তপোপ্রিয়

অবসন্ন অবেলায় 


আমার স্কুলে যাওয়াটা হয়েছিল বেশ দেরি করে। বয়স অনুযায়ী ক্লাসটা একটু নিচু হয়ে গেলেও একটু উঁচু ক্লাসেই আমাকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল। 

তার জন্য দায়ী ছিল মায়ের জীবনে ঘটে যাওয়া দুটি বিপর্যয়। একটি হল দেশভাগ আর সেই কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া। স্বদেশ ও স্বভূমি মানুষের গড়ে ওঠে বংশ-পরম্পরায়। পিতা-প্রপিতামহ কেবল নয়, তারও ঊর্ধ্বতন পুরুষ বাসস্থান নির্মাণ করে কোন এক নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে এমনই কোন বিশেষ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। কোন এক বিশেষ জাতির বিকাশ ঘটে কয়েকশ বা কয়েক হাজার বছর ধরে। মানুষের সঙ্গে এভাবেই তৈরি হয় নির্দিষ্ট এক বাসভূমির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। মানুষের পরিচিতি গড়ে ওঠে বাসস্থানকে ভিত্তি করে। স্বভূমি বিচ্যুত মানুষের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয় অস্তিত্বের সংকট। মানুষ তার জীবনে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন বোধ করে নিশ্চয় দুটি ক্ষেত্রে, যদি তাকে স্ব-ভূমি থেকে উৎখাত হতে হয় এবং যদি তার স্বধর্ম বিচ্যুতি ঘটে। দেশভাগও পূর্ববঙ্গনিবাসী হিন্দু বাঙ্গালীদের জন্য এই দুটি ক্ষেত্রেই বিপদ সৃষ্টি করেছিল। কারা কোন্ কেন্দ্রে বসে কী খেলা খেলল আর সেই কারণে এক সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী এক আশ্চর্য সকালে উঠে দেখল তাদের পিতৃপুরুষের বাসভূমি আর তার নিজস্ব বাসভূমি নয়, তা চলে গেছে অন্যের দখলে। বাস্তুচ্যুতি ঘটলে যাদের কারণে তারা কিন্তু এই উদ্বাস্তু জনতার নিরাপত্তার কোন দায় নিল না। পুরুষানুক্রমে তিল তিল করে সমস্ত সাধ আর সাধ্য জমিয়ে বানানো হয়েছিল যে আপন আবাস সেখানে হঠাৎই দেখা গেল বিজাতীয় আস্ফালন, অকারণে বিনা দোষে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হল । তার জমি কেড়ে নেওয়া হল, অথচ বিনিময়ে তাকে দেওয়া হল না বিকল্প জমি। এত বড় অন্যায় ঘটিয়েছিল যারা কলকাঠি নেড়ে তারাই আবার অদ্ভুত বিচারে জনহিতৈষী হয়ে যায় বিশ্বসংসারে। তখন সান্ত্বনা হিসেবে থাকে মানব সভ্যতার অন্য সব অন্যায় আর অবিচারের ঘটনা। সক্রেটিসকে বিষ খাইয়ে আর জোয়ান অব আর্ক ও জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মেরেছিল এই একই সম্প্রদায়ভুক্ত মানবহিতৈষীরা। 

মায়ের জীবনে স্বভূমি থেকে উৎখাত হওয়া ছিল প্রথম বিপর্যয় আর এই প্রথমটির ফলশ্রুতি হল বাবার মৃত্যু। চিরচেনা বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসাটাকে বাবা অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেনি। স্বজনভূমিতে অকারণে প্রতিকূল পরিবেশ গড়ে ওঠায় যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছিল তার হাত থেকে রেহাই পেতে প্রায় সর্বস্ব ফেলে নতুন বাসভূমিতে এসে বাবা অন্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছিল। সেটা ছিল দ্বীপান্তর বা নির্বাসনের সামিল। বাবার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল মানসিক অবসাদ। মায়ের জন্য এই মৃত্যুটা ছিল দ্বিতীয় বিপর্যয়। 

বড়জোর বছরখানেকের মধ্যেই বিপর্যয় দুটি ঘটে গিয়েছিল মায়ের জীবনে। ধাক্কাগুলি সামলে উঠতে অনেকটা সময় লেগেছিল। আমার এখন ভাবলে অবাক লাগে, কিভাবে মা নিজেই নিজেকে স্বাভাবিক করেছিল। স্বজন পরিবেষ্টিত অনুকূল পরিবেশেও আমরা অনেকেই এজাতীয় আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি। তার প্রমাণ দেখেছি নিজেরই ক্ষেত্রে। মা চলে যাওয়ার আঘাতে আমি এখনোও কাতর অথচ আমার চারপাশে রয়েছে সান্ত্বনা অটুট রাখার পরিবেশ। আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত নয়, মাথায় নেই জীবিকা নির্বাহের দুশ্চিন্তা। সুনির্দিষ্ট বাসস্থানে স্বজন পরিবেষ্টিত আমি, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভ্রূকুটি তুলে দাঁড়িয়ে নেই আমার সামনে। 

মায়ের জন্য পরিবেশটা মোটেই এমন সহজ ছিল না। চারপাশে যেসব লোক তারা কেউ স্বজন নয়, তাদের সঙ্গে মেলামেশাও ছিল না মায়ের। আগে চেনা লোক ছিল যারা, যাদের সঙ্গী করে বাবা অচেনা দেশে এসেছিল স্বজন বিশ্বাসে তারা তখন শত্রু হওয়ার অপেক্ষায়। মানুষজন অচেনা হলেও চলে যদি আজন্মলালিত বাসস্থানে থাকা যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে দেশটা ছিল সম্পূর্ণ নতুন আর অচেনা। যদি অনুকূল পরিবেশ কেউ থাকে তো নতুন অচেনা দেশও দুশ্চিন্তার নয়। কিন্তু পাহাড়-জঙ্গলে ছাওয়া ওই প্রকৃতি মায়ের কাছে ছিল এক দুঃস্বপ্ন। চেনা লোকেরা তো মায়ের জন্য দুর্জন হয়ে উঠতে যাচ্ছিলই, আবার অচেনা মানুষজনদের মধ্যেও ছিল না সহৃদয় ব্যবহার। কাঠ কাঠ চরিত্রের লোকেরা সব অনুদার প্রকৃতির মতোই রসকসহীন। প্রাকৃতিক সংস্পর্শই যে তাদের এমন বানিয়েছিল তা নয়, সঙ্গে ছিল দেশটির দুর্দৈব। প্রাণ জুড়োবার ছায়া দেওয়ার উপায় ভুলে গিয়েছিল তারা। মানসিক অবসাদে ভুগে ভুগে মৃত্যু হয়েছিল বাবার। এই অবসাদের সূত্রপাত ঘটেছিল নতুন দেশটিতে আসার পর পরই। কেবলই হা-হুতাশ করে বলত,

‘হায় হায়! কী হবে? তোমাদের আমি অকুলে ভাসিয়ে দিয়ে গেলাম।’

দিনের পর দিন বুঝিয়ে বা সাহস দিয়েও বাবাকে চাঙ্গা করতে পারেনি মা। ত্রিপুরাতে এসে উপার্জনের উপায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং হাতে নগদ টাকা না থাকাটা হয়েছিল প্রধান দুশ্চিন্তার কারণ। একদিন কথায় কথায় মাকে বলল,

‘যদি অনেক টাকা হাতে থাকত তাহলেই আবার ভরসা ফিরে পাওয়া যায়।’

কলকাতায় তার ভাগ্নেকে বাবা অনেক টাকা ধার দিয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে। মাকে জানালো, ওই টাকাটা হাতে থাকলে আমার কোন দুশ্চিন্তাই থাকত না। 

কোনভাবে পরিস্থিতিটাকে অনুকূল করতে না পেরে মা ভাবল, কলকাতায় গিয়ে ভাগ্নের কাছ থেকে ওই টাকাটা নিয়ে আসতে হবে। দাদা আর দিদি পড়াশুনা করত কলকাতায়। তাদেরও দেখে আসা দরকার। বাবা প্রস্তাবটা মেনে নিল সানন্দে, মাকে বাড়তি উৎসাহ দিতে লাগল কলকাতায় যাওয়ার জন্য। বাবাকে এই অবস্থায় ফেলে যাওয়ার একটু অনিচ্ছা ছিল অবশ্য মায়ের, আমাকে নিয়েও একটা চিন্তা ছিল। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে নাকি রেখে যাবে বাবার কাছে। বাবা জানিয়েছিল,

‘ছোটনকে তোমার সঙ্গে নিয়েই যাও।’

বাবা আমাকে ছোটন বলে ডাকত। অস্পষ্ট হয়ে এলেও আমার এখনো মনে আছে কতটা আমি তার প্রিয় ছিলাম। আমাকে কাছছাড়া করে থাকতে কষ্ট হলেও নিজের অবস্থার কথা ভেবে কাছে রাখতে ভরসা পায়নি। আমাকে সঙ্গে নিয়েই মা কলকাতা চলে গিয়েছিল। 

আসলে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এই ব্যাপারটা এসে গেল। বলতে যাচ্ছিলাম নতুন প্রতিবেশীদের ব্যবহার সম্পর্কে। তাদের কথাবার্তার এমনই ধরন যে হতাশায় সান্ত্বনা পাওয়া দূরের কথা, কেউ স্বস্তিতে থাকলেও সে অস্বস্তির শিকার হবে। আমরা চলে যাওয়ার পর বাবার অবস্থা এতই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে বাবা একসময় খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তাকে ভরসা দিতে তার কাছে রেখে যাওয়া লাবিজেঠিমা প্রতিবেশী লোকজনদের ডেকে এনেছিল নাকি কয়েকবার। তাদের সান্ত্বনার ভাষা শুনে কি বাবা কখনোও সাহস ফিরে পেয়েছিল? কে কী বলেছিল কিছু কিছু পরে জানতে পেরেছিলাম। নরেশ আইন বলে এক প্রতিবেশী বাবার কাছে এল একদিন। এসে খুব হম্বিতম্বি করে বলল, 

‘আপনি মশাই খাচ্ছেন না কেন বলুন তো? আপনি না খেয়ে মরলে আমাদের কী কাঁচকলা? আপনার বউ-ছেলে সব অনাথ হবে। এবার মশাই আপনি খেলে খান, না খেলে না খান, আপনার মর্জি। আমাদের কী দায় পড়েছে আপনাকে খেতে বলার? আমাদের কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই নাকি যে আপনাকে খাওয়ার জন্য তোষামোদ করব?’

মানসিকভাবে বিধ্বস্ত কাউকে যারা এমন ভাষায় সান্ত্বনা জানায় তাদের কাছে সহানুভূতি আশা করা যায় না। এ থেকেই বাবার আচমকা মৃত্যুর পর মায়ের জন্য সমস্ত পরিবেশটা কেমন দুঃসহ হয়ে উঠেছিল আজও তার কিছুটা অন্তত অনুমান করতে পারি। 

আমার স্কুলে যাওয়া পিছিয়ে গিয়েছিল এসব কারণেই। 

তারপর একদিন মা বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে উঠল। যতই প্রতিকূল হোক না কেন পরিবেশ বা পরিস্থিতি নিজের কাছেই নিজে মা সান্ত্বনা খুঁজে নিতে পেরেছিল। মায়ের সহায় হওয়ার কেউ ছিল না। ভরসা দিতেও কেউ আসেনি। নিজের দুরবস্থাটা বুঝতে পেরে সেদিন থেকে মা সঙ্গী করে নিয়েছিল শ্রীগোবিন্দকে। যে যাই বলুক না কেন, আমৃত্যু মা এই সঙ্গীর সঙ্গ ছাড়েনি। বলত অনেকে অনেককিছুই। ক্যানিং-এ থাকত নীলুমাসি। সে একবার মাকে বলেছিল, 

‘তুই কৃষ্ণঠাকুরের পূজো করিস কেন বলতো ছোড়দি? কৃষ্ণঠাকুর মানুষকে খুব কষ্ট দেয়।’

মাসি কথাটা বলেছিল স্বাভাবিক দরদ থেকে। কষ্ট তো জীবনে সত্যিই মাকে অনেক পেতে হয়েছিল, বিশেষ করে বাবা মারা যাওয়ার পর। মা নিজেই বলত, 

‘আমার হল কষ্টের কপাল। তা নিয়ে দুঃখ করে কী করব? সবার তো আর কপালে সুখ লেখা থাকে না।’

কপালের লেখা কথাটাতে মায়ের বেশ বিশ্বাস ছিল। বলত, 

‘অদৃষ্টের ফল, কে খন্ডাবে বলো, তার সাক্ষী আছে মহারাজা নল।’

এই বিশ্বাসই হোক বা অন্য কিছু, শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীগোবিন্দ মায়ের কাছে কখনোও বিরাগভাজন হতে পারেনি। মা বিশ্বাস করত, যা কিছু কষ্টদুঃখ সবই নিজের কর্মফল। তার ইষ্টদেবতা এজন্য দায়ী নয়। দায় থাকা তো দূরের কথা, মায়ের এটাই ছিল ধ্রুববিশ্বাস যে শ্রীগোবিন্দকে স্মরণ করে তবুও কিছুটা কর্মফল এড়ানো যায়। লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে এই ধ্রুববিশ্বাস কথাটা মা খুব বলত। 

বাস্তব জগত থেকে মা বেশ কিছুদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মাকে আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনেনি কোন বান্ধব। ফিরে এসেছিল মা নিজেরই স্বাভাবিক বোধে। এই ফিরে আসার প্রসঙ্গ পরে অনেকবার মা আমাদের শুনিয়েছিল গল্প করতে করতে। বলত, 

‘আমার মনে হল, যে গেছে সে তো গেছেই। আমিও যদি এভাবে পড়ে থাকি তো আমার নাবালকগুলি যে ছাড়ে-খারে যাবে।’

মা বাস্তবে ফিরে এসেছিল আমাদের তিন ভাইবোনের দিকে তাকিয়ে। আমার জন্য ভাবনাটা মুখ্য হয়ে উঠেছিল মায়ের কাছে। 

তবুও আমাকে স্কুলে পাঠাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। এলাকায় উচ্চমাধ্যমিক মানের বড় স্কুল ছিল একটাই। মুশকিল এই যে আমাদের বাড়ি থেকে স্কুলটা প্রায় দেড়-দু কিলোমিটার দূরে। অতটা রাস্তা কিভাবে যাব? এর থেকেও অনেক দূরের ছেলেমেয়েরা হেঁটে স্কুলে যেত, কিন্তু মা আমাকে ওভাবে ছাড়তে সাহস পেত না। প্রাইমারি স্কুলও ছিল দু-একটা, কোনটাই আমাদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারের কম নয়। ওই স্কুলগুলোতে আমাকে ভর্তি করাবার ইচ্ছেও ছিল না মায়ের। মা চাইত, ওই বড় স্কুলটাতেই আমি পড়ি। কিন্তু যাতায়াতটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। মা তখন ভাবল, 

‘থাক। এখন বাড়িতেই পড়াশোনা করুক। আর একটু বড় হলে তারপর স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া যাবে। বড় হয়ে বুঝতে শিখলে একা স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে, আমার চিন্তাটাও কম থাকবে।’

তারপর বাড়িতেই আমার পড়াশোনা চলতে থাকে, চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত চলে এভাবে। ততদিনে আমি বেশ বড় হয়ে গেছি। মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াই সকাল দুপুর। আশেপাশের সঙ্গী-সাথীও জুটে গেছে। মা বারণ করেও ঘরে আটকে রাখতে পারে না। সারাদিনে মায়ের অনেক কাজ। সবসময় আমাকে নিয়ে বসে থাকা সম্ভব ছিল না মায়ের। মনে হচ্ছিল যে এবার আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার সময় এসেছে। দু’-একদিন দেখিয়ে দিলেই যাতায়াতটা অভ্যেস হয়ে যাবে। পাড়ার অনেক ছেলেমেয়েই ওই বড় স্কুলটায় যায়। তাদের সঙ্গে আমিও দিব্যি যেতে পারব। 

সেই স্কুলের হেডমাস্টার মশাইয়ের তখন বেশ সুনাম। তাঁর নামটা ছিল শশাঙ্ক মোহন শীল। রোগাপাতলা, লম্বা আর কালো চেহারার ভদ্রলোক কথা বলেন কম, বলেন ধীরেসস্থে। আমি ওই স্কুলে ভর্তি হওয়ার অল্প দিন পরে উনি বদলি হয়ে চলে যান। একটা-দুটো ক্লাস নিয়েছিলেন ইংরেজির। তাঁকে আমার বেশ মনে আছে। হিসেব অনুযায়ী যদিও আমার পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার কথা কিন্তু ওই ভদ্রলোকের জন্য আমাকে চতুর্থ শ্রেণীতেই ভর্তি হতে হয়েছিল। 

বাজারের দিকে যেতে একটা রাস্তা বেরিয়ে গিয়েছিল বাঁ দিকে। উঁচু-নিচু পথে খানিকটা এগিয়ে যেতে কলেজটিলা বলে একটা জায়গা, ওখানে ছিল বিটি কলেজ। ওই স্কুলটা ছিল কলেজ কম্পাউন্ডে, কলেজেরই একটা লম্বা একতলা বাড়িতে। পাশেই ছিল কলেজ লেকচারারদের আবাসন। হেডমাস্টার মশাইয়ের জন্য সেখানেই একটা কোয়ার্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একদিন সন্ধেবেলা মা আমাকে নিয়ে দেখা করতে যায় হেডমাস্টার মশাইয়ের কোয়ার্টারে। আমার এখনো মনে আছে, কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন একতলা কোয়ার্টারের বারান্দায় শশাঙ্কবাবু শান্তভাবে দাঁড়িয়ে মায়ের কথা শুনছিলেন। ওখানে উনি মুখে মুখে নিজেই আমার একটা অ্যাডমিশন টেস্ট নিয়েছিলেন ইংরেজিতে। তোমার নাম কী, তোমার বাবা কী করতেন জাতীয় কিছু প্রশ্ন। তার মধ্যে বোধহয় বাবার পেশাটা কী ছিল তার উত্তর দিতে পারিনি আমি। মাকে ব্যাপারটা একটু অপ্রস্তুত করে দিয়েছিল। বাড়িতে ফেরার পথে মা বলেছিল আমাকে,

‘বাবা কী করত বলতে পারলি না? দ্যাখ্ তো, কী মনে করলেন ভদ্রলোক?’

শশাঙ্কমোহন বাবু তখন তখনই কথা দেননি যে আমাকে স্কুলে ভর্তি করে নেবেন। এই নিয়ে মায়ের আবার কয়েকটা দিন একটু দুশ্চিন্তার মধ্যে কেটেছিল। আশার কথা ছিল এটুকুই যে ভদ্রলোক বাবার পরিচয়টা জেনে একটু বোধহয় প্রভাবিত হয়েছিলেন, অন্তত মায়ের তাই মনে হয়েছিল। তাছাড়া মা বোধহয় তার মধ্যে খানিকটা সহানুভূতির দৃষ্টিও দেখতে পেয়েছিল মা। ক্লাস ফাইভে আমাকে ভর্তি করাবার ইচ্ছে ছিল মায়ের, শশাঙ্কবাবু বলেছিলেন যে এত উঁচু ক্লাসে প্রথম ভর্তি করাবার কিছু সমস্যা আছে। মাকে নিরাশ করেননি ভদ্রলোক, আমাকে তার স্কুলে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। তবে পঞ্চম শ্রেণীতে নয়, চতুর্থ শ্রেণীতে। কিছুটা আপত্তি থাকলেও মাকে রাজি হতে হয়েছিল। শুরুতেই এভাবে আমি একটা বছর পিছিয়ে পড়ায় মায়ের বেশ মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। 

এতগুলি বছর পেরিয়ে আবার যখন সেই সব দিনের কথা বলতে যাচ্ছি, মনে হচ্ছে আমারই চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই সমস্ত দিনের অদৃশ্য কায়াগুলি। তারা আমার এত কাছে অথচ অধরা, এ কোন্ অদেখা জাদুকরের আজব খেলা! দরজা খুঁজে পেয়েও ঢুকতে পারছি না রহস্য কুঠুরির অভ্যন্তরে, যদিও ওই অভ্যন্তরেই রয়েছে আমার চেনা প্রদেশ। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেবলই অপেক্ষা করি, বেলা কাটে। অবসন্ন নিথর সন্ধে লাগার আগে তাকিয়ে দেখি দিনের আলো, দিগন্তমুখী বকের ডানায়।

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *