সৌমিতা রায় চৌধুরী
পর্ব – ৫
১৯১৩ সালে দাদাসাহেব ফালকে নিবেদিত প্রথম নির্বাক ভারতীয় চলচ্চিত্র ছিল ‘রাজা হরিশচন্দ্র’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। অবিভক্ত ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের নাম ‘আলম আরা’। ১৯৩১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন ‘আরদেশির ইরানি’।
প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা শুরু হয় ১৯৩০ সালের প্রথম থেকে। বাজার ধরার আশায় উর্দু কিংবা ফরাসি ভাষায় চলচ্চিত্রগুলি প্রথমে নির্মাণ করা হত। ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানি প্রথমে এইগুলি নির্মাণ করত। বাংলা ভাষায় প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় ১৯৩১ সালে। ছবিটির নাম ‘জামাই ষষ্ঠী’। প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকী বোস এই চলচ্চিত্র গুলিতে অভিনয় ও পরিচালনা করতেন।
পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রথম বাংলা ছবি ‘দেনা পাওনা’ কলকাতার চিত্রা সিনেমা হলে মুক্তি পায় ১৯৩১ সালে। ১৯৩২ সালে ‘চণ্ডীদাস’ একটি উল্লেখযোগ্য সবাক চলচ্চিত্র। এর পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র জগত কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দামামা এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিনোদন জগত কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ শুরু হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিষয় নিয়ে কিছু সিনেমা জনমানসে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল।
প্রাচীন বাংলা সিনেমায় যে সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অবদান অসামান্য তাদের মধ্যে কানন দেবী অন্যতম। ১৯২৬ সালে জয়তিশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জয়দেব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে কানন দেবীর অভিনয় জীবন শুরু। তখন তিনি নিতান্তই কিশোরী। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করতে অভিনয় জগতে প্রবেশ। প্রথম জীবনে তাঁকে বহুবার প্রতারিতও হতে হয়েছে। এই সময় তিনি জোর বরাত এবং বাসবদত্তা নামে দু’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ছবি দু’টির কিছু বিষয়বস্তু তাঁর কাছে আপত্তিকর ছিল।
১৯৩৫ সালে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ চলচ্চিত্রে নিজেকে অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৩৭ সালে ‘মুক্তি’ ছবিটি তাঁর সফল জীবনের চাবিকাঠি। পরবর্তীকালে অসংখ্য চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন, যার বেশিরভাগই কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে। তাঁর অভিনীত ছবিগুলির মধ্যে ‘ঋষির প্রেম’, ‘কংশ বধ’, ‘মা’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘পরাজয়’, ‘যোগাযোগ’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘মেজদিদি’ উল্লেখযোগ্য।
কানন দেবী একজন সুগায়িকা ছিলেন। ওস্তাদ আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিক্ষা নেন। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম এবং পঙ্কজ কুমার মল্লিকের কাছেও তিনি গানের তালিম নেন। আধুনিক গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীতও তিনি গেয়েছিলেন যা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও খুশি করেছিল।
নিজের অভিনয় জীবনে কানন দেবী অনেকগুলি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। ‘পরিচয়’ এবং ‘শেষ উত্তর’ দু’টি চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালে বি এফ জে পুরস্কার পান। ১৯৬৮ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৭৬ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন। ২০১১ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ কানন দেবীর নামে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেন।
আসামের রাজপরিবারের সন্তান প্রমথেশ বড়ুয়া বাংলা চলচ্চিত্র জগতে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। কলকাতার হেয়ার স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। ইওরোপ ভ্রমণ করে এসে শান্তিনিকেতনে থাকার সময় ১৯২৯ সালে দেবকী কুমার বোস পরিচালিত ‘পঞ্চাশর’ নামে একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রূপালি পর্দায় পা রাখেন। ১৯৩২ সালে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তখন টকি যুগ। ‘বেঙ্গল — ১৯৮৩’ নামে একটি টকি নির্মাণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রকাশিত এটি একটি সাহসী প্রচেষ্টা। এই টকিটি চার দিনে নির্মাণ করা হয়েছিল। এই প্রচেষ্টা প্রমথেশ বড়ুয়ার দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় ছিল।
১৯৩৩ সালে বি এন সরকার নিউ থিয়েটারে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। এই ঘটনা চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তাঁকে কেরিয়ারের শীর্ষে পৌঁছে দেয়। ১৯৩৫ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া অভিনীত ‘দেবদাস’ মুক্তি পায়। এই সিনেমাটি কৌশল প্রবর্তনের জন্য বিশ্ব চলচ্চিত্রের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিবেচিত হয়। কৌশলটি ছিল “ইন্টারকাট টেলিপ্যাথি শট”। ‘মুক্তি’ ছিল প্রমথেশ বড়ুয়ার আরেকটি সাহসী ছবি। অসমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পটভূমিতে এই ছবির শুটিং হয়েছিল। রবীন্দ্রসংগীত এই চলচ্চিত্রে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘দেবদাস’। যা বাংলা ও হিন্দি উভয় ভাষাতেই নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া ‘মায়া’, ‘মঞ্জিল’, ‘মুক্তি’, ‘রজত জয়ন্তী’, ‘অধিকার’, ‘সুবহ শাম’, ‘রানী’, ‘জবাব’ ইত্যাদি। অভিনয়ের পাশাপাশি কিছু ছবি তিনি পরিচালনা করেছিলেন এবং কিছু ছবির চিত্রনাট্য তিনি নিজে রচনা করেছিলেন।
বাংলা চলচ্চিত্রকে প্রথম পর্যায়ে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে কানন দেবী ও প্রমথেশ বড়ুয়ার অবদান অনস্বীকার্য। পরবর্তীকালে আরো অনেক শিল্পী বাংলা চলচ্চিত্রকে স্বর্ণযুগের শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় পথ প্রশস্ত করেছিলেন এই দুই শিল্পী ও তাদের সহযোদ্ধারা।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)