সৌমিতা রায় চৌধুরী
উনবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র ভারতে জাতীয়তাবোধের ভাবনা সঞ্চারিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসান সমগ্র পৃথিবীতেই এক অপরিহার্য পরিণতি হিসেবে জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিকতার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার আস্বাদ গ্রহণ করেছিল।
ভারতে প্রায় দুশো বছর ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লব ইংরেজ শাসককে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ভাবতে বাধ্য করেছিল। সাহিত্যে, গানে, নাটকে, কবিতায় ইংরেজ শাসকের স্বৈরাচারী, মুনাফালোভী দিকটিকে প্রকটভাবে প্রকাশ করেছিল।
১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের সংস্কৃত-বাংলা মিশ্র ভাষায় রচিত একটি বন্দনাগীতি একদিকে জাতীয়তাবাদকে উদ্বুদ্ধ করতে যেমন মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল, পাশাপাশি ইংরেজ ঔপনিবেশিকতাবাদের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি ভারত মাতৃকার একটি কাল্পনিক মূর্তি। শ্রী অরবিন্দ ঘোষ এই গানটিকে বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত বলে উল্লেখ করেন। ১৮৯৬ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গাওয়া হয় ‘বন্দে মাতরম’। গানটি গেয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
পরবর্তী সময়ে ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি ইংরেজ শাসকের ত্রাস হয়ে দাঁড়ায়। তীব্র জাতীয়তাবাদী ভাবে সমগ্র দেশ উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণে গানটিকে ইংরেজ শাসক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং বহু মানুষকে গানটি গাওয়ার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। জেলগুলিতেও বন্দি স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলেন।
১৯০৯ সালে ঋষি অরবিন্দ ‘Mother I bow to thee!’ শিরোনামে ‘বন্দে মাতরম’ গানটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। বিংশ শতাব্দীতে গানটি প্রায় একশোটি সুরে রেকর্ড করা হয়েছিল। ‘বন্দে মাতরম’ সংগীতের প্রাচীনতম প্রাপ্ত অডিও টি ১৯০৭ সালের। ১৯৫০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করলে ‘বন্দে মাতরম’ গানটিকে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় স্তোত্রের মর্যাদা দেওয়া হয়।
২০০২ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দশটি জনপ্রিয় গান নির্বাচনে একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা চালায়। এই সমীক্ষায় সাত হাজার গানের মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরারোপিত ‘বন্দে মাতরম’ গানটি বিশ্বের দ্বিতীয় জনপ্রিয় গান হিসেবে নির্বাচিত হয়।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি রচনা করেছিলেন। বাউল গায়ক গগন হরকরার গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে’ — এই গানের সুর ও কথার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রথমবার এই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়।
পরাধীন ভারতের রাজনৈতিক, আর্থ সামাজিক সমস্যা এবং সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। তার পরিণতি স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ নামক প্রতিষ্ঠানের থেকে বাংলা তথা ভারতবর্ষ পেয়েছে অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান। যেমন —
ও আমার দেশের মাটি / তোমার পরে ঠেকাই মাথা
এবার তোর মরা গাঙে বাণ এসেছে / জয় মা বলে ভাসা তরী
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে / তবে একলা চলো রে
আমি ভয় করব না, ভয় করব না
নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়
বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান ….. ইত্যাদি।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হত। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এই কবির বিভিন্ন গান ও কবিতা ব্রিটিশ শাসককে বিভিন্ন সময় জনরোষের শিকার হতে হয়েছে। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির জন্য তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। নজরুলের অনেক গান ও কবিতা ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। সেইসব গান গাইতে গাইতে অনেক বিপ্লবী সরকারি নির্দেশের বিরোধিতা করে হাসিমুখে কারাবরণ করেছিলেন। নজরুলের কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান হল —
কারার ওই লৌহকপাট
জাগো অনশন বন্দী
জাতের নামে বজ্জাতি
আমরা শক্তি আমরা বল আমরা ছাত্রদল ….. ইত্যাদি।
নাট্যকার, সুরকার ও গীতিকার ডি এল রায় জাতীয়তাবাদী গান লিখতেন ও সুর দিতেন। এই গানগুলি দ্বিজেন্দ্রগীতি হিসেবে পরিচিত। জনপ্রিয় দ্বিজেন্দ্রগীতি গুলি হল —
যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিল জননী ভারতবর্ষ
ধনধান্যে পুষ্পে ভরা ….. ইত্যাদি।
আইনজীবী অতুল প্রসাদ সেনের দেশমাতৃকার প্রতি ছিল গভীর দেশাত্মবোধ। গান লেখা ও সুর দেওয়া ছিল তাঁর নেশা। অতুলপ্রসাদের লেখা কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান হল —
উঠ গো ভারত লক্ষ্মী, উঠ আদি জগত জন পুজ্যা
হও ধরমেতে বীর, হও করমেতে বীর, হও উন্নত শির নাহি ভয়
বল বল বল সবে শত বীণা বেনু রবে
ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে ….. ইত্যাদি।
ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটাতে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটেছিল, এই দেশাত্মবোধক গানগুলি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল ও দেশবাসীর মনে দেশের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়েছিল। তাৎক্ষণিক সময় চিত্রকে বর্ণিত করেছে এই গানগুলি। জাতীয়তাবাদকে জনমানসে ছড়িয়ে দিতে অনুঘটকের কাজ করেছিল এই গানগুলি।
অনেক হিন্দি গানও দেশাত্মবোধে শরীরকে শিহরিত করে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সেনাদের উদ্দেশ্য করে কবি প্রদীপ লিখেছিলেন, ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগো’।
ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এ আর রহমান দেশবাসীর কাছে উৎসর্গ করেছিলেন, ‘মা তুঝে সালাম’।
গুলশান মেহতার লেখা ও কল্যাণজী আনন্দজীর পরিবেশনায় ‘মেরি দেশ কী ধরতি’ গানটিও বেশ জনপ্রিয়।