সুবীর ঘোষ

স্কুল থেকে ফিরে এল শ্রীলা। মোটামুটি এই সময়েই রোজ ফেরে। স্কুলে মিটিং থাকলে অবশ্য আলাদা। এখনও আকাশের আলো বেশ  উজ্জ্বল। ফেরার পথে এক বিপত্তি হল আজ। ভিড় বাসে একজন কে তার পা ঘষটে চলে গেল। আর তার চটিটা গেল ছিঁড়ে । কোনওরকমে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি এসে গেছে শ্রীলা । কাল শনিবার। অন্য চটিটা পরে স্কুলে যাবে সে । রোববার সারিয়ে নিলেই হবে ।

তালা খোলার আগে ডাকবাক্সের দিকে চোখ মেলে দেওয়া তার রোজকার কাজ। আজ মনে হচ্ছে অনেক কিছু আছে । তালা খুলে ভেতরে ঢুকল শ্রীলা। ডাকবাক্সের চাবিটা এনে তালা খুলল। সাত আটটা চিঠি। একটাও তার নিজের নামে নয়।

শ্রীলা চিঠিগুলো নিয়ে ডাকবাক্সটা তালাবন্ধ করে দিল। খাটের ওপর একটা বই চাপা দিয়ে রেখে সে বাথরুমে গেল। ঘাড়ে মুখে জল মুছে সে এবার একটু টান টান হয়ে শুল। আজ অনেকগুলো ক্লাস নিতে হয়েছে তাকে। তার নিজের ক্লাস তো ছিলই। আজ তপতীদি আসেননি। তাঁর ক্লাসগুলোও তাকে নিতে হয়েছে। স্বভাবতই একটু বেশি ক্লান্ত আজ সে।

এই খাটটাতে শুয়ে শুয়েই তার জীবনের পঁচিশটা বছর কেটে গেল। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। এখন আর লাগে না। সারা পৃথিবীও যেন তার এই একা থাকাটা মেনে নিয়েছে। আগে তো রীতিমতো ভয় করত শ্রীলার। সে একা থাকতে রাজি । কিন্তু পৃথিবী রাজি নয়। তারা তাকে একা থাকতে দেবে না। কত লোকের কত গায়েপড়া ঘনিষ্ঠতা কত জনের কুপ্রস্তাব বুড়িদের তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা তাকে সামলাতে হয়েছে একা হাতে । চোখের পাতা ঘুমে জুড়ে আসছে তবু শ্রীলার অতিক্রান্ত জীবনের কথাগুলো ভেসে আসছে চোখের পর্দায়।

চোখ মেলে তাকিয়ে রইল সে । ছাদের দেয়ালে একটা হালকা ঝুল ফ্যানের হাওয়ায় নড়ছে । এই ছাদের দিকে তাকিয়েই শ্রীলার জীবনের রঙ বদলে বদলে  গেছে । শৈবাল যখন চলে যায় তখন চশমা ছিল না। এখন চোখের পাওয়ার বাড়তে বাড়তে প্লাস তিন। এক ভরন্ত ডাল থেকে সব পাখি উড়ে গেলে যদি একটা ডানাভাঙা পাখি থেকে যায়, যেমন অবস্থাটা হয় শ্রীলার ক্ষেত্রেও তাই। বিচ্ছিন্নতার আর কী সংজ্ঞা হতে পারে ! মানুষ সংঘবদ্ধ হতে চায় আবার সংঘবদ্ধ হলে সে ই মানুষই সংঘ ভাঙে , কোঁদল করে পাড়া মাৎ করে । সংসারের এ এক বিচিত্র খেয়াল। প্রথম প্রথম চোখের জলে ভেসে যেত শ্রীলার বিছানা। যেখানেই সে গেছে তার চোখে শুধু ধরা পড়ত সংঘময়তা। চিড়িয়াখানায় গেছে। একত্রে একপাল হরিণ দেখেছে। তার বাড়ির সামনের বটগাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত কত পাখি । একজোটের জটলা। কোথাও বুঝি কেউ একা নেই তার মতো। শৈবালকে ছেড়ে সে চিরদিনের জন্যে একা হয়ে গেছে। অথচ শৈ বাল তার কাছ থেকে চলে যেতে চায়নি । শ্রীলা নিজেই নিজের বুকে ছুরি মেরেছিল।

ছোটোবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে শ্রীলা বড়ো হয়েছিল মাসির সংসারে । মাসির ছেলে শৈবাল। বয়সে শ্রীলা বছর দুয়েকের বড় । একসঙ্গে বেড়ে ওঠা। একদিন মাসি মেসোকে নিয়ে কার যেন বিয়ের গয়না গড়াতে দিতে গিয়েছিলেন। শৈবাল তখন কলেজে। শ্রীলা সবেমাত্র স্কুলের চাকরিতে ঢুকেছে। শৈবাল সেদিন একটু আগেই কী ফিরে এসেছিল বন্ধুদের আড্ডা থেকে? হয়তো। বাড়িতে তখন শ্রীলা একা। একটু পরেই নেমেছিল তুমুল
বৃষ্টি । শ্রীলা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। শৈবাল তাকে হাত ধরে ভেতরে টেনেছিল— সোনাদি, ভেতরে এস। বৃষ্টিতে  ভিজো না। ভেতরে এসে বারান্দার দরজা বন্ধ করেছিল শ্রীলা। একটুআধটু খুনসুটিঁ সব সময়ই করত শৈবাল। গা-সওয়া ছিল সেটা শ্রীলার কাছে। কিন্তু সেদিন একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছিল বোধহয়। শৈবাল সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল শ্রীলাকে। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সোনাদি, ভীষণ। শৈবাল খুব উত্তেজিত ছিল। শ্রীলার ধমনি জুড়েও তখন বিদ্যুৎবাহী কম্পন। শৈবালের ঠোঁট চেপে দিয়ে সে বলেছিল— এসব কথা একদম নয়। কিন্তু সেটা ছিল শুধু মুখের বারণ। মনের বারণ নয়। শ্রীলার নিজেরও খুব ইচ্ছে করছিল যেন বৃষ্টি আরো দীর্ঘায়িত হয়। শৈবালের কাছে আরও  কিছুক্ষণ থাকা যায়।

 শারীরিকতায় যার শুরু দ্রুত হৃৎস্পন্দনে তার পরিণতি হয়েছিল। ওরকম হঠাৎ আসার সুযোগে একদিন শৈবাল তাকে তছনছ করে দিয়ে গেল। ভাঙা আয়নার কাচের মতো  চারদিকে ছড়ানো  ছেটানো  হয়ে পড়ে রইল তার

মনের টুকরোগুলো।  মন যে কাচের থেকেও ক্ষণভঙ্গুর জানা ছিল না শ্রীলার। সে কিছুতেই আর সেই টুকরোগুলো তুলে নিয়ে জোড়া দিয়ে আগের অবস্থায় যেতে পারল না। শৈবালকে তার আগের শৈবাল বলে মনে হল না। এক নতুন মানুষ নতুন পুরুষের আবির্ভাবে তার সমস্ত বয়ঃপ্রাপ্তির ব্যাকরণ নতুন ভাষায় লেখা হয়ে গেল যেন। কিন্তু পরে খুব মন খারাপ হয়েছিল তার। মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী যেন তার দিকে আঙুল তুলে তাকে দোষারোপ করছে। বয়সে সে-ই বড়।  দায়িত্ব তার বেশি । শৈবাল তার ভাই। তাকে শ্রীলাই তো ঠিক পথের নিশানা দেবে ।

অনেক ভেবেচিন্তে মাসির বাড়ি থেকে চোদ্দ কিলোমিটার দূরে সে একটা বাড়ি ভাড়া নিল। সেই বাড়িটাই এটা। এখান থেকেই স্কুলে যাতায়াত। ভেবেছিল এত দূরে এসে সে ভুলে যেতে পারবে শৈবালকে। শৈবালও নিশ্চয় চাকরি নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। ভৌগোলিক দূরত্বে তাদের সব স্মৃতি মলিন হয়ে আসবে। কিন্তু কোনও কিছুই শ্রীলার হিসেবের পথে গেল না। শৈবাল চাকরি পেল এই শহরেই। প্রায় প্রায়ই এসে পড়তে লাগল শ্রীলার এখানে । শ্রীলা ভেবেছিল শৈবালপর্ব মুছে ফেলে বিয়ে করবে। কিন্তু ভাবনা আর ঘটনার মধ্যে যে এতটা ফারাক সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা বোধহয় তখনও হয়নি শ্রীলার। শৈবালকে আটকাতে পারেনি সে। ভুলতে তো নয়ই। শৈবাল শ্রীলাকে বিয়ে করে সংসার গড়তে চেয়েছিল। কিন্তু মাসি ব্যাপারটা জেনে যেতেই ভীষণভাবে রুখে দাঁড়ালেন। শ্রীলার ভাড়াবাড়িতে এসে রীতিমতো অপমান করে গেলেন তাকে । ঘনঘন আসতেন মাসি সে সময়। আর পাঁচকথা শুনিয়ে যেতেন। শেষে একদিন এসে কেঁদে ফেললেন : সোনা, তুই আমার মেয়ের মতো। ও তোর ভাই। কেন তোরা এমন পাগলামি করছিস। তুই ওকে ছেড়ে দে । দুজনেই আলাদা বিয়ে কর। ভালো  হবে তোদের। তুই বড়। দায়িত্ব তো তোরই বেশি। বল্ আমি ঠিক বলেছি কী না ।

 সারারাত ঘুমোতে পারেনি শ্রীলা। চোখের জলে কুয়াশা রচিত হলেও সে স্পষ্ট দেখেছিল সারাটা দেয়াল জুড়ে শৈবালের দুখী  মৌনী মুখ। বাতাসেও শুধু তারই শরীরের গন্ধ। পাখির শিসে শৈবালের অশ্রুত কণ্ঠধ্বনি। তবু শ্রীলা স্থির করে নিল, আর নয়। মাসির ছেলেকে মাসির হাতেই ফিরিয়ে দেবে । শৈবালের ওপর তার কোনও  অধিকার সমাজ মেনে নেবে না কোনওদিন ।

পরদিন থেকে শুরু হয়ে গেল চরম পরীক্ষা। প্রথমে বোঝানো  দিয়ে সূত্রপাত। তারপর মান-অভিমান রাগারাগি মাথা গরম। ব্যথা পাবে জেনেই শ্রীলা শৈবালকে বলেছিল—তুমি আর এখানে কোনওদিন এসো না। শৈবাল তাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল। শ্রীলা নিজেকে সরিয়ে নিয়ে চরম কথাটা বলেছিল—আমাদের এই বিয়ে সম্ভব নয়, শোভনও নয়।

–অন্যের কাছে শোভন মনে হল কী না তাতে আমাদের কী যায় আসে ! এ বিয়ে আমাদের কাছে খুব প্রয়োজনীয়।

–মোটেই না। তুমি তোমার পক্ষে যা মানানসই সেরকম বিয়ে করে নিও। দু’চার দিন গেলে ঠিক মানিয়ে যাবে সবকিছু।

–আর তুমি কী করবে?

–আমার কথা পরে ভাবলেও চলবে। আপাতত তুমি এখানে আর আসছ না। তাই তো?

–দেখা যাবে —বলে বিদায় নিয়েছিল শৈবাল। 

আবার আসা যাওয়া চলতে লাগল। একদিন সারারাত পেরিয়ে গেল। তবু বাড়ি ফেরার নাম করে না শৈবাল। শ্রীলা তাকে তাগাদা দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বাড়ি না ফেরায় পরদিন মাসি এসে তুমুল চেঁচামেচি করে গেলেন। এবার কথায় বেশ নোংরা  ইঙ্গিত। একটা কথা শ্রীলার আজও মনে আছে—এবার লাইনের মেয়ে ভেবে তোকে  এ পাড়ার লোকরা তাড়িয়ে দেবে । শ্রীলা এসব কথা আশা করেনি। তার মনটা বল্গাছেঁড়া ঘোড়ার মতো। কিছুতেই বশে থাকছে না। শরীর নিশ্চয় এসে গেছে এর মধ্যে। কিন্তু শুধুই কী শরীরসর্বস্ব সে !
পরদিন আলটিমেটাম দিয়ে দিল শৈবালকে– এরপর যেদিন এখানে আসবে তার পরদিনই আমি বিষ খাব। শ্রীলার সেই আহত রুদ্রময়তার দিকে তাকিয়ে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল শৈবাল। চলে যেতেই হল তাকে।

কতবার পেছন ঘুরে দেখছিল ও। রুমাল বের করে চোখের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। শ্রীলার পক্ষে জানলায় দাঁড়ানো  আর সম্ভব ছিল না। ধীরে ধীরে ওদিকের জানলাটাই বন্ধ হয়ে গেল। আলো নিভে গেল শ্রীলার বাড়িতে।

শ্রীলা ভাবে । মানুষের অপরিণত চিন্তা আর সাময়িক আবেগ মানুষকে দিয়ে কত কাজ করায়। হয়তো সে কাজের পরিণতি ভালো হয় না। সারাজীবন আক্ষেপ থেকে যায়। এই যে শ্রীলার জীবনটা। এ তো নিজের হাতে ফুল ছিঁড়ে ফেলার মতো। জীবনের সব রঙ গলে গিয়ে এখন সব কিছুই ধূসর। তার কাজ আছে, ব্যস্ততা আছে কিন্তু কোনও কিছু নিজের মতো করে পাবার প্রত্যাশা নেই। সবই চলছে যান্ত্রিক অঙ্কে । সূর্য ওঠে,  সূর্য ডোবে । ক্যালেণ্ডার বদলে বদলে যায়। মাসচক্রে তার ঋতুকাল আসে। চলে যায়। অনেক কিছুতেই তার প্রয়োজন নেই। তবু নিয়মরক্ষা। এর মধ্যে মেসো মারা গেছেন। মাসি শৈবালের কাছে দিল্লি না মুম্বাই কোথায় যেন ! অনেকদিন হল মাসিরা ওদের বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছেন। শৈবাল এখানকার চাকরি ছেড়ে দূরে চলে গেছে। শ্রীলা তাদের কোনও খবর জানে না। আর দরকার-ই বা কী!

 ভাবতে ভাবতে তেষ্টা পেয়ে গেল শ্রীলার। উঠতে যাবে এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ঘড়িতে প্রায় ছ’টা বাজে । শ্রীলা জানে এ সময় কারা আসবে। দরজা খুলে দিতেই পাঁচ সাতজন মাঝবয়েসি স্ত্রীলোক। কারোর  শাড়িতে কাদা, কারোর খালি পা । কেউ সদ্য মাথায় সিঁদুর লাগিয়ে এসেছে । কারোর ব্লাউজ সরিয়ে বাইরে এসে পড়েছে শিথিল স্তনের কিছুটা। ওদের হাসির উত্তরে শ্রীলা বলে —দেখি দাঁড়াও কার কী আছে ।

এইসব স্ত্রীলোকরা কেউ শ্রীলার বন্ধু নয়। হওয়া সম্ভবও নয়। এরা থাকে সামনের বস্তিটায় যার নাম জবরপল্লি । জবরদখল করে নেওয়া জমির ওপর কলোনি তাই ওরকম নাম। ও জায়গাটায় এককালে একটা পতিত মাঠ ছিল। বড়  বড়  ঘাসে ভর্তি ছিল। গোরু মোষ চরত। শ্রীলার পশ্চিমের জানলা দিয়ে খানিকটা মাঠ দেখা যেত। মোষের পিঠে চড়ে রাখাল ছেলেদের মাঠময় ঘুরে বেড়াতে দেখেছে সে। মোষের পায়ে পায়ে বক ঘুরতেও দেখেছে। দূরে মাঠের প্রায় শেষে একটা উঁচুমতন জায়গা ছিল। সেখানে শরতে কাশের মাথা হাওয়ায় দুলত । শ্রীলা জানলার পাশে বসে থেকেই কতদিন সারা মাঠ পাক দিয়ে আসত। সেই মাঠটা আজ আর নেই।

মাঠে একদিন কিছু মানুষ এল। খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হল। একটা দুটো  করে খোলা খাপরার ঘর উঠতে লাগল। ঘাস কেটে কেটে চলার পথ তৈরি হল। সে পথে ভোঁ ভাঁ এসে দাঁড়াতে লাগল মোটরবাইক। একদিন তার স্কুলে যাবার পথে দেখা হয়ে গেল মানবেন্দুর সঙ্গে। মানবেন্দুই এগিয়ে এসে কথা বলল–দিদি ভালো আছেন ?

—হ্যাঁ ভাই। কোথায় চললে ?

মানবেন্দু নেতাগোছের সেটা শ্রীলা জানত। তাই ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করা। জিজ্ঞেস করে ভালোই হয়েছিল।  শ্রীলা জানতে পেরেছিল ওই মাঠে একটা বসতি গড়ে উঠবে। দিনমজুর রিক্সাওয়ালা বিহার থেকে আসা রদ্দাওয়ালা মুর্শিদাবাদের রাজমিস্ত্রি ঠিকে ঝি মুরগিমাছের খুচরো  ব্যাপারী সব ওখানের বাসিন্দা হবে। তাদের অনেকেই ছিন্নমূল কেউ কেউ সুদূর গ্রামদেশে রেখে এসেছে পরিবার। ঘরদোর গুছিয়ে নিয়ে বসার পর এরাই আবিষ্কার করে শ্রীলাকে। ওদের দিদিমণি সে। আস্তে আস্তে অনেককেই চিনে গেল শ্রীলা। জবার মা, লছমি, চন্দ্রমুখী, পদ্ম, টিয়ার মা, বুধনের দাদি,মালতি,বুচনবুড়ি এরকম সব নাম ওদের। ওরা আসে শ্রীলাকে দিয়ে চিঠি লেখাতে। সঙ্গে একটা করে পোষ্টকার্ড আনে।
মেটে ঘরে থাকায় অনেক সময় কাদা-কালি লেগে যায় পোস্টকার্ডে । সেসব যতটা সম্ভব মুছে নিয়ে চিঠি লিখতে হয় শ্রীলাকে। কখনও বাংলায় কখনও হিন্দিতে । কত বিচিত্র সব গ্রামে যায় সে চিঠিগুলো । আগে কখনও এমন নাম শোনেনি শ্রীলা—কাবিলডাঙ্গা, পাঁচড়া, ভাঙনখোলা, ধুপধুপি, চৌবাতিয়া, খটমলগঞ্জ। শ্রীলা জানে না সে সব চিঠি ঠিকমতন পৌঁছায় কী না। এরা অনেক সময় পরিষ্কার করে ঠিকানাও বলতে পারে না। পিনকোড তো  দূরের কথা, জেলার নামটাই ভালো  করে জানা নেই তাদের। কখনও বলে বীরভূম কখনও বলে সিউড়ি। শ্রীলা ধরে নেয় বীরভূমই হবে। সিউড়ি যখন কোনও  জেলার নাম নয়। কিন্তু বিহারের জেলার নামে শ্রীলার খটকা থেকেই যায় আরা না ছাপরা।

 এসব ধন্দ অতিক্রম করে কিছু চিঠি নিশ্চয় যথাস্থানে পৌঁছায়। নইলে কারও  কারও  কাছে উত্তর এসে যায় কীভাবে ! চিঠি লিখে দিতেও যেমন শ্রীলা, পড়ে দিতেও তাকেই দরকার।

চিঠি পড়ে দিতে দিতে খুব হাসি পায় শ্রীলার। এসবও চিঠির বিষয় হতে পারে! ছবিলাল নিয়ে এসেছিল তার  বউয়ের চিঠি। বউ জানিয়েছিল নুনুয়ার পিঠময় ঘামাচি হয়েছে। বুচনবুড়ির নাতি তার বাবাকে লিখেছিল তার জামাটা কুলগাছের কাঁটায় ছিঁড়ে গেছে। এরকম সব কথা। কারো গোরুর বাচ্চা হয়েছে তো কারো পাঁচিল বর্ষার জলে ধসে গেছে । জাপান বাউরি গ্রামে পৌঁছে  চিঠি দিয়েছে তার বউকে —আমার রিক্সাটা গদাই যেন ভালো করে  চালায়। ঠিকমতন টাকা চেয়ে নিবি । ধান পোঁতার কাজ শেষ হলে জবরপল্লিতে ফিরে আসব। চিন্তা করিস না।

শ্রীলার আর হাসা হয় না। এসব কথা তার কাছে জরুরি না হলেও যাদের চিঠি তাদের এগুলো  জানা দরকার। এসব খবরে তাদের দুশ্চিন্তা কাটে।

এরকমভাবে দিন যায়। স্কুল করে আর অন্যের হয়ে চিঠি পড়ে দেয় শ্রীলা। লিখে দেয়। স্কুলের বাইরে যে লেটারবক্সটা আছে তাতে চিঠিগুলো  ফেলেও দিতে হয় তাকেই।

একদিন জবার মা একখানা পোস্টকার্ড নিয়ে এল একেবারে  জলে কাদায় ভেজা। ব্যাপারটা এরকম : পোস্টম্যান বাড়ির সামনে  চিঠিটা ফেলে পালিয়েছিল। জবার মা তখন এ-বাড়ি ও-বাড়ি কাজ সারছে। ফিরে এসে দেখে বাতাসে উড়ে গিয়ে চিঠিটা কাঁচা নর্দমায় গিয়ে পড়েছে । বিশেষ কিছুই উদ্ধার করা যায়নি সে চিঠি থেকে। একটা নাম সে পড়তে পেরেছিল—মহাদেব। জবার বাবার নাম। গাঁয়ে ঘরে গেছে সে। জবার মার কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রীলা বলেছিল—দেখ জবার মা, তোমার বর নিশ্চয় ভালো আছে। নইলে চিঠিটা পাঠাল কী করে? শ্রীলার কথা শুনে কিছুটা বোধহয় আশ্বস্ত হয়েছিল জবার মা। কিন্তু স্বামীর দেশের গল্প জানতে না পেরে হা-হুতাশ কাটেনি তার। আর একবার পদ্ম এসে খুব দুঃখ করে গেল।

—জানো দিদি পিওনটা না খুব বদমাস। চিঠিপত্র  দিতেই চায় না।

—কী করে বুঝলি?

—দেখ না তোমার ভাই সেই কবে গেছে এখান থেকে। কেমন আছে কে জানে। কোনো খবর পাচ্ছি না।

—চিন্তা করিস না। নিশ্চয় ভালো আছে। দেখবি হয়তো ডাকঘরে পোস্টকার্ড পাচ্ছে না।

তখনই একদিন পোস্টম্যানের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গিয়েছিল। শ্রীলার কিছু চিঠি কিছু পত্র-পত্রিকা নিয়ে এসেছিল সে। শ্রীলা দুম করে পোস্টম্যানকে জিজ্ঞেস করে বসেছিল—আচ্ছা জবরপল্লির ওদের চিঠিপত্রের এত গোলমাল হয় কেন বলুন তো?

শ্রীলা আশঙ্কা করেছিল পোস্টম্যানটা হয়তো চটে উঠবে। কিন্তু না একটুও রাগেনি সে। খুব ঠাণ্ডাভাবেই উত্তর দিয়েছিল— আসলে কী জানেন দিদি, ওদের নেই কোনো ঠিকানার ঠিক। এদিকে নালা ওদিকে আবর্জনা। এদিকে নালা, ওদিকে আবর্জনা। ঐসব বাঁচিয়ে যাওয়া। তাও যা ঠিকানার ঠিক থাকত। কারো চিঠিতে লেখা থাকে তুলসীতলা। অমন তুলসীতলা তো হাজারটা আছে। পোস্টম্যানদের যে কী ঝামেলা আপনারা বুঝবেন না দিদি।

 শ্রীলা বুঝতে চায় বলেই তো এত কথা ভেবেছে। তখনই সে একটা প্রস্তাব দেয় পোস্টম্যানকে—ধরুন আমি যদি আমার ঘরের বাইরে একটা কাঠের বাক্স রাখি, জবরপল্লির লোকেদের যত চিঠি আসবে আপনি তাতে ফেলে দিয়ে যাবেন?

—এতো খুব ভালো কথা দিদি। আপনি যদি এতটা করেন ওদের জন্যে আর আমি এটুকু করতে পারব না? তাছাড়া আমার আর নালা নর্দমা ডিঙিয়ে ঐ বস্তিতে ঢুকতে হবে না।  সেই থেকে এই ব্যবস্থা চালু। প্রতিদিনই সন্ধেবেলা কেউ না কেউ চিঠির সন্ধানে আসে। যারা আসে না তাদের কারো চিঠি থাকলে ওদেরই হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয় শ্রীলা।

পায়রার ডাকের কথা শ্রীলা শুনেছে। পায়রা নাকি রাজা- বাদশাহের বার্তাবাহক ছিল। শ্রীলার হঠাৎ নিজেকে পায়রা পায়রা মনে হতে লাগল। তার হাত দিয়ে চিঠি চলে যাচ্ছে কত দূর দেশে কত অখ্যাত গ্রামে গঞ্জে। ওরা সবাই চলে যেতেই শ্রীলা একবার তাকায় তার রেখে দেওয়া ডাকবাক্সটার দিকে। শ্রীলারই মতো একা। যার নিজস্ব তাগিদ উদ্দেশ্য বলতে কিছুই নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *