তপোপ্রিয়

স্বপ্নিল আভাস

কারোও সমস্তটা জীবন কেবলই স্বপ্নের সমন্বয়, ঠিক যেমন ডন কুইক্সট। তাকে ঘিরে সবসময় নানা রঙের স্বপ্নেরা কেবলই উড়ে উড়ে বেড়ায় আর সে নিজেও নিজেকে স্বপ্নগুলির সঙ্গে অবিরল ভাসিয়ে রাখে। স্বপ্ন দেখা ভালো অভ্যেস হলেও সীমানা যদি না থাকে তো জীবনের কোন না কোন সময় কিছু না কিছু আক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। 

নিজেকে বিশ্লেষণ করার অবকাশ হলে দেখি, এমনই নেশা আমাকে ঘিরে রেখেছিল সবসময়। স্বপ্ন দেখার আরাম এমনই প্রবল ছিল আমার মধ্যে যে বাস্তব বিষয়গুলি ভুলে যেতাম। যখন সময় ছিল তখন তাই বুঝতে পারিনি সময় থাকবে না। 

বাস্তবটা কী তা যে বুঝতে পারতাম না এমন নয়। বুঝতে পারতাম ঠিকই কিন্তু সেই অনুযায়ী কাজ করার ইচ্ছে থাকত না। একসময় মনে হয়েছিল, নিয়মিত নিজের দিনলিপি লিখে যাব। তখন বয়স বেশ অল্প ছিল। যদি অভ্যেসটা গড়ে তুলতে পারতাম তো আজ বড়ই কাজে লাগত। বিপরীত চিন্তায় তখন আবার ভেবেছিলাম, দিনগুলি আমার স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে থাকছে। দিনলিপি লেখার কোন প্রয়োজন আছে কি? শেষের এই ভাবনাটাই সফল হয়ে আমাকে আর দিনলিপি লিখতে দেয়নি। এখন বুঝতে পারছি, স্মৃতিকে ভরসা করা যায় না। মায়ের কত কথা, কত কাজ কিছুতেই হুবুহু উদ্ধার করতে পারি না। যদি দিনলিপিতে লেখা থাকত কোন সমস্যাই ছিল না। হেলাফেলায় যা হারিয়ে ফেলেছি তাকে তো আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে না। 

স্বপ্ন দেখার মানসিকতাই এজন্য দায়ী। আমার বিগত দিনের কাজগুলিতে এমনই সব অবাস্তবতা। এখন দেখতে পাই, এমন ভিত্তিনির্ভর কাজকর্ম নিয়ে পৃথিবীর এই মানুষের সভ্যতায় বাস করা অনেকটাই বিপজ্জনক। হয়তো ঠাই হওয়া উচিত ছিল অন্য কোন প্রেক্ষাপটে।

আমাকে নিয়ে আমার মায়ের চিন্তা ছিল অনেক রকম। জীবনে সাফল্য বলতে মা বুঝত অর্থনৈতিক সুদৃঢ় ভিত্তি, আমার কাছে সাফল্য ছিল অন্যকিছু। মা বাস করত রূঢ় বাস্তবে, আমি স্বপ্নে ভেসে বেড়াতাম। তবুও যে অন্তত একটা আর্থিক ভিত্তি আমার মত কেউ গড়ে তুলতে পেরেছে সেটা সম্ভব হয়েছে মায়ের জন্যই। কঠোর বাস্তবের চেহারা আমার কাছে বড়ই অপ্রিয় ছিল, মা যে সেই বাস্তবকেই আঁকড়ে থাকত আমি সেটা পছন্দ করতাম না। আবার ইচ্ছে হোক বা অনিচ্ছায়, মায়ের কাজকর্ম একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়ারও উপায় ছিল না। 

মানুষ পরিবেশ গড়ে তোলে আবার পরিবেশও মানুষকে তৈরি করে। সেই ছোট্টবেলার পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল অনেকটাই দায়ী আমার স্বপ্নালু হয়ে ওঠার জন্য। মা সারাদিন হাজারটা কাজের পর সন্ধেবেলা বসত ঠাকুরের আরাধনায়। যে ঘরে তখন বাস ছিল আমাদের সেই ঘর এখন বাস করে আমার স্মৃতিতে। অন্তত তিনটি ঘর দেখতে পাই তিন ভিন্ন সময়ে। তাদের চেহারা যদিও স্পষ্ট তবুও অনেক কিছুই আবছা। শেষ যে ঘরে থাকতাম তার ভিতর কোথায় যে ঠাকুরের আসন পেতেছিল মা দেখতে পাচ্ছি না, অথচ পাঁচ-সাত বছর সেই ঘরে থেকেছিলাম। তবুও তার চেহারা কিভাবে ভুলে গেলাম? স্মৃতিকে সত্যিই বিশ্বাস করা যায় না। কেন যে দিনলিপি লিখিনি, এই আক্ষেপ সত্যিই আমাকে বিবর্ণ করে। 

সামগ্রিকভাবে মায়ের সন্ধেবেলাটা মনে পড়ে। ঠাকুরপুজো সেরে মা খাওয়ার আগে পর্যন্ত সময়টা কাটাত দিদির মেয়েদের সঙ্গে। অধিকাংশ দিন খাওয়া-দাওয়ার পর দশটা-এগারোটার মধ্যে শুয়ে পড়ত। আমি তখন নিশাচর হয়ে যেতাম। রাত একটা-দুটো বেজে যেত শুতে শুতে। 

রাত জেগে থাকার সময় কখনো হয়তো বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হত। আবার অকারণেও বাইরে যেতাম। বেরিয়েই উঠোন, বাঁ ধরে কলতলার দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। নামার মুখে ছোটখাটো গাছপালার ভিড় বা লাউ-ঝিঙের মাচান। ডান ধারে প্রশস্ত মাঠ, অন্ধকারে মনে হত অনির্দিষ্ট। সেই মাঠের শেষ সীমায় ঝাঁক ঝাঁক গাছপালার ভিড়, ঝোপঝাড়। সামনেই বড় রাস্তা, ঘর থেকে বিশেষ দূরে নয়। এক বা একাধিক গাছেরা থাকত সবখানেই, অন্ধকারে সকলেরই অবয়ব রহস্যমণ্ডিত। অন্য সব বাড়িঘরগুলির মধ্যে কিছু না কিছু ব্যবধান থাকলেও কতটা বা কেমন বোঝার উপায় নেই। 

নিশুতি রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে দাঁড়ালে আমি চোখ রাখতাম সবসময় আকাশের গায়ে। কৃষ্ণপক্ষের তিথিতে আকাশ হয়ে যা থাকত মাথার ওপর সেখানে অজস্র আলোকবিন্দু গায়ে গা ঠেকিয়ে এমনই সুনিবিড় আদরে মাখামাখি করে রাখত নিজেদের যে কোথাও কোন ফাঁকে কোন অবকাশ আছে কিনা খুঁজে পেতাম না। ওইরকম নিঃসঙ্গ রাতের ওই আকাশ আমাকে স্বপ্নপ্রবণ করে তুলত এমনই মাত্রায় যে তার ঘোর কাটাবার সাধ্য ছিল না কোন সময়। আমি স্বপ্নে ঘুরে বেড়াতাম কোটি কোটি তারকা জগতে আর আমার বাস্তব অক্লেশে অবাস্তব হয়ে যেত যখন ভাবতাম দৃশ্যমান জগৎটারও বাইরে কিছু থাকতে পারে কিনা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রান্তে যেসব তারকাপুঞ্জের পাঁচিল তারা তো আসলে শক্তিপুঞ্জ, তারা চলমান আলোর গতিতে। সেই পাঁচিলের বাইরে কোন্ জগৎ তার তো কোন ধারণাও নেই, যেহেতু আলোকোত্তর গতিসম্পন্ন সেই জগতের কোন বার্তা চিরকালই অধরা থেকে যাবে। বার্তাবহ আলোকেই যদি না নাগালে পাই তো সেই জগতকে ধরব কিভাবে?

এমন এক বিভ্রান্তিকর ভাবনায় দাঁড়িয়ে আমার স্বপ্ন দেখা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। স্বপ্ন যদি না দেখতে শিখি তো সেই অকল্পনীয় জগতকে ধারণায় আনব কোন্ মন্ত্রে? আমার মনে হত, স্বপ্ন দেখার ক্ষমতাটাও তো আমার সীমাবদ্ধ। স্বপ্ন দেখব যেসব উপাদানকে ভিত্তি করে সেগুলি এই দৃশ্যমান জগতের বাইরে থেকে তো আসেনি আমার মধ্যে। তাই যতই না হোক আমার ক্ষুরধার কল্পনা, আমার ক্ষমতাই নেই এমন কিছু ভাবার যা দৃশ্যমান জগৎ নিরপেক্ষ বা একেবারেই অবাস্তব। ওখান থেকেই আমি বুঝতে শিখেছিলাম, মানুষ এমন কিছু ভাবতে পারে না যা চূড়ান্তভাবে ভিত্তিহীন। মানুষের ভাবনায় যা মিথ্যে তা কোনো না কোনো বিন্দুতে সত্যি। এরকম ভাবনাচিন্তা আমার বাস্তবকে সবসময় বিপর্যস্ত করে রাখত। আমি ভাসতাম আকাশে। মাও আমার চিনত আকাশটাকে, কিন্তু আকাশে হারিয়ে যাওয়ার বিলাসিতা ছিল না তার মধ্যে। মা মাটিতে পা রেখেই হাঁটতে জানত। মায়ের সঙ্গে এখানেই ছিল আমার আসল অমিল। আগুনের সৌন্দর্য দেখে আমি ভুলে যেতে অভ্যস্ত যে সে পোড়ায়ও বটে। আগুনে হাত না দেওয়া পর্যন্ত এই বাস্তব জ্ঞানটা থাকত না আমার। মা কিন্তু আগুনে হাত না দিয়ে সাবধান হতে পারত, কারণ মা আগুনটাকে আগুন বলেই চিনত। মাকে তাই হামেশাই বলতে শুনতাম,

‘আগুনে হাত দিলে হাত তো পুড়বেই।’

মায়ের বাস ছিল বাস্তব পৃথিবীতে, আমি থাকতাম অবাস্তব আধারে। এই যে পার্থক্য, নানা ঘটনায় উপলব্ধি করতে পারতাম। মনে পড়ে সেই আমার দুর্গাপুজো নিয়ে শখ চাপার প্রসঙ্গ। 

তখন স্কুলেই পড়ি, এইট বা নাইনে। আজ আর মনে পড়ছে না কেন বা কিভাবে শখ চেপেছিল হঠাৎ বন্ধুদের নিয়ে দুর্গাপুজো করতে হবে। বন্ধু বলতে মাত্র দু’জন শিবু চক্রবর্তী আর শম্ভু মজুমদার। শম্ভু থাকত পশ্চিমবঙ্গে। নকশাল আন্দোলনের সময় গা ঢাকা দিয়ে চলে গিয়েছিল আমাদের ওখানে, এমনটাই ছিল তার বক্তব্য। যাই হোক না কেন, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল আমার আর সেও আমাকে খুব উঁচু নজরে দেখত, কেন কে জানে। তার ধারণা ছিল আমি কোনদিন এক দিগ্বিজয়ী লেখক হব। শিবু চক্রবর্তী বয়সে বা পড়াশোনায় আমার ওপরে থাকলেও মেলামেশা ছিল তার সঙ্গে বন্ধুর মত। তার ছোট ভাই বিভূতি একসময় আমার সহপাঠী ছিল। ওদের বাবা চিন্তাহরণ চক্রবর্তী আমাদের কুলপুরহিত আর স্থানীয় উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে দপ্তরির কাজ করতেন। আমার অনেক স্মৃতি শিবুর সঙ্গে। তার মধ্যে অবিস্মরণীয় কিছু হেঁটে চলার প্রসঙ্গ রয়েছে। বর্ষায় বনেবাদাড়ে আর অনুচ্চ টিলা ডিঙিয়ে, পাহাড়ি ঢাল ঘুরে চলা খরস্রোতা খাল সাঁকোয় পেরিয়ে, ঢেউখেলানো অসমতল প্রান্তর ধরে শিবুকে নিয়ে কোথায় না কোথায় চলে যেতাম আমি! শাল-জারুলের বনেজঙ্গলে চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সতেজ রিফুজি লতায় ছাওয়া দূরখি ঝোপের সঘন বেড়া, বৃষ্টি নামত হঠাৎ-হঠাৎ ঝিপিস ঝিপিস। শিবু ছাতা মিলে ধরত, নিজের সঙ্গে আমারও মাথায়। মন উচাটন বৃষ্টিবেলায় আমি আর শিবু ঘুরতাম সকাল কাটিয়ে দুপুর, জলজঙ্গল আর পাহাড়ি উপত্যকায়। সবুজ ঘাস আর ঝোপঝাড়ের লতাপাতায় লুকিয়ে লুকিয়ে হয়ে ঘুরত-ফিরত সুতলিসরু আধ ইঞ্চি ছিনেজোঁক, এক পলক অসতর্কতার ফাঁকে কখন যে গায়ে আটকে রক্ত চুষে টুসটুসে ঢোল হয়ে অজান্তেই টুক করে গা থেকে ঝরে পড়ত বনের মাটিতে টেরও পাওয়া যেত না। আমি আর শিবু ওই অবিস্মরণীয় পথ হাঁটতাম নজরুলকে সঙ্গী করে। আমি গাইতাম একের পর এক গান, শিবু সুর তোলার চেষ্টা চালাত। সে ছিল বড়ই নজরুলগীতির ভক্ত। 

এই দুজনকে সঙ্গী করেই দুর্গাপূজার শখ চেপেছিল। পাড়ায় একটা ক্লাব ছিল, শিবু ছিল তার ঘনিষ্ঠ সদস্য। ক্লাবটা ছিল নামেই, তার কোন ঘরবাড়ি বা অন্য অস্তিত্ব ছিল না। কোন বিশেষ সময়ে কোন পুজো উপলক্ষে তার আবির্ভাব ঘটত। ক্লাবের হয়তো একটা নামও ছিল, কিন্তু ক্লাবের চেয়ে আসল ছিল পাড়া। তখনো ওই ক্লাবে বা আমাদের পাড়ায় হয়তো কোন দুর্গাপূজা হত না। কাছাকাছি আইন উপাধি বিশিষ্ট একটা বাড়িতে দুর্গাপুজো হত নিয়ম করে আর সেখানে পাড়ার সবাই ভিড় জমাত এমনভাবে যে মনে হত সেটা যেন পাড়ারই পুজো। 

আমরা তিনজনে মিলে ঠিক করলাম, পাড়ায় ধুমধাম করে পুজো করব যেটা হবে একান্ত পাড়ারই পুজো। শিবুর সঙ্গে কী কারণে ক্লাবের বিরোধ বেঁধেছিল, সদস্যদের ওপর তার ভীষণ রাগ। শম্ভু নিজেকে অন্য গ্রহের উন্নত জীব ভাবত, কাউকে বিশেষ মানুষ বলে পাত্তা দিত না। অন্যদিকে সমস্ত এলাকার লোকজন তাকে একেবারেই পছন্দ করত না। তার বড় বড় বোলচাল পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষায় তাকে সবার কাছে অপ্রিয় করে তুলেছিল।

পাড়ার নেতাগোছেরছেলেরা কিন্তু প্রথম দিকে বিশেষ উৎসাহ না দেখালেও পরে ব্যাপারটাতে জড়িয়ে গেল। আমাদের সঙ্গে বেশ কিছু আলোচনাও হল তাদের। আপত্তি থাকলেও তারা আমাদের সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি হল কিছু শর্তে। সেই শর্তগুলি না মানায় তারা আর কোন সম্পর্ক রাখল না। 

আমরা তিনজনেই অদম্য উৎসাহে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে এটাও আমাদের জানা ছিল যে কেবল তিনজনেই অত বড় কাজ সামলানো অসম্ভব। তাই শুরু হল দলে আরোও ছেলেদের নিয়ে আসার চেষ্টা। অনেকেই যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। তখন সমস্ত কাজটার চূড়ান্ত পরিকল্পনার ছকে ফেললাম। স্থানীয় এক্স স্কুলের শিক্ষককে পরামর্শদাতা হিসেবে নির্বাচন করে তার কাছে যাচ্ছি তখন সকাল-বিকেল। পরিকল্পনা বিরাট, কেবল পুজোই নয়, তার সঙ্গে আয়োজন করা হবে নানা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান। সেসব ভেবে ভেবে উৎসাহে রাতে আর ঘুম হয় না। কাগজে-কলমে হিসেব করে দেখেও নিয়েছি যে বিপুল পরিমাণ টাকা চাঁদা হিসেবে তুলে ফেলতে পারব। বেশি নয়, জন প্রতি দু’-চার টাকা চাঁদা। চাঁদার পরিমাণ না বাড়িয়ে লোকের সংখ্যা বেশি করতে হবে। হাজারটা অভিনব চিন্তাভাবনা মাথায় কিলবিল করে ঘুরে বেড়াত চব্বিশ ঘন্টা। বাড়ির লোকদেরও জড়িয়ে ফেলেছিলাম। কী কী অভাবনীয় আয়োজন করা হবে পুজোকে কেন্দ্র করে সেসব শোনাই সবসময়। পুজোটা আসলে উপলক্ষ, তাকে ঘিরে যেসব অন্য আকর্ষণ উপহার দেব সেগুলিই প্রধান। মা আমার উৎসাহ দেখে, নিজেও উৎসাহ পায়, আবার বলে,

‘দুর্গাপুজো খুব শক্ত কাজ রে বাবা। অনেক টাকার ব্যাপার।’

মায়ের কথাটা পাত্তাই দিতাম না। তত্ত্বগতভাবে টাকাটা যোগাড় করা কোন সমস্যাই ছিল না আমার কাছে। আমি ভাবতাম, যেসব অভিনব পরিকল্পনা মাথায় এসেছে সেসব কিভাবে আরোও আকর্ষণীয় করে তুলব। মায়ের দেখতাম যত চিন্তা সব ওই টাকা। আমার উৎসাহে মা জল ঢেলে দিত টাকার প্রসঙ্গ তুলে। আর তাই মায়ের ওপর যথেষ্ট রেগেও যেতাম। টাকা-টাকা করলেই মাকে বকেঝকে থামিয়ে দিতাম। 

আমাদের নাচানাচি দেখে পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা ঠিক করল তারাও দুর্গাপুজো করবে। তোড়জোর করে আয়োজন শুরু হয়ে গেল। তাদের সিদ্ধান্তটা আমাদের জন্য একটা বড় ধাক্কা। একই পাড়ায় দুটো পুজো হলে চাঁদা দেওয়ার লোক পাওয়া যাবে না। জনবল যাদের বেশি তারাই বেশি চাঁদা পাবে। ওদের সঙ্গে বেশি লোকজন। কেবল তাই নয়, আমরা মূল তিনজন ছাড়া অল্প আর যে কয়েকটি ছেলে আমাদের সঙ্গে জুটেছিল দেখলাম ওদের সঙ্গেই তারা ভিড়ে গেল। এমনকি, আমাদের নিকট আত্মীয়রাও যোগ দিল ওদের দলে। তখন বুঝলাম যে শেষপর্যন্ত যদিবা আমরা পুজো করি তো তিনজন ছাড়া চতুর্থ কাউকে আর পাবনা আমাদের সঙ্গে। সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। কে চাঁদা তুলবে, কে পুজোর আয়োজন করবে? যেসব অভিনব অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা তাই বা কাদের দিয়ে করাব? কেবল তিনজনে অত অত কাজ কিছুতেই সামলাতে পারব না। এই প্রথম বুঝতে পারলাম যে চাঁদা তোলার কাজটাই সবচেয়ে কঠিন, আর এখানে অনেক ছেলে দরকার। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের ছেলেরা বড় বড় দল নিয়ে সকাল-বিকেল বাড়ি বাড়ি ঘুরত। আমরা অত ছেলে কোথায় পাব? হিসেব করে দেখলাম, আমরা তিনজনে যদি সব কাজ ফেলে কেবল চাঁদা তুলি সারাদিন ধরে তো যে টাকা দরকার তার দশ ভাগের এক ভাগও তুলতে পারব কিনা সন্দেহ। 

বাধ্য হয়ে দুর্গাপুজোর চিন্তা আমরা বর্জন করলাম। মনে আছে, খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেসময়। দিনের পর দিন অভিনব কিছু করার নেশায় এমনই রাঙিয়ে গিয়েছিলাম যে তা করে উঠতে না পারার বিষাদ আমাকে আপাদমস্তক গ্রাস করে ফেলেছিল। পুজোর তখন বেশ কিছুদিন বাকি। আমি নিভে আছি সবসময়। তো আমাকে ওইরকম বিষণ্ণ থাকতে দেখে মা একদিন আমার কাছে এসে বলল,

‘হ্যাঁরে বাবা, পুজো করবি না তাহলে? আহা রে, কত উৎসাহ নিয়ে মায়ের পুজো করবি ঠিক করেছিলি। যা না, নাহয় পাড়ার ওদের সঙ্গেই যা। পুজো করা দিয়ে কথা, এক জায়গায় করলেই হল। তুই গেলে ওরা খুশিই হবে।’

আমি বেশ জোরগলায় বলেছিলাম,

‘অসম্ভব। তা কিছুতেই হয় না।’

মা একটু থমকে গিয়ে আমার কথাটায় সায় দিয়েছিল।

‘হ্যাঁ, তা সত্যিই হয় না। একটা মানসম্মানের ব্যাপারও আছে। তা বলি কী বাবা, এক কাজ কর্। অত যখন উৎসাহ করেছিলি, কর্ মায়ের পুজো। আমার কিছু গয়না তোকে দিচ্ছি। বিক্রি করে পুজোর টাকা হয়ে যাবে।’

জীবনে আমি প্রচন্ড বিস্মিত হয়েছিলাম যে কয়েকবার তার মধ্যে একটি মায়ের ওই প্রস্তাব শোনার পর। আগেই বলেছি, মা আকাশে হাঁটতে জানত না, মাটিতে পা থাকত সবসময়। সেসময় মায়ের ওপর ভীষণ চাপ, দাদার তখনও পড়া চলছে। সংসার চালাতে গিয়ে মাকে সারাদিন কেবলই খাটতে হয়, একটা একটা টাকা জমিয়ে মা দাদাকে মাসের শেষে হোস্টেলে পাঠায়। গয়নাগুলি মায়ের একমাত্র সম্বল, শত দুরবস্থাতেও ওগুলি বিক্রি করার কথা কখনো বলতে শুনিনি মাকে। যখনই নিদারুণ অর্থকষ্ট হত তখনই মা নিজেকে নিশ্চিন্ত করার জন্য বলত,

‘আর গয়নাগুলিই তো আছে। চিন্তা কিসের?’

বাস্তবেই ছিল মায়ের বসবাস। আমি দুর্গাপুজো নিয়ে অভিনব ভাবনায় মেতে উঠলেও মা কেবল টাকাটার কথাই ভেবেছিল। অত বাস্তববাদী মা আমার উৎসাহের কথা ভেবে নিজের শেষ সম্বল গয়নাগুলি বিক্রি করে আমাকে পুজো করতে বলেছিল, একথা ভাবলে আমার জগতে কিসের যেন ঝংকার লেগে যায়। মাকে হারিয়ে আমি এখন রূঢ় বাস্তবে। সেই নিষ্ঠুর বাস্তবের মধ্যেও আবার অনুভব করি স্বপ্নের আভাস।

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *