তপোপ্রিয়

বর্ণবিপর্যয় 

যেদিকেই তাকাই না কেন চারপাশে, এদিকে ওদিকে, এর মুখে তার মুখে কেবলই নানান রঙের মিশ্রণ। রঙে রঙে সুসজ্জিত বলেই এই সভ্যতা এমন প্রিয়। দিনের প্রতিটি ক্ষণে পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় বর্ণবৈচিত্রের কতইনা সমারোহ। আকাশের গায়ে তাকালেও দেখি নানান রঙের ঝিকিমিকি। ইন্দ্রিয় অনুভূতিক্ষম হয়েছে এত এত বিচিত্র রং উপলব্ধি করার জন্যই কেবল। 

জীবন জড়িয়ে রাখে রঙেরা। আবার কখনো জীবন থেকে রঙের বিসর্জন ঘটে। কখনো জগত বিবর্ণ হয়ে ওঠে কারোও কাছে। যদি কারোর জীবন থেকে রং হারিয়ে যায় তাহলে কেমন হয়? রঙেরা কেবল হারিয়ে যায় না, কখনো কখনো অনেক রঙের সম্মেলন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পৃথিবী বা বিশ্বজগতের নিজস্ব ছন্দে তাকে কোন বিকার না ঘটলেও মানুষ বুঝতে পারে রংয়ের এই বৈধব্য। 

মাকে সবসময়ই দেখতাম বর্ণবিবর্জিত। তার যথেষ্ট কারণও আছে আর সেগুলি বুঝতে কষ্ট হত না কখনোই। সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছিল আমার সমস্ত স্বপ্ন দেখার প্রেরণা। সমস্ত স্বপ্নের লক্ষ্য ছিল একটাই। আবার কোনো না কোনো মূল্যে রঙের আয়োজনে সাজিয়ে তুলব বিচ্যুতবর্ণ মায়ের জীবন। প্রায় সব মানুষকেই দেখি শেষপর্যন্ত লক্ষ্য হারিয়ে উপলক্ষ আঁকড়ে ধরে। আমিও যে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে গিয়েছিলাম সেটা মায়ের শেষ সময়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। 

মায়ের শেষ সময়েই দেখেছিলাম রঙেরা কিভাবে হারিয়ে যেতে পারে কোন জীবন থেকে। বর্ণবিবর্জিত ছিল যদিও মায়ের সারাটা জীবন, কিন্তু রঙের চূড়ান্ত বিসর্জন ঘটেছিল ওই সময়ে। 

অনেক কিছুই বুঝতে পারত না মা তখন, চিনতেও পারত না সবাইকে। দু’-একবার আমাকেও ভুলে গিয়েছিল। কোন নামই মায়ের মাথায় থাকত না। কয়েক বছর আগে একটা আয়া থাকত মায়ের কাছে চব্বিশ ঘন্টা। ছিল বোধহয় বছরখানেক। তখন মায়ের স্মৃতি বিপর্যয়ের প্রাথমিক পর্যায়ে। ওই আয়া মেয়েটির নাম ছিল শ্যামলী। আসলে সে এক বিবাহিত মহিলা, বয়সটা কম আর বেশ ছটফটে চরিত্রে। তার নামটা মায়ের মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। তারপর থেকে যাকেই রাখতাম আয়া হিসেবে তাকেই মা শ্যামলী নামে ডাকত। কেবল আয়াই নয়, যে কোন মহিলার নামই মায়ের কাছে ছিল শ্যামলী। কারণে-অকারণে যখনই কাউকে ডাকার প্রয়োজন হত মা ওই শ্যামলী বলেই ডাকত। মায়ের জীবন থেকে এভাবেই সমস্ত রং হারিয়ে গিয়েছিল।

একদিন সন্ধের পর থেকে মায়ের মধ্যে দেখা গেল অস্থিরতা। তখন অনেক কারণেই মা অস্থির হয়ে পড়ত। কখনো বা অস্থিরতার কোন সুস্পষ্ট কারণও থাকত না। দুটি বিশেষ প্রসঙ্গে মা কাতর হত সবসময়, একটি খিদে আর অন্যটি একা থাকা। খিদের ব্যাপারটা মাকে জ্বালাত অদ্ভুতভাবে, যেহেতু মা খেলেও ভুলে যেত খেয়েছে কিনা। আবার কাছে কেউ না থাকলেও মায়ের মধ্যে দেখা যেত অসহিষ্ণুতা। পড়ে যাওয়ার ভয়টাও প্রবলভাবে বাসা বেঁধেছিল। এই ভয়টা ছিল বলেই মা পছন্দ করত কেবল শুয়ে থাকা। কখনো আবার মায়ের মধ্যে এমনই উন্মত্ততা দেখা যেত যে শুইয়ে বা বসিয়ে রাখা যেত না। কেবলই অস্থিরভাবে উঠে উঠে বিছানা থেকে নেমে পড়তে চাইত ঘষটে ঘষটে। 

এসব ব্যাপার ছিল সবসময়ের। একবার মায়ের অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল অন্য কারণে। সেদিন সন্ধে থেকেই মা কাউকে খুঁজতে শুরু করেছিল। এরকম কতই তো খেয়াল চাপে মায়ের, বিশেষ গা করিনি কেউ প্রথমটায়। যে আয়া মহিলা ছিল তখন মায়ের কাছে, সেও মাকে থামিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু স্থির থাকতে পারছিল না মা। হয়ত বুঝিয়ে-সুজিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল, শুয়ে থাকল কয়েক মিনিট। হঠাৎই বালিশ থেকে মাথা তুলে উচাটনতা মাখা মুখচোখ নিয়ে প্রশ্ন তুলল,

‘আরে, ও কোথায় গেল? ডাক্, ওকে ডাক্।’

ক্রমশ মায়ের অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিল। ব্যাপারটাকে আর সরলভাবে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হল না। বিছানায় শুয়ে থাকতে চাইছিল না। বালিশ থেকে মাথা তুলে নিজেই সেই হারিয়ে যাওয়া কাউকে খুঁজতে যাচ্ছিল। সবাই মিলে বুঝিয়েও শান্ত করা মুশকিল হচ্ছিল। আমি পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কার কথা বলছ মা? কাকে খুঁজছ?’

‘আরে ওই যে ছেলেটা, আমাদের বাড়িতে থাকত, বাজার-টাজার করে আনত। কোথায় গেল রে ছেলেটা? ওকে আর দেখতে পাই না কেন? হায় হায়, ও কি হারিয়ে গেল নাকি?’

মায়ের মুখ জুড়ে দেখছিলাম অসম্ভব দুশ্চিন্তা। যত ভাবেই বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম মানানো যাচ্ছিল না। কোন এক স্বজন হারিয়ে ফেলার অস্থিরতা প্রকার-প্রকরণে। প্রথমে ভেবেছিলাম বুঝি আমারই কথা বলছে। স্মৃতি বিপর্যয়ের নানা ধরনের এটাও হতে পারে এক প্রকাশ। ব্যক্তি বিশেষের কার্যকলাপ মনে থাকলেও ব্যক্তিটিকে ভুলে গেছে।

‘দেখো, তোমার আমি তো সেই ছেলে। আমিই তো বাজার করে দিতাম।’

কিন্তু মা আমাকে কিছুতেই হারিয়ে যাওয়া সেই ছেলে বলে মানছিল না। দাদাও এসে বোঝালো। মা তাতেও শান্ত হল না। সন্ধে থেকে অনেক রাত পর্যন্ত মায়ের কাটল সেই হারানো স্বজন খুঁজে। চোখ না বুজলেও দেখি, মা তার ঘরে বিছানায় বসে ছটফট করছে, চুলগুলি উসকো-খুশকো। এক দন্ড স্থির থাকতে পারছে না। উদ্ভ্রান্ত চেহারা, চোখের তারায় অশান্ত দুশ্চিন্তা,

‘আরে ও কোথায় গেল? ওই যে ছেলেটা থাকত আমার কাছে। বাজারহাট করে দিত। আর তো দেখি না। কোথায় গেল?’

অনেক পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আসলেই মা সত্যিই বুঝি কাউকে খুঁজে পাগল হয়নি সেদিন। মা খুঁজছিল কোন এক বিশেষ সময়কে। সেই সময় হয়তো চলে গিয়েছিল পনের-ষোল বছর আগে। মাকে নিয়ে তখন এক বাড়িতে ভাড়া থাকি, দাদার সংসার অন্য বাড়িতে। সকালে বাজার করে দিয়ে যেত নিয়ম করে দাদা। এই নিয়মের অন্যথা হত না কোনদিন। দীর্ঘদিন দাদা এভাবে আমার আর মায়ের জন্য বাজার করে দিয়ে যেত। আমাদের ছেড়ে দাদার আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা ছিল যেমন দুঃখের, তেমনি দাদা যে কিছুতেই তার নিম্নতম দায়িত্বটুকু ভুলে যায়নি এই ব্যাপারটা মায়ের স্মৃতিতে খোদাই করে রেখেছিল এক উজ্জ্বল রং। সব স্মৃতি হারাতে হারাতেও মা সেই রংটাকে সেদিন খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু রংটাকে খুঁজে পেলে কী হবে, সঠিক আধারে সেই রং লাগাতে পারছিল না। এভাবেই বর্ণবিপর্যয় ঘটেছিল মায়ের মধ্যে। তার যন্ত্রণার স্বরূপটা ওইভাবেই দেখা গিয়েছিল।

রং হারিয়ে ফেললে কোন খেলাই জমে না। শীতের শেষে বিবর্ণ পাতার দীর্ঘনিঃশ্বাসে ভরে থাকে বসন্তের বাতাস। তারা সব রং হারিয়েই বিদায় নেয়। এভাবেই হারিয়ে গেছে মানুষের সভ্যতার অন্তর্গত কত রাজ্যপাট। বিজাতীয় আধুনিক মানব সম্প্রদায়ের এই যে উদ্ভব তার আড়ালে রয়েছে অজস্র জাতি-উপজাতির বিলুপ্তি। সবই বর্ণবিপর্যয়ের কারণে। আমার তাই কখনো কখনো সন্দেহ জাগে, মানুষের সভ্যতার রং ফিকে হয়ে আসছে কিনা। বর্ণবৈচিত্রের সম্ভারই জীবনের আভাস। রঙের মলিন হয়ে যাওয়া মানেই জীবন মলিন হয়ে যাওয়া। 

তাই বুঝি কোন এক বৃন্দাবনে কোন এক বিগত দিনে জীবন রাঙানোর প্রতীকী খেলা শুরু হয়েছিল। সেই নিয়ম এখনো চালু রেখেছি আমরা বছরের একটি দিনে হলেও। 

মায়ের কথা আবার মনে পড়ে, মা আমার রং খেলতে ভালোই বাসত। খেলার সঙ্গী পেত না তেমন। আবার খুব যে উন্মুখ হয়ে থাকত রং খেলার জন্য, এমনও নয়। একেবারে যে খেলার সঙ্গী ছিল না মায়ের, তাই কি? দিদির ছেলে-মেয়েরা ছিল, একসময় পরিচিত পাড়া-প্রতিবেশী অনেকেই ছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে মাকে তো কোনদিন হৈ হৈ করে রং খেলতে দেখিনি। 

রং খেলাটা মায়ের ছিল অনেকটাই অন্যরকম। স্নানটান ছেড়ে পুজো করার সময় মা ঠাকুরকে সাজাতো আবির দিয়ে। ওই রং খেলার মধ্যে আনন্দের তুলনায় ভক্তিটাই বেশি। আসলে যে পরিবেশটা ছিল বাড়িতে সেখানে রং খেলা নিয়ে মাতামাতি করত না কেউ তেমন। তবুও মায়ের মধ্যে দেখতাম কিছু হলেও রং খেলার উৎসাহ। দিদির ছেলে বা মেয়েদের সঙ্গে তাদের আবদারে মা রঙ মাখামাখি করত। তেমন হৈ-হৈকরে না খেললেও রং খেলা নিয়ে গল্প বলায় মা উচ্ছল হয়ে উঠত, গল্প শোনাত ছোটবেলার আর গল্প শোনাত বিয়ের পর আমাদের যে দেশের বাড়িতে এসেছিল সেখানকার। লোকের তখনও কোন অভাব ছিল না। দেশভাগের দামামা বাদ দিলেও বিপদের আঁচ পাওয়া যায়নি। মায়ের মুখে প্রায়ই শুনেছি দোল-দুর্গোৎসব কথাগুলি একসঙ্গে। 

তারও অনেক অনেক দিন পর ভাড়াবাড়িতে থাকছি যখন মাকে নিয়ে, রং খেলা আসত বছর বছর। কোনবার দাদা হয়তো তার ছেলেকে নিয়ে এল, তারও তেমন সঙ্গী নেই কেউ খেলার মত। মাকে অপটু।হাতে তাই একটু রংটং দিল, মাও দিল খানিকটা আবির। সেটা ঠিক খেলা নয়, অনেকটা নিয়মরক্ষা। বাড়িওয়ালার ছোট ছেলের বয়স ছিল আঠেরো-উনিশ। তাকে মা আবির মাখাবার জন্য অপেক্ষা করত। তার মায়ের সঙ্গে মায়ের খুবই বন্ধুত্ব ছিল। ছেলেটিও প্রায়ই আসত আমাদের ঘরে। বেশ সহজ-সাদাসিধে, গল্প করত প্রাণ খুলে। তার সারাটা দিন বাইরে বাইরে কাটত আড্ডা মেরে। রং খেলার দিনেও সে বাড়ি আসত বেলা একটা-দুটো বাজিয়ে। রংটং বিশেষ খেলত না সে, কিন্তু তাকে দেখলেই মা সোৎসাহে এগিয়ে এসে বলত,

‘এসো, তোমাকে একটু আবির দেই।’

মায়ের উৎসাহ দেখে সেও অরাজি হত না। আগ্রহ নিয়েই দাঁড়াত আমাদের দরজার সামনে মায়ের কাছে।’

‘তোমাকে রং দেব বলে কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি।’

খানিকটা আবির মা তারপর ছেলেটির কপালে আর মাথায় লাগিয়ে দিত হাত দিয়ে, আর বলত,

‘এইতো হয়ে গেছে। আবার কী?’

কানায় কানায় রঙের পাত্র পূর্ণ হয়ে ওঠে বসন্তে। এত রঙের আন্দোলন দেখলেই আমার কেবল মনে হয়, সব রং চিরদিনই দেখতে পাব কিনা। সবাই কি সব রঙ সবসময় দেখতে পায়? রং থাকলেও কি তার বৈচিত্র পুরোপুরি বোঝা সম্ভব? আমি যেমন আমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এখন সবই ধূসর দেখি। জানতামই না, একদিন চারপাশে আকাশ-জমি-মাঠ-ঘরবাড়ি সব এমন বিবর্ণ চিত্র হতে পারে। যতই আমি বাড়ির দেয়ালে কম্পিউটারি কায়দায় প্লাস্টিক পেইন্টস্ লাগাই না কেন, আমার সেই ছোট্টবেলার স্বজনভূমির জৌলুস কিছুতেই ফিরে পাই না এই রঙে, যেখানে ঘাসে ছাওয়া টিলার ঢালে শাল-শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত বন্ধুরা। আমারও গোটা জগৎটায় তাই বর্ণবিপর্যয় ঘটে গেছে। 

একদিন মায়ের সঙ্গী খুঁজে হন্যে হয়ে যেতাম। যাকে নিয়ে সময় কেটে যাবে, গল্প করতে পারবে তেমন কাউকে কোথায় পাব? মায়ের একাকিত্ব ছিল আমার প্রধান মাথাব্যথা। সঙ্গীর অভাবে আমার কাছে ঘুরে ঘুরে এসে বসত একটু কথা বলার জন্য। আমি সবসময় ব্যস্ত কাজে বা অকাজে। মায়ের সঙ্গে গল্প করতে চাইতাম না। মা বলত,

‘থাক, তোমার কাজ আছে। তোমাকে বিরক্ত করব না। কাজ কর।’

বলত মা মলিন মুখে। অনিচ্ছাসত্ত্বে চলে যেত নিজের ঘরে। আসলে মায়ের ইচ্ছে থাকত কথা বলার। দেখত, আমি বলি কি না,

‘কাজ থাক মা, চলো, একটু গল্প করি।’

বলতাম না। আর এখন আমার ইচ্ছে হয় গল্প করার। মাকে খুঁজে খুঁজে হন্যে হয়ে যাই। কত কথা জমে আছে ভিতরে। মাকে যদি বলতে পারতাম!

আমার জগতে বর্ণবৈচিত্রের সম্ভারে যে ঘাটতি হয়ে গেছে তা আর পূরণ হওয়ার নয়। একদিন মাকে উপযুক্ত সঙ্গী দিয়ে একাকিত্ব দূর করতে পারিনি। আর আজ আমার ছোট্ট মেয়েটি একা একা এঘর ওঘর ঘুরে বেড়ায়। তারও কোন সঙ্গী নেই। দুই সঙ্গীবিহীন প্রজন্মকে একই সময়ের প্রেক্ষাপটে মেলানো যায় না বলেই আমার প্রদেশের রঙিন মানচিত্র ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *