তপোপ্রিয়

আকাশ দরিয়ায়

আকাশে উঠলে অহংকার জাগে। নিচে পিছিয়ে থাকা জনপদ পুতুল-পুতুল, দেখে লাগে যেন খেলনা আমারই খেলাঘরের। মনে হয় নিজের মধ্যে জেগে উঠেছে বিপুল ক্ষমতা, নিজেকেই মাপতে পারি না।

কতকালের সাধ মানুষের আকাশ ধরার। ডানার স্বপ্ন, উচ্চতার মোহ। আরও ওপরে, আরও, আরও—- যত ওঠা যায় আরও ওঠার নেশা পাগল করে দেয়। আমি এমনই উঠব নিচে তাকালে কেবল দেখব সবাইকে আর সবকিছুকে, ওপরে তাকালে কিছুই নেই কেউ নেই।

আকাঙ্খা জমে জমে তারপর বিমান।

আকাশের সঙ্গে আলাপ করার প্রথম সুযোগ পেয়েছিলাম বিস্মৃতবেলায়। এতই ছোট ছিলাম, আলাপ করতে পারিনি। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে ত্রিপুরাতে এসেছিল আমাদের পরিবার অনেকদিন আগে। পাহাড়-জঙ্গলের দেশেই আমার শৈশব। পাহাড় মানে ছোট ছোট মাটির স্তূপ, মাটির রং লাল। মাটির স্তূপগুলোর নাম টিলা, স্থানীয় ভাষায় বলে মুড়া । এক টিলা থেকে অন্য টিলায় যেতে মাঝখানে খাদ, স্থানীয় নাম কুচি । টিলার মাথা আর ঢালে জঙ্গল, কেটে সাফ করে আর টিলার মাথা সমতল বানিয়ে বসতি বানাতে ব্যস্ত উদ্বাস্তু হয়ে আসা পূর্ববঙ্গীয়রা। জঙ্গল হয়তো হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের দরজার পাশে। দিনের বেলাতেই নির্ভয়ে উঠোনে এসে বেরিয়ে যায় শেয়াল। রাতে বেড়ার দরজা গায়ের জোরে ফাঁক করে ঘরে ঢুকে হাঁস-মুরগি ধরে নিয়ে পালায় বনবিড়াল।

অনেক অসুবিধে। বলে শেষ করা যায় না। দুঃখের কাহিনী শোনাতে প্রত্যেকেরই অফুরন্ত উৎসাহ। বলতে গিয়ে কোথায় যে পৌঁছে যায় খেয়াল থাকে না। সবাই বলে, কী ওপাড়ে ফেলে এসে কী পেলাম। প্রত্যেকেরই ও-বঙ্গে ছিল পাঁচটা দিঘি, একশ নারকেল গাছ, দু’শ বিঘা জমি আর দশটা আটচালার ঘর। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। মা শেষে বলত,

‘থাক, আমাদের আর বলে লাভ নেই রে বাবা। আমরা কিছুই ফেলে আসিনি।’

ত্রিপুরাকে প্রায় চারদিকেই ঘিরে রেখেছে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান, যা এখন বাংলাদেশ। মাথার কাছে একচিলতে দড়ির মতো যোগসূত্র আসামের সঙ্গে, ওটাই ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে একমাত্র স্থলপথ যোগাযোগ। ত্রিপুরায় থাকার এটাই বড় অসুবিধে, ভারতীয় মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। যাতায়াত ব্যবস্থা বড়ই পিছিয়ে থাকা। পাহাড়গুলো মাটির স্তূপ হওয়াতেই ঝামেলা। বর্ষায় গলে গলে যায়। রাস্তাঘাট ঠিক থাকে না। ওই কারণেই রেল যোগাযোগ তৈরি করা যায়নি রাজ্যের অন্দরে।

এটাই আবার ত্রিপুরায় থাকার উপকারী দিক, যাতায়াত ব্যবস্থার এই অসুবিধে। ত্রিপুরার লোকেরা, বাধ্য হয়ে যদিও, যখন-তখন প্লেনে চাপে। কলকাতায় আসাটা প্রায়ই জরুরী হয়ে পড়ে মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্তদের। প্রায় সবাই প্লেনেই চেপে বসে।

আমার আকাশযাত্রা সবই মায়ের সঙ্গে। ত্রিপুরা চিরদিনের মত ছেড়ে আসার আগেও দু’-তিনবার যেতে হয়েছিল কলকাতায়, পরেও আবার ত্রিপুরাতে যেতে হয়েছিল কয়েকবার। ত্রিপুরা থেকে চলে এসেছিলাম ঠিকই, জমিজমা সব পড়ে রয়েছিল। মায়ের খুব চিন্তা ছিল,

‘জমিগুলি আর বিক্রি করতে পারি না কি রে বাবা।’

ওই জমিজমা কত যত্নে গুছিয়েছে মা। বাবা লণ্ডভণ্ড ফেলে চোখ বুজেছিল। কেড়েকুড়ে নিতে যাচ্ছিল প্রতিবেশীরা। মায়ের সেই যুদ্ধ দেখেছি। হারিয়ে যাওয়া সম্পদ কিভাবে উদ্ধার করেছিল। বছরের পর বছর ধরে অক্লান্ত চেষ্টায়। তার ওপর আছে চাষবাস। সেই জমিজমা থেকেই বছরের খাওয়া-পড়া, দিদির বিয়ে, আমাদের পড়াশোনা। সবই একা হাতে গুছিয়েছিল মা তিল তিল করে।

‘সব কি শেষে অদানে-অব্রাহ্মণে যাবে ?’

বলত মা। বোধহয় আশঙ্কা বেড়ে যেত একবার পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে আসার সময় কুমিল্লা শহরের বাড়িটা ফেলে দিয়ে আসতে হয়েছিল ভেবে। মাকে আর আমি দেখতে পাই না আজকাল, কোন্ রহস্যে হারিয়ে গেছে কেজানে ! কিন্তু মনে খোদাই করা দেখি সেই দুশ্চিন্তায় নিষ্প্রভু মুখখানা। আমার ইচ্ছে করে নিথর বসে থাকি কোন অসীম নৈঃশব্দে আর কেবলই ভাবি মায়ের মুখ। এত ভাবি এত ভাবি যে মনের পর্দায় অস্পষ্ট সেই মুখ যেন প্রাণ পেয়ে বাস্তব হয়ে ওঠে।

কখনো কখনো দিগন্ত কাঁপিয়ে গুরুগম্ভীর টানা আওয়াজ ভাসতে থাকে। পৃথিবীর অনেক শব্দই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সুপরিচিত। ওই আওয়াজ শুনে তাই অজান্তেই চোখ চলে যায় মাথার ওপর। আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মন্থর মেজাজে এগিয়ে যেতে দেখি ধাতব বিমান। তার রুপোলি গায়ে রোদ লুটোপুটি খায়, মেঘশিশুরা বিলি কাটে। আমি দেখি আর নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকি, আর হারিয়ে যাই, কেবলই হারিয়ে যাই। কোথায় কেজানে !

সেবার মাকে নিয়ে ফিরছিলাম কলকাতা থেকে। তখন কেবল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স, ত্রিপুরার জন্য ভাড়া কিছুটা কম রাখে। প্লেনগুলো প্রায়ই তাই ঝড়তি-পড়তি হয়। আমরা যে প্লেনটায় উঠলাম সেটা বোধহয় সবচেয়ে লজঝড়ে। তার গায়ের ধাতব পাতগুলি দেখি এখানে-ওখানে বেঁকিয়ে আছে, জোড়গুলি থেকে অনেক স্ক্রু আর পেরেক খুলে খুলে পড়েছে। ভিতরের অবস্থাও শোচনীয়। আসনগুলি ছেঁড়া, স্পঞ্জ বেরিয়ে এসেছে। মেঝেতে পাতা কার্পেট রঙচটা, ছেঁড়াফাটা। মা প্লেনে বসে হাসতে হাসতে বলল,

‘কোত্থেকে জোগাড় করেছে রে ? কী ছিরি প্লেনটার !’

হয়তো সেটা বর্ষাকাল। আকাশ দমদমে গেলাম যখন থম মেরে ছিল। প্লেনটা তো ছাড়লো শেষপর্যন্ত। কিছু অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করছিলাম। প্লেনগুলি থাকে যাত্রীঠাসা। অথচ সেই প্লেনটা প্রায় ফাঁকাই। দশ-কুড়িজন যাত্রী হবে কিনা সন্দেহ। আর একটা ব্যাপারও অদ্ভুত লাগছিল। সব যাত্রাতেই প্লেনে দেখেছি বিমান সেবিকারা থাকে। সেই প্লেনে ছিল না। মূল পাইলট ছাড়া আর বোধহয় তার দু’-একজন পুরুষ সহকারীকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তারাই যাত্রীদের খাবার-দাবার দিচ্ছিল। সত্যিই ব্যাপারটা অদ্ভুত।

প্লেন তো আকাশে উঠল। মেঘের আস্তরণ ভেদ করে ঢুকে গেল অনেক উঁচুতে অজানা প্রদেশে। তাকিয়ে দেখি, নিচে কেবল মেঘ আর মেঘ। তাদের গায়ে ঘন কালো রং। সেই ঘন কালো মেঘ ভেদ করে নিচের কোন দৃশ্যই দেখার উপায় ছিল না।

তারপর শুরু হল বৃষ্টি। সে যে কী দুরন্ত বৃষ্টি আঁচ পাচ্ছিলাম জানলার কাচে চোখ রেখে। প্লেনটাকে আগাপাশতলা ঘিরে ধরেছিল কালো কালো মেঘের জটলা। দুর্-দুর্ করে মেঘগুলি দেখছিলাম জানলার কাচে ঠোক্কর মারছিল। বাইরেটা একেবারেই অন্ধকার। কেবল বৃষ্টি নয়, বাইরে যে ঘোর দুর্যোগ চলছে বুঝতে পারা যাচ্ছিল প্লেনের আচরণে। ঘন ঘন এয়ার পকেটে পড়ছিল প্লেন। কখনো এদিকে কাৎ হচ্ছিল, কখনো ওদিকে। গোঁত্তা খাচ্ছিল ক্রমাগত সামনে আর পিছনে। প্রবল ঝাঁকুনি তুলে তুলে একবার নামছিল আর একবার উঠছিল। দুলছিল টালমাটাল। মনে হচ্ছিল ভয়ংকর ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে একটা গরুর গাড়ি চলছে।

মায়ের মুখটা দেখছিলাম ভয়ে শুকিয়ে আছে। এক চিলতে শুকনো হাসি মুখে টেনে মিনমিন করে বলল,

‘কী খারাপ ওয়েদার রে ! কী যেন আছে কপালে।’

আমারও গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। পাইলটের সহকারীদের দেখছিলাম থমথমে মুখে প্লেনের এদিক থেকে ওদিকে ব্যস্তভাবে যাতায়াত করছে। ভিতরে যে আমারও ভয় সেটা মাকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য বেশ বিজ্ঞের গলায় বলেছিলাম,

‘দূর্, এটাকে খারাপ ওয়েদার বলে নাকি। এ তো সাধারণ বৃষ্টি। ওয়েদার খারাপ হলে কি আর প্লেন ছাড়ত ?’

মা আমার কথা শুনে ভরসা পাওয়া উচিত কিনা বুঝতে পারল না হয়তো। মুখের দুশ্চিন্তা কাটল না । জানলার দিকে তাকিয়ে নিথর বসে দেখতে লাগল বাইরের তাণ্ডব।

প্রকৃতির এমন এক ভয়ংকর খেলায় মাকে সঙ্গী করে আমি ছিলাম। এখন বড় ইচ্ছে করছে যদি মায়ের কাছে বসে মায়ের সঙ্গে সেদিনের সেই অভিজ্ঞতার গল্প করতে পারতাম !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *