তপোপ্রিয়

অন্য কোন জীবন 

কলকাতায় প্রথম এসে ভাড়া ছিলাম একটা তিনতলা বাড়িতে। খাড়া খাড়া সিঁড়ি, উন্মুক্ত ল্যান্ডিং। বৃষ্টি হলে সিঁড়ি ভেসে যেত জলে। 

আমরা ছিলাম তিনতলার দুটো পাশাপাশি ঘরে। রাস্তার ঠিক ওপরেই ছিল একটা টানা বারান্দা, এক প্রান্তে ঘুপচি বাথরুম। সেই বাথরুমের চেহারা দেখলে বুকে আতঙ্ক হতো। ভরদুপুরেও ঘন অন্ধকার, আলো জ্বাললে অন্ধকার যেন বেড়ে যেত। বাথরুমে যেতে হবে ভেবে সারাদিন কাটতো আমার মানসিক বিস্বাদে। দেয়াল-টেয়াল নোংরা, কালো ছাপছোপ গায়ে। আমি স্নান করতে চাইতাম না। মা বলতো,

‘আরে, কদ্দিন স্নান না করে থাকবি ? শরীর অসুস্থ হয়ে যাবে যে রে। তুই এক কাজ কর্, বারান্দাতে বসেই স্নান করে নে।’

মায়ের পীড়াপীড়িতে বাথরুমের সামনে বারান্দাতে বসে স্নান করতাম। সময়টা ছিল শীতকাল। মা গরম জল করে দিত, আপত্তি করলেও শুনতো না। আমি আপত্তি করতাম মায়ের খাটনির কথা ভেবে। কিন্তু মায়ের দেখতাম আমাদের জন্য পরিশ্রম বাড়লে খুশি হত।

বাড়িটার ভাড়া ছিল দেড়শ না দু’শ টাকা, আজ থেকে অন্তত চল্লিশ বছর আগের কথা। ওই টাকাই তখন আমাদের কাছে অনেক। দাদা ওকালতি পাশ করে খুবই অল্পদিন হলো এক সিনিয়ার উকিলের কাছে কাজ শিখছে সবে। মাসে চার-পাঁচশ টাকা পায় হয়তো। তার ওপর ভরসা করেই এগিয়ে যাওয়া। সেই সিনিয়র উকিলের সন্ধানও আবার মা-ই যোগাড় করে দিয়েছিল। এটা একটা অদ্ভুত আত্ববিশ্বাস, মায়ের মধ্যে সবসময় দেখতে পেতাম। যাকে নেহাত তুচ্ছ মনে হতো, যার মধ্যে কোন সম্ভাবনা আছে বলে সন্দেহ থাকতো মা সেই যোগসূত্র আশ্চর্যরকম কাজের বুঝিয়ে দিত। বর্তমান কেরিয়ারসর্বস্ব দুনিয়াতে যোগসূত্র কাজে লাগাবার ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তার জন্য হাজারটি উপায়ের পরামর্শ দেয় বিশেষজ্ঞরা। মায়ের সেসব শিক্ষা ছিল না, অথচ এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি কোত্থেকে পেয়েছিল ভাবলে অবাক লাগে। 

যে সিনিয়র উকিল দাদার জন্য মা ব্যবস্থা করে দিয়েছিল সে কতটা কাজের হবে আমরা বুঝতে পারিনি, পরে দেখা গেল তাকে নির্ভর করেই দাদা দাঁড়িয়ে গেল, তাকে আর দ্বিতীয় জনের কাছে যেতে হয়নি। তখন অবশ্য একেবারেই সূচনা, খুবই কম আয় দাদার। তিনজনের সংসার, তার ওপর আমার পড়াশোনা। এত কম টাকায় কিভাবে দিন চলবে ভেবে মায়ের বড়ই দুশ্চিন্তা হতো। আয়ের আবার কোন ঠিকঠিকানা ছিল না। এভাবে করে করে কবে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে ? মামা বলতো মাকে,

‘হ্যাঁ, ও পারবে। দলিল লিখে পকেটে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে এসে তোকে বলবে, মা, নাও এনেছি।’

বলতো মামা বিদ্রুপ করে। দাদার ওপর তার একেবারেই আস্থা ছিল না। মামা আর দাদা দুজনেই দুজনকে একটু যেন অপছন্দই করত। দুজনকে কথা বলতে দেখতাম একে অন্যকে ঠেস দিয়ে।

রোজ খবরের কাগজ কেনার মত অবস্থাও ছিল না। দাদা কাজ থেকে ফেরার পথে কোন কোনদিন কিনে নিয়ে আসতো। ভাবতাম, রোজ পেলে ভালোই হতো, যদিও খবর-টবর বিশেষ পড়তে ভালো লাগতো না আমার। মা কিছু কিছু পড়ত, তবে মায়ের খবর পড়ার নেশা ছিল না। খবর পড়ত মা হাতে কাজ না থাকলে। 

একসময় ওইসব দিনগুলিতে আমি ছিলাম ভাবলে কেমন অবাক লাগে। মাকেও দেখতাম পুরনো দিনের কথা ভেবে বিস্মিত হতে। দেশের বাড়ির গল্প শোনাত মা, সেখানকার লোকজন, আচার-বিচার, নানা ঘটনা। গল্প বলত মা নিজের ভাইবোন, বাবা-মা, আত্মীয় পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের। বলতে বলতে মুহ্যমান হয়ে পড়ত, কিছু সময়ের জন্য ভুলে যেত বর্তমান। আচ্ছন্ন গলায় মা মন্তব্য করত,

‘সব কোথায় হারিয়ে গেল রে বাবা ! ভাবলে কেমন স্বপ্নের মতো লাগে।’

মায়ের সেই অনুভূতি বোধ হয় তখন ঠিক বুঝতে পারতাম না। এখন মাকে হারিয়ে আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারি মায়ের সেই বিষণ্ণ মনোভাব। যে দিনগুলির কথা ভাবছি সেগুলি আমারই জীবনে কোনদিন ঘটে গেছে একথা নিজেরই বিশ্বাস হতে চায় না, আবার নিজেকে ওইসব দিনগুলি থেকে বিচ্ছিন্নও করতে পারি না, এই দু’-রকম টানাপোড়েনের মাঝখানে পড়ে কেমন যেন বিপন্ন হয়ে ওঠে আপন অস্তিত্ব। আমি যে কে ধাঁধায় পড়ে যাই। কোথায় আমার অবস্থান, অতীতে না বর্তমানে ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারি না। পুরনো দিনগুলি মনে হয় হাতের নাগালে অথচ হাত বাড়িয়ে দেখি নাগালের বাইরেই থেকে যায়। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলি মনে হয় পাশের ঘরে আছে, আমি কেবল ওই পাশের ঘরে যাওয়ার দরজাটা খুঁজে পাই না। লেখায় বা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকি যখন প্রায়ই ভুলে যাই মায়ের অবস্থান বাস্তবে আর নেই। হামেশাই মনে হয় মা বোধহয় কাছে এসে দাঁড়ালো আমার, ডাকলো আমাকে। মায়ের কথা বলা, চলাফেরা, কাজকর্ম অক্ষয় হয়ে রয়েছে অথচ ঘরে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না মাকে। অনুভবে সরব অথচ নাগালে নেই, এই পরিস্থিতি মেনে নেওয়া বড়ই কঠিন। মা থাকবে না জানতাম, কিন্তু আজ সেই দিন যখন বাস্তব হয়ে এসেছে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না।

মাঝখানে অন্তত চল্লিশটি বছর কেটে গেছে ভাবলে বেশ অবাক লাগে। মনে হয় যেন একটু আগে ঘটে গেছে সব, অথবা এখনও ঘটে চলেছে। আমরা সদ্য কলকাতায় এসে উঠেছি ওই তিনতলার বাড়িতে। দাদা সকাল ন’টার মধ্যে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাত আটটা বা নটায়। সারাদিন তার কোর্টে কাটে, তারপর যায় সিনিয়রের বাড়িতে, তার চেম্বারে। মা সকাল সকাল যাই হোক দাদাকে রান্না করে দেয়। তার জন্য মাকে উঠতে হয় খুব তাড়াতাড়ি। উঠে মায়ের শুরুতেই আছে ইষ্টদেবতার আরাধনা, তারপর মা উনুন ধরায়। বালতির গায়ে মাটিলেপা উনুন, ঠেসে তার মধ্যে গুল রেখে আগুন জ্বালাতে হয় নিচে। বারান্দায় উনুন রেখে মা ওভাবে আগুন ধরায় রোজ। সময় লাগে বেশ, আগুন দিলে সঙ্গে সঙ্গেই উনুন ধরে যায় না, বসে ফুঁ দিয়ে দিয়ে, হাওয়া করে ধরাতে হয়। বেশ কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠতে থাকে, মা একটা হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করে যায়। কোন কোনদিন উনুন আবার ধরতে চায় না, মা চেষ্টার পর চেষ্টা করে করে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। মাকে বেশ নাজেহাল দেখায়, চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। ঘরে এসে মা হতাশ গলায় বলে,

‘নাঃ, আর পারব না। উনুন ধরতেই চায়না। গুলগুলি একদম ভেজা।’

দাদা হয়তো দাড়ি কাটছিল, মাকে সাহায্য করার জন্য দাড়ি কাটা ফেলে উঠে এসে বলে,

‘দেখি, সরতো, কী হয়েছে দেখি।’

‘একেক দিন আছে না, কিছুতেই কিছু হতে চায় না।’

উনুন হয়তো জ্বলে শেষপর্যন্ত, কিন্তু সময়ও বেশ এগিয়ে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মা হাহাকার করে ওঠে,

‘হায় হায়, কত বেলা হয়ে গেল রে বাবা ! আজকে যে কী রান্না করে দেব ? ওকে খাইয়ে দিতে পারব কিনা কে জানে।’

উনুনে ভাত চাপিয়ে মা দ্রুতহাতে তরকারি কুটতে বসে আর কেবলই সন্দেহ প্রকাশ করে, কতটা কী করতে পারবে। দাদা হয়তো মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে যে না পারলে মা যেন তাড়াহুড়ো না করে। যা হবে তাতেই চলবে, ডালসেদ্ধ-ভাত। মায়ের প্রাণে তা মানে না। মা বলে,

‘তা কি বললে হয় রে বাবা ? সারাদিনের জন্য বেরোবি। এতবড় রাজার বেলা যাবে, ঠিকমতো না খেয়ে গেলে হয় ?’

হা-হুতাশ করলে কী হবে, মা ঠিক রান্না নামিয়ে দেয়, সময়মতো। আবার টিফিনও তৈরি করে দেয় দাদাকে। টিফিনটা বেশ বিচিত্র। আলু, গাজর, বিট সেদ্ধ করে কুচিয়ে একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া। এরকম টিফিন করে দেওয়ার পরামর্শ দাদাই মাকে দিয়েছিল। তাতে পেট ভরে, শরীরও খারাপ হয় না। খরচও বাঁচে।

খরচ বাঁচাবার চেষ্টাটাই তখন প্রধান। কাজের লোক নেই কেউ। রান্নাবান্না থেকে ঘরটর ঝাড়পোছ করা, থালা-বাসন মাজা ইত্যাদি সব কাজ মা করে নিজের হাতে। অবশ্য এই কাজ মায়ের গায়ে লাগে না, এর চেয়ে বেশি কাজ করতেই মা অভ্যস্ত। নিজস্ব সংসারের কাজ অন্য কেউ করে দেবে এটা মায়ের একেবারেই পছন্দ নয়। মা বলে,

‘এ কি কোন কাজ রে বাবা ? সারাদিনই তো বিশ্রাম।’

একটা জল দেওয়ার ভারি অবশ্য রাখতে হয়েছে। তিনতলায় কোন জলের ব্যবস্থা নেই, না বাথরুমে না রান্নাঘরে। নিচ থেকে জল ওপরে তোলা যে একেবারেই অসম্ভব মা নিজেও স্বীকার করে।

‘উরে বাপরে, সিঁড়িগুলি যা খাড়া খাড়া !’

ভারি এসে সকালেই কয়েক ভার জল দিয়ে যায়। যে কটা বালতি, হাঁড়ি আছে সব জলে ভরে রাখে মা। বাথরুমের চৌবাচ্চাটাও ভারি জলে ভরে দিয়ে যায়। মাসে ভারির পিছনে বেশ কিছু টাকা দিতে হয় বলে মায়ের খুব আফশোস।

বাড়ির নিচে রাস্তায় বাজার বসে রোজ সকালবেলা। ঘুম থেকে উঠে মুখচোখ ধুয়ে দাদা ঘুরে আসে বাজার থেকে। বেশি তো আর যেতে হয় না, সিঁড়ি ধরে তিনতলা থেকে নামলেই হল। মা অবশ্য বারণ করে দাদাকে বেশি কিছু কিনতে, যা না হলে সকালের রান্না হবেই না তাই আনে দাদা। বাকি বাজার থাকে মায়ের জন্য। দাদা বেরিয়ে যাওয়ার পর সকালের রান্না সেরে মা যায় বাজারে ঘুরতে। বেলা তখন এগারোটা-বারোটা। শেষ বাজার ঘুরে ঘুরে মা জিনিসপত্র কেনে বেছে বেছে, দামেও শস্তা হয়। বাজার থেকে এসে মা এক এক করে সব আনাজপাতি ব্যাগ থেকে নামায়, আমি ঘরে থাকলে আমাকে শোনায় বাজার করার গল্প। কী কত কিনেছে বা কী উদ্দেশ্যে, কিনতে গিয়ে সবজিওয়ালাদের সঙ্গে কী কী কথাবার্তা হয়েছে। আর মা বিশেষ করে বলে আমাকে দামের কথা।

‘বাপরে বাপ, কী দাম ! আমি আর বাজার করতে পারবো না রে বাবা। মনকাকে বলবো, তুই যা হয় কিনে নিয়ে আসবি।’

মা দাদাকে মনকা বলে ডাকত। 

যখন একান্ত হয়ে থাকি, অন্য অনুষঙ্গ আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে না তখনই সেইসব দিনগুলি আমার কাছে ফিরে আসে বা আমি চলে যাই তাদের কাছে। এই সব ঘটনা, এইসব কথা কোনদিন আমারই জন্য উপস্থিত ছিল আমার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে, এই ভাবনা কেমন যেন অলীক বলে মনে হয়। একদা বাস্তব প্রত্যেকেরই জীবন থেকে নিশ্চয় এমন করেই বিলীন হয়ে যায়। অতীতকে স্মরণ করে দেখতাম মা-ও আমার হামেশাই মুহ্যমান হয়ে যেত আর আমাকে বলতো,

‘ভাবলে কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয় রে বাবা।’

মায়ের সেই উপলব্ধিটাকে আমি ধরতে পারছি এতদিন পর, যখন মাকে জানাতে পারব না আমারও বুকের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া অতীত কেমন আকুল স্পন্দন মূর্ত করে তুলেছে।

মাঝেমধ্যে মনে হয় এসব হয়তো ঘটেনি কিছুই আমার জীবনে। সবই বোধহয় কল্পনা। নিজেরে অস্তিত্বে সন্দেহ জাগে। সত্যিই কি আমার আদৌ কোন উপস্থিতি ছিল কোনদিন জগতের একাংশে সংঘটিত ওইসব ক্রিয়াকান্ডে বা এখনও আছে ?

নিজেরই অতীত আমার বর্তমানকে অবিশ্বাস্য করে তোলে আর সেই দোদুল্যমান প্রেক্ষাপটে দেখি আমি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছি কোন এক বারান্দায় কোন এক বৈকালিক অবকাশে। ওটা ওই তিনতলা বাড়িটারই বারান্দা। বাড়ির ঠিক নিচে সামনে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। লোকজনের অবিশ্রাম যাতায়াত। আমি আর মা দেখছি সামনেই রাস্তার ওপরে নানা দোকানপাট। একটা তেলেভাজার দোকানের নাম চোখের খিদে। বিকেল থেকে সেই দোকানে ক্রেতার ভিড়। মা বেশ মজা পায় দোকানের নামটা দেখে। আমার দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বলে,

‘কী অদ্ভুত নাম রে, চোখের খিদে ! বাপরে বাপ, লোকের কী ভিড় দোকানে দেখ্ রে বাবা।’

সব আমার কাছে কী প্রবল জীবন্ত, মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই ধরা যায়। সেই পুরনো রাস্তা ধরে যেতে হয় আমাকে প্রায়ই। যেতে যেতে দেখি তিনতলা বাড়িটা তেমনই আছে, তার সামনে ওই চোখের খিদে দোকানটাও। দেখে আমার সর্বাঙ্গে কেমন আন্দোলন ওঠে। সবই আছে যেমন ছিল, এমনকি আমিও, কেবল মাকেই আমার খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় খুঁজলে পাওয়া যাবে তা-ও জানিনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *