তপোপ্রিয়
বিবশ বেলার ভীতি
মায়ের ছিল বড়ই ভূতের ভয়। রাত্তিরে একা একা বাইরে যেতে গেলে চোখমুখ শুকিয়ে যেত। ত্রিপুরাতে থাকতাম যেখানে সেটা শহর ছিল না। এমনিতেই রাজ্যটা পাহাড়-জঙ্গলের দেশ। শহরকেও শহর মনে হতে চায় না, শহর ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে জঙ্গল আর পাহাড়। কোন গোটা শহরই বোধহয় ওখানে পুরোপুরি সমতল নয়। রাস্তাগুলি চলতে চলতে ঘন ঘন ওঠানামা করে। শহরের এপাশটায় খাড়াই তো ওপাশে ঢাল।
আমাদের বাড়ি শহরের বাইরে হওয়ার জন্য নির্জনতা ছিল আরও বেশি। প্রথমদিকে বাড়িটা ছিল গাড়ির রাস্তা থেকে অনেকটা ভিতর দিকে। বাড়ির সামনে খোলা মাঠ। কয়েকশ’ ফুট লম্বা মাঠের পাশেই ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া জঙ্গলে কাঁঠাল আর আনারস বাগান। খোলা মাঠটায় পাট গাছের চাষ হলে মনে হত সেখানেও একটা বন তৈরি হয়ে গেছে। এই পরিবেশ নির্জন হবে স্বাভাবিক কারণেই। আবার বাড়িতে ঢুকতেই বড় একটা আমবাগান, তার পাশে বড় বড় দুটো বাঁশঝাড়। বড় ঘরে বসে পিছনের জানলা দিয়ে তাকালে ওখানেও একটা প্রশস্ত মাঠের মতো চত্বর, যার শেষ থেকে আবার এক সারি আম-কাঁঠাল গাছ আর তারপরে অনেকটা ঢাল নেমে গেছে এক জলাভূমির দিকে। জানলায় দাঁড়ালে গাছপালার ফাঁক দিয়ে জলাভূমিটা দেখা যেত অনেকদূর পর্যন্ত।

এই যে জঙ্গল-জঙ্গল পরিবেশ, এখানে আনাচে-কানাচে মজুত রয়েছে নানারকম ভয় পাওয়ার উপকরণ। দিনেও নিরালা দুপুরে একা একা বাঁশঝাড়ে বা পুকুরপাড়ে যেতে গা ছমছম করে। রাতে এলাকাটার রহস্যময়তা বেড়ে যেত আরও অনেক। গ্রামীণ পরিবেশ বলে আকাশ যেমন অনেক স্বচ্ছ তেমনি অন্ধকারও খুব বেশি পরিষ্কার। অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা, বাঁশবন, ঝোপঝাড়কে মনে হত আরো গাঢ় অন্ধকার। তাদের জমাট বাঁধা অস্পষ্ট অবয়ব বুকে ভয় জাগিয়ে তুলত। তার মধ্যে ছিল আবার ঘাড়ের কাছে পেঁচার ডাক। একটু পরপর নিকটবর্তী জঙ্গল থেকে ভেসে আসতো শেয়ালদের সমস্বরে হুক্কা-হুয়া। ঝিঝিঁ পোকার ঐকতান, পাখিদের অবসন্ন স্বরেও বুক দুরুদুরু করে উঠত।
এরকম পরিবেশে রাতে বাইরে যেতে খুব ভয় পেত মা। বাইরে তো রাতে যেতেই হতো নানা কারণে। সঙ্গে যদি দাঁড়াবার কাউকে পেত তো সমস্যা কাটত, আর না হলে বাইরে গিয়ে সাত-তাড়াতাড়ি কাজ সেরে হুড়মুড়িয়ে ঘরে চলে আসত। আবার নিজের এই ভীতি নিয়ে নিজেই ঠাট্টা করত, কিছুটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলত,
‘ভূত-টুতে আমার খুব ভয় রে বাবা।’
কেবল যে ভয় পেত মা এমন নয়, নিজেই নিজেকে সাহস দেওয়ার চেষ্টাও করত। গলার স্বরে সাহসী ভাব এনে বলত,
‘ভয় আবার কী ? ভূত-প্রেত আবার আছে নাকি কিছু। সব মনের ভয়।’
এই কথাগুলি বলত মা জোর করে, নিজের কথাতে নিজেরই যে আস্থা নেই মায়ের চোখমুখ দেখলেই বোঝা যেত। ভূতকে যেমন ভয় পেত তেমনি ভূত আবার মায়ের প্রিয়ও ছিল। ভূত নেই, একথা আমার বিশ্বাস করত না এটা সহজেই বোঝা যেত। প্রায়ই মা বলত,
‘ভগবান থাকলে ভূতও আছে।’
ভগবানের অস্তিত্ব নিয়ে মায়ের মনে কোন দ্বিধা ছিল না। নিজের জীবন নেই একথাও মা বিশ্বাস করতে পারত, কিন্তু ঈশ্বর নেই একথা মায়ের কাছে কল্পনা করাও কঠিন ছিল। ভূতের ওপর বিশ্বাস ততটা প্রবল না হলেও ভূতকেও মা অবিশ্বাস করত না। আসলে ওপর ওপর অন্তত মা ভূতকে ততটা প্রাধান্য দিতে চাইত না। ভগবানে বিশ্বাস থাকা নিন্দনীয় নয়, কিন্তু ভূতকে ভয় পাওয়াটার মধ্যে আছে অনেকটাই দুর্বলতা। তার ভূতের ভয় দেখে অন্যেরা কেউ ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে এজন্য মা নিশ্চয় ভগবানের প্রসঙ্গ তুলে ভূতকে প্রমাণ করতে চাইত।
বাবার মৃত্যু মায়ের কাছে ছিল বড়ই বিষাদময় প্রসঙ্গ।
‘অমন জলজ্যান্ত মানুষটা কেমন হয়ে গেল !’
যখন-তখন দীর্ঘনিঃশ্বাসের ধ্বনিতে শুনতাম মায়ের এই আফশোস। মৃত্যুর সময় কাছে না থাকতে পারাটাও ছিল আরেক অতৃপ্তি। আমরা তিনটি নাবালক ছেলেমেয়ে, বিশৃংখল জমিজায়গা ইত্যাদি আরও কত অনিশ্চয়তা। সব মিলিয়ে বাবার মৃত্যুটা মা মেনে নিতে পারেনি। জানিনা মায়েরও মনে ক্ষীণ এমন বিশ্বাস ছিল কিনা, কোনদিন হয়তো বাবাকে আবার ফিরে পাওয়া যাবে। অবাস্তব হলেও কিছু কিছু কল্পনা মানুষের কাছে আরামদায়ক। অবিশ্বাস্য বিষয়কে বিশ্বাস করে কখনো কখনো আমরা বেঁচে থাকার আগ্রহ ফিরে পাই। অন্তরের গোপনতম প্রদেশে আমরা অনেকেই রাজপুত্র-রাজকন্যা পুষি, প্রিয়তমকেও সেই গূঢ়তম কক্ষের চাবি দিতে পারি না।
তবুও মায়ের হা-হুতাশে প্রকাশ পেত বাস্তব সত্যের স্বীকার,
‘যে গেছো সে তো আর কখনো ফিরে আসবে না রে বাবা।’
বাবার মৃত্যু দুঃখ হয়ে লুকিয়ে থাকত মায়ের মনে, হঠাৎ হঠাৎ প্রকাশ পেয়ে যেত। তবে অনেক সময় দুঃখটাকে লঘু করে দেওয়ারও চেষ্টা থাকত একটা মায়ের কথায়। প্রসঙ্গক্রমে ভূত এসে যেত। মজা করে মা বলত,
‘বেঁচে থাকতে যে মানুষটা অত প্রিয় ছিল এখন যদি ফিরে আসে তো ওরে বাবা !’
একেবারে সত্যি স্বীকারোক্তি, এখানে কিছুমাত্র ভনিতা নেই। মায়ের ভূতের ভয়টা এরকমই জীবন্ত ছিল।
মৃত্যু মায়ের কাছে বিষাদের কারণ হলেও ভয়ের মাত্রাটাকেই বেশি মনে হত। মৃত্যুকে মা ভয় পেত অনেকটাই আধিভৌতিক কারণে। কাছাকাছি কেউ মারা গেলে সেই রাতে মা কিছুতেই একা বাইরে যেতে পারত না। হরিবোল ধ্বনি দিতে দিতে শবদেহ নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় মাকে দেখতাম ঘরে থেকেও ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে রাতে। আবার নিজের ভীতির জন্য মুখে থাকত মায়ের সংকোচের হাসিও।
আর ভয় পেতো মা চোরকে। রাতে চুরি বা চোরের প্রসঙ্গ উঠলেই মায়ের ভীতি নজরে আসত। বেশ কয়েকটি চুরির ঘটনা প্রায়ই শুনতাম মায়ের মুখে, তার নিজেরই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। গল্পগুলি বলতে গিয়ে নিজের চোর-ভীতি জানাতে মা সংকোচবোধ করত না।
ভূতকে কেন মানুষ ভয় পেতে শিখেছে বুঝতে পারিনা। কেনই বা ভূতের একটা ভীতিপ্রদ পরিচয় তৈরি করা হয়েছে ? তাহলে কি একথা সত্যি যে আমার অতীত আমার প্রিয় নয় ? অতীতকে মানুষ ভুলে যেতে চায় বলেই কি ভূতকে ভয় পাওয়ার অভ্যেস তৈরি করেছে ? মনে হয় এটাই সত্যি কথা। অতীত মানুষের কাছে যতনা সুখের দুঃখ নিশ্চয় সেখানে অনেক বেশি। অতীতকে মানুষ ভুলে যেতেই পছন্দ করে, আর তাই ভৌতিক আবহ ভীতিপ্রদ করে সাজায়।
মাকে জিজ্ঞেস করিনি বোধহয় কখনও কেন মা ভুতকে এত ভয় পায়। তবে মায়ের ভয় দেখে হামেশাই লম্বাচওড়া কথা বলে বোঝাতাম আমার কত সাহস আর ভূতকে ভয় পাওয়াটা বোকামি। তেমন জবরদস্ত ভৌতিক পরিবেশে যে নিজেরও বুক শুকিয়ে যাবে সেই সত্যি কথাটা অবশ্য প্রকাশ করতাম না কখনো। মা প্যাঁচ মারতে জানত না, সরল বিশ্বাসে আমার সাহসটাকে মেনে নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করত, আর সেই বিস্ময়ে মিশে থাকত কিছুটা গর্বও।
কোন এক সদ্য সন্ধে-লাগা ক্ষণের কথা আবছা হয়ে ভেসে উঠছে মনের মধ্যে। কী কারণে সেদিন খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল মা। হয়তো পুকুরে বা অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার হয়েছিল একান্তই। যাওয়ার সাহস হচ্ছিল না একেবারে। আমি হয়তো খেলতে গিয়েছিলাম বিকেলে। সন্ধে লাগে লাগে সময় ঘরে ফিরে দেখি মায়ের ভীতি, কেমন জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে সাহস ফিরে পেল। কাতর গলায় বলল,
‘একটু দাঁড়াবি রে বাবা আমার সঙ্গে ?’
মায়ের সেই ভয়-ধরা কাতর মুখর ছবিটা মনে পড়ে, আর মনে পড়লে বুঝতে পারি কেন ভূতের ভয়টাই প্রবল। কিছু কিছু স্মৃতির ছবি এত বিষণ্ণ করে যে সমস্ত দেহ অবশ হয়ে যায়। কোন কাজেই মন থাকে না।
ফিকে ফিকে ছায়া ছায়া অন্ধকার, সন্ধে লাগে লাগে পরিবেশ, গাছপালা-ঝোপঝাড় ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই নির্জন কালিমায় আমার ভীততাড়িত জড়সড় মাকে সঙ্গ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি যাতে সে সাহস পায় আর মা আমাকে মিনমিনে গলায় বলছিল,
‘দাঁড়া রে বাবা, দাঁড়া একটু আমার সঙ্গে।’
এমনই আরেক নির্জন কালিমালেপা ক্ষণের কথা স্মরণে ভাসে আমার দিনলিপির একটি বিবশ পাতায়। মাকে শেষযাত্রায় নিয়ে যাচ্ছিলাম সেই মধ্যরাতে। কাচে ঢাকা গাড়িতে ফুল-মালা-চাদরে ঢাকা ছিল মায়ের নিথর দেহ। পিছনে অন্য এক গাড়িতে ছিলাম আমি অন্যদের সঙ্গে। সামনের কাচে ঢাকা গাড়িটা কোন বাঁক ঘোরার মুহূর্তে হয়তোবা চোখের আড়াল হচ্ছিল একেকবার, আর আমি কানে শুনতে পাচ্ছিলাম অনেক বছর আগের সেই সন্ধেবেলায় মায়ের ভীতিকাতর অস্ফুট কন্ঠস্বর,
‘একটু দাঁড়াবি রে বাবা আমার সঙ্গে ? বড় ভয় করছে রে।’
আজও যখন সেই ক্ষণটির কথা মনে পড়ছে আমি সত্যি বুঝতে পারছি এমন স্মৃতি ভুলে থাকাই আরামের। এই অতীত ভূতের চেয়েও ভয়ংকর। ভূত তবু বিশেষ পরিবেশ ছাড়া ভয় দেখায় না, কিন্তু অতীত সব সময় তাড়া করে।
মাঠে-ঘাটে, আদাড়ে-বাদাড়ে ভুতের উপযুক্ত বাসস্থানের কোন অভাব ছিল না। ভূতকে ভয় পেলে কী হবে, ভূতের গল্পে আকর্ষণও ছিল বেশ। সন্ধেবেলা অনেকেই গল্প করতে আসত, হয়তো কোনো প্রয়োজন উপলক্ষ করে, কাজের কথা বলতে বলতে এসে যেত ভূতের প্রসঙ্গ। ধান কাটার মরশুমে, হবে সেটা বসন্তের শেষ বা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস, সন্ধেবেলা প্রায়ই জমজমাট পরিবেশ বাড়িতে। ধান মাড়াইয়ের কাজ শুরু হত হয়তো বিকেল থেকে, শেষ হতে হতে সন্ধে গড়িয়ে যেত, রাতও এসে পড়ত। কাজ অনেক। প্রথমে ধানের পাঁজা থেকে আঁটি বাঁধা গুচ্ছ গুচ্ছ ধান বিছিয়ে রাখা হত একটা বাঁশের খুঁটির চারপাশে। খুঁটিতে বাঁধা একটা লম্বা দড়িতে চার-পাঁচটা গরু পাশাপাশি জুড়ে গরুগুলিকে তাড়া করে ক্রমাগত ঘোরানো হত খুঁটি কেন্দ্র করে। গরুগুলির ক্রমাগত যাতায়াতে ধান ঝরে পড়তে থাকত শুকনো ধানগাছ থেকে। মাঝেমধ্যে বিছিয়ে রাখা ধানগাছ বা খড় উল্টেপাল্টে দেওয়া হত গরুদের চলার ফাঁকে ফাঁকে, আবার ধান ঝরে যাওয়া খড় সরিয়ে নতুন ধানের আঁটিগুলি খুলে বিছিয়ে দেওয়ার কাজও থাকত। গোটা ধান মাড়াইয়ের কাজে দু’-তিনজন লোক লাগত। তারা কাজ করত আর কাজের সঙ্গে গল্প চলত নানান মেজাজের। আমরা থাকতাম ঘরের দাওয়ায়, আবার কখনো বা ঘরে অন্য কাজে। মাকে বরাবর উপস্থিত থাকতে হত পুরো ব্যাপারটা মিটে না যাওয়া পর্যন্ত। হয়তো নিজেও মা মাড়াইয়ের কাজে হাত লাগাত, লোক যেদিন তেমন পাওয়া যেত না, আর নয়তো জলচৌকি নিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে থাকত।
ইলেকট্রিকের আলো ছিল না। কেরোসিনে জ্বলত হারিকেন বা কুপি, তাদেরই লালচে আলোয় কাজ চলত। ওই আলোয় অন্ধকারের ঝোপঝাড় সব দূর হত না একেবারেই, তারা ভিড় জমিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত চারপাশে। কোনদিন জোর হাওয়া থাকলে মাঝে মধ্যেই কুপি নিভে যেত। চারপাশে ওঁত পেতে থাকা অন্ধকারের ঝোপগুলি যেন আচমকা সুযোগ পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত। ওই ধান মাড়াইয়ের আসরে নানা গল্পের সঙ্গে ভূতের প্রসঙ্গ এসেই যেত। সেরকম ভূতের গল্প জীবনে আর শুনলাম না, শুনতে ভয়ও পেতাম আবার অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। আসলে ভূত বা তার গল্পটা নয়, পরিবেশটা কী হবে সেটাই ব্যাপার।
এসবই আমার এ জন্মের কাহিনী, অথচ কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারি না এখন। মনে হয় কোন এক বিস্তৃত জন্মের ইতিহাস। প্রতিভাস ম্যাগাজিন