তপোপ্রিয়
সময়ের ভাঁজ
সেই কোন ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, সময় কারো জন্য বসে থাকে না। বয়স বাড়ার নানা পর্যায়ে ব্যাপারটা বিভিন্ন অনুভূতি সৃষ্টি করে এসেছে। সময় থেমে থাকে না মানে কী ? ছোট ছিলাম যখন ভাবতাম ঘড়িটাই যত নষ্টের গোড়া। সময় এই যে অবিশ্রাম ধারায় কেবল চলে যায় সে তো ঘড়ির কাঁটাতেই সূচিত হয়। বেশ ইচ্ছে হত একসময় ঘড়ির কাঁটাগুলো ভালো করে বেঁধে রাখব কোনো খুঁটির সঙ্গে। এভাবে যদি সময়কে আটকে রাখা যায়।

একটা দেয়ালঘড়ি ছিল বাড়িতে আমাদের। চেহারা তার একেবারে সনাতন ঢঙের। কাঠের শরীরটার ওপরের অংশটা গোলাকৃতি ষড়ভুজ বা অষ্টভুজ, নিচে পেন্ডুলামের খোপটা চতুর্ভুজ। গায়ে তার রোমান হরফে এক, দুই, তিন, চার লেখা। বেশ বড় বড় মিনিট আর ঘন্টার কাঁটাগুলি, কোন সেকেন্ডের কাঁটা ছিল না। পেন্ডুলামটা দুলত টিক টিক টিক। সপ্তাহে একবার কাঁচের ঢাকনা খুলে দুদিকে চাবি ঘুরিয়ে দিতে হত। ঘড়িটা দেয়ালের গায়ে নাগালের বাইরে ঝোলানো ছিল। একটা চেয়ার তলায় রেখে তার ওপর দাঁড়িয়ে মা চাবি দিত ঘড়িটায় সপ্তাহে সপ্তাহে। অনেক দিনের পুরনো ঘড়ি, বিশ্বস্তভাবে সময় দেখিয়ে যেত। একটু-আধটু বেগড়বাই যে করত না এমন নয়। হয়তো বেশ স্লো যেত বা চলতে চলতে কাঁটাগুলি দাঁড়িয়ে পড়ত। পেন্ডুলামটাকে স্ক্রু ঘুরিয়ে একটু নামিয়ে বা উঠিয়ে দিতে হত। ঘড়িটার ওপর মা বিরক্ত হত প্রায়ই।
‘ঘড়ি না, ঘোড়া।’
বিদ্রুপ করে বলত মা। কিন্তু মায়ের কথায় মিশে থাকত কী একটা যেন টান। ঘড়িটার ওপর বিরক্ত হতো মা, বকাবকিও করত, কতদিন বলেছিল ঘড়িটাকে জলে ফেলে দেওয়ার কথা। যতই বকুক না কেন মা শুনে মনে হতো যেন বকছে নিজের কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে।
ওই ঘড়িটা আজ হারিয়ে গেছে।
কালের চলন প্রকাশ পেত যার চলনে সে নিজেই কালের গহ্বরে অন্তর্ধান করেছে। আমার বড় ইচ্ছে করে ওই ঘড়িটাকে আবার ফিরে পেতে। কী এক আশ্চর্য বিশ্বাস আমাকে বিহ্বল করে রাখে ঘড়িটার কথা মনে হলে। তার ঢাকনা খুলে ভিতরের কলকব্জা বড় হয়ে আমি অনেক ঘাঁটাঘাটি করেছি তার বার্ধক্যজনিত রোগ সারিয়ে তুলব আশায়। তার হারিয়ে যাওয়ার কারণ কিছুটা আমিও। মনে হয় যদি ওই ঘড়িটাকে আবার ঘরের দেয়ালে ফেরত পেতাম আর পেন্ডুলামটা দুলত নিয়মিত ছন্দে এদিক ওদিক তো হয়তো হারিয়ে যাওয়া দিনগুলিও ফিরে আসত। ঘড়িটা আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে তার সমকালীন সময়কে অঙ্গীভূত করে।
এমনি করে আমি ফিরে পাওয়ার জন্য আকুল আরো কিছু বিষয় যারা আমার বিগত দিনগুলির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত, অথচ আজ যাদের অস্তিত্ব নেই। চলে যাওয়া সময়কে ফিরিয়ে আনবো কিভাবে ? যদি বিগত সময়কে আবার এখন পাই তো সেই সময়ের অন্তর্গত সমস্ত কুশীলব আর ঘটনাগুলিকেও ফেরত পেতে পারি। একটা সরল গাণিতিক নিয়ম আমাকে ভাবায়। কোন অতীত সময় ফিরে পেলে তার অন্তঃস্থ সমস্ত বিষয়ই আবার ফিরে আসবে, অথবা বিপরীত প্রক্রিয়াতে অন্তঃস্থ বিষয়গুলিকে যদি উদ্ধার করা যায় তো বিশেষ সময়টিকেও উদ্ধার করা যাবে। আমি তখন এক অধরা অংকের কথা ভাবি যে অংক আমাকে সেই অজানা পদ্ধতি শেখাবে যাতে বিগত সময়ের কয়েকটি বিষয় হাতে পেলেই সময়টি আবার ফিরিয়ে আনা যায়। আমার কেবলই বিশ্বাস হয়, এই ভাবনা বাতুলতা নয়। যদি হারিয়ে যাওয়া সময়ের কয়েকটি বিষয় মূলধন করে গোটা সময়কালটিকে ফিরিয়ে আনা যায় তো তার সঙ্গে ওই সময়কালের সমস্ত কিছুই ফিরে আসতে পারে। তখন কি আবার মাকে ফিরে পাবো না ?
কালের গায়ে ভাঁজ পড়ে, চলতে চলতে সময় মোচড় খায়। এ খুব সাধারণ কথা, আবার জটিলতম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিরাট ব্যাপ্তি জুড়ে মহাকালের যে নিরন্তর প্রবাহ তা সমস্ত অবস্থাতেই অবিচল থাকতে পারে না, কিছু না কিছু ক্ষেত্রে বিকৃতি দেখা যাওয়াই স্বাভাবিক। আবর্তনের ধারায় সময়ের গা কোথাও না কোথাও পাক খেয়ে যাবেই, ভাঁজ পড়বে কালের গায়ে। মোচড়ই খাক আর ভাঁজই পড়ুক, এই প্রক্রিয়াতে কোন বস্তুর দুটি দূরবর্তী বিন্দু কাছাকাছি চলে আসে। ওই দুটি দূরবর্তী বিন্দুর অবস্থান যদি হয় অতীতে এবং বর্তমানে তো কোন বিশেষ অতীত আর বর্তমান কাল এমন বিচিত্র খেয়ালে নিকটবর্তী হয়ে যায়। অতীত তখন বর্তমানের নাগালে থাকে। আর যদি দুটি বিন্দু পরস্পর আপতিত হয়, বর্তমান তখন অতীতকে ফিরে পেতে পারে।
সময়কে নিয়ে মানুষ ভেবেছে যুগযুগান্ত ধরে। এই ভাবনার কোন অন্ত নেই। অতীতের কাজ আমার বর্তমানকে নির্ধারণ করে। বর্তমানেই বুঝতে পারি, অতীতে কোন্ কাজ ভুল করেছি। সেই ভুল সংশোধনের জন্য অতীতে ফিরে যাওয়া দরকার অথবা অতীতকে ফিরে পাওয়া। সময়কে তাই নিয়ন্ত্রণে আনতে মানুষ এমন উৎসাহ পায়।
আমাকেও এই ভাবনা সজীব রাখে। হয়তো সমস্তটাই আকাশকুসুম, তবুও ভাবলে প্রেরণা পাই যে কোন একদিন নিশ্চয়ই সময়ের এই রহস্যমণ্ডিত বাঁক খুঁজে পাব। সেই অজানা অংক জানা হয়ে যাবে আমার। এই বিশ্বাসের তাড়নাতেই আমি ফিরে পেতে চাই জীবনের কিছু হারিয়ে ফেলা বিষয়। বলেছি ওই দেয়ালঘড়ির কথা। কিন্তু ওটাই একমাত্র নয়।
আমার আবার ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে হয় মায়ের সেই শ্রীকৃষ্ণের ফোটো। ওখানে অনেক ইতিহাস। ওই পুরনো ঘড়ির চেয়েও অনেক বেশি। ঘড়িটা নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। তার হারিয়ে যাওয়ার কথাটা আজ আর মনে নেই। বোধহয় একেবারেই অচল হয়ে যাওয়ায় তাকে ফেলে রাখা হয়েছিল। তারপর কোথাও হারিয়ে গেছে বা কেউ নিয়ে চলে গিয়েছিল। অথবা এমনও হতে পারে যে বাড়ি পাল্টানোর সময় তাকে ফেলে এসেছিলাম। শ্রীকৃষ্ণের ফোটোটা না থাকার ঘটনা কিন্তু এমন অস্পষ্ট নয়। তাকে আমি নিজের হাতে বিসর্জন দিয়েছিলাম। মনে পড়ে আজ সেই কথা। বেশিদিন আগের নয়। মা তখন পুরোপুরি স্মৃতিবিস্তৃত। বেঁচে আছে কেবল। অস্বাভাবিকতা মায়ের চলনে-বলনে-কার্যকলাপে। আমাকেও চিনতে ভুল করে হরহামেশা। মা আর ঠাকুরপুজো করতে পারেনা। একেবারে নিজস্ব কাজগুলিও অন্যকে করে দিতে হয়।
শ্রীগোবিন্দ মায়ের প্রিয় ঠাকুর। অনেকেই মাকে বারণ করত কৃষ্ণপুজো করতে, নাকি তাতে দুঃখ বাড়ে। মা শুনত না কারও কথাই। প্রথম যখন ঠাকুরপুজো শুরু করে মা আসনে ওই কৃষ্ণের ফোটো বসিয়েছিল। ত্রিভঙ্গমুরারী, হাতে বাঁশি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বছরের পর বছর শ্রীকৃষ্ণের ফোটোতে ফুল আর তুলসী দিয়ে পুজো করে এসেছে মা সুখে-দুঃখে, কোনদিন অন্যথা করেনি। নিদারুণ কষ্টের সময় নিজের মনোবেদনা নিবেদন করেছে। যত্ন করে সেই ফোটো মা ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে রাখত নিয়মিত। সেই ফোটো অনেকদিন ব্যবহারে অনেকটাই নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আমি নিজের হাতে সংস্কার করে দিয়েছিলাম। নতুন ফ্রেম কিনে এনে আঠা-পেরেক লাগিয়ে মজবুত করে তোলা ছাড়াও মূল ছবিটার অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া অংশগুলির স্পষ্টতা ফিরিয়েছিলাম রং-তুলি দিয়ে। ফোটো প্রায় নতুন হয়ে গিয়েছিল। মা দেখে খুবই খুশি। যথেষ্ট খেটেছিলাম, সময় অনেক লেগেছিল, কিন্তু মায়ের আনন্দ দেখে মনে হয়েছিল ঠিক এজন্যই আমি কাজটা করেছিলাম। আপ্লুত গলায় মা বলেছিল,
‘খুব ভালো কাজ করেছিস রে বাবা। ঠাকুর তোর মঙ্গল করবে।’
তারও অনেকদিন পর সেই কৃষ্ণের ফোটো বিসর্জন দেওয়ার কথা ভাবলাম আমি। মায়ের তখন চূড়ান্ত অস্বাভাবিক অবস্থা। দুর্দশায় আমিও বেশ কাতর। শ্রীকৃষ্ণের পুজো আর কে করে ? নিষ্ঠা নিয়ে পুজো না করাও নাকি খারাপ, অন্তত কৃষ্ণঠাকুরের পুজোয় ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে চলে না। আবার নিত্য পুজোর ঠাকুরকে নাকি তুলে রাখা অন্যায়। দশজনের কথা শুনে উপায়ান্তর হয়ে বিসর্জন দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। কেবল জিজ্ঞেস করা হলো না মাকে। যেহেতু মা তখন মতামত দেওয়ার পর্যায়ে নেই। যদি সুস্থ থাকত আমি নিঃসন্দেহে যে মা কিছুতেই আমাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে দিত না। ওই কৃষ্ণের ফোটো ছিল মায়ের প্রাণের প্রিয়, বেলা-অবেলার সঙ্গী।
কোন এক যাত্রায় কৃষ্ণের ফোটো সঙ্গে করে বেরিয়েছিলাম বিসর্জন দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কলকাতার বাইরে গঙ্গা পেরিয়ে যেতে যেতে থামলাম একটা সেতুর ওপর। কয়েকশো ফুট নিচে পাক খেয়ে বয়ে যাচ্ছিল গঙ্গা। কৃষ্ণের ফোটোটা হাতে নিয়ে আমি পলকের জন্য বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যিই ফেলে দেব ? এই ফোটোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মায়ের কত হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, কত আবেগ আর কত আন্তরিকতার কাহিনী। ফেলে দিলে আর কি ফেরত পাব ?
এক পলক মাত্র। কখন যে হাতের মুঠি খুলে দিয়েছিলাম নিজেরই খেয়াল ছিল না। কেবল দেখেছিলাম, কৃষ্ণের ওই ফোটো সবেগে ঘুরতে ঘুরতে অনেক নিচে গঙ্গার বিপুল জলরাশির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই মুহূর্তে জানতাম, আর ওই ফোটো কোনদিনও উদ্ধার করতে পারব না। আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগের ঘটনা। মা বোধহয় তার বছরখানেক পর আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
আমি জানি বিশ্বজগতের কিছু না কিছু অবস্থায় এই বছরগুলি নিশ্চয় মোচড় খেয়ে আছে। যদি সেই মোচড় সনাক্ত করা যেত তো সেই বিন্দু খুঁজে পেতাম যেখানে আমি দাঁড়িয়েছিলাম গঙ্গার সেতুর ওপর শ্রীকৃষ্ণের ফোটো ফেলার মুহূর্তে।
তাহলে ওই ফোটো আবার ফেরত পেতাম।
সঙ্গে ফেরত পেতাম আমার মাকে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন