রম্যরচনা

অধ্যায় : এক

হাচিয়া ফালের সবাই শত্রু। সে এমন এক জগতে বসবাস করে যেখানে কেউ তার মিত্র নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, জায়গাটা আবার পৃথিবী। ওইজন্যই যত বিপদ। যদি সে চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে থাকত আর এমন শত্রুবেষ্টিত হত তো পৃথিবীতে এসে বেঁচে যেত। ঝামেলা হয়েছে পৃথিবীতে সে থাকছে বলেই। চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার উপায় নেই, যেহেতু ওই স্থানগুলো মানুষের বাসযোগ্য নয়। 

হাচিয়া ফাল, তার পিতা ভাগিয়া ছাল এবং মাতা নাচিয়া ঝাল। তারা সব ইয়া-সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। তাদের সবারই নামের শেষে ইয়া শব্দটি যুক্ত থাকে। যেমন, তার এক মাসির নাম কাঁদিয়া খাল ও মামার নাম হাঁটিয়া  হাল। আবার দুই কাকার নাম ফাটিয়া থাল ও বাঁচিয়া কাল এবং পিসির নাম ঢাকিয়া গাল। এইসব ইয়া-সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকের চরিত্রে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বর্তমান। যেমন, তার কাকা বাঁচিয়া কালের স্বভাব সবার পিছনে লাগা, বাবা ভাগিয়া ছালের সর্বদাই পালাই-পালাই ভাব, মা নাচিয়া ঝালের বকাঝকা ও ঝগড়া করার ক্ষমতা দেখে মড়া মানুষও জ্যান্ত হয়ে নেচে ওঠে, আবার মামা হাঁটিয়া হাল কেবল সর্বক্ষণ হাঁটাহাঁটিতেই ব্যস্ত, মাসি কাঁদিয়া খাল কেবল কান্নাকাটি করতেই জানে, পিসি ঢাকিয়া গাল কী যেন কারণে বা ভয়ে সব ঢাকাঢুকি করে রাখে। অন্য কাকা ফাটিয়া থালের ফাটাফাটি কীর্তিকান্ড। হাচিয়া ফাল নিজে প্রবল সন্দেহপ্রবণ মানুষ। সে সবাইকে শত্রু বলে ভাবে এবং ওইটা ভাবলেই সে বাঁচতে পারে। 

এত এত শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে বসবাস করা যে কী দুষ্কর কাজ তা একমাত্র হাচিয়া ফালই জানে। তার কপালগুণে কিংবা দোষে যে তার সংস্পর্শে আসে সে-ই তার শত্রু বলে প্রতিপন্ন হয়। বন্ধু হিসেবে কাউকে পাওয়ার সে অনেক চেষ্টা করেছে। সবই নিষ্ফল হয়েছে, এমনই তার ভাগ্য মন্দ। সে শুনেছিল যে কুকুর সর্বদাই প্রভুভক্ত হয়। বন্ধু পাওয়ার ব্যাকুল আগ্রহে সে একবার একটি কুকুর পুষেছিল। সেই কুকুরও একদিন অকারণে বা অজানা কারণে তার শত্রু হয়ে গিয়ে তাকে ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিয়েছিল। গাদা গাদা ও গোদা গোদা ইনজেকশন নিয়ে এবং চব্বিশঘন্টা না ঘুমিয়ে না খেয়ে না ঘুরে ঠায় ঘরে বসে বসে দিনরাত জলাতঙ্কের দুশ্চিন্তায় ভুগে ভুগে তার কুড়ি কিলো ওজন বেড়ে গিয়েছিল। তখন তার মনে হয়েছিল, পরিবেশ এবং পরিস্থিতিও তার শত্রু, নাহলে না খেয়ে না ঘুমিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগতে ভুগতে কার ওজন বেড়ে যায় ? নিজের পোষ্য কুকুর প্রভুকে কামড়ায়, একথাই বা কে কবে জন্মে শুনেছে? এই ঘটনা অথবা দুর্ঘটনার পর সে আর কাউকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার চেষ্টা করেনি, জগতে কেউ তার বন্ধু হতে পারে বা হবে এমন সন্দেহও মনে ঠাঁই দেয়নি।

একদা সে তার শত্রুদের নামের একটি লিস্টি বানাতে শুরু করেছিল। একদিনেই সব নাম লিখে ফেলবে ভেবেছিল। একদিন কেন, এক সপ্তাহেও লিখে কুলিয়ে উঠতে পারল না। এক মাসেও সম্ভব হল না সব নাম লেখা। দেখতে দেখতে বছর কেটে গেল, তবুও শত্রুদের নাম লেখা চলছে তো চলছেই। সেই লিস্টি লেখার কাজ তারপর সে আর থামাতে পারেনি। রোজই সে লিস্টিতে নাম লিখে যায়। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম ভুলে গেলেও লিস্টিতে নিত্যনতুন শত্রুদের নাম নথিভুক্ত করার কাজ সে কোনদিনও বাদ দেয় না। অবসর সময়ে বা অসময়ে ওই লিস্টি লিখেই তার সময় কাটে। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে লিস্টিতে রোজ নতুন শত্রুদের নাম না লিখলে তার বদহজম হয়ে যায়। ইদানিং আবার সে এক নয়া বিষয় আমদানি করেছে ওই লিস্টিতে। আগে কেবল নাম লিখেই সে ক্ষান্তি দিত, এখন নামের পাশাপাশি শত্রুদের কার্যকলাপ ও কেন তারা তার শত্রু সেসব বিবরণও সবিস্তারে লিখে রাখে। ব্যাপারটা তার এমনই নেশার কারণ হয়ে গেছে যে লিস্টি লেখার উদগ্র উত্তেজনা ও আগ্রহে তার ভোররাতেই তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সে স্বপ্নে এমন সব শত্রুর হদিশ পায় যাদের সে বাস্তবে দেখেইনি কোনদিন। তাদের নাম এবং বিবরণও সে লিস্টিতে লেখে। ফলে তার লিস্টি এখন দ্বিধাবিভক্ত, একটি ভাগের নাম বাস্তব শত্রুসমূহ এবং অন্য ভাগের নাম স্বপ্নাদ্য শত্রুসমূহ। পরে ভেবেচিন্তে সে লিস্টিতে তৃতীয় একটি ভাগের সংযোজন করেছে কল্পিত শত্রুসমূহ বলে যেখানে থাকে এমন শত্রুদের নাম যাদের সে বাস্তবে বা স্বপ্নেও দেখেনা, কেবলই হতে পারে বলে কল্পনা করে। 

অর্থাৎ দাঁড়ালো এই যে শত্রু তালিকাভুক্তির কোন নির্দিষ্ট নিয়মকানুন নেই। অহরহ চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেসমস্ত ব্যক্তিবর্গ ও জীবকুল, অবস্থানরত রয়েছে যেসব বস্তুসমূহ তারা অনায়াসে হাচিয়া ফালের শত্রু হয়ে যেতে পারে। বিবেচনা করলে দেখা যায়, জগতে প্রতিটি বিষয়ের মধ্যেই শত্রু হওয়ার অনুকূল উপাদান বর্তমান এবং প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে শত্রু হওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা। যে জল পান করা জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য সেই জলই আবার লোককে ডুবিয়ে মারে। এভাবে প্রতিটি বস্তুই কোন না কোনভাবে শত্রুসুলভ আচরণ করে। ঘটনা হল এই যে আমরা সাধারণ মানুষ সেসব বিষয় দেখতে পাই না, দেখার সেই চোখ নেই আমাদের। সৌভাগ্যক্রমে, হাচিয়া ফালের রয়েছে সেই অন্তর্দৃষ্টি, তাই সে শত্রুদের নির্ভুলভাবে শনাক্ত করে মহাভারততুল্য শত্রুতালিকা নির্মাণ করতে পারছে। আশা করা যায়, কোন একদিন সে তার এই মহাকীর্তির কল্যাণে অমর হয়ে যাবে যদিও লোকেরা এখন তাকে তেমন পাত্তা দেয় না। তাতে অবশ্য তার দুঃখ নেই, কারণ লোকে পড়ে তাকে বাহবা দেবে এই উদ্দেশ্যে সে শত্রুতালিকা নির্মাণের কাজে হাত দেয় নি, সে এই চিরস্মরণীয় কাজ করছে শত্রুদের এড়িয়ে নিজে বেঁচে থাকার জন্য।

হালে যেভাবেই হোক, হাচিয়া ফালের লিস্টির কিয়দংশ আমাদের হস্তগত হয়েছে। পাঠ করে মনে হয়েছে যে তা অতি প্রয়োজনীয় এক আকর্ষণীয় বিবরণী। জগতে এত প্রকারের শত্রু এত ভাবে হতে পারে তা ভাবা যায় না। সকলেরই সে বিষয়ে অবগত হওয়া উচিত। তাহলে সবাই সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য সমস্ত শত্রু সম্পর্কে সাবধান থাকতে পারবে। শত্রুভাবাপন্ন ব্যক্তিদের বিষয়ে কেউই বিশেষ সচেতন নয়। সে কারণেই নানা জনের নানা বিপদ ঘটে থাকে। হাচিয়া ফালের বিবরণী পড়লে শত্রুদের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে একটি আন্দাজ পাওয়া যাবে। সে কারণেই হাচিয়া ফালের শত্রুদের তালিকা ও কার্যকলাপের বিবরণী সবার জন্যই অতীব উপকারী। এই তালিকার বাস্তব কার্যকারিতা তাই উপেক্ষা করা যায় না। 

এই কারণবশতই প্রকাশিত হল এই কাহিনী, হাচিয়া ফালের শত্রুরা। আশা করা যায় যে কাহিনীটি আদ্যোপান্ত জেনে সকলেরই সবিশেষ উপকার হবে। মূল কাহিনীর ভূমিকা হিসেবে তাই এত কথা বলা, যা অপরিহার্য ছিল। আগামী পর্ব থেকে বিচিত্র চরিত্রের শত্রুবর্গের পরিচিতি একে একে প্রদান করা যাবে। তথ্যসূত্র অবশ্যই হাচিয়া ফালের তৈরি করা শত্রুতালিকা, এই কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করে সবাইকে না জানিয়ে রাখা রীতিমত অপরাধ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *