রম্যরচনা

অধ্যায় : ছয়

অচেনা লোকরা শত্রু হলে তবুও সান্ত্বনা থাকে, কিন্তু যদি নিজের আপনজনকেও শত্রু হতে দেখা যায় তা কি প্রাণে সহ্য হয়? হাচিয়া ফালের একেবারে নিজের লোকেরাও শত্রু। যেমন, তার মা নাচিয়া ঝালের কথা আগেই বলা হয়েছে। তার বাবা ভাগিয়া ছাল তাকে উপদেশ-টুপদেশ দেয় দেখা হলেই, যদিও তার সঙ্গে দেখা হওয়া কালেভদ্রে ঘটে যেহেতু সে সবসময় সবার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। তো একদা তাকে সৌভাগ্যক্রমে হাতের কাছে পেয়ে ওইরকম সুকৌশলে পালিয়ে থাকার উপায়টি কী জানতে চেয়েছিল। এমনই লোকটার পালিয়ে যাওয়ার স্বভাব যে ছেলের ওই প্রশ্নের উত্তরটাকেও পালিয়ে নিয়ে চলে গেল। বাবা হোক আর যাই হোক, সেও নিঃসন্দেহে হাচিয়া ফালের শত্রু। না হলে কি বুঝতে পারত না যে উত্তরটা জানতে পারলে ছেলের সবিশেষ উপকার হবে? ছেলে তার শত্রুদের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পারবে? নিজের লোকরা সব শত্রু হয়ে যায় বা হয়ে আছে এই ভয়ে সে জন্মে বিয়ে করবে না ঠিক করেছে, পাছে না বউ হিসেবে একটা বাড়তি শত্রু উড়ে এসে জুড়ে বসে, একদঙ্গল ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়ে ঘরে শত্রুর শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়। এই নিয়ে তার মা নাচিয়া ঝালের সঙ্গে তার খটাখটি লেগেই আছে, যেহেতু মা তাকে দেখা হলেই বিয়ে করতে বলে। মা হয়ে ছেলেকে যে এমন কু-পরামর্শ দেয় তাকে শত্রু না ভাবার কোন কারণ আছে কি?

তো সেদিন তার এমনই এক আপনজন তার সঙ্গে দেখা করতে এল। খুব নিকট না হলেও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় তো বটেই। তারই সমবয়সী, নাম কাটিয়া তাল। সে এসে কথা নেই, বার্তা নেই, দুম করে প্রস্তাব দিল,

‘চলো, আমরা দুজনে মিলে একটা ব্যবসা করি। তোমার যা বুদ্ধি তাতে ভালোই লাভ হবে।’

নিজের বুদ্ধির প্রশংসা শুনে হাচিয়া ফাল বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সকলেই হয়। তো প্রসন্নচিত্তে প্রস্তাবটা শুনে সে সমর্থন করতে গিয়েই থেমে গেল কাটিয়া তালের পরবর্তী সংযোজন শুনে। সে বলল,

‘তোমার যেমন বুদ্ধি, তেমনি টাকা-পয়সা। তাই ব্যবসার জন্য আর চিন্তা করতে হবে না। তোমার বুদ্ধি আর টাকার জোরে ব্যবসাটা ভালোমতোই দাঁড়িয়ে যাবে।’

শুনে হাচিয়া ফাল কিঞ্চিৎ বিমর্ষ গলায় প্রশ্ন তুলল,

‘ব্যবসার সমস্ত টাকা আমি দেব নাকি?’

কাটিয়া তাল তাকে বোঝালো।

‘টাকা তো সব তোমাকেই দিতে হবে। পুরোটা বুদ্ধি যেহেতু তোমার টাকাও পুরোটা তোমারই হওয়া উচিত। যেহেতু তোমার বুদ্ধি থাকবে, আমার টাকা থাকলেই সেখানে মিসম্যাচ করে যাবে। তখনই সব ব্যবসা লাটে ওঠে যখন নানাজনের বুদ্ধি আর নানাজনের টাকা মিলেমিশে ঘোঁট পাকিয়ে যায়। ব্যবসাতে যার বুদ্ধি তার টাকা থাকাই হল সাফল্যের আসল কথা।’

শুনতে শুনতে হাচিয়া ফাল খুশি হবে কি হবে না, রাজি হবে কি হবে না বুঝতে পারছিল না। নিজের বুদ্ধির তারিফ শুনে খুশি হতে গিয়েও হওয়াটা আটকে যাচ্ছিল নিজেকে সমস্ত টাকা দিতে হবে জেনে। কিন্তু-কিন্তু করে সে প্রস্তাব রাখল,

‘তা এক কাজ করো। ব্যবসা থেকে আমার বুদ্ধি বাদ দাও, আমার টাকাও। তোমার টাকা আর তোমার বুদ্ধি লাগাও প্রথমে। পরে নাহয় আমার বুদ্ধি আর টাকা লাগানো যাবে। শুনে কাটিয়া তাল আর্তনাদ করে উঠল,

‘পাগল! ব্যবসা তাহলে গোড়াতেই লাটে উঠে যাবে। তোমার মত আমার অত বুদ্ধি আছে নাকি?’ 

এবার হাচিয়া ফালের আর কোন সংশয় রইল না। কাটিয়া তাল স্বমুখে স্বীকার করছে যে হাচিয়া ফালের মত তার অত বুদ্ধি নেই। এমন স্বীকারোক্তি শুনলে কে না উৎফুল্ল হয়? তো সে আর মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব না রেখে রাজি হয়ে প্রশ্ন তুলল,

‘কী ব্যবসা করবে বলে ঠিক করেছ?’

কাটিয়া তাল কিছুমাত্র না ভেবে জানালো,

‘কনসালটেন্সি ফার্ম। এখনকার ট্রেন্ড হচ্ছে এসব ব্যবসা। লোককে ধরে ধরে বলব, এটা করো ওটা করো। যেটা যে করবে তাতেই জড়িয়ে যাবে। তখন আবার এসে পরামর্শ চাইবে। আমরা পরামর্শ দেব, তার জন্য ফিজ নেব। এভাবে প্রত্যেকেই যেটা সে করবে তাতে কেবলই জড়িয়ে যেতে থাকবে আর আমাদের কাছে বারবার আসবে পরামর্শ নিতে। আমরাও তাকে পরামর্শ দিয়ে যাব আর সে আমাদের ফিজ দিতেই থাকবে।’

শুনে বেশ ভালই মনে হল মতলবটা। তবুও নিঃসন্দেহ হতে জিজ্ঞেস করল হাচিয়া ফাল,

‘লোক ধরে ধরে যে বলবে, এটা করো ওটা করো, এত লোক পাবে কোথায়?’

কাটিয়া তাল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল,

‘ওই ব্যাপারটা আমার ডিপার্টমেন্ট। তোমার বুদ্ধি আর টাকার সঙ্গে আমার কাজ হচ্ছে লোক ধরে আনা। তার জন্য চাই স্ট্রং নেটওয়ার্ক আর কানেকশনস্, ওটাই সবচেয়ে শক্ত কাজ। তোমাকে দিয়ে তা হবে না বলে ব্যবসার এই কঠিন দায়িত্বটা আমি নিলাম তুমি। কেবল বুদ্ধি আর টাকা দিয়েই খালাস।’

হাতিয়াফাল বুঝল যে কথাটা খুবই সত্যি। লোকের সঙ্গে যোগাযোগটাই আসল কাজ। নাহলে বহু লোকেরই তো বুদ্ধি আর টাকা আছে, তারা সবাই ব্যবসা করতে পারে না কেন? যেহেতু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার ঝক্কি সামলাতে পারে না তারা। তাই সে রাজি হয়ে গেল। ব্যবসা শুরু করার উপযুক্ত টাকা কাটিয়া তালকে দিয়ে দিল।

তারপর দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায় কাটিয়া তালের আর পাত্তা নেই। তাকে কিছুতেই ধরা যাচ্ছিল না। শেষমেষ বহু চেষ্টাচরিত্র করে তার নাগাল পাওয়া গেল। ব্যবসার কী হল জিজ্ঞেস করায় কাটিয়া তাল স্মার্টলি বলল,

‘ব্যবসা তো চলছে! ওই নিয়েই প্রচন্ড ব্যস্ত আছি বলে তোমার সঙ্গে দেখাও করতে সময় পাচ্ছি না। লোকজন নিয়ে ডিল করা কি সহজ কাজ? তুমি তো বুদ্ধি আর টাকা দিয়ে ঘরে বসে আরামে আছ। আমি ঘুরে ঘুরে খেটে খেটে মরে যাচ্ছি, খাওয়া-দাওয়ারও সময় পাচ্ছিনা।’

শুনে কিছুটা ভরসা পেলেও হাচিয়া ফাল সন্দেহ জানালো,

‘ব্যবসা যদি এমন রমরম করে চলছে তো ফল দেখছি না কেন? লাভ কোথায়?’

কাটিয়া তাল অবুঝকে বোঝানোর মত করে বলল,

‘ওই দেখো, ব্যবসার মূল কথাটাই তুমি জানো না। ব্যবসার জন্য খাটতে হচ্ছে না, কাজকর্ম নেই কিছু, সব করে মরছি আমি, ঘরে বসে তুমি একটু স্টাডি করলেও তো পারো। ব্যবসা নিয়ে একটু রিসার্চ করে আমাকে বুদ্ধি দেওয়া তো তোমার কাজ। সেটা করছ কোথায়? আমার ওপরই সব চাপিয়ে দিচ্ছ। বুদ্ধিটাও আমাকেই খরচ করতে হচ্ছে। আরে বাবা, ব্যবসাতে লাভ কি দুদিনেই পাওয়া যায়? পড়াশোনা করলে দেখতে পেতে যে জেসটেশন ল্যাগ বলে একটা ব্যাপার আছে, অর্থাৎ কিনা সব যোগাযোগ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করার সময়। সেই জেসটেশন ল্যাগ না পার হলে লাভ আসবে কোত্থেকে?’ 

দেখতে দেখতে বছর কেটে গেল, সেই জেসটেশন ল্যাগ আর কাটল না। তারপর সে খবর পেল, কাটিয়া তাল কী এক চাকরি নিয়ে ইউরোপের কোন এক দেশে চলে গেছে, তার ব্যবসার জন্য দেওয়া টাকাটা ফেরত না দিয়েই। তাকে একবার ভদ্রতা করে কিছু জানিয়ে যাবারও প্রয়োজন মনে করেনি। ঘরেই যদি এমন শত্রুরা থাকে তো হাচিয়া ফাল কোথায় যাবে? প্রতিভাস ম্যাগাজিন

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *