দীপান্বিতা
লু শুন
বিশ্ব সাহিত্যে আধুনিকতা বা মডার্নিজম বলতে আমরা সবাই বুঝি ইউরোপীয় সাহিত্য। যাঁরা একটু বেশি সাহিত্তানুরাগী তাঁরা লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের কথাও বলবেন। ইউরোপে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আধুনিকতা ব্যাপকভাবে আলোড়ন তোলে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। তবে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই দেখা যায় এর সূত্রপাত। শহরের প্রসার, জীবনযাপনে ভোগবাদের বৃদ্ধি, শিল্পের অবমূল্যায়ন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সাহিত্যে আধুনিকতাবাদ-এর জন্ম নেওয়ার প্রধান কারণ বলা যায় যার প্রকাশ ঘটে ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারি উপন্যাস ও বোদলেয়ার-এর লা ফ্লয়ারস দ্যু ম্যাল গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকায় আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে উনবিংশ শতকের শেষে যা ছিল মূলত কাব্যকেন্দ্রিক এবং এই আন্দোলনের মধ্যমণি ছিলেন কবি রুবেন দারিও ও তাঁর অনুগামীরা।
কিন্তু আমরা অনেকেই খবর রাখি না যে চৈনিক সাহিত্যেও আধুনিকতা দেখা দিয়েছিল প্রায় স্বাধীনভাবে এবং তা ছিল ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার তুলনায় শক্তিশালী। ১৮৯৯ সালে লিয়াং চিচাও নামে এক বুদ্ধিজীবী তাঁর লেখায়-সাহিত্যে চালু ঘষামাজা সনাতন ভাষার সঙ্গে নতুন প্রচলিত মাতৃভাষার মিশেল দেওয়ার কথা বলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই আধুনিকতা চৈনিক সাহিত্যে ব্যাপকভাবে আলোড়ন তোলে যার প্রাণপুরুষ ছিলেন চেন দুশিউ ও তাঁর সাহিত্যপত্র নিউ ইয়ুথ । চেন দুশিউ কনফুসিয়াস যুগের সনাতন সাহিত্য ভাষার চরম বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর পত্রিকায় হু শিহ-র একটি প্রবন্ধ সাহিত্য মহলে ঝড়ের আবহাওয়া সৃষ্টি করে। তিনি তাঁর প্রবন্ধে লেখকদের মাতৃভাষা বাই হুয়াতে সাহিত্যসৃষ্টির জন্য ডাক দেন। বাই হুয়া ভাষায় তিনি নিজেও বেশ কয়েকটি কবিতা লেখেন। এই সময়েই নিউ ইয়ুথ পত্রিকার এক নিয়মিত লেখক ডায়েরি অফ এ ম্যাড ম্যান বা উন্মাদের দিনলিপি নামে একটি গল্প ছাপতে পাঠান। এই গল্প তার আঙ্গিক ও বর্ণনাভঙ্গির স্বকীয়তা এবং বিষয়বস্তু ভাবনার আধুনিকতায় কেবল চৈনিক সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও এক সম্পদ বলে স্বীকৃতি পায়। এটাই চীন দেশে প্রকাশিত প্রথম আধুনিক ছোট গল্প । গল্পটির তীব্র স্যাটায়ার প্রাচীন চৈনিক নৈতিকতাকে ভয়ংকর ভাবে বিদ্ধ করে। গল্পে দেখা যায় এক বিকৃতমস্তিষ্ক লোক সবসময় সন্দেহে ভুগছে যে সব লোক তাকে মেরে খেয়ে ফেলার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। এই গল্পের লেখক হচ্ছেন লু শুন।
তাঁর আসল নাম ঝোউ শুরেন, লু শুন ছদ্মনাম। জন্ম ১৮৮১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। ঝেজিয়াং প্রদেশের শাওশিং-এ ছিল তাঁর বাবা-মায়ের বসবাস, যাঁদের অবস্থা যথেষ্ট পড়ে গিয়েছিল। লু শুন-এর ঠাকুরদা তাঁর পড়াশোনার ভার নেন। এমন একটি স্কুলে তিনি ভর্তি হন যেখানে শিক্ষাদীক্ষার ধরন-ধারন প্রাচীন চৈনিক শিক্ষা পদ্ধতির তুলনায় একটু উদার ছিল। এগারো বছর বয়স থেকেই তিনি সাহিত্য ও অন্য ধরনের নানা লেখা সাগ্রহে পড়তে থাকেন। কনফুসিয়াস যুগের সনাতন সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মধ্যে তখন থেকেই একটা বিরাগ দেখা দেয়।
বারো বছর বয়সে লু শুন-এর জীবনে এক পরিবর্তন আসে, ঠাকুরদার আশ্রয় ছেড়ে তিনি বাধ্য হন তাঁর মায়ের কাছে চলে যেতে। তাঁর ঠাকুরদার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে এবং আদালতে তা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়, ঠাকুরদাকে জেলে ধরে নিয়ে যায়। সম্পন্ন অবস্থা থেকে হঠাৎ দারিদ্র শুরু হলে তা কেমন দুঃসহ লু শুন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পান। বাস্তব পৃথিবীর দুঃখকষ্টের সঙ্গে এই যে তাঁর পরিচিতি এটাই পরবর্তী সময়ে লু শুন-এর সাহিত্যকে এত উজ্জ্বল করে তোলে।
লু শুন ও তাঁর বিখ্যাত ছোট গল্প উন্মাদের দিনলিপি নিয়ে আমাদের সাহিত্যজগতেও কম আলোচনা হয়নি। যেমন আগে বলা হয়েছে, এই গল্পে এক বিকৃতমস্তিষ্ক লোক রাতদিন ভাবছে সে এক নরখাদকের সমাজে বসবাস করছে। গল্পটির বর্ণনা হয়েছে প্রথম পুরুষে যা চৈনিক সাহিত্যে ইতিপূর্বে অনাস্বাদিত। নিউ ইয়ুথ সাহিত্যপত্রে গল্প ছাড়াও তাঁর কবিতা এবং প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশ পেত। পঞ্চাশটিরও বেশি ছোটগল্প তিনি এই নিউ ইয়ুথ সাহিত্যপত্রে লেখেন। দা আউটক্রাই এবং হেজিটেশন নামে তাঁর দুটি গল্প সংকলন প্রকাশ পায় যেখানে গল্পগুলিতে রয়েছে লু শুন-এর ছোটবেলায় শোনা লোক কাহিনী ও মিথের প্রভাব। দ্য ট্রু স্টোরি অফ আহ কিউ-কে বলা হয় লু শুন-এর শ্রেষ্ঠ কীর্তি যা মূলত একটি বড় গল্প বা নভেল। এখানে বলা হয়েছে গ্রাম থেকে আসা এক নিঃসঙ্গ শ্রমিকের কথা। তার সব উদ্যম ব্যর্থ হলেও আহ কিউ এমনই অন্ধ যে ভাবে তার ব্যর্থতাগুলি আসলে জয়। শেষে তার এই বোকামির জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। গল্পে লু শুন আসলে বর্ণনা করেন সমসাময়িক চৈনিক সমাজের দৃষ্টিসংকীর্ণতাকে।
একুশ বছর বয়সে লু শুন জাপানে যান। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর দেশবাসীকে ডাক্তারি শিখে সেবা করা। পড়াশোনার চাপ সত্বেও সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে তিনি সবসময় মত্ত থাকেন, পশ্চিম দুনিয়ার প্রকাশিত রচনাগুলি বেশি পড়েন। রাশিয়ার লেখক গোগোল ও চেকভ তাঁকে বেশ প্রভাবিত করেন।
প্রায় সাত বছর পর লু শুন স্বদেশে ফিরে মাধ্যমিক স্কুলে জীবন বিজ্ঞান পড়াবার কাজ নেন। ইতিমধ্যে তাঁর মনোভাব পাল্টে গিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতে থাকেন যে চিকিৎসাবিদ্যার চেয়ে সাহিত্য জনগণের সামাজিক উন্নয়নের অনেক বড় হাতিয়ার।এর দু’বছর পর তিনি শিল্পমন্ত্রকে এক চাকরিতে যোগ দেন ও বৌদ্ধসূত্রগুলিকে সংকলন করেন। কয়েক বছর পর জাতীয় বেইজিং বিশ্ববিদ্যালযয়ে চৈনিক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপকের চাকরি পান কিন্তু ১৯১৯ সালে ব্যক্তিগত কারণে বাড়িতে চলে আসেন ও পুরোদমে গল্প লিখতে থাকেন।
১৯২১ সালে আবার বেইজিং শহরে ফিরে এসে বেজিং নরমাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার চাকরি পান। এসময়েই প্রতিষ্ঠিত গল্পকার হিসেবে তিনি সর্বসাধারণের স্বীকৃতি লাভ করেন। উন্মাদের দিনলিপি প্রকাশিত হয়েছিল তার এক বছর আগেই।
লু শুন আদ্যন্ত একজন কমিউনিস্ট ছিলেন, কিন্তু কখনও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন নি। অন্যদিকে যেসব তরুণ কমিউনিস্ট লেখকরা সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার পক্ষে ছিলেন তাঁদেরও তিনি সমর্থন করতে পারতেন না। ১৯২৬ সালে তিনি বেজিং ছেড়ে চলে আসেন এবং ১৯৩০ সালে তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হয় লীগ অব লেফট উইং রাইটার । এরপর তিনি একের পর এক নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে থাকেন ও বহু জার্নালে সম্পাদনার কাজ পান। ১৯৩৩ সালে তাঁর যক্ষা হয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। যক্ষা ধরা পড়ার পর যখন তিনি বেশ অসুস্থ তখন শেন পাও নামে এক দৈনিক পত্রিকায় প্রায় রোজ নানা বিষয়ে আর্টিকেল লিখে গেছেন। তাঁর অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ার সময় কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে এবং তাঁকে জাতীয় আত্মা বলে সম্মান জানানো হয়। লু শুনকে এখন আধুনিক চৈনিক সাহিত্যের এক বড় স্তম্ভ বলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন।