পাঠক মিত্র
কবিতায় ফিরে দেখা নজরুল
নজরুল বিদ্রোহী কবি বলে চিহ্নিত হলেন তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্মলগ্ন থেকেই । চিরদিনের মত তিনি পরিচিত হলেন এই নামেই । কিন্তু তাঁর বিদ্রোহ শুধু কি ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে ছিল । তা কিন্তু নয় । তাঁর নিজের কথায়, ‘আমি শুধু রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি নাই, সমাজের, জাতির দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে ।’ তাঁর জীবন চেতনার সত্য তরবারি দিয়ে আঘাত করেছেন নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, নারী-পুরুষ থেকে সমাজে সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে । তিনি শুধু সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আঘাত করেই ক্ষান্ত হননি । তিনি বলেছেন-
‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না–
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রনিবে না- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত ।’
এ বিদ্রোহ তাঁদেরই বিরুদ্ধে-
‘যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ ।’
সর্বনাশের ভবিষ্যত বাণী তাঁর আজকের সময়ের ব্যাখ্যায় অন্য দিক নির্দেশ করতে পারে । কিন্তু তিনি নিজেকে ভবিষ্যতের দিশারি হিসেবে দেখেননি । তাই তিনি বলেছেন–
‘বর্তমানের কবি আমি ভাই
ভবিষ্যতের নই নবি ।
কবি ও অকবি যাহা বল মোরে
মুখ বুজে আমি সই সবি ।’
তাঁর লেখার সাহিত্য মূল্য নিয়ে যাই সমালোচনা হয়েছে তিনি পরোয়া করেন নি তার । তিনি বলতে পেরেছেন–
‘রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না কো মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে ।
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু যাহারা আছ সুখে ।’
বড় ভাব নিয়ে তিনি গেয়ে যাননি মানবতার গান, সাম্যবাদের গান । যা কিছু গেয়েছেন তাঁর জীবন চেতনার গভীরতা থেকে গেয়েছেন । তাই ত তিনি বলতে পেরেছেন-
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান ।’
মানুষকে জাগিয়ে তোলার গান গেয়েছেন চারণ কবির বেশে । মানবতা ভিক্ষা চেয়েছেন দ্বারে দ্বারে । 1921 সালে কুমিল্লা শহরের এক প্রতিবাদ মিছিলে গেয়েছেন–
‘ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও
ওগো পুরবাসী
সন্তান দ্বারে উপবাসী ।
চাই মানবতা ভিক্ষা দাও ।’
এই গানে কেবল মানবতা ভিক্ষা চাননি । সত্য মানবকে জাগানোর ডাক দিয়েছেন তিনি ।
‘পুরুষ সিংহ জাগোরে–
সত্য মানব জাগোরে–
তন্দ্রা অলস জাগোরে.. ।’
ধূমকেতু পত্রিকার এক সংখ্যায় ‘ভিক্ষা দাও’ নামের এক সম্পাদকীয়তে লিখেছেন, ‘ভিক্ষা দাও, ওগো পুরবাসী ভিক্ষা দাও । তোমাদের একটি সোনার ছেলে ভিক্ষা দাও । আমাদের এমন একটি ছেলে দাও যে বলবে আমি ঘরের নই, আমি পরের । আমি আমার নই, আমি দেশের ।’ দেশের জন্য জাগিয়ে তোলার এই আহ্বান আজও হয়তো তার প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি ।
আসলে নজরুল মানুষের মধ্যে তার সত্য মানবকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন যাতে তাঁদের কাছে তাঁর প্রশ্নের জবাব তাঁরাই দিতে পারে । তাঁরাই খুঁজে নিতে পারে তাঁদের সকল মুক্তি, সাম্যের অধিকার । যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না । তাই তিনি প্রশ্ন রেখেছেন —
‘এক ধরণীর সন্তান কেন কেউ রাজা, কেউ প্রজা ?
প্রজা হয় শুধু রাজবিদ্রোহী, কিন্তু কাহারে কহি,
অন্যায় করে কেন হয় না ক’ রাজাও প্রজাদ্রোহী ।’
কবিগুরু যেমন নবীনদের, সবুজদের ডাক দিয়ে বলেছেন আধ-মরা প্রবীণদের ঘা মেরে বাঁচাতে, কবি নজরুল কিন্তু সমাজে কৃষক, শ্রমিক-মজুর থেকে সকল মানুষ যাঁরা আধ-মরা হয়ে বেঁচে আছে তাঁদের সকলকেই জেগে ওঠার ডাক দিয়েছেন । তিনি বলেছেন–
‘যত শ্রমিক শুষে নিঙরে প্রজা
রাজা উজির মারছে মজা ।’
এই রাজা উজিরকে চিনিয়ে দিতে চেয়েছেন আর একটু অন্যভাবে । খুব সোজা কথায় তিনি বলেছেন–
‘মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ,
যে যত ভন্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান
নিতি নব ছোরা গড়িয়া কসাই বলে জ্ঞান বিজ্ঞান ।’
আর আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁর দূরদৃষ্টি আজও তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে পারে না । তিনি বলেছেন–
‘যারা যত বড় ডাকাত দস্যু–
জোচ্চোর দাঙ্গাবাজ
তারা তত বড় সম্মানী গুণী
জাতি সংঘেতে আজ ।’
এই দাঙ্গাবাজেরা এখনো গণতন্ত্রের কথা বলে । গণতন্ত্র দেখিয়ে শান্তির কথা বলে আজও ।
নজরুল তাঁর সাহিত্যে কাব্যে অত্যাচারী আর শোষকের চরিত্র পরিষ্কার করে এমনভাবে বলেছেন, যা আর কেউ তেমনভাবে বলেন নি । আসলে তাঁর দুঃখক্লিষ্ট জীবনের দৃষ্টিতে তা দেখেছেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে । তিনি শুধু নিজের দেশের মানুষের জন্য নয়, সকল দেশের মানুষের শান্তি হরণকারীদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার ভাষা যুগিয়েছেন মানুষকে । তাই ত তিনি বলতে পারেন, ‘চাই না ধর্ম, চাই না কাম, চাই না মোক্ষ, সব হারাম আমাদের কাছে..।’ কবি-যে সকল মানুষের তাঁর কথাতেই বলতে হয় । তিনি বলেছেন, ‘আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশের, এই সমাজের নই, আমি সকল দেশের, সকল মানুষের ।’ স্বাধীনতার ভাগাভাগি দেশে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখলেন–
‘ভুল হয়ে গেছে
বিলকুল
আর সব কিছু
ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো
নজরুল ।’
তারপর আবার যখন নতুন দেশ বাংলাদেশ গড়ে উঠল, কবি তখন নির্বাক ও নিঃশব্দ । এ দেশ থেকে কবির ঠাঁই হয়ে গেল সেই দেশে । এ দেশ তখন নিরুত্তাপ ছিলেন । কিন্তু সেই দেশ তাঁকে জাতীয় কবির আসনে বসিয়ে দিলেন । কবির মৃত্যুর খবরে সেদিন এ দেশের মানুষ জানতে পেরেছিল কবি নতুন দেশে ছিলেন ।
অন্নদাশঙ্কর রায় আবার লিখলেন—
‘কেউ ভাবল না ইতিহাসে ফের
ভুল হয়ে গেল বিলকুল
এতকাল পরে ধর্মের নামে
ভাগ হয়ে গেল নজরুল ।’
যে কবি সকল দেশের সকল মানুষের সে ত ভাগ হতে পারে না । দেশের ভাগে, ধর্মের ভাগে সে ভাগ হতে পারে না । তবে কবি নজরুল ভাগ হতে পারে । যদিও সে ভাগ কোনো দেশের নয়, ধর্মের নয়, তা সকল দেশের, সকল ধর্মের কেবল ঘৃণিত, অত্যাচারিত, পদানত মানুষের ভাগে কবি । যাঁদের হয়ে কবি গান গেয়েছেন । কবির কথায়—
‘তোমারে সেবিতে হইল যাহারা
মজুর মুটে ও কুলি
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র
অঙ্গে মাখাল ধুলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা,
গাহি তাহাদেরি গান…।’