সুব্রত ভৌমিক
রবিবার সে পাল্টায়। রোজকার মতো দোকানদারি নেই। একটা হলুদ বিকেল যেন হাত নেড়ে ডাকে। দুপুরটা গড়িয়ে চারটে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বাজলেই সাইকেলটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। নাম মধুসূদন, মধুসূদন অধিকারী। ছেঁটে মধু।
দেখে, চারধারটা খুব হাসি-হাসি। আসলে হাসছে না। যেন হাসিখুশি মুখোশ। তাই সাইকেলটা চালাতে চালাতে সেও একদিন গুরুগম্ভীর মুখে কবেকার একটা হুস-হুস খেলার কথা ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে চেপে ধরা দিনটা থেকে নিজেকে প্রাণপণ একটু ছাড়াবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ বড়ো রাস্তার মুখে খানিক জ্যামে আটকাতে বাঘের মতো কার একটা হাত এসে পড়ল কাঁধে। তাকিয়ে দেখল, বাঘ না, বাঘের মতো একটা মানুষ। সুকেশদা। একসময় তাদের গডফাদার ছিল। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পত্রিকা প্রকাশ, গাছ লাগাও অভিযান ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের গুরু। সাইডে টেনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে, কেমন আছিস?’
মধু চুপ থেকে বলল, ‘ভালো না।’
‘কেন, কী হয়েছে!’
‘রোজ রোজ শুধু বাড়ি আর দোকান—এই অর্থসর্বস্ব জীবনটা আর নিতে পারছি না, সুকেশদা।’
মধু বাংলায় অনার্স। কিন্তু তাতে চাকরি ওঠেনি। বছর খানেক হল তাই বাবার ব্যবসাটায় মাথা দিয়েছে। বাজার-কালীবাড়ির সামনে তাদের মুদিখানার দোকান। এখনও বিয়ে হয়নি। বা করেনি। সাতসকালে উঠে রোজ দোকানে যায় আর সন্ধে নাগাদ বাবা এসে ক্যাশে বসলে তবে খানিক ডানা মেলে। মানে বাড়ি ফেরে। আবার রাত দশটা নাগাদ দোকান বন্ধ করতে যায়। আর কোথাও যায় না।
শুনে সুকেশদা বলল, ‘তোর ক্রাইসিসটা ধরতে পারছি। প্রতিদিনের ফিলিংসগুলো বাঁচতে পারছে না। ইচ্ছেগুলো রোজ মরে যায়।’ এই ব’লে একটা চায়ের দোকানে বসিয়ে এবার অবাক হল, ‘কিন্তু একী রে, একী হাল হয়েছে তোর! কেমন দিলখুশ ছিলিস। বৈষয়িক গালগল্পে হাই তুলতিস। এমন গোমড়ামুখো হয়ে গেলি কী করে?’
চুপ থেকে মধু ক্ষোভ উগরাল, ‘জীবন তো এইরকমই দেখছি, সুকেশদা৷ সাজতে হয়। ওয়ার্ড কমিশনার শিবু বোস যেমন বুঝেছিল, মানুষ হওয়ার চেয়ে মানুষ সাজা ভালো। লোকে দেখতে পায়। প্রশংসা করে।’
‘কিন্তু তাতে আসল মানুষ মরে যায় রে।’
‘সে কি আদৌ আছে?’
‘আলবাৎ আছে৷’ সুকেশদা আচমকা চায়ের টেবিলটার উপর সজোরে একটা ঘুষি কষাল। একটা সিগারেট ধরাল। গোল গোল রিং ছাড়তে লাগল।
মধু প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘কোথায় সে!’
‘খোঁজ খোঁজ৷ জীবন এক আনন্দের সন্ধান।প্রেমময়৷ আগে তার প্রেমে পড় বুঝলি, প্রেমে পড়৷’ ব’লে সুকেশদা হঠাৎ ফের উধাও। ধোঁয়ার রিংগুলোর মতো ভাসতে ভাসতে লীন।
#
অতএব মধু বদলাল। আশ্চর্য এক প্রেমে পড়ল। যেন জীবনপথটায় কেউ পড়বে। পড়ে। কার সাথে যেন দেখা হওয়ার কথা। বাতাস ভালো লাগে। সকাল ভালো লাগে। বিকেলটা রঙ পাল্টে হাতছানি দেয়। চোখ বুজলে গেল’বার ঘুরতে যাওয়া সিমলার এক পাহাড়ি পথ চোখে ভাসে। দেখে, সেখানে হলদে বিকেল লাগা একটা পাহাড়ি মেয়ে স্কুলড্রেস পরে সাইকেলটা হাতে করে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠছে। উপরে তাদের ছোট্ট কাঠের বাড়ি। ঢোকার মুখে হঠাৎই ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকায়। মুখের কোথায় একটু হাসে। তারপর বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়ে। চিরদিনের মতো হারিয়ে যায়। কোত্থাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না তাকে।
সেই থেকে মধু তাকে তন্নতন্ন করে খোঁজে ।
ট্রেনে-বাসে, এখানে-সেখানে, রাস্তায়-কলেজে।
কিন্তু পায় না।
এভাবে খুঁজতে খুঁজতে পাশের বাড়ির এক ভাড়াটে মেয়ের সঙ্গে দেখা। মানে চোখাচোখি। শুনেছে মেয়েটি পড়াশোনায় ভালো। নানা গল্প-উপন্যাস পড়ে। মাঝে মাঝে বই পাল্টাতে পাবলিক লাইব্রেরিতে যায়। সুকেশদা প্রেমে পড়তে বলেছে। অতএব মধু আর দেরি করল না। কিন্তু কই! মেয়েটার জন্য সে বাথরুমে ঢুকে জোরে জোরে গলা ফাটিয়ে গান গায়। ছুটির দিন সারা দুপুর ছায়া পড়া ছাদের কার্নিসে বসে দোকানের হিসেব লেখে। আর সে সন্ধে নাগাদ বেশ ঘুমিয়ে-টুমিয়ে চোখ ফুলিয়ে ছাদে উঠে দুটো কাপড় তুলে নেমে যায়। বুঝতেই পারে না। নাকি ধরা দেয় না? সুতরাং বাড়ি থেকে বেরোবার মুখে মধু একদিন মেয়েটিকে ধরার চেষ্টা করল। বলল, ‘ইয়ে, আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল।’
‘আমার সঙ্গে! কী কথা!’
‘না মানে, আমি পাশের বাড়ি থাকি।’
‘হ্যাঁ, দেখেছি।’
‘আপনাকে একটা কথা জিগ্যেস করতাম।’
‘কী!’
‘আচ্ছা, আপনরা কি সিমলায় থাকতেন?’
‘সিমলায়! না তো।’
‘না মানে, পাহাড়ের ধাপে একটা ছোট্ট কাঠের বাড়ি ছিল না?’
‘না, না।’
‘কোনও হলুদ বিকেলে বের হননি কখনও?’
‘কী উলটো-পালটা বকছেন!’
‘না মানে, কোনও বিকেলেই তাহলে বের হন না!’
মেয়েটি চুপ। বড়ো চোখের পাতাদুটো উঠিয়ে একবার তাকাল। তারপর খানিক চোখ রেখে বলল, ‘বুধবার বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরিতে যাই।’ বলে চলে গেল।
শুনে সুকেশদা বলল, ‘ছাড়্। যে মেয়ে শব্দ বোঝে না, নীরবতা বুঝবে কী করে। এই ইট-কাঠ-পাথুরে জীবনটায় মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা হয় না রে। যদি বা হয়, কেউ কাউকে চিনতে পারে না। তোকে আরও লুসিড হতে হবে, বুঝলি? মানে তুই এবার বরং কাউকে ডাইরেক্ট বলে দ্যাখ্ তো। বাছিস না৷ তালে কিছু থাকবে না। কৃষ্ণও বাছেনি। তবে প্রেমে সাহস লাগে, ব্রাদার। সেইটে আগে প্র্যাকটিস কর।’
সুতরাং মধু এবার সাহস প্র্যাকটিস করতে নেমে গেল। করতে করতে একেবারে দুঃসাহসী হয়ে উঠল। কাউকে প্রেম নিবেদন করার জন্য একেবারে মুখিয়ে আছে। কিন্তু তাই বলে তো দেখামাত্র কারও উপর ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না। তার জন্য একটু পাশে বসা লাগে—একটু আলাপ, প্রশ্রয়। তাই একদিন এক চলন্ত বাসে এমনই প্রশ্রয়ের মতো পাশে বসা একটা মহিলার উড়ো চুল মুখে এসে লাগতেই মনে মনে তাকে লক্ষ্যবস্তু করে ফেলল সে। গোদা গোদা হাত, একটু ভারী। তা হোক। ভারী কি নারী নয়? বরং কেমন মাংসের সমাহার। নির্বিচার বাছাইয়ের এমন মোক্ষম সুযোগ আর কী-ই বা হতে পারে। অতএব প্র্যাকটিস মতো বীরদর্পে সে সহাস্যে বলে উঠল, ‘ইয়ে, আপনি কি খুব বিজি?’
‘মানে?’
কী আশ্চর্য, বিজি মানে জানে না! অঞ্জয়দার পুচকে মেয়েটা তো রাতদিন এটা বলে। তুতলে বলল, ‘না মানে, আপনি কি খুব ব্যস্ত? খুব হুড়মুড়িয়ে গাড়িতে উঠলেন কিনা তাই—‘
‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।’ ভদ্রমহিলা এবার খুশি হয়ে বলল, ‘এই তো সকালে উঠেই ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম। উপরি টাকা ঢুকিয়ে এলাম। এবার যাব এল-আই-সি অফিসে, প্রিমিয়াম জমা দিতে। মাঝে অবশ্য একটা বাড়িতে যেতে পারলে ভালো হতো। ক’টা টাকা পেতাম। দেখি। তো সেখান থেকে বেরিয়ে যাব একটা বিউটি পার্লার, বিউটি পার্লার থেকে বেরিয়ে একটা মোবাইলের দোকান, মোবাইলের দোকানটা হয়ে একটা শপিংমল, তারপর সেখান থেকে—‘
‘থাক থাক। আর বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি। তারমানে আপনার হাতে একদম সময় নেই, তাই তো?’
‘না না, বললাম তো। কিন্তু কেন বলুন তো!’
‘না মানে, তালে আর ফালতু গ্যাঁজাব না। ডাইরেক্ট বলি। আচ্ছা, আপনি কি কখনও সিমলায় থাকতেন?’
‘সিমলায়! না না।’
‘ও। তা সেটা নিয়েই আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতাম।’
‘আমার সঙ্গে? কেন বলুন তো!’
‘এমনিই। দিনগুলোয় তো কিছু নেই। কোনও ঘটনা, সম্পর্ক, মানুষ। লোকে এখন চাকরি খোঁজে, মিস্ত্রি খোঁজে, মানুষ খোঁজে না। তাই আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে বাস থেকে নেমে একটা মানুষের পাশাপাশি একটু হাঁটতাম।
‘কেন!’
‘দুটো কথা বলতাম।’
‘তাতে কী হবে!’
‘কিছু না। কী হয় সেটা দেখতাম।’
‘কী হয় সেটা দেখতেন মানে!’ মহিলা থমকাল। পিটপিট করে দু-মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল। তারপরই হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে এক হেঁচকায় চুলের মুঠি ধরে গোদা হাতে মুখের উপর একখানা হেভিওয়েট পাঞ্চ। খানিক থেমে ফের আরেকটা। এইরকম পরিস্থিতিতে পাবলিক খুব দায়িত্বশীল হয়। কর্তব্যপরায়ণ হয়৷ এ-টু-জেড সব ধোয়া তুলসি পাতা। সুতরাং ছাতা-ব্যাগ-জুতো-চিরুনি যার যা ছিল তাই দিয়ে হাতে-পায়ে-মুখে প্রাণপণ দমাদ্দম বাড়ি। শেষমেশ রোনাল্ড’র একটা দুর্দান্ত ফ্রি-কিকের মতো কার একটা কষে মারা লাথিতে চলন্ত বাসের খোলা দরজা দিয়ে একেবারে এবড়ো-খেবড়ো পিচ-ওঠা রাস্তায়৷
#
তো মধু এখন নির্বিকার। স্বাভাবিক। মুখের কোনও এক্সপ্রেশন নেই। হাসে না, কাঁদে না, রাগে না। এইরকম একটা মুখ রোজ প্র্যাকটিস করে৷ করতে করতে এখন আর আসল মুখটাই মনে পড়ে না তার। চারধারটাও তাই। যেন একটা প্রসাধনী মুখ। সবসময় কেমন খুশি-খুশি। হাসিখুশি মুখোশের মতো। কোনও প্রিয়জন মারা গেলে ছুটে যায়, তবে কষ্ট নেই। কোথাও একটা দারুণ গান বাজছে, তো বাজছে।
এভাবেই একদিন দোকান বন্ধ থাকায় মধু এক বুধবারের বিকেলে বাজার করার জন্য সাইকেল চালাচ্ছিল। চালাতে চালাতে আনমনে অন্য এক রাস্তায় ঢুকে পড়ে হঠাৎ ব্রেক কষে ভাবছিল, ‘কোথায় যাচ্ছি যেন!’
এমন সময় কাঁধে ফের একটা অদৃশ্য হাত। ঘুরে দেখল, সুকেশদা। শুনে বলল, ‘ডোন্ট ওরি। এই যে তুই কী কাজে যাচ্ছিলিস ভুলে গিয়ে অন্য একটা পথে চলে এসেছিস, এটাই আসল পথ৷ এপথেই সে পড়ে। দেখা হয়।’
‘তার মানে! কে! কার কথা বলছ!’
সুকেশদা হাসল। আঙুল তুলে সামনের দিক দেখাল। মধু মুখ উঠিয়ে দেখল, পথটার উল্টো দিক থেকে পাশের বাড়ির সেই মেয়েটি আস্তে পায়ে হেঁটে আসছে। গায়ে এক হলদে বিকেল, হাতে লাইব্রেরির বই।