রম্যরচনা
অধ্যায় : আট
পাড়াকাঁপানো ঝগড়া হলো সেদিন আকন্ঠ জুৎসই আর সর্বস্ব লোপাটের মধ্যে। নাকি কে কার নামে কুকুর পুষতে শুরু করেছে এই নিয়ে ঝগড়া। নিজের নিজের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ঝগড়া হচ্ছিল তাদের, পাশাপাশি অন্যান্য বাড়ির লোকরাও তাদের ছাদে উঠে সেই ঝগড়া উপভোগ করছিল। আবার মাঝেমধ্যে অন্যান্য ছাদের লোকরা নানা কথা বলে উসকে দিচ্ছিল তাদের যাতে ঝগড়াটা চট করে না শেষ হয়ে যায়। ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত এমন দাঁড়ালো যে আকণ্ঠ জুৎসই আর সর্বস্ব লোপাট একই ছাদে থাকলে মারামারি হয়ে যেত। দুজনের দুটো আলাদা বাড়ির ছাদ এবং দুই ছাদের মধ্যে খানিকটা ব্যবধান থাকায় ব্যাপারটা সম্ভব হলো না। এই নিয়ে তাদের আক্ষেপের হুংকারও শোনা যাচ্ছিল ঝগড়ার ফাঁকে ফাঁকে। দুটো ছাদের মধ্যে একটা ব্রিজ থাকার প্রয়োজনীয়তা বোঝা যাচ্ছিল লোকেদের কথায়। থাকলে যে কেউ স্বচ্ছন্দে অন্যের ছাদে গিয়ে মারামারিটা করে ফেলতে পারত। দর্শকরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, সবাই মিলে চাঁদা তুলে তৎক্ষণাৎ দুটো বাড়ির ছাদ একটা ব্রিজ বানিয়ে যুক্ত করে দেওয়া সম্ভব কিনা। ঝগড়াটা কতক্ষণ চলবে এবং ব্রিজ বানানোর কাজটা তার আগেই সম্পন্ন হবে কি হবে না এই প্রশ্নের সামনে পড়ে শেষপর্যন্ত উদ্যোগটা নেওয়া আটকে গেল। ব্রিজ বানালেই একে অন্যের ছাদে মারামারি করতে যাবে কিনা সেটাও ছিল এক প্রশ্ন। তাছাড়া কেউ পাঁচ টাকার বেশি চাঁদাও দিতে রাজি হলো না। তাতে দেখা গেল সাকুল্য দু’শ টাকা পাওয়া যাবে যা দিয়ে ব্রিজ বানানো সম্ভব নয়। বাঁশ দিয়ে একটা মাচাও বানানো যাবে না। একটা বাঁশের লাঠি পেলেও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সেই লাঠি দিয়ে মারামারি করবে কিভাবে দুজনে কাছাকাছি না হতে পারলে? কয়েকটা মোটা দড়ি বা কাছি কিংবা একটা বাঁশও কেনা যায়, কিন্তু দড়ি বা বাঁশে ঝুলে তারা একে অন্যের ছাদে গিয়ে মারামারি করে আসবে এতটা উৎসাহ তাদের দেওয়া যাবে কিনা তাতেও সন্দেহ দেখা দিল। তখন সবাই মিলে আলোচনা করে বরং বিনা খরচে ঝগড়াটা দেখারই সিদ্ধান্ত নিল।
সবার মত হাচিয়া ফালও নিজের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে লোক দুটোর ঝগড়া দেখছিল। ওই দুজনেই তার শত্রু, তাই তারও ইচ্ছে করছিল একেকজনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে অন্যজনের সঙ্গে ঝগড়া করার। এভাবে দুটো শত্রুর ওপরই যৌথভাবে গায়ের ঝাল মেটানো যাবে, কিন্তু তাতে আবার দুটো শত্রুর প্রত্যেকটারই পক্ষ নেওয়ায় প্রত্যেকেরই সুবিধে হয়ে যাবে ভেবে সে পিছিয়ে এলো। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র, এই হাতে-গরম কৌশলটা সে কাজে লাগাতে পারছিল না বলে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। ঝগড়া-করা দুটো লোকই তার শত্রু হয়ে যাওয়ায় এই সমস্যা। কার পক্ষ নেবে, কার সঙ্গেই বা কার হয়ে ঝগড়া করবে? যেটাই করুক না কেন, কোন না কোন শত্রু সমর্থন পেয়ে যাবে। তাতে পরোক্ষভাবে হলেও তার শত্রুতার বদলা নেওয়া হবে না, এই ব্যাপারটা কি প্রাণে ধরে সহ্য করা যায়?
দুটো লোকই যে তার শত্রু সে বিষয়ে হাচিয়া ফাল নিঃসন্দেহ। আকণ্ঠ জুৎসই তাকে দেখলেই হেসে হেসে কুশল জিজ্ঞেস করে। হাসিটা বিদ্রূপের নাকি অভিসন্ধিমূলক, নাকি তাকে নিয়ে মজা করার উদ্দেশ্যে সেটা পরিষ্কার নয়। অকারণে কেউ কাউকে দেখে হাসবে কেন? তার চেহারা দেখে হাসি পাওয়ার কী আছে, সে জোকার নাকি হকার? আয়নায় নিজেকে বারবার দেখেও বুঝতে পারেনি হাচিয়া ফাল কেন তাকে দেখে আকন্ঠ জুৎসই হাসে। লোকটা তাকে দেখে হাসলেই সে প্রত্যেকবার বাড়িতে এসে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের চেহারায় হাস্যকর কোন উপাদান খুঁজে পায়নি।
ব্যাপারটা তাকে বারবার চিন্তায় ফেলে দেয়। তাছাড়া ওই কুশল জিজ্ঞেস করাটারই বা কী মতলব? সে ভালো আছে কি মন্দ আছে তা জানার অত কৌতুহল কেন লোকটার? তার কী খবর তাই বা দেখা হলে শোনার অত আগ্রহ কেন? তার সব হাঁড়ির খবর জেনে নিয়ে নিশ্চয়ই শত্রুতা করার ধান্দা। তাছাড়া লোকটা সাতকাহন করে নিজের যত ভালো ভালো খবর তাকে দেবে। সেটাই বা করে কেন খামোখা? তার ছেলে ভালো চাকরি পেয়ে বিদেশে গেছে, মেয়ের ভালো পাত্র পেয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে একটা নতুন গাড়ি কিনেছে, সপরিবারে আন্দামানে বেড়াতে যাবে, এসব ভালো ভালো খবর তাকে শোনানো কেন? উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। এসব শুনে যাতে হাচিয়া ফাল হিংসেতে জ্বলে আর অশান্তিতে ভোগে। এভাবে ভালো মানুষের রুপ ধরে যে কারো মনে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় সে শত্রু নয়তো কী?
সর্বস্ব লোপাটও এমনই এক বিচ্ছিরি শত্রু। সবসময়ই তার মুখ বেজার। দেখে মনে হবে যেন অজন্ম কনস্টিপেশনে ভুগছে। আজ পর্যন্ত যতবার দেখা হয়েছে কখনো তার মুখ প্রসন্ন দেখেনি, ভদ্রতা করে একটু হাসেওনি। সে ভালো কি মন্দ আছে এমন জিজ্ঞাসাও করেনি কোনদিন, এমন ছোটলোক। দেখা হলেই কেবল তার ও তার পরিবারের নানান অসুখ-বিসুখ, দুঃখ-কষ্ট আর হাজারটা সমস্যার ফিরিস্তি দেবে। এতসব অসুখ-বিসুখ, বিপদ-আপদের কাহিনী শুনিয়ে যাতে হাচিয়া ফালের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, যাতে তার মনখারাপ হয়। এসব শত্রু ছাড়া করে কেউ? আর কেবল তাকে বলবে নিজের সাংসারিক ও চাকরি-বাকরির যত অশান্তির কথা। সেসব ঘ্যানঘ্যানানি শুনিয়ে যদি থামত তাহলেও মানা যেত। নিজের অশান্তির কেচ্ছা সবিস্তারে বর্ণনা করে লোকটা তাকে বলে, ‘তুমি বাপু সুখে আছো। সংসারও নেই, কারোর গোলামিও করতে হয় না। দিব্যি মজায় জীবন কাটছে। তোমাকে দেখে হিংসে হয়।’ যে লোকটা স্পষ্ট বলে তাকে দেখে হিংসে হওয়ার কথা সে শত্রু হতে বাধ্য।
এই দুই প্রকারের শত্রু দুজনকে যুগপৎ উচিত শিক্ষা দেওয়ার কথা প্রায়ই ভাবে হাচিয়া ফাল। কিন্তু উপায় কিছু ভেবে পায় না। দুই শত্রুরই স্বভাব ও চরিত্র পরস্পরবিরোধী হওয়ায় দুজনকে একসঙ্গে শায়েস্তা করা যায় এমন একক কার্যকরী পদ্ধতি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা তাই তাকে রোজই হতাশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বর্জন করতে হয়। অনেক উপায়ের কথাই তার মাথায় আসত, যেমন দুটোকেই ধরে নাপিত ডেকে একসঙ্গে ন্যাড়া করে দিলে মন্দ হত না। কিন্তু কোন নাপিত কাজটা করতে রাজি হবে কি? তাছাড়া লোকদুটো কি ন্যাড়া হতে চাইবে? আবার একজন যদিবা রাজি হয় বিপরীত স্বভাবের অন্য আরেকজন রাজি হবে না নিঃসন্দেহে। রাজি না হলে তাদের জোরাজুরিও করা যাবে না। এইরকম নানা সমস্যার জন্য কোন শাস্তিকেই কাজে লাগানো যাচ্ছিল না।
আজ সেই দুটো শত্রুকে পরস্পর ঝগড়া করতে দেখে হাচিয়া ফাল হঠাৎ বুঝল, সে এতদিন যা চাইছিল তা কেমন আশ্চর্যভাবে ঘটে গেছে। এ অনেকটা মেঘ না চাইতেই জল। দুটো শত্রু পরস্পর ঝগড়া করছে মানে একসঙ্গে দুটো শত্রুই উপযুক্ত শিক্ষা পাচ্ছে। মহানন্দে হাচিয়া ফাল তাদের ঝগড়া দেখতে ও শুনতে লাগল।
প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)