রম্যরচনা

অধ্যায় : পাঁচ 

শত্রু হওয়ার কোন নিয়ম নেই। থাকলে ভাল হত। তাহলে বোঝা যেত কে কিভাবে শত্রু হতে পারে। তেমন নিয়ম জানা থাকলে যেকোন মূল্যে তাকে হাচিয়া ফাল মেনে চলত। অনিয়মে-কুনিয়মে যখন তখন সবাই শত্রু হয়ে চলেছে তো চলেছেই। নিয়ম-টিয়ামের কোন তোয়াক্কা না করেই। বিপদটা সেখানেই। এই যে সবাই শত্রু হয়ে চলেছে তার তো একটা নীতি থাকতে হবে? নিয়ম-নীতি মানবে না, কেবল শত্রু হয়ে যাবে এ আবার কী কথা? 

একসময় হাচিয়া ফাল ভেবেছিল, কোন জীবিত প্রাণীর সঙ্গে সে সম্পর্ক রাখবে না। কোন মৃত প্রাণী বা মানুষের সঙ্গেও নয়। জীবিত বা মৃত সমস্ত প্রাণী ও মানুষকেই সে এড়িয়ে চলবে। মৃত ব্যক্তি বা প্রাণীর কথা উঠল এই জন্য যে সে দেখেছে, জীবিতদের মত মৃত মানুষ বা প্রাণীও শত্রু হতে ওস্তাদ। শত্রু হতে মৃত জীবরা জীবিতদের তুলনায় এককাঠি সরেস। জীবিত যারা তাদের দেখা যায়, ধরাছোঁয়ার উপায় আছে। কিন্তু মৃতদের না যায় দেখা, না যায় শোনা, ধরাছোঁয়ার প্রশ্নই নেই। তারা তাকে ভূত হয়ে ভয় দেখিয়ে শত্রুতা করে।

কারোর সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার কথা সে ভেবেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে অচল থাকতে পারল না। লোকরা গায়ে পড়ে এসে তার শত্রু হতে থাকে, সে যতই তাদের এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করুক না কেন। রাস্তাঘাটে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েও সে দেখেছে, লাভের লাভ হয় না কিছুই। লোকরা সেক্ষেত্রে তার বাড়ি বয়ে এসে শত্রু হতে থাকে। লোকের গায়ে পড়ে বাড়ি আসা সে কিভাবে আটকাবে? বাধা দিতে গেলে ঝগড়াঝাঁটি করতে হয়, তাতে শত্রুতা আরও বেড়ে যাবে। তাছাড়া সে নিজে ঝগড়াঝাঁটি করতে পারে না বিশেষ, সেটা করতে দক্ষতা আছে তার মা নাচিয়া ঝালের। এমনই কপাল যে তার মা নাচিয়া ঝালও তার শত্রু হয়ে বসে আছে। লোকের গায়ে পড়ে বাড়ি এসে শত্রু হওয়া আটকাতে সে একটা সিকিউরিটি গার্ড বা পাহারাদার রাখার কথা ভেবেছিল। রাখেনি এই কারণে যে সে জানত, সেই পাহারাদার ব্যাটাও তার শত্রু হয়ে যাবে নির্ঘাৎ। আর জীবিত লোকজনদের যদিওবা পাহারাদার দিয়ে সে আটকায় মৃত শত্রুদের আটকাবে কিভাবে? তারা আবার বাড়ির গেট বা দরজা-জানলা বন্ধ রাখলেও দিব্যি ঘরে ঢুকে যাওয়ার কায়দা জানে। তাদের আটকাতে তাহলে তাকে একটা ভূত পাহারাদার রাখতে হয়। সেই ভূত পাহারাদার সে পাবে কোথায়? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, মৃত পাহারাদার পেলেও সে তাকে কাজে বহাল করবে কি? সে শত্রু হয়ে যাবে না তার কি কোন গ্যারান্টি আছে? 

শত্রুদের এড়িয়ে চলতে নানা রকম পন্থার কথা দিনরাত ভাবে হাচিয়া ফাল। কোনটাই কাজের হয় না সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যাওয়ার কথা ভেবেও নাকাল হতে হয়েছিল। আরও সব অভিনব উপায়ের কথা ভেবেই চলেছে সে যেভাবেই হোক শত্রুদের নজর এড়িয়ে থাকার জন্য। কোনমতেই সে চায়না কোন শত্রুর মুখোমুখি হতে। সেটা সম্ভব হয় না কারণ, শত্রু নয় এমন কাউকে সে দেখেনি আজ পর্যন্ত।

রাস্তায় বার হলে তো নয়ই, বাড়িতে থেকেও যখন শত্রুদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছিল না তখন সে একবার ভেবেছিল যে নিজের বাড়িতে একটা বাঙ্কার বা গুপ্তকক্ষ বানিয়ে লুকিয়ে থাকলে মন্দ হত না। একটা গুপ্তকক্ষ বানিয়ে বসবাস করলে শত্রুরা তার পাত্তা পেতনা একেবারেই। ঝামেলাটা অবশ্য অন্য জায়গায়। বাঙ্কার হোক বা গুপ্তকক্ষ, সেটা বানাতে গেলে মিস্ত্রি-মজুর ধরে আনতে হবে। সে ব্যাটারাও তো তার শত্রু হয়ে যাবে। হতে বাধ্য। তার জ্বলন্ত উদাহরণও রয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে ঘরের দেয়ালে রং করার জন্য তাকে মিস্ত্রি-মজুর লাগাতে হয়েছিল। জন্মে চিন্তা না সে কাউকে। তাদের সঙ্গে বাড়িজমি, ধারদেনা বা বিশেষ কোন সুযোগ-সুবিধে নিয়ে কোন বিবাদ-বিসম্বাদ থাকার কথা নয় এবং ছিলও না। তার বাড়িতে রং করার কাজে ডেকে সে বরং তাদের উপকারই করেছিল কাজ পাওয়ার সুযোগ পাইয়ে দিয়ে। তার জন্য তাদের চাহিদামত যথেষ্ট টাকা-পয়সাও দিয়েছিল, কার্পণ্য বা দরাদরি করেনি, অথচ তারা অকারণে তার শত্রু হয়ে গিয়েছিল। সেটা সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল বাড়িতে রং করার কাজ শুরু হওয়ার পর। রোজ তারা তার সঙ্গে ডেকে ডেকে আলাপ করবে। কাজ করবি কর্ না বাবা, এত আড্ডা মারার শখ কেন তার সঙ্গে? সে কি তাদের ইয়ারদোস্ত নাকি ব্যবসার পার্টনার? ভাইবন্ধু, আত্মীয়ও নয়। তবুও তার সঙ্গে দেখা হলেই নানা প্রশ্ন। ‘বাবু, এত বড় বাড়িতে একা থাকেন?’ বা, ‘আপনি চাকরি করেন?’ বা, ‘আপনার আত্মীয়রা থাকে কোথায়? বিয়ে-শাদী করেননি কেন?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বিরক্তি দেখিয়ে ধমক-ধামক মেরেও লাভ হয়নি। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল যে তার সব গোপনকথা জেনে নিয়ে ওদের মতলব ছিল পাকাপোক্ত শত্রু হয়ে যাওয়া। একেকবার ইচ্ছে হয়েছিল যে মাঝপথে কাজ বন্ধ করে ঘাড় ধরে সব কটাকে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ঘরে রং করাটা আধখ্যাঁচড়া হয়ে পড়ে থাকবে বলে মুখ বুঝে ওদের শত্রুতা সহ্য করে গিয়েছিল। তারা যে শত্রু ছিল তার প্রমাণ পেয়েছিল তাদের কাজ করার সময় বাড়ি-ঘরদোর নোংরা করে যাওয়ার বহর দেখে। আর কাজ শেষ করার পর সে দেখল, যে যে দেয়ালে সে যেমন যেমন বলেছিল সব তেমন তেমনই করে গেছে লোকগুলো। একটু অন্যরকম কিছুই মাথা খাটিয়ে করে যায়নি যা সে নিজে ভাবতে পারেনি। ইচ্ছে করলেই আরও ভাল কিছু করতেই পারত যেহেতু তাদের অভিজ্ঞতা তার চেয়ে বেশি। করেনি। এ শত্রুতা ছাড়া আর কী হতে পারে?

তাই বাড়িতে আবার মিস্ত্রি-মজুর ডেকে এনে বাঙ্কার কিংবা গুপ্তকক্ষ বানাবার উপায় নেই। তাতে আবার একদল নতুন শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। তাছাড়া তারা শত্রুতা করে ব্যাপারটা সবাইকে বলে বেড়ালে তার বাঙ্কার বা গুপ্তকক্ষ বানাবার মূল উদ্দেশ্যটাই মাটি হয়ে যাবে। রংমিস্ত্রিরাও এমনটাই করেছিল। তার ঘর রং করার ব্যাপারটা শত্রুতা করে রটিয়ে দিয়েছিল সর্বত্র। রাজ্যসুদ্ধ সবাই জেনে গিয়েছিল যে তার ঘরে রং করা হচ্ছে। আর এই নিয়ে লোকের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে তার পাগল হওয়ার জোগাড়। আসলে সবাই তো তার শত্রু আর তাকে হিংসে করে। সে যে ঘরে নতুন রং লাগিয়ে আরামে থাকবে সেটা কি কারও সহ্য হয় প্রাণে? 

অতএব বাঙ্কার বা গুপ্তকক্ষ বানানো যাবেনা। তাহলে শত্রুদের হাত থেকে আত্মগোপন করে লুকিয়ে থাকার জন্য সে কি একটা গর্ত বানিয়ে নেবে নিজের হাতে? এটা বেশ পছন্দসই মনে হল। এ নিয়ে পরে নাহয় ভেবেচিন্তে দেখা যাবে কিভাবে একা একা গর্তটা কবে কোথায় খুঁড়বে সে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *