন করি কগা গাদ্যাররে শাস্তি দিছে। বঙ্গবন্ধুর ত দয়ার শরীল। হ্যাতেনে বাঁইগুনেরে সাধারণ ক্ষমা করি দিছে। কামডা যে হ্যাতেনে ভালা কইরছে এইডা কই ক্যামনে। ভারত এত সাহায্য কইর্ল, কত সৈন্য মুক্তিফৌজের লগে মরি গেল, কেউ কেউ অন্ উল্টা গান গাইছে, হেগুনরে বেইমান ছাড়া আর কী কইতাম্ হারি। আরে ভারত সরকার বডার খুলি দিছে বলিই ত অনেক মানুষ হরানে বাঁচি গেছে, না অইলে কী দশা অইত। বিদ্যাশ বিঁভুয়ে এক গেলাস জলও ত কেউ কাউরে দেয় না, হ্যাতারা আঁঙ্গরে নয় মাস ধরি রাইখ্ছে, খাওয়াইছে, হরাইছে, হেইডা কী কম কতা! শুধু কী সরকার, স্থানীয় মাইন্ষ্যেও কম করে ন। হরের দ্যাশের মানুষ বলি দূর দূর করি তাড়ায় ন, হেই ত বাপের ভাইগ্য। কত জাগা যে হাল্টাই হাল্টাই থাইক্ছি, হোট্লাহুট্লি চ্যাঁচাই চ্যাঁচাই লই গেছি, হ্যাডের ব্যারামে অইছিলাম একসার । কারো কারোরে লই গেছে উড়িষ্যা, আসাম, মধ্যপ্রদেশ, আমরা ত আছিলাম বিলইন্না, উদয়পুর আর হরে হরে আগরতলা অই সর্বশ্যাষ ধম্মনগরে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে দিন গেছে। বাদাইম্যারা ছোঁক ছোঁক কইর্ত না ক্যামনে কই। হুসলাই একবার নিত হাইর্লে ত ষোল কলা হুরণ অয়। মান সম্মান বাঁচাই যে আইতাম্ হাইর্ছি আম্নের বাপ মার আশীর্বাদ আছিল বলিই না। অন্ শইর্ল্যের মইদ্যে কী রোগ বাসা বাঁধি আছে, কে জানে। কত দুহের কতা আঁরে হুনায়। আঁর হৌড়ির মরণের কতা হুনি মাথাও চাপড়ায়। ওমা হরে হরে দেই আরও বাড়ির গ্যাঁতিরা আই ইনায় বিনাই দুহের কতা কই আছড়াই হড়ে। লেদা হোলাডাও কইতে ছাড়ে না।
ঘরে ঘরে ব্যারাম লাগিই আছে। ওষুধ হইথ্যর আকাল। ঘোর অরাজকতা চইল্ছে হুরা দ্যাশে। খান সেনারা যাইবার আগে বেক্ সম্পদ লুডি লই গেছে, ট্যাঁয়া হইসার ভান্ডার শূন্য করি দি চলি গেছে। মাইন্ষ্যের রোজগারহাতি নাই। বঙ্গবন্ধু অইন্য দ্যাশের কাছে চাই চিন্তি দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে বাঁচাইবার চেষ্টা করের। দ্যাশের মইদ্যে অন্ও হত্তুর ত কম নাই। রাজাকার আলবদররা ঘাপটি মারি রইছে। যুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীর গেরিলাগরে কম ত খতম করে ন। হেগুনে চাইছিল দ্যাশডা হাকিস্তানের লেজুড় অই থাক্, তাইলে আখের গুছাইতে হেগুনের সুবিধা অইব। এই কতাগাইন অন্ ড্যাগা ড্যাগা হোলাহাইনেরাও বুজি হালাইছে। দ্যাশ যে স্বাধীন অইছে হ্যাতাগ হছন্দ অয় ন। বঙ্গবন্ধুরে মারি হালাইলে খুশি অইত। হিন্দুরা কোন দিগে যাইব, এই হশ্নটা উইঠ্ছে ক্যাম্নে। আঁই মাইন্ছি অন্ও অনেক হিন্দু ভারতের ক্যাম্পে আছে। হিন্দুগ উপ্রে অইত্যাচার অইছে বিধায় সাহস করি আইত হারেন না। কে নিশ্চিত কইর্ব নিরাহত্তা! দিনের আলো আর রাতের আঁন্দার আত ধরাধরি করি চলে, কোনটাতেই মুখ দ্যায়ানো যায় না। বিশ্বাস হিরাই আইন্ত হাইর্লে এরুমডা অইত না। এই দ্যাশডা হিন্দুগ দ্যাশ ন, এই কতা উইঠ্তে বইতে কিছু মানুষ বুজাই দের। বুজা, কত বুজাইবি বুজা, আঁই কইতেই থাকুম্, এই দ্যাশ হিন্দু মোছলমান বেকের আর য্যাতারা য্যাতারা বসবাস কইর্ছে এত হুরুষ ধরি বেক্গুনের। মাইন্ছি অন্ও স্বীকৃতি দেয় ন বেক্ দ্যাশ, দিব স্বীকৃতি আস্তে আস্তে। আঁর স্বামীর মনে দুখ্ লাইগছে, কয়, হুইন্ছনি, রাষ্ট্রসঙ্ঘে চিনারা আঁঙ্গ দ্যাশের বিরুদ্ধে ভেটো দিছে, হেই দ্যাশ মাইন্তেই চায় না বাংলাদেশের মাইন্ষ্যের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে, মা-র যেমন হোলামাইয়ারে বুয়ে জড়াইবার অধিকার আছে, ভাষা কৃষ্টি লই বাঁইচ্বার অধিকার আঁঙ্গ আছে। আইজ্ না হয় কাইল বিশ্বের বেক্ দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে এই কতাগাইন মাইন্তেই অইব। না অইলে দ্যাশের ভিত্রে বারে বেকেরে এই ভুলের মাশুল দিতই অইব। হ্যাতেনের মুখহান এই কতাগাইন কইত যাই জ্বলজ্বল করি উইঠ্ল। আঁর মায়া লাইগ্ল, ছোড হোলার লাই মার মনে যেরুম লাগে, খালি দিব, লইত না কিছুই। ঘর আর ঘর নাই, বাড়ি আর বাড়ি নাই, দ্যাশ আর দ্যাশ নাই। এক কোনায় বই চুপ করি থাই নিজের মনে। আঁঙ্গ বাড়ির সামনের শ্মশানের মঠ কত সুন্দর, ধরি রাইখছে বেক্গাইন, অতীতের লগে কেরুম সুন্দর মিলাই দিছে বর্তমান আর ভবিষ্যত। চলেন আমরাও মিলাই দি। বড় সুন্দর কতা কইছ তুঁই, আঁর মনে ধরি গেল।
যন্তনাডা এরুম করি গাঁতি যাইব, কে জাইন্ছে। জীবনে যে অইন্য রঙ লাইগ্ব, কে আর ভাইব্ছে। অনেক চেষ্টা চরিত্র করিও আগের ঘরে, আগের বাড়িত্ হিরি যাইতাম হারিয়েন না। ভাবনায় আর সম্পর্কের মইদ্যে চিড় ধইর্ছে। আঁর হৌড়ি যে জাগায় ঘুমাইত, অন্ হেই জাগায় হোড়া হোড়া গন্দ জমাট বাঁধি আছে। হাকের ঘরের চুলা দুইহান কাঁচা মাডি দি লেপি দি রান্না বয়াইছি। হর্মুলের ধোঁয়া থাইক্বার ঘরে ছড়াই গেলে চখ জ্বালা জ্বালা করে। কদ্দিন অইল বিলাইডা হিরি আইছে। কন্নাই আছিল কী জানি। বুইজ্তাম হাইরছি, মনই আপন, আর বেক্গাইন হর, শত চেষ্টা করিও স্বাধীন দ্যাশের ভাঙাচুরা হরিবেশটারে কোনমতেই আপন কইর্তাম হারিয়ের না। হইসাকড়িও হুরাই আইছে, কিছু সাহায্য আইছে, হেইডা দি কদ্দিন চইল্ব। বাজারেও আগুন লাইগ্ছে, বেক্গাইন মাঙ্গা, আত ছোঁয়াইলেই আত হুড়ি যায়। আমেনার বাপ আই কয়, হাঁস এই চাইরহান ডিম হাইড়্ছে, আম্নেরা হান। আঁই কইলাম, এই দুর্দিনে তোঁরা খাইবা কী, লই যা। হ্যাতে কিছুতেই নিতে রাজি অইল না। হোলামাইয়াগুনের মুখগাইন হুক্না অই আছে। বাড়িহুদ্দা মাইন্ষ্যের মুয়ে কোন কতা নাই। হ্যাডে ভাত নাই, আর কী কতা কইব। নেতারা আইছে এদ্দিন বাদে। কয়, দেইখ্তেই ত হাইর্ছেন দ্যাশের অবস্থাহান, সরকার যট্টুক হারের, অইন্য দ্যাশের তুন্ চাই চিন্তি আনের, এট্টু হাম্লাই টাম্লাই চলেন, দিন এরুম থাইক্ত ন, দুখ্কষ্ট কাডি যাইব। ভাঙ্গি ত দিছে বেক্ কিছু হশ্চিমারা, গইড়্তে ত সময় লাইগ্ব। হ্যাতাগ কতা হুনি এরুম এক্কান দশা অইছে, স্বপ্নগাইন আই জড় অইলেও, ছিট্কাই চলি যায় চয়ের নিমিষে। অফিস কাচারিও খুলে ন। আদালতে মুজিবুর পন্থি বিচারকেগ ধরি ধরি নাকি খান সেনারা মারি হালাইছে। ইস্কুলও তছ্ন্ছ্ করি দিছে, চেয়ার টেবিল বেক্ ভাঙ্গাভুঙ্গা, ইস্কুলে যাইবার উপায় আছে নি। দুই একজন হিন্দু মাষ্টর আছিল, হ্যাতাগরে মারি মাথা হাঁডাই দিছে। তবুও আঁর স্বামী কয়, কদ্দিন আর বই থাইক্ব, এবার সদরে যাইয়ুম্, কদ্দিন অই গেল, কারও মুখ দেই না। আঁই আর মানা করি ক্যাম্নে, মনের উপ্রে কারও ত দখলদারি নাই।
আমন ধান অইছে। মাঠভরা ধান দেই অস্থির মনডা কিছুডা শান্ত অয়। আঁঙ্গ হোষা কুত্তা কালু আগের মতই লেজ নাচায়। গরুগুন আর হৃষ্টপুষ্ট নাই। চয়ের কোনায় কালি, মুয়ের চোয়ালে চোয়ালে ভাঁজ আর ডাক দিলে মনে হয় কত কষ্ট দুখ্ হেগুনের মনে। আঁই গলা ধরি আদর কইর্লে মাথাডা বাড়াই দেয়। উডানে মাড়াই অইছে হুব পাকিস্তানে, অন্ অইছে আঁঙ্গ স্বাধীন দ্যাশ বাংলাদেশে। মাডি ত স্বাধীন অইছে, গাছ স্বাধীন অইছে, মনের খুশি মত ঠাইল লড়ায়, হঁইকরাও স্বাধীন অইছে, মনের খুশিমত ডাকে। হেগুনের মনের মইদ্যেও খুশির জোয়ার আইছে, না অইলে এরুম চড়িবড়ি ঘুরি বেড়ায়! কান্তিলাল আর সুরেন্দ্ররা আর ঘরে হিরে ন, ইন্ডিয়ার কোন জাগাত্ ডেরা বাঁইনছে, হেগুনের মুখ আর কোনদিন এ জীবনে দেইখ্তাম ন। কাইজ্জা না কইর্লে হ্যাডের ভাত হজম অইত না, বাড়িহান গরম করি রাইখ্ত। ঢেঁই ঘরহান আর নাই, ভাঙিচুরি চুরমার করি দিছে। আঁঙ্গ বড় এক্কান কত বছরের মোডা আমগাছ আছিল, হিঁন্দুইরগা রাঙা আম ধইর্ত, হেই উঁচা য্যান্ আকাশ ছুঁই হালায়। কাডি লই গেছে চোরারা, গরমের দিনে গাছহান আঁঙ্গরে ছায়া দিত, গাহান ঠাণ্ডা অই যাইত। মানুষ মইর্ছে, গাছ মইর্ছে, দিন গেছে। হুইরের জলও হুয়াই গেছে। কত ভাব যে মরি গেছে, গেছে ত গেছে, উদ্দার করার আর কোন উপায় খুঁজি হাই না। হুনিয়ের বঙ্গবন্ধু দ্যশডারে নতুন্ করি গইড়্বার লাই দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে ডাক দিছে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধম্মনিরপেক্ষতারে সম্বল করি হ্যাতেনের স্বপ্নরে হুরণ কইর্ত চায়। এই কতাগাইন রেডিওত্ হুনা। কেউ কেউ আবার মুসলিম ধম্মরে সামনে রাই সংবিধান বানাইত চায়। চাইবার অধিকার বেক্গুনের আছে, কইবার অধিকারও বেক্গুনের আছে, কিন্তু মনডা যদি খচ্খচ্ করে তাইলে এই নতুন্ দ্যাশে আঁঙ্গ জাগা কন্নাই অইব। মনে হশ্ন জাগে, বেক্ ধর্মের মানুষ এক লগে থাইক্লে সমইস্যাটা কীয়ের। ধম্ম ধর্মের জাগায় থাইক্ল, মানুষ মানুষের জাগায় থাইক্ল, সোজা সরল ইসাব। হথ্যম হথ্যম রিলিফ দিছে। যত দিন যার, দেয়নের হরিমাণডা আগের মত নাই। বিদ্যাশের মাইন্ষ্যে বুইজ্ছে বাংলাদেশের বাস্তুহারারা নিজের খানা দানা নিজেরাই জোগাড় করি হালাইত হাইর্ব এদ্দিনে। কিন্তু আঁঙ্গ যে দিন চলে না কে আর হেই খবর রায়। দুই এক গিরি য্যাতারা ছড়াই ছিডাই আছিল, হ্যাতাগ মইদ্যে কেউ মরিধরি গেছে, কেউ হিরি আইছে। এম্নে কী আইছে, নিজেগ ভিডামাডির মায়ায় হিরি আইছে। মানুষ য্যান্ আগের মত নাই, ঝিমাই গেছে। স্বাধীনতা হাওনের লাই যেরুম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গ দিছিল, গড়ার কামে আর হেরুম উৎসাহ দেই না। নিজেগ হাওনাগণ্ডা বুজি নিত চায় আগে, বাঁইরা মইর্লেও ভালা, বাঁইচ্লেও ভালা। সরকার যেই ট্যাঁয়া হাঁডায়, ছোলাই ভোলাই খায়। হিয়ের লাই কী এত তরতাজা হোলারা, ভারতের সেনারা হরান দিছে। যার গেছে, তার গেছে, কার কী, হ্যাতারা গুছাইগাছাই লয়, মৌজ করে। হেইডা ভাবে না, নতুন্ দ্যাশ, সরকার কী আকাশ তুন্ দিব, সময় দিত অইব। আরে স্বাধীনতা কী মধুর ভাণ্ড, খান সেনাগ দৌড়াই গাছ তুন্ হাড়ুম আর চুক্ চুক্ করি টানি খামু।
কী আনন্দ, কী আনন্দ আঁঙ্গ দ্যাশে মুদ্রার নাম ট্যাঁয়া অইছে। আঁর হোলা বাজার তুন্ যাই নতুন্ হাঁন্ডি হাতিল কিনি আইন্ছে। হাকের ঘর এদ্দিন উদাম আছিল, অন্ উপ্রে টিনের চাল অইছে, থাইক্বার ঘরের লগে জোড়া লাইগ্ছে। বিষ্টির সময় এঘর তুন্ হেই ঘরে যাইতে ভিজ্তে অইত ন। হাকের ঘরের হাশে লাকরি হর্মূল রাওনের গুদাম ঘর অইছে। অন্ চাইর মুই রেইন্লে ঘর ঘর মনে হয়। হাঁজাই গুছাই রাইখ্বার লাই ইচ্ছাও জাগের। মাঝে মাঝে উপ্রের দিগে রেনি থাই, বড় টঙডা আর দেই না, কোন কালেও হাইতাম্ ন, ভষ্ম অই গেছে, টঙডা আঁরে দেয় না, আঁইও টঙডারে দেই না। আঁঙ্গ ঘরের লগে আগে এক্কান শেফালি হুল্ গাছ আছিল, ঝারা দিলে সাদা সাদা হুল্ হড়ি উডান বিছাই থাইক্ত, জঁইয়া হোকা আডার মত লাগি থাইকত গাছে। দিন দিন ঘরহান মানুষ অই উইঠ্ছে, গোডা ঘরের চেহারাহান অইন্যরকম, কিন্তু আগের চেহারাহান কী ভুলন যায়! নৌকা আই সওয়ারি লই ভিড়ছে ঘাডে, দূর দূর তুন্ চাষীরা শাকসব্জি হল্হলাদি লই আইয়ের আঁঙ্গ আঁডে, লোকে লোকারণ্য। ইস্কুলে যোগ দিছে মাষ্টর সাবেরা, ছাত্ররা বই খাতা হিন্সুল লই যার মনের আনন্দে দলে দলে। জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ বেক্গুনের মিষ্টি গলায় কী ভালা যে লাগের, বাতাসে হেই সুর ভাইস্তে ভাইস্তে চলি আইয়ের হঁতে মাডেঘাডে। মাইন্ষ্যে ভাবের ঘোরে কেউ নাচে, কেউ গায়, কেউ এই গানের কতায় বুঁদ অই থায়। আঁঙ্গ দ্যাশহান আঁঙ্গ কাছে হিরি আইছে, এই খুশি রাওনের জাগা নাই। আঁই ঘরের উত্তর মুই বড় গাছের হাশে অগ্গা শেফালি হুলের গাছের চারা রুই দি, উডুক না বাড়ি যদ্দিন সময় লাগে, তদ্দিনে ঘরগাইন জোড়া লাগি যাইব আগের মত এক এক করি।
কইল্কাতা তুন্ চিঁডি আইছে বড় হোলার। হ্যাতে লিখছে বড় কোম্পানিত্ চাকরি অইছে। শহর তুন্ দুই মাইল দূরে জাগা কিনি কাকার ঘরের লগে ঘর বানাইছে। হাকা বাড়ি, মোজাইক্ করা মেঝে, সেগুন কাডের দরজা জানালা, তিনহান ঘর, খাট, আলমারি, সোফা, ডাইনিং টেবিল, এক্কান বড় রেডিও আছে। অ্যাকুরিয়ামে লাল সাদা নীল মাছেরা ঘুরি ঘুরি বেড়ায়। ঘরের মইদ্যে মাছের চাষ, হুনি ত আঁর আক্কল গুড়ুম। দেয়রের সংসারও বড় অইছে, হ্যাতেরে আদর যত্ন করে নোয়া কাকিমা, ভালামন্দ রাঁধিবাড়ি করি খাওয়ায়। হিয়ানে একশ বাঙালি মিলি এক্কান কোঅপারেটিভ বানাইছে। বড় বড় তিনহান হুইর আছে। হটিকের মত জল। আঁর হোলা বেয়ান অইলে হুইরে সাঁতার কাডে। বুইজ্লাম আঁর হোলার উন্নতি অইছে, সুয়ে শান্তিতে আছে জানি আঁর মনেরও শান্তি অইল। চিঁডির ভাষাহান আর ভাবহান আঁঙ্গ দ্যাশের মত আর নাই। কইল্কাত্তাইয়া গন্দ লাইগ্ছে। লাইগ্বই ত। এত বড় দ্যাশ, স্বাধীন অইছে হাতচল্লিশ সালে, হেই দ্যাশ কী আঁঙ্গ দ্যাশের মত হিছাই থাইক্ব। এদ্দিন ত হশ্চিমারা আঁঙ্গরে হরাধীন করি রাইখ্ছে, এই ত মাত্র স্বাধীন অই গা ঝাড়া দি উইঠ্ছে, আঁঙ্গ হা’র নীচের জমি অন্ও নরম, থল্থইল্লা, শক্ত অইব তয় না। ভালা ভালা রাস্তাঘাড অইব, হড়ালেহার হুযুগ অইব, কল্কারখানা অইব, অফিস আদালত বাইড়্ব, চাকরিবাকরি অইব, গ্ৰামে গ্ৰামে বিজলী বাতি আইব, তন অইব সুয়ের দিন। যহ্ন এসব কতা ভাবি, আঁর শরীলডা শিরশির করি উডে। মাইয়াডারে কইলাম্, দ্যাশের অবস্থাহান অন্ শান্ত, ভালা করি হড়ালেয়া কর, তয় না দাদার মত উন্নতি করবি। দেয়চ্ না তোর বাবা কয়, স্বাধীন দ্যাশেরে আগাই নিত অইলে মাইয়াগুনেরও আত লাগাইত অইব। তোর বাবা এট্টু ঝাড়ি ঝুরি উডি কোটে কামকাইজ শুরু করুক, তোরে আবার শহরে হাঁডাই দিমু, প্রাইভেটে জিলা ইস্কুলে একবার যদি হাঁস কর্তি হারছ্, আর হিছে হিরি চাইত অইত ন। মা, দিদিরে এক্কান চিঁডি লিখি দ। আঁর ভাগ্না ভাগ্নীরা কী ভালা, এই ক’মাস আঁঙ্গরে কী আদরেই না রাইখ্ছে, এই যে এত বড় দূর্যোগ গেল, এট্টুও কিছু বুইজ্ত দে ন। দুইজন মাইন্ষ্যের খানাদানা, আঁঙ্গ অসুখবিসুখ বেক্ কিছু মুখ বুজি হামলাইছে। দিদির ঋণ আমরা কোনদিন শোধ কইর্তাম্ হাইর্তাম্ ন।
মাইয়া আঁর ছোড হোলার আত ধরি শহরে গেল। যাইবার সময় কই গেল এবার জয় করি হিরুম। শহরে অন্ গরমের ঠেলায় হরান যায় যায়। গা ঝাড়া দি উইঠ্তে সময় লাইগ্ব। মাইয়া ত আঁর সাহস করি গেল, ভয় কাডি গেছে এই কতা ক্যাম্নে কই। ঘরবাড়ি লুটহাট ভাঙচুর অইছে, হেই ক্ষতের দাগ ছড়াই ছিডাই আছে ইয়ানে হিয়ানে। ডাকখোঁজ করি যে সান্তনা দিব, হেইরম মাইন্ষ্যের অন্ও দেয়া নাই। রাস্তাঘাডে গাড়িঘোড়া হেরুম চলে না। দুই এক ঘর মানুষ হিরি আইছে, ডাকি ডাকি কতা কয়। হাকশাক করি যে খাইব, হেই বন্দোবস্ত নাই। দুই এক্কান ভাতের হোটেল নোয়া করি খুইল্ছে। মাইয়াডার লাই হোটেল তুন্ খাবার আইয়ে। দেবদেবীর হতিমাগুন আর আস্ত নাই। মিটিং মিছিল বেক্ কিছু থামি রইছে, চুপচাপ, মনঃকষ্টে ঝিম মারি রইছে, বেক্ ঘর তুন্ একজন, দুইজন করি শহীদ অইছে, শোক ভুলন এত সহজ কতা নি। মাইন্ষ্যের মনে হিংসার ভাব আগের তুন্ কমি আইছে। যুদ্দ থাইম্ছে যে কয় মাস ত কাডি গেছে, অভাবের জ্বালায় অন্ও ঘুরি ঘুরি মরে। হস্তায় আডা, চাইল বিলি অর যিয়ানে, লম্বা লাইন দি খাড়াই রইছে হিয়ানে ঘন্টার হর ঘন্টা মাইন্ষ্যে। মাইয়ার বাপ আই কয়, ভালা করি হড়ালেয়া শুরু কর, সরকার ধুলাবালি ঝাড়ি, চেয়ার টেবিল ঠিক করি ইস্কুল কলেজ খুইলবার ব্যবস্থা কইর্ব শীগ্গির্ই। মাষ্টরেরা য্যাতাগরে মারি হালাইছে, হেই জাগায় নোয়া মাষ্টর নিব। বাবুরে, মক্কলরা শহরে মামলা কইর্বার লাই আওন শুরু করে ন, রোজগারহাতি নাই, ক্যাম্নে যে চালাইয়ুম, চিন্তায় আছি। মাইয়া আঁর দিন রাইত হড়ে আর দুই এক ঘর টিউশনি করে যদি বাবার কষ্ট কিছুডা অইলেও লাঘব্ কইর্ত হারে। কী জানি ক্যাম্নে ক্যাম্নে যোগাযোগ অইছে, হিন্দুর মাইয়া অইলেও টাউন হলে রচনা প্রতিযোগিতায় হথ্যম অইছে। যে মাইয়া জীবনে কোনদিন ইস্কুলে যায় ন, বাড়িত্ হড়ি হড়ি যে এদ্দুর আগাইব, কল্পনাও কইর্তাম হারি ন। জিলার ম্যাজিস্ট্রেট আশীর্বাদ করি কয়, আরও মন দি হড়ালেখা কর, অনেক দূর যাইত অইব।
মাইয়া আঁর প্রাইভেটে হরীক্ষা দি মাধ্যমিক হাস কইরছে হায়ার সেকেন্ড ডিভিশনে। বেক্গুনে বাহবা দি কয়, এই হাশ হার্স্ট ডিভিশন-এর হমান। ঘরে বই হড়ালেহা করি অসাইদ্য সাধন কইর্ছে। মাইয়ারে লই গর্বে আঁর মাথা উঁচা অই গেছে। ইয়ার হরে হেতি মহিলা কলেজে ভর্তি অই উচ্চ মাইদ্যমিকও হাশ কইর্ছে। সরকার অন্ বেসরকারি ইস্কুলগুন সরকারি কইরছে, কত শিক্ষক নের। আঁর মাইয়ার চয়ে বিরাট স্বপ্ন, ইস্কুলের মাষ্টারনি অইব। ইয়ের লাই পিটিআই ট্রেনিং কইর্ত অইব, সোজা কতা নি। কইলাম্ মাইয়ারে, মা, হুদা হুদা স্বপ্ন দেখছের কিয়ের লাই, কত হোলামাইয়া হরীক্ষা দিব, হাইর্বি নি তুই। মাইয়া জিদ্ ধইর্ছে, হশিক্ষণ নিব, মাষ্টরের হরীক্ষাও দিব । ও মাগ, দিনরাইত কী খাডান খাডে, গাধার খাড্নি, দরজা বন্ধ করি দিনের বেলায় হড়ে। কেরসিনের আকাল, রাইতের বেলায় হইড়ব ক্যাম্নে। শ্যাষমেশ মোমবাতি কিনি দিছে হেতির বাপ। হেই পরীক্ষায়ও হথ্যম অইলে বেক্গুনে ধইন্য ধইন্য কইর্ল। মাইয়া আঁর বাড়ির কাছের ইস্কুলের মাষ্টারনি অইল। জীবন যে কহ্ন বাঁকিবুঁকি যায়, কেউ টেরও হায় না, কিন্তু যে নিজের লইক্ষ্যে হৌঁচায়, হেই কেবল বুইজ্ত হারে কত কাডখড় হোড়াইলে এরুম দিন দেইখ্ত হারে। হথ্যম হথ্যম কত দুশ্চিন্তা আছিল, একে মাইয়া মানুষ, ইয়ার হরে হিন্দুর মাইয়া মুয়ের হরিক্ষায় কী জিগ্গাইতে কী জিগ্গায়, হেতি হাইর্ব ত। আঁর মাইয়া যে ভিত্রে ভিত্রে হড়ালেয়া করি এরুম ঝুনা নাইর্কলের মত অইছে, মা অই আঁই বুইজ্তাম হারি ন! আঁর মাইয়া অন্ রোজ হড়াইত যায়, আঁই ঘরের মইদ্যে বাইচ্চাগুনরে হড়াই আর ইয়ার হাঁকে চুলায় আগুন জ্বালাই রাঁধি। ধোঁয়া গল্গল্ করি উডে। আকাশের মুই উডি হুরা উডানের বাতাসে ছড়াই নাইর্কল সুয়ারির ডাইলের কাছে ছোডে।
দিন যত হার হর, মাইন্ষ্যের মন য্যান্ কেরুম হাল্টাই যার। আঁঙ্গ ঘরে আগে এক্কান ঘড়ি আর ক্যালেন্ডার আছিল, শহর তুন্ আনি দিছিল আঁর স্বামী। আনি কইছিল, সময় আর তারিখ দেই চইল্বা, তাইলে বুইজ্তে হাইর্বা, সময়ের কাম ক্যাম্নে সময়ে কইর্ত অয়। কতাহান হ্যাতেনে হাল্কা চালে কইছে বটে, অন্ বুজি এর এক্কান গভীর অর্থ আছে। কত কিছুই ত আমরা বুইজ্তাম্ হারি না। কন্নাই ঢাকা শহর আর কন্নাই আমরা, ক্যাম্নে আর বুজুম সরকার গরীব মাইন্ষ্যের কতা কতডা ভাবনা চিন্তা করের। আগে ত নিজেরা আলাদা করি ভাইব্তাম, হেই ভাব্না দূর অই গেছে। অন্ য্যান্ বেক্ কামে জমির মালিক, বর্গাদার, চাষা, কামার কুয়োর যুগী ধোয়া নাপিতের হোলারা এক লগে গায়ে গা লাগাই লাইন দেয়। বেক্গাইন অইছে অভাবে হড়ি। চাইর মুই খালি নাই নাই। ইংরাজরা যাইবার আগে যেমন দ্যাশের রস টানি নি আধা ছিবড়া করি দি গেছে, হাকিস্তানিরা হুরাডাই ছিবড়া করি দিছে, টাঁকশালে ট্যাঁয়া নাই, কারখানায় হুরান জমানার মেশিন, চাষের বীজ নাই, সার নাই, চিকিৎসায় ওষুধ নাই, হড়ইব যে বই কিনবার হইসা নাই। মাইন্ষ্যে বুজে না, সরকার ত বিনা হইসার বই দের, এক এক করি কইর্ব, ধইর্য্য ধরন লাইগ্ব। শ্রীরামকৃষ্ণ কইছে না, যে সয়, সে রয়! যে না সয়, সে নাশ হয়। মনের কতা কইছে, মাইন্ষ্যের মত কতা কইছে, মহাহুরুষ কিনা জানিনা, হণ্ডিত মানুষ, জ্ঞানী মানুষ, কে আর বুইজ্ল। আঁর হৌড়ি থাইক্লে কইত, বউ ঘডি কহ্নও উবুড় করি রাইছ্ না, তাইলে ধন মান দুইডাই যাইব। বুড়াবুড়িরা যা কয়, মন তুন্ কয়, হুনি হুনি শিখ্ছে, আঁঙ্গরে শিখাই যার, কামে ত কোনদিন আইব। মানুষ চলি যায়, কতা থাই যায়। আঁঙ্গ দ্যাশের ধন বেক্গুনে মিলি বাড়াইত অইব, একার কাম ত ন। মুজিব ত ভগবান ন, আল্লাহ ন, চাইলেই ঘডি ভরি দিব। মাইন্ষ্যের মন কোন মুই যার, বুজা মুশকিল, আজাইরা কতা কয়, গালমন্দ করে। অন্ যা অবস্থা অইছে নদীত্ বাঁন দিলেও মুশকিল, না দিলেও বেক্ ভাঁই চলি যাইব।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)