রম্যরচনা

অধ্যায় : দুই

হাচিয়া ফাল একদিন রাস্তায় বেরিয়েছে। 

রাস্তায় সবাই যেতে পারে, কারো তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। হাচিয়া ফাল যদি রাস্তায় বার হয় কার কিছু কি যায়-আসে? রাস্তা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। যে কেউ সেখানে ইচ্ছে হলেই যেতে পারে। সবারই রাস্তায় যাওয়ার সমান অধিকার রয়েছে, যে সরকারকে ট্যাক্স দেয় সে যেমন যেতে পারে, যে ট্যাক্স দেয় না তারও রাস্তায় যাওয়া কেউ আটকাতে পারে না, স্বয়ং সরকার বা তার প্রশাসনও নয়। যদি সরকারকে ট্যাক্স না দিলে রাস্তায় যাওয়া নিষিদ্ধ হত তো পাগল বা কুকুরদের রাস্তায় দেখা যেত না। লক্ষণীয় যে, অধিকাংশ পাগল এবং কুকুররা সর্বক্ষণই রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় অথচ তারা কেউ সরকারকে ট্যাক্স দেয় না। সাদা কথা হল, সবাই রাস্তায় ইচ্ছে হলেই যেতে পারে, সরকারকে ট্যাক্স দিল কী না দিল সেটা কোন ব্যাপার নয়। স্বয়ং সরকার যদি কারো রাস্তায় যাওয়াতে বাধা না দেয় তো সাধারণ কোন লোক বাধা দেবে হতে পারে না। এসবই হল হাচিয়া ফালের ভাবনার একফালি দৃষ্টান্ত। সে কেমন ভাবে, কী ভাবে, কিভাবে ভাবে অতঃপর আশা করা যায় বারবার না বলে দিলেও নিজগুণে সবাই সেসব অনুমান করে নিতে সক্ষম হবে।

এসব যুক্তি-তর্ক ভেবে হোক বা না ভেবে, হাচিয়া ফাল একদিন রাস্তায় বার হয়েছিল। কী কারণে সেটা দেখার বিষয় নয়, কেউ কেবল কারণ থাকলেই রাস্তায় বার হবে এমন নিয়ম হলে জীবন চলে না। অকারণেও কেউ যেতে পারে রাস্তায়। কী কারণে বা এমনি এমনি সে রাস্তায় গিয়েছিল সেসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কী ঘটল সেটা হল দেখার বিষয়। 

অনেক লোকই ছিল রাস্তায়, যেমন থাকে। তাদের দিকে বিশেষ নজর না ফেলে এবং তাদের কথায় কর্ণপাত না করে সে হেঁটে যাচ্ছিল নিজের মত। হাঁটছিল সে আপনমনে, হঠাৎ তার দেখা কূটকচালি বাবুর সঙ্গে। লোকটা কোথায় যাচ্ছিল কে জানে, তাকে দেখেই হৈ হৈ করে বলে উঠল,

‘আরে এই যে হাচিয়া ফাল। কী খবর ?’

লোকটাকে দেখেই সে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, কথা শুনে সেই শঙ্কা আরও বেড়ে গেল। খামোখা কেউ কারও খবর জানতে চাইবে কেন? উদ্দেশ্যটা নিশ্চয় সাধু হতে পারে না। খবর জেনে তারপর পিছনে লাগার ধান্দা। হতেই পারে। কাউকে বিশ্বাস নেই। এইসব লোক, যারা রাস্তায় দেখা হলেই ডেকে খবরাখবর নিতে চায় তারা বিশেষ সুবিধের পাত্র হয় না, সে তা নিজের বিবিধ তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জানে। বহুবার বহু লোকের সঙ্গে সরল বিশ্বাসে তাদের খেজুরে আলাপের সামিল হতে গিয়ে দেখেছে সে যতটা সরল লোকগুলি একেবারেই তেমন নয়, তারা তাকে এমনসব কথা শুনিয়ে দেয় যা কোন না কোনভাবে সেইসব ব্যক্তিদের আত্মপ্রচার অথবা তার জন্য অপপ্রচার, যা যেকোনভাবেই তার অশেষ মানসিক ক্লেশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর কিছু না হোক, আজেবাজে কথা বা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তারা এমনই বাক্যজালে আবদ্ধ করে রাখবে যে সময় ও প্রয়োজনীয় কর্মসম্পাদনের বারোটা বেজে যায়। এভাবে এইসব উটকো লোকজন রাস্তাঘাটে সদাসর্বদা শত্রুতা করার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। তাদের খপ্পর থেকে অতি সাবধানে নিজের গা বাঁচিয়ে চলতে না জানলে বিপদ অনিবার্য।

তবুও উত্তর কিছু একটা দিতেই হয় ভদ্রতার খাতিরে। কিন্তু কী উত্তর দেবে? ভাল বললে লোকটা তার খারাপ করার জন্য উঠেপড়ে লাগতে পারে, আবার খারাপ বললেও বিপদ আছে। তার খবর খারাপ জানলে লোকটা তার ভাল করার চেষ্টা না করে উল্টে তাকে আরও বেকায়দায় ফেলার ফন্দি আঁটতে পারে। চট করে এতসব চিন্তাভাবনা মাথায় খেলিয়ে হাচিয়া ফাল ভাল-খারাপের মাঝামাঝি একটা উত্তর দিল বেশ বুদ্ধি খাটিয়ে যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে। সে বলল,

‘এই চলে যাচ্ছে।’

‘চলে যাচ্ছে কী হে? দেখে তো মনে হচ্ছে বহাল তবিয়তেই আছ, যদিও চেহারা একটু আমসিমার্কা লাগছে।’

লোকটা শোরগোল তুলে জানাল। শুনে তার সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। মতলবটা ভাল নয় অবশ্যই। সে বহাল তবিয়তে আছে কী নেই সেটা তার ব্যাপার। লোকটা কেন এমন মন্তব্য করবে? তাছাড়া তার চেহারা আমসিমার্কা বলায় সে আরও চটে গেল। আমসিমার্কা চেহারা নিশ্চয়ই ভাল বিষয় নয়। এসব বলে তার মন খারাপ করে দেওয়ার কোন চাল হতেই পারে। হাচিয়া ফাল লোকটার উদ্দেশ্য আন্দাজ করতে গিয়ে কোন উত্তর দিল না। কূটকচালি বাবু নিজেই আবার জিজ্ঞেস করল,

‘তা যাচ্ছ কোথায়? দেখাই তো পাওয়া যায় না তোমার আজকাল। ডুমুরের ফুল হয়ে গেলে নাকি?’

লোকটার গায়ে-পড়া ভাব দেখে হাচিয়া ফাল বেশ বিরক্ত হয়ে গেল। নিঃসন্দেহে লোকটার মনে কোন অভিসন্ধি রয়েছে। না হলে সে কোথায় যাচ্ছে তা জানার কেন এত কৌতুহল? তাকে হরদম দেখা পাওয়ার কেন এত বাসনা? সে ভিআইপি, না এমএলএ, না সেলিব্রিটি? কূটকচালি বাবুকে কেন সে নিত্য দেখা দিতে যাবে? কিসের দায় তার তাকে নিত্য দেখা দেওয়ার? এসব অভিযোগ করা তো শত্রুতার লক্ষণ। তাছাড়া তাকে অকারণে কেন ডুমুরের ফুল বলবে? ডুমুরের ফুল থাকুক আর না থাকুক সে আলাদা কথা, কিন্তু ফুল যেহেতু গাছে থাকে তাই তাকে ফুল বলা মানে সে গাছে ঝুলে থাকুক নিশ্চয়ই লোকটার তেমনি ইচ্ছে। হাচিয়া ফাল বুঝল যে লোকটার মতিগতি মোটেই সুবিধের নয়। বিপদের আশঙ্কায় সে লোকটাকে এড়াতে গিয়ে বলল,

‘আমার একটু তাড়া আছে। অন্যদিন কথা হবে। আজ আসি, কেমন ?’

কূটকচালি বাবু তাকে রেহাই দিতে চাইল না মোটেই। বলল,

‘কী এমন রাজকাজ তোমার যে এত তাড়া? দাঁড়াও, দুটো কথা বলি। এতদিন পর দেখা যখন।’

লোকটার কথা শুনে হাতিয়া ফাল থ’। তাকে কেমন আটকে রাখার মতলব। তার সঙ্গে লোকটার কথা বলার কী এমন গরজ? নিশ্চয়ই তাকে কথা বলে বলে ফাঁসাতে চায়। তারপর বলল কেমন দেখ, কী এমন রাজকাজ তার! তার মানে, তার কোন কাজ থাকতে পারে না, থাকলেও তার কোন মূল্য নেই। কোন সন্দেহ নেই লোকটা তার সঙ্গে শত্রুতা করার জন্যই এভাবে ভাব জমাতে এসেছে গায়ে পড়ে। এত আলাপ কেন? ঠিক করল সে, পালাতে হবে। লোকটা যখন শত্রুতা করতে এসেছে সহজে তাকে ছেড়ে দেবে না। অতএব জোর করে না পালিয়ে উপায় নেই। পালাবেই যখন ঠিক করল তো পালাবার আগে ভদ্রতাসূচক কিছু কথা বলার দরকার আছে কি? না, দরকার নেই। তবুও সে ভাবল, একটা কিছু বলে যাওয়া উচিত যাতে লোকটা তাকে হঠাৎ পালাতে দেখে পাগল না ভেবে বসে। তাই যদি ভাবে তো আবার অন্য বিপদ আছে। সেই কথাটা সে চারদিকে রটিয়ে বেড়াবে। যদি লোকটা সবাইকে বলে বেড়ায় যে হাচিয়া ফাল পাগল হয়ে গেছে তাহলে সবাই মিলে জোর করে ধরে তাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিতে পারে। সে শুনেছে, একবার যাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সে পাগল না হলেও ওইখানে থাকলে সত্যিসত্যি পাগল হয়ে যায়। এই বিপদের কথা মাথায় রেখে সে তাই বলল,

‘আজ যাচ্ছি। সত্যিই খুব তাড়া রয়েছে। পরে একদিন আপনার সঙ্গে প্রচুর গল্প করব। অনেক কথা বলার আছে।’

কথাগুলি কোনক্রমে শেষ করে কূটকাচালি বাবুকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই সে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। লোকটা তাকে বাধা দেওয়ার বা আটকাবার সুযোগই পেল না। 

বাড়িতে ফিরে হাচিয়া ফাল তার তালিকাপঞ্জিতে কূটকচালি বাবুর নাম তার একজন শত্রু হিসেবে নথিভুক্ত করল। এই কাজটা সে রোজই করে, বাড়িতে থাকলেই করে, বারবার করে। এজন্য শত্রুদের নাম তালিকাপঞ্জিতে নথিভুক্ত করার কথা বারবার উল্লেখ না করাই ভাল, কারণ তা একই বিষয়ে চর্বিতচর্বন হয়ে যেতে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *