আশিস ভৌমিক
লেখক পরিচিতি
(জন্ম 5 ই এপ্রিল 1974, গ্রাম -বৃন্দাবনচক , পাঁশকুড়া , পূর্ব মেদিনীপুর ।প্রাথমিক পড়াশোনা গ্রামে ।উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় ।সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ।গৃহ শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্য চর্চা । বিভিন্ন লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন । প্রথম কাব্যগ্রন্থ “”হিরণ্ময়ী ” । দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ” কালবেলা “।
প্রথম পর্ব
সৃষ্টিলগ্ন থেকে পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা অন্যতম। প্রায় ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ ইরাকের তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছিলো প্রাচীন এই সভ্যতা। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মতো সুমেরীয় সভ্যতার লোকজনও বিশ্বাস করত, পৃথিবী ও মহাজাগতিক সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন অদৃশ্য দেব-দেবীরা। এই বিশ্বাস থেকেই সুমেরীয় সভ্যতায় জন্ম নিয়েছে তিন হাজারেরও অধিক দেব-দেবী। সময়ের সাথে সাথে মেসোপটেমিয়াতে সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়কালের (আক্কাদীয়, ব্যবিলনীয়, ক্যালডীয়) পরিবর্তন ঘটলেও উপকথার শেকড় প্রোথিত রয়েছে এক জায়গাতেই। সেজন্য মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত বিভিন্ন সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে ভিন্ন নামের দেব-দেবীর উপস্থিতি থাকলেও তাদের কাহিনির বহমান স্রোত গিয়ে মিলেছে একই সমুদ্রে। সুমেরীয় সভ্যতা হলো মেসোপটেমীয় সভ্যতার স্রষ্টা। তাই ধরা যায়, মেসোপটেমীয় ধর্মের ভিত্তিপ্রস্তর হয়েছে এই সভ্যতার সময়েই।
সুমেরীয় দেবতাদের মানব প্রকৃতি
মেসোপটেমিয়ার ধর্মীয় চিন্তাধারায় প্রধানত জীবিকা প্রদানকারী হিসাবে প্রকৃতির শক্তির উপাসনা জড়িত। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে উপাসনার বস্তুগুলিকে মূর্তিমান করা হয়েছিল। প্রাচীন সুমেরীয় ধর্মতে দেবতাদের উপস্থাপন করা হয়েছে মানব আকৃতির সাথে মিল রেখে। উপকথা অনুযায়ী, দেব-দেবীদের অলৌকিক শক্তি বিদ্যমান থাকলেও, মননে ও গড়নে এরা ছিল মানুষের মতোই।
তারা নৃতাত্ত্বিক ছিল, যার ফলে মানবিক রূপ ছিল। একইভাবে, তারা প্রায়শই মানুষের মতো কাজ করত, খাদ্য ও পানীয়ের প্রয়োজন, সেইসাথে অ্যালকোহল পান করত এবং পরবর্তীতে মাতালতার প্রভাব ভোগ করত, কিন্তু সাধারণ মানুষের তুলনায় তাদের পরিপূর্ণতা বেশি বলে মনে করা হয়। তারা আরও শক্তিশালী, সর্বদর্শী এবং সর্বজ্ঞানী, অকথ্য এবং সর্বোপরি অমর বলে মনে করা হয়েছিল। তাদের বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি ছিল একটি ভয়ঙ্কর উজ্জ্বলতা ( মেলাম্মু ) যা তাদের ঘিরে রেখেছিল, যা পুরুষদের মধ্যে অবিলম্বে বিস্ময় এবং শ্রদ্ধার প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। ঐতিহাসিক জে. বোটেরোর অভিমত ছিল যে দেবতাদেরকে রহস্যজনকভাবে দেখা হতো না, বরং তাদেরকে উচ্চ-উপস্থিত প্রভু হিসেবে দেখা হতো যাদেরকে মান্য ও ভয় করতে হতো, যেমন ভালোবাসতেন এবং পূজা করতে হতো।
মানবজাতির মতোই দেবতারা মনে পোষণ করতেন লোভ, লালসা, কামক্ষুধা, আবেগ, ভালোবাসা, হিংসা, ঈর্ষাপরায়ণতা ইত্যাদি। মানুষের মতো জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠলেও মানুষের সাথে ছিল তাদের একটাই ফারাক। দেবতারা ছিলেন অমর। সোজা ভাষায়, গড়নে এরা মানুষের মতো হলেও, শক্তিমত্তা এবং সৌন্দর্যে এরা মানুষের চেয়ে উৎকৃষ্ট। কোনো সুমেরীয় দেবতাই ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তারা আকারে ছিলেন বিশাল।
পৃষ্ঠপোষক দেবতার ধারণা
সুমেরীয় সভ্যতার আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলো, পৃষ্ঠপোষক দেবতাদের ধারণা। প্রতিটি প্রধান শহর তাদের প্রধান স্থানীয় দেবতা হিসেবে আলাদা আলাদা দেবতার পূজা করত। উদাহরণস্বরূপ, উরুকের লোকেরা দেবতা আন এবং দেবী ইনানাকে শ্রদ্ধা করত। ওদিকে নিপ্পুরের বাসিন্দারা এনলিলকে তাদের পৃষ্ঠপোষক দেবতা বলে মনে করত। এরিদু এনকিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে ধরা হতো। সমস্ত পরিচিত মন্দিরগুলি শহরে অবস্থিত ছিল, যদিও শহরতলিতেও কিছু উপাসনালয় থাকত।
মন্দিরটি একটি জিগুরাটের আকারে মাটির ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছিল , যা একটি পিরামিডের মতো আকৃতির একটি টাওয়ারের মতো ছিল এবং দৈত্যাকার ধাপগুলির সমন্বয়ে গঠিত। এটিকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। টাওয়ারটিকে দেবতাদের স্বর্গ থেকে নেমে আসার এবং স্বর্গে আরোহণের জন্য এক ধরণের সিঁড়ি বা সিঁড়ি হিসাবে বিবেচনা করে। পুরো মন্দিরটিকে একটি বিশাল বেদী হিসাবে গণ্য করা হতে পারে। কিছু মন্দির, যেমন এরিদুতে এনকি মন্দিরে একটি পবিত্র গাছ ( কিসকানু ) ছিল, যা রাজার দ্বারা সম্পাদিত বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রীয় বিন্দু ছিল, যিনি “মাস্টার মালী” হিসাবে কাজ করতেন।
মেসোপটেমিয়ার মন্দিরগুলি মূলত দেবতার বাসস্থান হিসাবে পরিবেশন করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যিনি শহর ও রাজ্যের মঙ্গলের জন্য পৃথিবীতে বসবাস করতেন এবং বিচার ব্যবস্থা ধরে রাখতেন বলে মনে করা হয়। তার উপস্থিতি একটি পৃথক ঘরে দেবতার একটি মূর্তি দ্বারা প্রতীকী ছিল। মূর্তিটির মধ্যে দেবতার উপস্থিতি একটি খুব সুনির্দিষ্ট উপায়ে ভাবা হয়েছিল, দেবতার উপস্থিতির জন্য একটি মিথের আশ্রয় নেওয়া হতো।
রাজারা তাত্ত্বিকভাবে ধর্মীয় নেতা ছিলেন, তবে অনেক ধরণের পুরোহিতও বিদ্যমান ছিল। সাধারণত, সেবা বা কাজের মাধ্যমে দেবতার মঙ্গল বজায় ছিল ( দুল্লু )। ইমেজ পরিহিত ছিল এবং দিনে দুবার ভোজ পরিবেশন করা হয়. বলিদানের খাবারও নিয়মিতভাবে নির্ধারিত হত, একটি বলিদানকারী পশুকে একজন মানুষের প্রতিস্থাপন বা বিকল্প হিসাবে দেখা হত, এবং এটি বিবেচনা করা হত যে তখন দেবতা বা দানবদের ক্রোধ বলির পশুর দিকে পরিচালিত করা হোত।
সুমেরীয় সৃষ্টি তত্ত্ব
মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় ৪,৫০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিল সুপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা। পৃথিবীর প্রথমদিককার সভ্যতাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রাচীন শহর নিপ্পুরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের সময় বেশ কিছু মাটির ব্লক (ট্যাবলেট) পাওয়া যায়, যাতে সুমেরীয় সভ্যতায় মানব সৃষ্টির গল্প লেখা ছিল। একে ‘এরিডু জেনেসিস’ বলা হয়। গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, আজ থেকে প্রায় ২,১৫০ বছর আগে ‘এরিডু জেনেসিস’ লেখা হয়, তবে অনুমিতভাবেই লোকমুখে এ গল্প বহু আগে থেকে চলে আসছে।
সৃষ্টির শুরুতে
সুমেরীয়রা মনে করত, মহাবিশ্ব একটি বদ্ধ গম্বুজের আকৃতিবিশিষ্ট এবং সেটিকে ঘিরে রয়েছে আদ্যকালীন লবণাক্ত জলের এক সমুদ্র। এই গম্বুজের ভিত্তিটি হল শিলাময় পৃথিবী এবং পৃথিবীর নিচে রয়েছে একটি পাতাললোক এবং আব্জু নামে পরিচিত মিষ্টি জলের একটি মহাসাগর। আদ্যকালীন লবণাক্ত জলের সমুদ্র থেকে আবির্ভূত হন নাম্মু। অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল পরিবেশ। আকাশ, পৃথিবী, স্বর্গ, নরক কিছুই ছিল না তখন। চারিদিক বিষাক্ত। প্রানের অস্তিত্ব ছিল না। সেই আদি সাগর থেকে উঠে এলেন নাম্মু। তিনি অযৌন যোনি প্রাপ্ত। পারথেনোকারপির মাধ্যমে তার থেকে জন্ম হলো স্বর্গ ও পৃথিবীর যুক্ত সত্ত্বার। আন এবং কি। তার দুই সন্তান।স্বর্গের প্রতিনিধিত্ব করেন আনু, যিনি পুরুষ। পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বকারী দেবী কি। আনু ও কি’র মিলনে তাদের পারস্পরিক প্রাকৃতিক জৈব ক্রিয়ায় উৎপত্তি হলো বায়ুদেবতা এনলিলের। আকাশ হলো কিছুটা নির্মল। বায়ুর শৈশব দশা কাটার পর তার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। তার প্রভাব জোরে তিনি আনু আর কি-কে আলাদা করে ফেললেন। আনু নিজে ঊর্ধ্বমুখী হলেও সন্তানের সাথে কি নেমে এলেন নিচের দিকে। এই ভাবেই তৈরি হল স্বর্গ পৃথিবী আর চাঁদের মাঝে বায়ুমণ্ডল।
নিচে নেমে এসে একসময় এনলিল আর তার মা কি স্থির হলেন। কিন্তু চারদিক বড় অন্ধকার। আলো কোথায়! আলো পেতে কি এবং এনলিল সৃষ্টি করলেন তাদের তিন সন্তান। অর্থাৎ এনলিল তার মায়ের সাথে মিলিত হয়ে জন্ম দেন দেবতা নিনুর্তা, চন্দ্রদেবতা নান্না এবং সূর্যদেবতা উতুরকে। নিনুর্তাকে যুদ্ধ ও কৃষি দেবতা হিসেবে পূজা করা হতো। আবার অন্য মতে চন্দ্রের দেবতা নান্না জন্ম দিলেন সূর্যদেব, উটুর। নান্না অন্ধকার আকাশে আলো আনার জন্য দায়ী ছিলেন, যাকে একটি সমতল পৃথিবীর উপর তিনটি গম্বুজে বিভক্ত বলা হয়েছিল প্রতিটি গম্বুজ একটি মূল্যবান পদার্থ দিয়ে তৈরি। তিনি আকাশের চারপাশে নক্ষত্র এবং গ্রহগুলি ছড়িয়ে দেন এবং তার স্ত্রী নিঙ্গালের সাথে একত্রে ইনানা এবং তার যমজ ভাই উতুর জন্ম দেন।
এবার এনলিল ও কি-র সম্মিলনে বাতাস আর পৃথিবী এক হয়ে সৃষ্টি করল দেবতা এনকির। এনকি ছিলেন মিষ্টি জলের দেবতা। এছাড়াও তিনি পুরুষদের যৌন সক্ষমতা ও জ্ঞানের দেবতা হিসেবেও সুপরিচিত। প্রকৃতপক্ষে তিনিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রভু, গাছপালা আর মিঠা জলের দেবতা। তার নির্দেশে মাটি চিরে প্রবাহিত হলো শক্তিমান টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদী। জলে সাঁতার কাটতে লাগল নানা প্রজাতির মাছ, জমি হয়ে উঠল কৃষিকাজের উপযোগী। ধরণীতে দেবতাদের থাকার জন্য এনকি বানালেন শহর। পত্তন হলো প্রাচীনতম নগরী এরিদু, বাদ-তিবিরা, লারসা আর শুরুপ্পাকের।
কালক্রমে আরো বহু দেবদেবীর পদচারণায় পৃথিবী মুখরিত হয়ে উঠল। তাদের কাজ তারা নিজেরাই করতেন। মাটি কাটা, ঘরবাড়ি বানানোসহ আরও বহু কাজ করতে করতে দেবতারা হয়ে পড়লেন ক্লান্ত। তারা আনুর কাছে আবেদন জানালেন, এই দিনভর কাজ থেকে মুক্তি দিতে। আনু ভেবে দেখলেন, সত্যিই তো, তার সন্তানেরা কাজ করতে করতে মরেই যাচ্ছে!
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)