তপোপ্রিয়

একা হয়ে যাওয়া 

কথা বলতে শিখে মানুষের কিছু মন্দ ব্যাপারও হয়েছে, কথা বলার সঙ্গী না হলে তার চলে না।আর এই কথা বলার সঙ্গীকে নিয়েই যত গন্ডগোল। মনের মত সঙ্গী খুঁজে খুঁজে জীবন কেটে যায়, যার সঙ্গে কথা বলে আমার অন্তরের উঁচু-নিচু অসমান জায়গাগুলো সমতল হয়ে যাবে, যাকে কাছে পেয়ে নিজেকে কখনো একা লাগবে না। তেমন সঙ্গী জীবনে কজন খুঁজে পায় ? সেই মনের মত সঙ্গী দূরের কথা, একজন যেমন-তেমন সঙ্গী আমরা সারাজীবন পেতে চাই, সব সময়ের জন্য। তার সঙ্গে মনের মিল হোক আর না হোক, তর্ক-বিতর্ক হতে থাকুক, তবুও তাকে আমার চাই এই কারণে যে সে আমার একাকিত্ব দূর করবে।

এই সহজ কথাটা আমি একসময় একেবারেই বুঝতে পারতাম না। হরিমোহন আর নাড়ুগোপাল দুই বৃদ্ধকে দেখতাম আমার ছোটবেলায়, যখন-তখন হয়নয় কথায় তুলকালাম বেঁধে যেত দুজনের মধ্যে।কী ঝগড়ারে বাবা, অনেকটাই মনে হত অকারণে। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে একে-ওকে বলে বেড়াত সবসময়। এতই যদি একে অন্যকে অপছন্দ তো কথা বলা কেন আবার ? একবার ঝগড়ার পরই যদি কথা বলা বন্ধ হয়ে যেত তো বারবার ঝগড়া হওয়ার কোন প্রশ্ন ছিল না। তারা এবেলা ঝগড়া করে ওবেলা ভাব জমাত এবং শেষ করত আবার ঝগড়া দিয়ে। আবার ভাব জমিয়ে শেষে আবার ঝগড়া। লেগেই থাকত দুজনের মধ্যে এমন ব্যাপার-স্যাপার। ওদের এই স্বভাব দেখে আমি বেশ বিরক্ত হতাম। আমার মত আরও অনেকে বেশ নিন্দে করত দুজনের।
একদিন হঠাৎ খবর পেলাম নাড়ুগোপাল মারা গেছে। আগের দিন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে গিয়েছিল, সকালে আর সেই ঘুম ভাঙল না। লোকজন ভিড় জমাল বাড়িতে। শোক-দুঃখ কান্নাকাটি করল না কেউ বিশেষ।বয়স হয়েছিল, স্বাভাবিক ঘটনা।কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম মাত্রা পেল হরিমোহনের উপস্থিতিতে। সে এমন বুক চাপড়ে আকুল কান্না শুরু করল যে তাকে সামলানো দায় হল। যে লোকটার সঙ্গে দিনরাত তার এত বিরোধ তার জন্য এমন শোক দেখে অবাকই লাগল বেশ। কেউ কেউ আবার মুখও বেঁকাল। আমার মা সহানুভূতির গলায় বলল, ‘আসলে অনেকদিনের সঙ্গী তো, তাই এত দুঃখ।’ আমি বললাম, ‘সঙ্গী কী বলছ গো, বল শত্রু। দিনরাত তো ঝগড়া করে বেড়াত।’ মা ম্লান ভঙ্গিতে বলল, ‘তবুও তো সঙ্গী।’
মায়ের এই কথাটার মানে সেদিন ঠিক বোধগম্য হয়নি। আসল চমক তখনও বাকি ছিল। সেটা ঘটল দিন কয়েক পর।একেবারে আচমকা হরিমোহনেরও মৃত্যু হল। বয়স তারও হয়েছিল সত্যিকথা, মৃত্যুটা তাই অবাক হওয়ার কিছু নয়। কিন্তু নাড়ুগোপাল চলে যাওয়ার পরপরই তার ওভাবে চলে যাওয়াটা একটু যেন কেমন কেমন।  মা বলেছিল মনে আছে, ‘একজন সঙ্গী আরেকজনকে ডেকে নিল।’ আমি অবিশ্বাসের গলায় বলেছিলাম, ‘দূর, কী যে বলছ !’ মা বেশ আস্থাভরা গলায় জানিয়েছিল, ‘না রে বাবা, এই বয়সে সঙ্গীহারা হয়ে যাওয়ার কী কষ্ট তা যে সত্যিকারের সঙ্গী সে বোঝে।’   
আমি বুঝিনি সেদিন, আজ বুঝি। বুঝতে শুরু করেছিলাম আরও আগে থেকেই যখন মায়ের একাকিত্ব দূর করার জন্য সঙ্গী খোঁজা শুরু হয়েছিল আমার।সে যে কী দুরূহ কাজ তা আমিই জানি। এই শহর আর এই আধুনিক বাড়ি আমার মাকে সঙ্গীহীন বানিয়ে দিয়েছিল।আমি দিনের পর দিন মায়ের জন্য সঙ্গী খুঁজে গেছি, যার সাহচর্যে আমি বাড়ি না থাকলে মাকে একা একা দিন কাটাতে হবে না। আর কেবলই স্বপ্ন দেখতাম একদিন ঠিক মায়ের জন্য একটা আনন্দের পরিমন্ডল তৈরি করতে পারব যেখানে লোকজনের কোন অভাব থাকবে না। আজ আমি জানি স্বপ্নরা সফল হয় না, এবং এটাই এই জগতের নির্মম হলেও চরম সত্যি।
মানুষ জীবনে একা হয়ে যায়, বিশেষ করে শেষ বয়সে। কাজকর্ম কমে যেতে থাকে, শারীরিক ক্ষমতা ফুরিয়ে আসে আর লোকজনের সঙ্গে মেলামেশাও আগের মত হয় না। মাধব কর্মকারকে দেখেছিলাম চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর। বাড়ির সামনে রাস্তায় ঘুরে বেড়াত সারাদিন আর চেনা-অচেনা যাকে পেত তাকে পাকড়াও করে শুরু হত তার কথা বলা।শেষে এমন হল যে সবাই তাকে দূর থেকে দেখেই পালিয়ে যেত। তারপর সে শুরু করল আরও বেপরোয়া কাজকর্ম। যার-তার বাড়িতে যখন-তখন হাজির হয়ে বেল বাজাত। দরজা খুললেই কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সটান ঢুকে যেত ভিতরে। এটা-ওটা কথা বলতে বলতে বসে পড়ত কোথাও একটা। বসে শুরু হত অনর্গল কথা বলা। লোকেরা প্রথম প্রথম বাধ্য হত তাকে সঙ্গ দিতে ভদ্রতার খাতিরে। বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারত না। ইচ্ছে না থাকলেও কথা বলত বসে। কিন্তু সে আর কতদিন ? একসময় সবারই সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেল। বেল বাজালে লোকেরা আর দরজা খুলতে না। কেউ কেউ সরাসরি মুখের ওপর বলে দিত, ‘আপনি এভাবে হুটহাট এসে হাঙ্গামা করবেন না। লোকেদের তো কাজকর্ম থাকে নাকি ?’ এত অপমানেও দেখতাম তার তেমন শিক্ষা হত না। কিছুদিন স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চিতে বসে নানা লোকের সঙ্গে আড্ডা দিত। বাজারে-দোকানে ঘুরে বেড়াত কথা বলার সঙ্গী খুঁজে খুঁজে। সবাই যে তার ওপর এত বিরক্ত, দেখলে পালিয়ে যায় তার ঘ্যানঘেনে স্বভাবের জন্য সেসব সে বুঝেও বুঝতে চাইত না। কথা বলার সঙ্গী খুঁজে বেড়াত লোকটা। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত।
আমিও মায়ের জন্য কথা বলার লোক খুঁজে বেড়াতাম। যতদিন মা নিজের মত চলাফেরা করতে পারত, এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াত নিজের ক্ষমতায় আমার এই মাথাব্যথা ছিল না। নতুন পাড়ায় আসার পর দিব্যি মা নানাজনের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছিল।রোজই বিকেলের দিকে তাদের সঙ্গে গল্প করতে  বেরিয়ে যেত।পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথাবার্তা হত, আবার এর-ওর বাড়িতে গিয়েও গল্প করত। বেশি ভাব ছিল মালিনীর মায়ের সঙ্গে। আমরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম তার সামনে রাস্তার উল্টোদিকে এক বাড়ির ভাড়াটে। মেয়ে মালিনী স্কুলে নীচু ক্লাসে পড়ত আর তার বাবা কাজ করত কোন একটা অফিসে। মাকে মালিনীর মা মাসিমা বলে ডাকত। মুখোমুখি বাড়ি বলে দিনের যখন-তখন তার সঙ্গে দেখা হলেও জমিয়ে গল্প হত বিকেলে বা সন্ধেবেলা। দুজনেরই তখন কাজের চাপ থাকত না। ঘরে এসে মা আবার আমাকে প্রায়ই কী গল্প হল মালিনীর মায়ের সঙ্গে তার আদ্যোপান্ত বিবরণ দিত।
যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেখানেও মায়ের গল্প করার কত লোক ! বাড়ির মালিকের স্ত্রী কাজ করত একটা ওষুধের কোম্পানিতে, সারাদিন কাটত তার সেখানেই। সন্ধেবেলা ঘরে ফেরার সময় আমাদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সে মাকে ডেকে বলত, ‘মাসিমা কী করছেন ? চলে আসুন ওপরে।’ তার ডাকে সাড়া দিয়ে মা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যেত তিনতলায় বাড়িওলার ঘরে। খুব ভাব ছিল মায়ের ওই মহিলার সঙ্গে। ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প হত তাদের। একেক দিন রাত দশটা-এগারোটা বেজে যেত মায়ের নিচে নামতে নামতে।
বাড়ির দোতলায় থাকত আরেক ভাড়াটে পরিবার লক্ষ্মী-তারাপদ এবং তাদের দুই স্কুলপড়ুয়া মেয়ে পম্পা-রুম্পা। মায়ের সবচেয়ে বেশি ভাব ছিল তাদের সঙ্গে। লক্ষ্মী কাজ করত কেন্দ্রীয় সরকারের এক অফিসে আর তারাপদ কলকাতা হাইকোর্টে। তারা আমাদের আত্মীয়ই হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে লক্ষ্মীর বৃদ্ধা মা যখন এসে মেয়ের কাছে থাকতে লাগল তখন তারা আরও আপন হয়ে গেল। তার জন্য লক্ষ্মীর মায়ের অনেকটাই ভূমিকা। সে এমন ব্যস্ততা দেখাত যে মনে হত মা তার কতজন্মের চেনা আপনজন। আর লক্ষ্মীও মাসিমা-মাসিমা করে এমন করত যে মনে হত সে আমার মায়ের এক মেয়ে। আমি জীবনে অনাত্মীয় করোও এমন আন্তরিকতা প্রায় দেখিইনি আর। আজ বুঝি আমার মায়েরও অন্যকে আপন করে নেওয়ার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল। তাই লক্ষ্মীরা এত আপন হয়ে গিয়েছিল আমাদের। আর তাদের ঘরে তো মায়ের সারাদিনে যখন-তখন যাতায়াত। কথা বলার লোকের আবার কী অভাব ? তারা ছিল মায়ের প্রকৃত অর্থেই একেবারে নিজের লোক।
একতলাতেও আমাদের পাশে ছিল দুই ভাড়াটে। আমার সমবয়সী দেবুদের পরিবার আর রঞ্জনবাবু-দোলার মা। দেবুর সঙ্গে থাকত তার বাবা-মা ও দিদি। দোলার মায়ের সঙ্গে আমার মায়ের তেমন গল্প হত না, তবে তাদের ঘরে মা এবং অন্যরা যেত টিভি দেখতে। তবে দোতলায় লক্ষ্মীদের ঘরে গিয়েও টিভি দেখতে মা। ঘরে ঘরে তখন এত টিভি ছিল না। দেবুর মায়ের সঙ্গেও গল্প হত মায়ের, তবে তার সঙ্গে তত বেশি ঘনিষ্ঠতা দেখতাম না। আর কার সঙ্গে কী কী কথাবার্তা হত সেসব আবার আমাকে মা সোনাটা ঘরে এসে।
সেইসব মানুষগুলোকে আজ আর দেখতে পাই না। তারা সব অনেকদিন আগেই দূরে দূরে চলে গেছে, মরেও গেছে প্রায় সবাই। আমাদের নতুন বাড়ি হওয়ার অনেক আগে থেকেই এক এক করে লোকগুলো হারিয়ে যেতে শুরু করেছিল। মা তখনও চলাফেরা করতে পারে, কথা বলার লোকের এমন আকাল লাগেনি। দিদির মেয়েরা আমাদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছিল। তাদের নিয়ে মায়ের সারাদিন দিব্যি কেটে যেত। তারপর আমাদের নতুন বাড়ি হল, সেখানেও দিদির মেয়েরা সঙ্গে ছিল অনেকদিন। গোলমাল শুরু হল মা অসুস্থ হওয়ার পর। মায়ের চলাফেরা বন্ধ হল, দিদির মেয়েরা চলে গেল। তখন থেকেই মায়ের সঙ্গীর অভাব।
তার সুরাহা আমি আর করতে পারিনি কোনদিন। একসময় উপায়ান্তর হয়ে ভেবেছিলাম একটি অনাথ মেয়েকে দত্তক নিয়ে আসব।আমার কর্মস্থলে যাওয়ার ট্রেনে সহযাত্রী ছিল স্কুলশিক্ষক মৃণাল। তাকে ইচ্ছেটা জানালে সে তার অন্য এক স্কুলশিক্ষক বন্ধুর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল। মিশনারি অনাথ আশ্রমের সঙ্গে তার চেনা ছিল। একদিন সন্ধের পর আমরা শেয়ালদাতে তেমন এক হোমে গেলাম। কথাও বললাম সেখানকার এক সিস্টারের সঙ্গে। তারপর নানা কারণে আর এগোইনি। মৃনাল আমাকে বলেছিল, ‘তার চেয়ে আপনি একটা বিয়ে করে ফেলুন। মাসিমার আর লোকের অভাব থাকবে না।’ তার কথা তখন উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
তারপর মা আরও অসুস্থ হওয়ার পর একের পর এক আয়া রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেসময় কোন কোন আয়া ভাল জুট যেত কপালে, মায়ের কিছুদিন সঙ্গীহীনতা থাকত না।কিছু কিছু আয়া আবার খুব পাজি হত এবং মায়ের কষ্ট বেড়ে যেত তখন। সারাদিন আমাকে কাছে পেতে চাইত। বাইরে গেলে কখন আমি বাড়ি ফিরব তার পথ চেয়ে বসে থাকত। আজ বড় বেশি চোখে ভাসে সেই দৃশ্য, নিজের ঘরে বিছানায় বসে মা যতটা সম্ভব মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে আমার ঘরের দিকে, আমাকে দেখার আশায়। নিজে উঠে আসার সাহস হারিয়ে গেছে, আমাকে দেখলে ডাকবে তার কাছে যাওয়ার জন্য। সেই করুণ চোখের আকুল চাউনি মনে পড়লে আমার ভিতরে সব কেমন লন্ডভন্ড পাকাতে থাকে। আমার কেবলই মনে হতে থাকে, আবার কি কোন একদিন  মাকে তার ঘরে আমার আশায় উন্মুখ হয়ে বসে থাকতে দেখব না। আমাকে দেখতে পেলেই করুণ মুখ হাসিতে সাজিয়ে হাতছানি দিয়ে কাছে যাওয়ার জন্য ডাকবে না ?     
পেশাদার কথা বলার লোকের গল্প শুনতে পাই আজকাল। তারা ঘণ্টাপিছু টাকার বিনিময়ে সঙ্গ দেবে, গল্প করবে। কিছুদিন আগের পৃথিবীর মানুষের এই সমস্যা ছিল বলে তো শুনিনি কখনও। তখন তো পৃথিবীর জনসংখ্যা অনেক কম ছিল। এখন জনসংখ্যা পাঁচশ কোটি পেরিয়ে হাজার কোটি হওয়ার পথে। আর এখনই কথা বলার লোক ভাড়া করতে হবে টাকা দিয়ে ! পৃথিবীতে যত লোক বাড়ছে তত আমাকে একা হয়ে যেতে হচ্ছে। তাইতো সন্দেহ জাগে, যে প্রযুক্তির জগতে আমরা বাস করছি তা সত্যিই মানুষের জন্য উপকারী কিনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *