অমিতাভ সরকার
যে মালা শুকায়
তালাত মাহমুদ
বাবা চাননি ছেলে চলচ্চিত্রে গান করুক। গান গাইলে বাড়ি ছাড়তে হবে- এইরকম অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছেলে গানকেই সারা জীবনের সঙ্গী করেছিলেন(ভাবুন সেই কতদিন আগের কথা, তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল, যোগাযোগ ব্যবস্থাও এত উন্নত ছিল না, আজকের এত সুযোগসুবিধা -এসব সবই তখন চিন্তার বাইরে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে তখন গান গাওয়াটাকে খুব একটা ভালোভাবে দেখা হতো না।)।
সেদিনের সেই সম্ভাবনাময় তরুণটি গানের উন্নতির জন্যে নিজের চেনা শহরও ছেড়েছিলেন। চলে আসেন কলকাতায় (প্রায় এক দশক পরে যখন চলচ্চিত্র জগতে গায়ক হিসাবে ছেলেটির বেশ নামডাক হয়, তখন পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা আবার স্বাভাবিক হয়েছিল।)। বোম্বেতে তখন যেমন কারোর নামের সঙ্গে কাপুর, খান -এসব থাকলে জনপ্রিয়তার বেশি সুযোগ ছিল, তেমনি কলকাতায় তখন চলছিল ‘কুমার’ ট্রেন্ড। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, স্মার্ট, সুদর্শন যুবকটি আসল নাম বদলে নাম নিলেন-‘তপন কুমার’।
‘তুমি এসো, ফিরে এসো।’ বাংলায় তাঁর গাওয়া প্রথম গান। বুঝতেই পাচ্ছেন কার কথা বলছি! মানুষটি আর কেউ নন, স্বয়ং তালাত মাহমুদ।
কী? এখনো চিনতে পারছেন না, তাইতো! আরো কয়েকটা গানের কথা বলি। ‘রূপের ঐ প্রদীপ জ্বেলে’,’তুমি সুন্দর যদি নাহি’,’ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে’,’যে আঁখিতে এত হাসি লুকানো’,’দুটি পাখি দুটি তীরে’ ..কি, গানগুলো শোনা শোনা লাগছে না!’ শ্রীকান্ত আচার্যের কণ্ঠে শুনেছেন, তাই না? এই সমস্ত গানগুলোর মূল শিল্পী আর কেউ নন, তিনি তালাত মাহমুদ, বাঙালির প্রিয় তপনকুমার (কারণ, উনি বাংলায় তপনকুমার নামে গান গেয়ে বিখ্যাত হন।) প্রায় দেড়শো মতো বাংলা গান গেয়েছেন। গানগুলো এত জনপ্রিয় হয়েছিল, যে পাঁচের দশকে বেতারে অনুরোধের আসরে যখন গানগুলো বাজতো, শ্রোতাদের মধ্যে এরকম ভাবনাও তৈরি হয়েছিল, তালাত মাহমুদ কী দুজন, বা তপনকুমার এবং তালাত মাহমুদ একই ব্যক্তি তো? সেই সময়ের নামকরা সব সুরকারদের সুরেই তালাত মাহমুদ গান গেয়েছেন- কমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, কানু ঘোষ, দুর্গা সেন, রবীন চ্যাটার্জী থেকে পরবর্তীকালে সুধীন দাশগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভি বালসারা, শ্যামল মিত্র -কে নেই! বাংলা গানগুলো শুনলে মনেই হবে না, যে শিল্পী অবাঙালি। এত স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ, নিবিড় ভাব- এত মিষ্টি আওয়াজ-যা অন্য কারোর থেকে তাঁকে আলাদা করে রেখেছে। একাধারে মন উজাড় করা গলা, আবার তেমনি চেহারা। চোখমুখে প্রতিভার দীপ্তি। তেমনি পরিশ্রমীও। কিন্তু গায়ক হয়েই যে এত বড়ো মাপের প্রতিষ্ঠা পাবেন, এতদূর ভাবেননি। এমনও হয়েছিল, যে একবার গান ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। শুনবেন সে গল্প! চলুন, শুরু করি।
অন্য সবার থেকে তালাত মাহমুদের গলার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল – কাঁপা কাঁপা অদ্ভুত একটা ভাব। শ্রোতারা এটাকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল। লখনউ, কলকাতার পর মুম্বাইতেও যখন গান করে নাম করে ফেললেন, তালাতের চরম সুখ্যাতি দেখে নিন্দুকেরা এরকমও বলতে শুরু করলো, যে ওর কাঁপা কাঁপা গলাটা আদপে কিছুই নয়-গাইতে গেলে নার্ভাস হয়ে যান, সেইজন্য এমন হয়। কতটা তালাত মাহমুদের কানে গেল। খুবই মুষড়ে পড়লেন। কিন্তু হাল ছাড়লেও যে চলবে না। তাহলে উপায়! তালাত মাহমুদ খুব কসরত শুরু করলেন, যাতে এই স্বতঃস্ফূর্ত কাঁপা কাঁপা ভাবটা একদমই না থাকে। এইসময় সংগীত পরিচালক অনিল বিশ্বাস, (যাঁর হাত ধরে একদিন ফিল্ম গানের জগতে গায়ক হিসাবে ওঁর নাম হয়েছিল) তালাত মাহমুদকে ডাকলেন। কারদার স্টুডিও, সেখানে গানের রেকর্ডিং চলছে। তালাত একের পর এক টেক দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কোনোটাই অনিল বিশ্বাসের পছন্দ হচ্ছে না। শেষে থাকতে না পেরে, তালাত মাহমুদের পিঠে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, শরীর কি খারাপ? তাহলে অন্যদিন রেকর্ডিং হবে। তালাত সবিনয় জানালেন, শরীর ঠিক আছে। কিন্তু কোথায় ভুল হচ্ছে, সেটা যদি বলে দেন তাহলে ঠিক আমি সংশোধন করে নেব। অনিল বিশ্বাস তালাতের সেই কাঁপা কাঁপা সিগনেচার স্টাইলটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। জানতে পেরে তালাত বললেন, যে নিজের কেরিয়ারকে বাঁচাতেই সচেতনভাবে যাতে কাঁপা কাঁপা ভাবটা না আসে, সেইজন্য প্রচুর পরিশ্রম করে ওই ভাবটা থেকে নিজের কণ্ঠকে বের করে এনেছেন। অনিল বিশ্বাস আশ্বস্ত করেছিলেন, লোকে ওরকম অনেক কিছু বলবে। কারোর কথায় নিজেকে বদলানোর দরকার নেই। ওই স্টাইলটা তোমার নিজস্ব, তাছাড়া শ্রোতারা সেটা যখন পছন্দও করছে, তখন তোমার অসুবিধাটা কোথায়। অনিল বিশ্বাসের কথায় তালাত মাহমুদ পুরানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন। সঙ্গীত জীবনের আয়ু আরও দেড় দশক বেড়ে গেল। তালাত মাহমুদের কঠিন সময়ে অনিল বিশ্বাস এভাবেই শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন, বলেই হয়তো…। আর থামতে হয়নি। একের পর এক কাজ, আর দারুণ দারুণ সব গান। এই সুরকার অনিল বিশ্বাসই তালাতকে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ, ভয়েস ফেড ইন, ফেড আউট করা শিখিয়ে ছিলেন, যাতে গানের ভাবও বজায় থাকবে, গানের মধ্যে শিল্পী সামান্য বিরামও পাবেন, আর শ্রোতারাও আবিষ্ট হয়ে শুনতে থাকবে।
তালাত মাহমুদ বরাবরই যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন-তা সে নিজের জীবনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারেই হোক বা সংগীত সাধনার ক্ষেত্রেই হোক। কলকাতায় এসে বাংলাকে ভালোবেসে ফেলেন, বাংলাভাষাকে ভালবেসে ফেলেন, বাংলার মানুষজনদেরও আপন করে নেন, যেমন -নিজের ছোটো ভাইয়ের মতো সাহায্য করেছেন গায়ক সুবীর সেনকে। (সুবীর সেন তখন বোম্বেতে গানের ক্যারিয়ারে মাথা তোলার চেষ্টা করছেন।)। আর একজনের কথা এই আলোচনায় স্বভাবতই এসে যায়। তিনি বাংলার মেয়ে লতিকা মল্লিক। ‘কাশীনাথ’-এর মতো কিছু বাংলা সিনেমায় অভিনয় করে অভিনেত্রী হিসেবে লতিকার কিছু নামডাক হচ্ছে। আবার উভয়েই পরস্পরের গুণগ্রাহী। কিন্তু লতিকা যে বাঙালি, তার ওপর খ্রিস্টান! বাড়ির লোক মেনে নেবে না। তালাত মাহমুদ কারোর পরোয়া করেননি। প্রেমঘটিত এই ‘নিকাহ্’(বিবাহ)-র খবর শুনে ওঁর বাবা প্রাথমিকভাবে অনেকটা মুষড়ে পড়লেও কয়েক বছর পরে পুত্রবধূকে গ্রহণ করেন, ভাঙা সংসারটা আবার ভালোভাবে জোড়া লাগে এবং এই দম্পতি বাকি জীবনটা বেশ সুখেই কাটিয়েছিলেন। লতিকার ১৯৫১ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারী ‘নাসিমা’ নামকরণ হয়, এবং ১৯৫৩ সালে পুত্র খালিদ আর ১৯৫৯ সালে কন্যা সাবিনার জন্ম হয়। তালাত মাহমুদের নাতনি সাহার জামান বর্তমানের একজন নামকরা সাংবাদিক(২০২৪ সালে তালাত মাহমুদের জন্মশতবর্ষে ‘তালাত মাহমুদ, দ্য ডেফিনিটিভ বায়োগ্রাফি’ বইটি লিখেছেন।)
তালাত মাহমুদের জন্ম ১৯২৪ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারী লখনউয়ের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা শের মনজুর মেহমুদ, মা রফিউন্নিসা। বাবা ছিলেন রামপুর এস্টেটের কর্মচারী, ছয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে গৃহবধূ রফিউন্নিসার সংসারে সংগীতের চল ছিল না। কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই উদারমনা পিসির উৎসাহে তালাত গানকে ভালোবেসে ফেলেন। হাতের কাছে যা রেকর্ড পেতেন, সব মনোযোগ সহকারে শুনতেন, এমনও হয়েছে, এমনকি সারারাত জেগেও শাস্ত্রীয় সংগীতের রসাস্বাদন করেছেন। কুন্দনলাল সায়গল ছিলেন তালাতের আইডল। বাবার আপত্তি থাকলেও ১৯৩০ সালে মরিস সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের পণ্ডিত এস.সি.আর.ভাটের কাছে ধ্রুপদ সংগীত শেখা শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে গজল গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। মাত্র ষোলো বছর বয়সে অল ইন্ডিয়া রেডিও লখনউতে
দাগ, মির, জিগরের গজল গাওয়ার সুযোগলাভ। স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের জন্য তাঁর এইচএমভি ৭৮ আরপিএম রেকর্ড রিলিজ করে (ফৈয়াজ হাসমির লেখা কমল দাশগুপ্ত সুর করা ‘সব দিন এক সমান নাহি থা)।
১৯৪৪ সালের সবচেয়ে বেশি তাঁর গানের রেকর্ড বিক্রি হয়। সারা ভারতব্যাপী গজল গায়ক হিসাবে তালাত মাহমুদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। লখনউ থেকে গজল গানের
পরিচিতির সুবাদে কলকাতায় আসা।
কলকাতায় এসে পঙ্কজ কুমার মল্লিক, প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া, সায়গল, এম এ রাউফ- এঁদের সুনজরে পড়ে যান। কলকাতা, লখনউ দুই জায়গাতেই সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন তখন। কিন্তু অভিনেতা হিসেবে তত সাড়া পাচ্ছেন না। নায়কোচিত চেহারার জন্য অনেকে শশী কাপুর, দিলীপ কুমাররা প্রথম প্রথম ওঁকে সিনেমার নায়কও ভাবতেন। নায়ক হিসাবে অভিনয়ের সুযোগও পেয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার কলকাতায় এলে গান হিট হলেও ছবি হিট হচ্ছিল না বলে আরও ভালো সুযোগের আশায় ১৯৪৯ সালে মুম্বাই চলে আসেন। এতে গায়ক হিসাবে আরও নাম ছড়িয়ে পড়লো। ১৯৫০ সাল তালাত মাহমুদের জীবনে একটি স্মরণীয় বছর। অনিল বিশ্বাসের ‘আরজু’-তে ‘অ্যায় দিল মুঝে অ্যাইসি জাগা লে চল’, নৌশাদের সুরে ‘বাবুল’ সিনেমায় ছয়টি গান, দিলীপ কুমারের লিপে ‘মেরা জীবন সাথী বিছড় গায়া’, খেমচন্দ্র প্রকাশের সুরে ‘জান পহেচান’ সিনেমায় ‘আরমান ভরে দিল কি লাগান’(গীতা দত্তর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে, যাতে প্রথম রাজ কাপুর নার্গিস জুটি পর্দায় ঠোঁট মেলান)-প্রভৃতি সুপার হিট সব গান এই বছরই মুক্তি পায়। এরপর একে একে মদনমোহন, শংকর জয়কিষান,সাজ্জাদ হুসেন, গুলাম মহম্মদ, খৈয়াম, শচীনদেব বর্মন, সলিল চৌধুরী সবার সুরেই বাজিমাত। হিন্দি গানের পাশাপাশি তালাত মাহমুদের উর্দু গজল, আধুনিক গান ছিল খুব বিখ্যাত। ‘কবে সে বুতকাদে সে’,’রাত তারোঁ নে সব’ -প্রভৃতি গজল আজও তেমনি মনোগ্রাহী। ‘জ্বলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে’,‘দিল ইয়ে নাদান’,’রাহি মতওয়ালে’,’যায়েঁ তো যায়েঁ কাহা’, ‘ফির ওহি শাম’ প্রভৃতি ফিল্মসংগীত চিরস্মরণীয়। মাড়োয়ারী, তেলেগু,অসমীয়া, মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, ভোজপুরি ইত্যাদি বারোটি ভাষায় গান গেয়েছেন। লতা মঙ্গেশকর, শামশাদ বেগম, গীতা দত্ত -অনেকের সঙ্গেই যেমন দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছেন, তেমনি -দেব আনন্দ, ভারতভূষণ, সুনীল দত্ত প্রকৃতি প্রচুর নায়কদের লিপেও গান গেয়েছিলেন।
তবে এটা না বলে উপায় নেই, আজ যখন বাঙালিরাই বাংলাটা ঠিকঠাক শিখতে চায় না, সেই কত বছর আগে তালাত মাহমুদ লখনউ থেকে এসে স্রেফ বাংলাকে ভালোবেসে, গানকে ভালোবেসে বাংলা ভাষাটা ভালো করে শিখেছিলেন। ‘যে মালা শুকায়’,’এলো কি নতুন কোনো’,’আলোতে ছায়াতে’,’আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে’,’যেথা রামধনু ওঠে’,’চাঁদের এতো আলো’,’নত মুখে কেন’- চিরকালীন এই সব গানে একটা শান্ত, পরিশীলিত ভাব, তেমনি ব্যঞ্জনাময়-শ্রোতাদের মধ্যে একটা নিবিড় অনুভব জাগিয়ে তোলে। (আশ্চর্য লাগে, যিনি এতো ভালো বাংলা বলতেন, তাঁকে দিয়ে কেন রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতি রেকর্ড করানোর কথা ভাবা হলো না? খুব জানতে ইচ্ছে করে, সমসাময়িক কালে কারোর কেন এই বিষয়টা মনে আসেনি? নাকি মনে আসলেও সেটা কোনো না কোনো কারণে কার্যকরী হয়নি?)
নিজেও খুব বেছে বেছে গান করতেন, গানের কথা, সুর মনোমত না হলে সে সব গান গাইতেন না। গানের ব্যাপারে কোনোরকম উচ্চাকাঙ্খা, সমঝোতা- এসব নিয়ে কোনোদিনই ভাবেননি। ভালোবাসা থেকেই গান গেয়ে গেছেন, এবং দেশবিদেশে অগুনতি শ্রোতাদের জয় করেছেন। (এমনও হয়েছে, অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠান করবেন। দেড়দিন আগেই তালাত মাহমুদের কনসার্টের সব টিকিট শেষ। তখন তালাত সাহেব সিনেমাতে খুব একটা গাইছেন, তাও না, প্রচারেও নেই- তবুও এত উন্মাদনা। একেই মনে হয় বলে শ্রোতাদের শিল্পীর প্রতি টান।)
তালাত মাহমুদের কণ্ঠ মানে এক ধরনের নিবিড় প্রশান্তি, যেখানে হইচই নেই, অনাবশ্যক আড়ম্বর নেই, আছে শুধু রুচিবোধ, শিক্ষা, মানুষের পাশে মানুষকে এক রাখার, প্রেমে বাঁধার নিটোল বাতাবরণ। এ প্রেম শাশ্বত, লোকদেখানো নয়, চাকচিক্য, অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছলতা এখানে একেবারেই অনুপস্থিত। সমকালে তাঁর মতো শিক্ষিত, বুদ্ধিদীপ্ত উচ্চ সংগীতশৈলী সম্পন্ন গায়ক দ্বিতীয় আর কেউ ছিলেন না। হিন্দুস্থানী গজলকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা, গজলের শ্রুতিগ্রাহ্য রূপদান-ইত্যাদি কারণে তালাত মাহমুদকে কিং অব গজল, গজল-ই-শাহেনশাহ ইত্যাদি নাম দেয়া হয়। (উল্লেখ্য, ভারতীয় সংগীতে অবদানের জন্য তালাত মাহমুদ ১৯৯২ সালে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হন।)
সেসময়ের চল অনুযায়ী তালাত মাহমুদ অভিনেতা-গায়ক হতেই চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত অভিনেতা হিসেবে বাংলা হিন্দি মিলিয়ে ষোলোটা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নায়িকারা ছিলেন, কাননবালা(কানন দেবী), ভারতী দেবী, মধুবালা, সুরাইয়া, মালা সিনহা, নূতন, শশীকলা, রূপমালা, নাদিরা,শ্যামা। সিনেমাগুলো ছিল- রাজলক্ষ্মী(১৯৪৫), তুম অর ম্যায়(১৯৪৭), সমাপ্তি(১৯৪৯), আরাম(১৯৫১),ঠোকর(১৯৫৩), দিল-ই-নাদান(১৯৫৩),ডাকবাবু(১৯৫৪), ওয়ারিস(১৯৫৪), রাফতার(১৯৫৫), দিওয়ালি কি রাত(১৯৫৬), এক গাঁও কি কাহানি(১৯৫৭), লালা রুখ(১৯৫৮), মালিক(১৯৫৮), সোনে কি চিড়িয়া(১৯৫৯)। এরমধ্যে তিনটে সিনেমা বক্স অফিসে হিট ছিল।
অভিনেতা হিসেবে সেরকম নাম করতে পারেননি, বলে ১৯৬০ সালের পরে অভিনয় ছেড়ে দিয়ে গানের দিকেই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন।
তাছাড়া সময়টাও তখন বদলে গেছিল। তালাত মাহমুদ সেটা অনুভবও করেছিলেন। ১৯৬০ সালের পর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির ফলে গজল, ব্যালাড, রোমান্টিক বা ট্রাজিক -এই সব ধরনের গানের প্রতি শ্রোতাদের আগ্রহ যেমন কমতে থাকে, মুকেশ, রফি প্রভৃতি ফিল্মি গায়কদেরও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, গভীর মেজাজের সিরিয়াস গান তৈরিও আগের তুলনায় কম হতে থাকায় তালাত মাহমুদের মতো প্রশিক্ষিত গায়কদের মানানসই গানও কম হতে থাকলে ফিল্মে গান করা কমিয়ে দেন, আগের তুলনায় বেছে বেছে সীমিত সংখ্যক গান রেকর্ড করা শুরু করেন। প্রথম রেকর্ড যেখানে ১৯৪১ সালে, তার ত্রিশ বছর পর ১৯৭১ সালে হিন্দি ফিল্মে শেষবারের মতো গাইলেও ১৯৮৭ তে উর্দু সিনেমায় হেমলতার সঙ্গে ভ্যালি-ই-আজমে ওঁকে কণ্ঠ দিতে শোনা যায়।
১৯৪১ থেকে ১৯৮০ সাল- এই চার দশকে তালাত মাহমুদের গানের সংখ্যা মোটে আটশো মতো। কিন্তু সংগীত সাধনা ছাড়েননি। প্রথম ভারতীয় ফিল্ম গায়ক হিসেবে ১৯৫৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পূর্ব আফ্রিকা সফর করেছেন। লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন -প্রভৃতি জায়গায় অনুষ্ঠান করে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, যেটা কোনোদিনই কমেনি। রেকর্ডিং ছেড়ে দেওয়ার পাঁচ বছর পরে ১৯৯১ সালের নেদারল্যান্ড সফরেও ছিল শ্রোতাদের উপচে পড়া ভিড়।
মানুষ হিসেবে তালাত মাহমুদ ছিলেন সহৃদয়, সহনশীল, এবং উদারমনস্ক। মানুষ হিসেবে খুব নম্র, ভদ্র ছিলেন। কিছু সেবামূলক কাজেও জড়িত ছিলেন(যেমন- সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠানে কোনোদিন পারিশ্রমিক নেননি। যাদের ভালবেসেছেন, তাদের জন্য নীরবে ত্যাগ স্বীকারও করেছেন, মুখে কিছু বলেননি।)। দেখতে যেমন সুদর্শন ছিলেন, পোশাক-আশাকও ছিল ফিটফাট, শুট-বুট টাই-কোট পরেও যেন সোজাসাপ্টা নিপাট ভালো মানুষ। কোনোদিন প্রচারের জন্য কাজ করেননি। পরবর্তীকালে প্রতিভা অনুযায়ী হয়তো সেভাবে প্রচারও পাননি, কিন্তু তা নিয়ে কোনো অভিযোগ করেছেন বলে শোনা যায়নি। তালাত মাহমুদের ঘনিষ্ঠরা বরাবরই তাঁকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসার আসনেই বসিয়ে এসেছেন। সমকালীন সব শিল্পীদের সঙ্গে
ছিল তাঁর নিবিড় সখ্য। হেমন্তজায়া বেলা মুখোপাধ্যায় একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অনেকেই হেমন্তর গলা নকল করে গান গেয়েছেন, বা হয়তো ভবিষ্যতেও গাইবেন, কিন্তু তালাত মাহমুদের গলা অনুকরণ আজ অবধি কেউ করতে পারেন নি আর ভবিষ্যতে পারবেনও না। ওই গলার এমনি মাধুর্য, এমনই দরদ, যেন স্রষ্টা তাঁর সমস্ত আবেগ ওখানেই ঢেলে দিয়েছেন। এখানেই ওঁর শ্রেষ্ঠত্ব, তাও এত পরিমিত সংখ্যক গান গেয়েও।
১৯৯৪ সালে ৯ই মে চুয়াত্তর বছর বয়সে তালাত মাহমুদ মুম্বাইয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এতদিন হয়ে গেছে, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সংগীত স্রষ্টাদের নিয়ে নানান অনুষ্ঠান হয়, কিন্তু কোথাও তালাত মাহমুদকে নিয়ে সেভাবে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা যায় না, বিভিন্ন রিয়েলিটি শোয়ে তালাত মাহমুদের গান তেমন গাইতে দেখা যায় না, আর গাইলেও গানগুলোর মূল শিল্পী হিসাবে তালাত মাহমুদের নামটুকু অনেকে উচ্চারণ করার সৌজন্যটুকু দেখাতে ভুলে যান, আজকাল অধিকাংশ শ্রোতা তালাত মাহমুদকে চেনেন, জানেনই না-রিমেক গানের আড়ালে কার্যত ঢাকা পড়ে গেছেন, কিন্তু আবরণটা সরানোর আন্তরিক ইচ্ছে ঠিক কারোরই যেন নেই, আগ্রহেরও যথেষ্ট অভাব।
একজন নিষ্ঠাবান শিল্পী যদি জন্মের শতবর্ষ পরেও এরকম অবহেলিত থাকেন, তাহলে তার দায় কি বাঙালি হিসেবে আমাদের নয়?