রম্যরচনা
অধ্যায় : ১১
রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে সদাসর্বদা সতর্ক থাকতে হয়। চোখকান খোলা না রাখলেই বিপদ। কোথায় যে কোন্ শত্রু ঘাপটি মেরে আছে! একটু বেখেয়াল হলেই আর রক্ষে নেই। এমন শত্রুতা করে বসবে যে সামাল দিতে দম বেরিয়ে যাবে। তার নজির রয়েছে ভুরি ভুরি। সতর্ক হয়ে চললেই যে রেহাই পাওয়া যায় সবসময় তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। যারা শত্রুতা করার জন্য মুখিয়ে থাকে তারা অনেক বেশি ধুরন্ধর। শত্রুদের বুদ্ধি অথবা কুবুদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দেবে এমন ক্ষমতা কারো নেই। তবুও সতর্ক থাকলে শত্রুরা বেশি ক্ষতি করতে পারে না, অল্পেতেই পার পাওয়া যায় এই যা সান্তনা।
চোখকান খোলা রেখেই চলে হাচিয়া ফাল যখন ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তাঘাটে যাওয়ার দরকার হয়। লোক তো আর এক-দু’জন থাকে না, হাজার হাজার লোকের দল। অনবরত যাতায়াত করে তারা। কেউ চলে পিছনে, কেউ সঙ্গে সঙ্গে পাশাপাশি, কেউবা সামনে, কেউ আবার পিছন থেকে দ্রুত গতিতে সামনে চলে যায়, কেউ কম গতিসম্পন্ন হওয়ার জন্য পিছিয়ে পড়ে। এইতো গেল একই দিকে তার সঙ্গে চলে যারা তাদের কথা। উল্টো দিক থেকেও আসে বহু লোক। তাদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে যায়। এভাবে রাস্তা ধরে চলতে থাকা লোকজনের শ্রেণীবিভাজন করে নেয় হাচিয়া ফাল ঘর থেকে বার হলেই। এটা না করলে সতর্ক থাকা সম্ভব হয় না। কে কিভাবে চলছে রাস্তা ধরে সেই ধারণাটা যদি স্পষ্ট থাকে তো তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতন থাকা যায় আগে থাকতেই। রাস্তায় চলতে থাকা কোন শ্রেণীর লোকের মনে কোন দুরভিসন্ধি আছে কি নেই সেটা খানিকটা হলেও আন্দাজ করা সম্ভব হয়।
একই দিকে তার সঙ্গে চলে যেসব লোক তাদের নিয়ে বেশি সমস্যা। এই জাতীয় লোকজনকে পাঁচটি শ্রেণীভুক্ত করা যায়, যা একটু আগেই বলা হয়েছে। এমন পাঁচ দলে বিভক্ত লোকজনের দিকে একইসঙ্গে নজর রাখা কি সহজ কাজ? আবার উল্টো দিক থেকে যারা আসে তাদের ধরলে মোট ছটি দল লোক হয়। এরকম ছয় দলভুক্ত লোকদের জন্য চোখকান খোলা রাখতে গিয়ে হাচিয়া ফাল অনুভব করে যে তার ছয় জোড়া চোখ আর কান থাকা দরকার ছিল। ছয় জোড়া না হোক অন্তত ছটি করে চোখ আর কান যদি পেত জন্মসূত্রে তাতে বিধাতাপুরুষের কী সমস্যা হত? হাজার হাজার শত্রু দিতে পারলে আর মাত্র চারটি করে বেশি চোখ ও কান দিতে পারলে না, এটা এক ধরনের অবিচার বলে মনে হয় তার। যদিও অভিযোগটা কাকে জানাবে বুঝতে পারে না সে।
সামনে একই দিকে চলে যেসব লোক তাদের থেকে বিপদের আশঙ্কা তত নেই। যারা সামনে মুখোমুখি হয়ে উল্টোদিকে চলে যায় তাদেরও বোঝা সম্ভব যদি না তাদের মধ্যে কেউ তার পিছনে গিয়ে হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে। তখন সে একই দিকে চলমান পাঁচ দল লোকের কেউ না কেউ হয়ে যায় এবং যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ ঘটায়। তাই সামনে থেকে উল্টো দিকগামী লোকদের নিয়েও নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই। তারা পিছনে চলে গেলেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে হয় দিক পরিবর্তন করল কিনা। যদি করে তো তার কোন মতলব থাকার সম্ভাবনা বেশি।
রাস্তায় যেসব লোকেরা পিছনে থাকে তাদের নিয়েই যত দুশ্চিন্তা। শান্তিতে থাকা যায় না চলাচল করার সময়। পিছন থেকে তারা যা খুশি করতে পারে, ছোরাছুরি মারাও বিচিত্র নয়। হাচিয়া ফাল যখন রাস্তাঘাটে যায় তখন তার মাথায় সর্বক্ষণ এই পিছনে থাকা লোকগুলির কথা ঘুরে বেড়ায়। বারবার পিছনে ফিরে তাকাতে তাকাতে একসময় সে পুরোপুরি পিছন দিকে ঘুরে সেদিকেই চলতে থাকে। তাতে এতক্ষণ পিছনে থাকা লোকগুলি চোখের সামনে এলেও যারা সামনে ছিল তারা আবার পিছনে চলে যায়। অশান্তি তাই যেমন ছিল তেমনই থাকে। এই যন্ত্রণা থেকে একমাত্র মুক্তি পাওয়ার উপায় ছিল যদি মাথার পিছনেও দুটো না হোক অন্তত একটা বাড়তি চোখ থাকত।
অবশ্য পাশাপাশি বা সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে যেসব লোক তাদের সম্পর্কেও সন্দেহ থেকেই যায়। তারা কে যে কী মতলবে পাশাপাশি থাকে, কখন কী শত্রুতা করে বসে এই নিয়ে হাচিয়া ফাল দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকে। পিছনে থাকা লোকগুলি যেমন তার অজান্তে কলা দেখানো থেকে শুরু করে ছোরা পর্যন্ত মারতে পারে তেমনি পাশে চলা লোকগুলিও যে কোন মুহূর্তে গলা টিপে ধরা থেকে কনুইয়ের গুঁতো যে মেরে বসবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে হাচিয়া ফালের তাই যন্ত্রণার শেষ থাকে না। সামনে-পিছনে, ডাইনে-বাঁয়ে এত এত শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে হয় যে সতর্ক হতে গিয়ে সে কখনো এদিক কখনো ওদিক করতে করতে কোন দিকেই যেতে পারবে না বলে ভাবে। অনেক সময় আবার একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, না পারে সামনে যেতে না পিছনে। তার রাস্তায় চলাটা তাই এক দেখার মত বিষয় যা দেখে হুজুম হুম তাকে একবার বলেছিল,
‘তুমি রাস্তায় হাঁটছ নাকি সার্কাসে ট্রাপিজের খেলা দেখাচ্ছ? ছোটবেলা থেকে কি হাঁটতেও শেখোনি?’
ওই হুজুম হুম তার বাল্যশত্রু। লোকের যেমন বাল্যবন্ধু হয় তার ক্ষেত্রে সেটা বাল্যশত্রু হয়ে গেছে। কপাল খুবই মন্দ বলে হাচিয়া ফালের ওইরকম বাল্যশত্রু আরোও কয়েকজন রয়েছে। তাদের কল্যাণে তার দুর্দশার অন্ত নেই।
প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)
