রম্যরচনা

অধ্যায় : চার

এত এত শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে জীবনযাপন করা খুবই দুঃসহ কাজ বলে হাচিয়া ফাল একবার ঠিক করেছিল, সে সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। তার এই সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটাতে মোটেই কোন ধর্মকর্ম করার বাসনা ছিল না, কারণ তার বাবা ভাগিয়া ছাল তাকে বলে রেখেছিল,

‘দ্যাখ্ হাচিয়া, ধর্মকর্ম করা খুব জটিল কাজ। ওসব করলে লাইফ হেল হয়ে যাবে।’

বাবার সেই উপদেশটা মনে আছে তার। তাই সে সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিল শত্রু দেখে দেখে সংসারের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিবাগী হওয়ার বাসনায়।

কিন্তু বললেই তো আর চট করে সন্ন্যাসী হওয়া যায় না, তার জন্য কিছু জোগাড়-যন্তর দরকার। সন্ন্যাসী হতে চাইলে কী করা উচিত সে ধারণা ছিল না তার। সন্ন্যাসী হওয়ার সহজ উপায় বিষয়ক কোন বইটই আছে কিনা খোঁজাখুঁজি করে দেখল বিস্তর। পাওয়া গেল না।

দুর্ভাগ্যক্রমে, মনের ইচ্ছেটা সে ব্যক্ত করে ফেলেছিল কয়েকজনের কাছে। তারা সবাই তাকে বোঝাতে লাগল যে সন্ন্যাসী হওয়া অতীব শক্ত কাজ। এসব পোকা মাথায় না থাকলেই ভালো, লোকগুলিকে সে হিতাকাঙ্খী ভেবে ভুল করেছিল। দেখা গেল যে এরা সবাই তার শত্রু। নাহলে তারা তাকে সন্ন্যাসী না হওয়ার কুপরামর্শ দেবে কেন? 

অনেক ভাবনাচিন্তা করে সে বুঝতে পারল যে একজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। তার কাছেই জানা যেতে পারে কিভাবে সন্ন্যাসী হওয়া যায়। এইসব ভাবনাচিন্তা তাকে একা একাই করতে হয়। কারো সঙ্গে পরামর্শ করার কোন উপায় নেই। যেহেতু সবাই তার শত্রু, তাই কেউ তাকে হিতকথা বলবে যাতে মঙ্গল হবে, এমন অবিশ্বাস্য ব্যাপার সে কস্মিনকালেও মনে ঠাঁই দেয় না।

যাই হোক, একটা সন্ন্যাসী খুঁজে তার সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্তটাই সে পাকাপোক্ত করল। আর যাই হোক, কোন সন্ন্যাসী অন্তত তার শত্রু হবে না এ বিশ্বাস তার ছিল। সন্ন্যাসীরা ধর্মকর্ম নিয়ে থাকে, লোকের অমঙ্গল চিন্তা করে না। তারা লোকের উপকারই করে থাকে বলে সে জানে। তাছাড়া সে তো আর লোকটার কাছে কোন উপকার চাইতে যাবে না, কেবল জানতে যাবে সন্ন্যাসী হওয়ার উপায়। সেটা না বলার কোন কারণ নেই, আর এই সামান্য ব্যাপারটা জানাবার জন্য সে নিশ্চয় তার কাছে কোন পারিশ্রমিক বা ফিজ দাবি করবে না। সেসব না হয় পরে দেখা যাবে। এখন প্রথম প্রশ্ন প্রথমে। সন্ন্যাসী কোথায় পাওয়া যায়? 

সন্ন্যাসী কোথায় থাকে? সে রাস্তাঘাটে ঘুরতে বেরিয়ে কোন সন্ন্যাসীকে দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না। হরদম যে দেখেনা সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সন্ন্যাসীদের জন্য কোন বাজারও নির্দিষ্ট করা নেই যে সেখানে গেলে তাদের সে পেয়ে যাবে। আগেকার দিন হলেও কথা ছিল। তখন সে জানে সন্ন্যাসীরা বনে-জঙ্গলে থাকত, আশ্রম বানিয়ে ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করত। আজকাল জঙ্গলে গেলে সন্ন্যাসীদের দেখা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। জঙ্গল কেটে লোকেরা এমন সাফ করে দিচ্ছে যে পশুপাখিরও পাত্তা পাওয়া যায় না, এমনকি, জঙ্গলে আজকাল গাছপালাও নেই বললেই চলে। তাই জঙ্গলে গিয়ে সন্ন্যাসীর খোঁজ করাটা যে বেকার হবে সেটা বুঝতে জঙ্গল-বিশারদ হতে হবে না। সন্ন্যাসীরা আগে পাহাড়-পর্বতের গুহাতেও বসবাস করত। বর্তমানে আর তারা গুহাবাসী নয় এটা সে জানে, জানে না যেটা তা হল সন্ন্যাসীদের এখনকার জীবনযাপন এবং গতিবিধি। পাহাড়ে-পর্বতে গেলে হয়ত দু-পাঁচটা সন্ন্যাসী পেলেও পাওয়া যেতে পারে, তবে অতটা খোঁজাখুঁজি করার ইচ্ছে বা উদ্দম তার নেই। পৃথিবীর মানুষ যে হারে আধুনিক হয়ে উঠছে তাতে সন্ন্যাসীরাও নিশ্চয়ই সমান তালে পাল্লা দেবে। এইসব আধুনিক সন্ন্যাসীরা কেমন হবে সেটাও একটা চিন্তার বিষয়। 

হাচিয়া ফাল এভাবে কিছুদিন সন্ন্যাসীদের নিয়ে পড়ে রইল, তাদের নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালাল ঘরে বসে ভেবে ভেবে। তারপর তার মাথায় এল, তীর্থক্ষেত্রে সন্ন্যাসীদের অবশ্যই দেখা পাওয়া যাবে। তাছাড়া তারা কোন এক ধর্মস্থানে থাকবেই। যেকোন একটা সন্ন্যাসী পাওয়া নিয়ে কথা, যেখানে খুশি থাকুক সে। যত সহজে তাকে পাওয়া যাবে ততই মঙ্গল।  

দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে একদিন উদ্যোগ করে হাচিয়া ফাল একটা ধর্মস্থানে গিয়ে হাজির হল। সৌভাগ্যক্রমে সন্ন্যাসী কয়েকজনকে পেয়েও গেল সে। এখন আবার নতুন সমস্যা। আগে একজনকেই পাচ্ছিল না আর এখন একাধিক। কাকে ছেড়ে কার কাছে যাবে? দেখে কি বোঝা যায় কে সঠিক হবে? খেয়ে তো দেখার উপায় নেই কে ভালো কে মন্দ! যা থাকে কপালে ভেবে সে একজনকে গিয়ে পাকড়াও করল। ওপর ওপর দেখে মনে হল লোকটা তেমন মন্দ নয়। রক্তবস্ত্র পরিহিত এবং মাথায় জটাজুট, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। এমন জবরজং পোশাক হলেও চেহারায় শান্তশিষ্ট এবং রোগাটে। রেগে গিয়ে তেড়ে মারতে এলেও অনায়াসে পালিয়ে বাঁচা যাবে।

সন্ন্যাসীর সামনে উপস্থিত হয়ে কিছুটা ভয়ে ভয়েই হাচিয়া ফাল তার মতলব জানাল। লোকটা নিশ্চুপ থেকে আপাদমস্তক তাকে দেখে একটা হাহাকারমিশ্রিত হাসিতে দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে জিজ্ঞেস করল, 

‘সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছে? লেখাপড়া কদ্দুর?’ 

সন্ন্যাসী হতে গেলে লেখাপড়া করতে হবে জানা ছিল না হাচিয়া ফালের। সে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানাল,

‘তেমন বেশি নয়। বেশি করতাম, কিন্তু করতে পারলাম না শিক্ষকরা সব আমার শত্রু হয়ে গেল বলে। তারা কেবল আমাকে পরীক্ষাগুলোতে ফেল করিয়ে দিত।’ 

শুনে সন্ন্যাসী আবার হাহাকার করে হেসে উঠল। বলল,

‘উত্তম। আমিও লেখাপড়া করিনি। লেখাপড়া করলে সন্ন্যাসী হওয়ার ব্যাঘাত ঘটে।’

শুনে হাচিয়া ফাল খুশি হতে যাবে যখন সেই সন্ন্যাসী পিলে চমকানো গলায় ঘোষণা করল,

‘সন্ন্যাসী হতে গেলে তোকে ঘর-সংসার ছাড়তে হবে। পারবি?’

এইখানে তার মনে সন্দেহের উদ্রেক হল। সে জানতে গেছে সন্ন্যাসী হওয়ার উপায়, ঘরবাড়ি ছাড়ার প্রশ্ন উঠছে কেন? লোকটার মতলবটা কী? মনে মনে এমন জিজ্ঞাসা রেখে সে সতর্ক হতে থাকলে সেই সন্ন্যাসী বিকট এক হুঙ্কার ছেড়ে বলল,

‘স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ত্যাগ করতে হবে। পারবি?’

‘আমার সেসব নেই।’

অতি সাবধানে উত্তর দিল সে। সন্ন্যাসীর হুঙ্কার শোনা গেল আবার,

‘উত্তম। তুই তাহলে সন্ন্যাসী হওয়ার যাত্রায় এক পা এগিয়ে গেছিস। বাকি রইল আর একটা পা। সেটা তুলে নিতে পারলেই তোর মনোবাসনা পূর্ণ হবে। তোর ঘরবাড়ি আছে ?’

ততক্ষণে হাচিয়া ফাল বুঝতে শুরু করেছে যে এই সন্ন্যাসীটাও তার শত্রু হতে চলেছে। না হলে অমন বীভৎস হাসি হাসবে কেন? সে সন্ন্যাসী হতে চায় এতে হাসির কী হল? তাছাড়া আগ বাড়িয়ে এতসব অবান্তর প্রসঙ্গের উত্থাপন কেন? অতএব এর কাছে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা এই সন্দেহটা বাস্তব হতে লাগল। তবুও সে সন্ন্যাসীর শেষ প্রশ্নের উত্তরে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে জানাল যে বাড়িঘর আছে তার। সঙ্গে সঙ্গে তাকে লক্ষ্য করে ধেয়ে এল সন্ন্যাসীর বাক্যবাণ,

‘থাকা মানেই পাপের সংস্পর্শে থাকা। সন্ন্যাসী হতে চাইলে তোকে এক্ষুনি এই পাপের বোঝা ঘাড় থেকে ফেলে দিতে হবে। তুই এক কাজ কর্, তোর বাড়িঘর যা আছে তা দানধ্যান করে দে। তাহলেই তুই বাকি পা-টা তুলে নিতে পারবি, মুক্তপুরুষ হয়ে যাবি। তোর সন্ন্যাসী হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। কাকে বাড়িঘর দান করবি? কোন চিন্তা নেই, আমি বলে দেব। তোর হয়ে সব পাপের বোঝা আমি আমার ঘাড়ে নিয়ে নেব। তুই দায়মুক্ত হয়ে যাবি, তোর সব দায় হবে আমার।’

এবার হাচিয়া ফাল সন্ন্যাসীর আসল ধান্দাটা বুঝতে পারল, লোকটা আগড়ম-বাগড়ম কথা বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার বাড়িঘর হাতিয়ে নিতে চাইছে। না, আর কোন সন্দেহ নেই সন্ন্যাসীটা শত্রুই হয়ে গেল, ঘোরতর শত্রু।

হাচিয়া ফাল তখন পালাতে পারলে বাঁচে। হঠাৎই কোন ভূমিকা না করে সটান উঠে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসীর সামনে থেকে প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালিয়ে গেল। সন্ন্যাসী কিছু বলার অবকাশই পেল না। এমন পালানোর কায়দা রয়েছে তার জিনের মধ্যে, যেটা সে জন্মসূত্রে পেয়েছে তার বাবা ভাগিয়া ছালের কাছে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *