বনমালী মাল

বিগত কয়েক মাস আমি ক্রমাগত সুখ পেয়ে যাচ্ছি। সুখ বলতে মানুষ যা ভাবে, তেমনই। কোনো আপেক্ষিকতা নেই, রহস্য নেই – স্রেফ সিম্পল সুখ। যা চাইছি তাইই হচ্ছে। যা ঘটছে, বাদ-বিচার করে পরে বুঝেছি, আমি আসলে এটাই চাইছিলাম। অনেকেই বলেন, আমি বোধ-বিষয়-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। আমার এত এত বই সাজানো আছে দোতলায়। চর্যাপদ, চণ্ডীমঙ্গল, রবীন্দ্রনাথ, মানিক এমনকি ফ্রয়েড কৌটিল্য মার্ক্স মহাভারতও। দালি পিকাসোর ছবি আছে। কৃষ্ণের সামনে নতজানু অর্জুন বসে আছে আমার রুমের পূর্ব দিকের দেওয়ালে। পশ্চিমের জানালা থেকে রোদ ঢুকলে সবকিছু ঝাপসা করে অসংখ্য শাঁখ বাজে আর একটা সন্ধ্যা নেমে আসে। কিন্তু যেদিন থেকে আমার সুখের সময়টা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে আমি ওই পেন্টিংটা স্পষ্ট দেখতে পাই – এমনকি পশ্চিমের ধাঁধালো রোদেও। সন্ধ্যা আসার মুহূর্তে আমি দুজনকেই প্রণাম করি। থ্রি ডি ছবিতে কৃষ্ণ ও অর্জুনের হাত যেন আমাকেই উদ্দেশ করে। 

     পৈতৃক ভিটা ছিল আমার। সেটা রক্ষা করার পাশাপাশি আরো কিছু যোগ করেছি। নিজে চাষের জমি দেখাশোনা করতে সময় পাই না, অথচ জমির পর জমি এখনও কিনে যাচ্ছি, ভাগে দিই আর খোরাকির চেয়েও বেশি চাল ঘরে এনে তুলি। এক-একবার ভাবি, অতিরিক্ত চালগুলো ওরাই রাখুক। আমার আশীর্বাদী মুদ্রার সামনে ওরা তাহলে চিরকাল অর্জুনের মতন বসে থাকবে। কিন্তু যখন নিজেকে মহান করে তোলার নেশা কেটে যায়, নিজে যখন শত-সহস্র নারীর সংস্পর্শে শুধু দেহই পাই – ওদের বলি –

        “চাল এত কাটল কী করে! এত পোকা কেন!”

আমি কেন খামোখা দান করে করে ওদের পঙ্গু বানাবো! আসলে এমন বুলি না ওড়ালে আমার সামনে ওরা সহজে সোজা হয় না। দান করতে চাই না, এই সত্যির সামনে একটা আদর্শ সত্যিকে ঘষে-মেজে তাদের শোনাই – 

    “দেখ, দানী কর্ণ সারাজীবন দান ক’রে ক’রে ব্রাম্ভণ থেকে শুদ্র-কে লোভীই করে গেছে শুধু।”

     এমন সুখের দিনে কাকগুলোর অবশ্য এমনই হওয়ার ছিল। কা কা শব্দটা যখনই অবাধ উন্মত্ততা পেরিয়ে খিঁচুনির দিকে যেত, তখনই দেখতাম খোলা আকাশ থেকে কালো তারা ঝরে ঝরে পড়ছে। আমার সুখের দিনে তাদের নিরলস চেষ্টা অসার পালকদেহ নিয়ে ঠাটিয়ে পড়ে আছে। ঘন্টাখানেকের ভেতর একপাল পিঁপড়ে কাকের মাপে – কাক দেখা যায় না আর। প্রতিটা কাকের বেলায় আমি অন্ধকার পর্যন্ত অপেক্ষা করি। সৎকার করবার পূণ্য যে কত বিরল! বিপিনের রান্নাঘরের জানালায় আলো জ্বলেনি। নিশ্চই তার মা আর বউ চোখ পেতে আছে রাস্তায়! একটা ছেলে আছে ঘরে। ছোটো একটা মেয়ে আছে তার। তবু মাটি হওয়া কাকগুলোর একটা গতি তো করা উচিত! 

    রাত্রি আরো গাঢ় হলে আমি বিপিনের ঘর পেরিয়ে ফেলে আসি তাদের। কখনো ওরা দেখতে পায়, জানতেও পারে, আশ্চর্য – তবু কিছু বলে না।

   যেদিন কোনো কাক হরদম ডাকে, ক্লান্ত হয়, তারপর নিশ্চুপ – সেই দিনগুলোতে আমার সুখী হওয়ার বিশ্বাস আরো জাগ্রত হয়। দোতলার ঘরে আমি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যাই। কোনো কোনোদিন কবিতার ঘোরে পড়ি। নীচে নেমে এসে ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটি। কখনো আগের রাতে জল হয়ে গেলে ভাবি, কতদিন দিনের আলোয় বৃষ্টি দেখিনি! আকাশের দিকে উদাস চেয়ে থাকি। 

   বিপিনের মেয়েটা কখন সামনে এসে আধা আধা ছড়া কাটতে চায়। তার ঠাণ্ডা ছিপছিপে হাতটা আমাকে চমকে দেয়। বৃষ্টি এল নাকি! মেয়েটা আজকাল বেশীই আসে না কি! বিপিনের বউও ইদানীং কথায় কথায় আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে – “ছেলে-মেয়েগুলো সবসময় তোমার কথা বলে।”

    কী বোঝাতে চায় বিপিনের বউ!  

আমাকে ওরা খুব ভালোবাসে! আমার একলা সংসারে যেদিন সময় বাড়ন্ত হয় – ওদের ঘরে আমার পাত পড়ে। এমন সুখের মাঝে কোথাও কোনো ফাঁক-ফোকর রয়ে যাচ্ছে না তো! তবু তো কাকগুলো ডেকে ডেকে সারা হয়। মরে পড়ে থাকে কৃষ্ণচুড়া গাছের ছায়ায়। 

    কানাঘুষো খবরটা যেদিন সত্যিকারের সত্যি হয়ে গেল, সেদিন বিপিনের জটিল চাউনি নিয়ে আমার আর কোনো চিন্তা রইল না। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কে যেন জোর গলায় নিজের আনন্দে চেঁচিয়ে বলেছিল – “পাকিস্তানটা শেষ হয়ে গেল।”

    জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে কয়েকটা ছেলে ফুরিয়ে গেল। শুধু জলে ভেজা ঢালাই রাস্তা আর কাঁঠাল গাছের পাতা চকচক করছে তখন। কোনো শব্দ নেই, কখন বৃষ্টি এসে চলে গেল! আর গল্পে বসলাম না।

     পরের দিন আমাদের ব্যালটে জেতা মসীহা এখানে সেখানে সভা-মিছিল করে জানিয়ে দিল আমাদের শত্রুদেশ পাকিস্তানের সঙ্কটময় দুরবস্থার কথা। সারাদিন না লেখা, না পড়া তবুও শরীর মন কেমন সতেজ! আমাদের মসীহাদের জল চিকচিকে শরীর থেকে সুখ ঝরে ঝরে পড়ছে। সবাই কান পেতে শুনতে লাগল তাদের অক্লান্ত স্লোগান। আমাদের সবার শত্রু এমনভাবে নিপাত গেছে, তার জন্য মসীহাদের আর সরকারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারলাম না। 

    “আমাদের ভোট বিফলে যায়নি” – বলতে বলতে বিপিনের নুয়ে পড়া মা জানালার আলোয় এসে দাঁড়াল। হেসে তাকে সায় দিলাম। বিপিনের মেয়ের সামনে শিশু হয়ে গেলাম তবু গুমোট কাটল না! অথচ বর্ষাকাল তো তখনও ফুরায়নি! 

   আমার নিরবচ্ছিন্ন সুখের সেই উত্তম শুরু – সেই মধ্যম। কল্পনায় দেখতে পেলাম, আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমানায় আর কোনো শেল বা বোম পড়ছে না। কোনো চোখ নেই অন্য প্রান্তে। কোলাহল নেই এপ্রান্তের ঘুমে ও স্বপ্নে। বৃথা চেষ্টা করে দিনের পর দিন ডাকতে গিয়ে কাক মারা যাচ্ছে। আমার লেখাপড়া আর চিন্তার মাঝে ইদানীং ছেয়ে আসে একটা বিস্তীর্ণ জনহীন প্রান্তর! ব্যবহৃত হাঁড়ি কুড়ির অবশেষ সেখানে! হাঁ করে যেন একা কোনো এক মালিক দগ্ধ ক্ষয়িত হাতে একটা দানপত্র আগলে বসে আছে।  

   যেহেতু আমি ভীষন ভাবতে পারি, তাই কোনো রক্তপাত না ঘটেই ওই দানপত্র এসে গেল আমার হাতে। নিজে ওই মালিক স্মিত হাসি হেসে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল। একরের পর একর সম্পত্তি হল আমার আর কিছু একর বেচে আরো ঘর – আরো বই। দোতলার অন্ধকারে আমি অবিরাম হাসছি। লাফাতে লাফাতে হাঁটছি। হিন্দি সিনেমার মুখস্থ কিছু মুদ্রায় কাকে শাসাচ্ছি, আমার থেকে ক্ষুদ্র কাউকে সামনে রেখে তার সামনে হাত নাড়ছি। বিপিনের জানালা দিয়ে যে আলো আসে, যেটুকু ঘর দেখা যায়, সেদিকে তাচ্ছিল্য তাকাই। 

    ক্লান্ত হয়ে নাকি নিজেকে ঠেলা দিয়েই আলোটা জ্বালালাম। পুলকে ভেসে গেলে যেমন শব্দ ধরে যায় – বিপিনকে ডাকলাম। আমার সমবয়সী, আমার বাল্যবন্ধু বিপিন –

    “এবার তোরও সম্পত্তি বাড়বে বিপিন। আমাদের দেশের সীমানা বেড়ে গেছে।”

 বিপিন এল কিনা বুঝতে পারলাম না। এক দৃষ্টিতে তার অন্ধকার জানালার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, বিপিনের ঘরটা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে! আমার আর ওর ঘরের মাঝখানের ঘাসে ঢাকা খামারটা প্রসারিত হতে হতে…

    এখনকার দিনে ভারত আর কতটা! আমাদের গায়ে গায়ে লেগে আছে এক রাজ্য – অন্য রাজ্য। যেসব পাখিরা দিনের বিভিন্ন সময়ে সুর তোলে, তারা হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের এখানে এসে ভিড় জমাতে লাগল। শুধু অনুমান করতে পারলাম, হয়তো তাদের অন্য জায়গার ঘর ছিঁড়ে গেছে। দু’-চার মাসের মধ্যে স্পষ্ট বোঝা গেল, আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলির গাছ, ঘর আর মাটি খুঁড়ে ফেড়ে একাকার হয়ে গেছে। 

  একটানা কতদিন বৃষ্টি দেখিনি তবু কোথায় ছিল এত জলধারা – পুঁজ আর রক্ত-ঘোলা স্রোত – যেহেতু আমাদের পথ হয়ে সমুদ্রে যাওয়া যায়, গদগদিয়ে গিয়ে পড়ছে বঙ্গোপসাগরে। এমনকি যেসব অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল, সেসবও জলের তলায় তলায় চলে এসেছে আমাদের রাজ্যে। পাড়ায়। ঠেকে যাচ্ছে এর-তার পায়ে পায়ে। একদিন একদম নিরীহ একজন মানুষের হাতে এসে ধরা দিল একটা ভারী ধারালো কাতান। আমাদের পাড়াতেই থাকে। যে এতদিনেও তার নামটা অন্যদের কাছে পরিচিত করে তুলতে পারেনি সেই নিশ্চিন্ত মানুষটাকে কতজন বুঝিয়েও কাজের কিছু কাজ হল না। ভোঁতা মানুষটা শুধু অমায়িক হেসে কাতান হাতে ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে গেল।

     কীজানি অন্য পাখিদের এত বেশি ডাকাডাকি কাকগুলোকে উস্কানি দিচ্ছিল নাকি! নাকি খাওয়ার আর থাকার দুশ্চিন্তায় তারা এমন উন্মাদের মত ডেকেই যাচ্ছিল! নির্জন দোতলার ঘরে আমি কেমন অবশ হয়ে গেলাম! সেদিন লিখতে পারলাম না। তার পরের দিনগুলোতেও না। পাক খেতে খেতে কেবল ওই বয়ে যাওয়া স্রোতটার কথাই মনে পড়তে লাগল। থেকে থেকে যেন কত কষ্টে অস্ফুটে একটা কথা বেরিয়ে আসতে চাইছে –

       “আমার দেশটাও এরকম হয়ে গেল! একটার পর একটা রাজ্য!”

    বিপিনের ঘরে খেতে গিয়ে যতক্ষণ না এই কথাগুলো বলতে পারতাম, ততক্ষণ মনে শান্তি আসত না, যেহেতু আমাকে তারা সরল ভাবুক ভাবে। আমারও উচিত তাদের কিছু ভাবানো। বলতাম, কাকগুলো তাহলে এই ক’দিন এই জন্যই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করত! 

 বিপিন কিছু বলত না। কিছু না বললে আমি গুমরে অস্বস্তিই পেতাম। আমার মত ওও তো কিছু না কিছু ভাবছেই! এখন কে আর এত সহজ সরল! অথচ ভেতরে কিছু ভাবলেও বাইরে কোনো প্রকাশ নেই। বিপিন এরকমই। ছোটবেলা থেকেই চিনি তো। আলোর সঙ্গে তার কী ভীষণ বন্ধুত্ব ছিল! যেন বারোটা জ্বলজ্বলে সূর্যের সামনে এলেও সে নিজেকে আড়াল রাখতে পারবে। 

   খাওয়া শেষ করে একবার বিপিনের মেয়েটাকে কোলে নেওয়া উচিত। তখনও ঘুমায়নি দেখে অবাক হলাম। বিপিনের বউ বলল, 

  “আজ দুয়ারটা একটু বাড়ছে বলে তার কী আনন্দ!”

 এতকিছু লুকিয়ে রাখা, বেঁধে রাখার চেষ্টাকে কে যেন এক অদৃষ্ট মন্ত্রে আলগা করে দিল!

 –শুধু আমার একার নয় তাহলে! এদেরও দুয়ার বাড়ছে!

 আমার পশ্চিম দুয়ার পুরোটাই মাকড়সার মোটা ফাঁদে জড়িয়ে থাকত। আজ আলো থাকতে থাকতে স্পষ্ট দেখেছিলাম, কিছু নেই এমন পাতলা ফিনফিনে কিছুর উপর একটা বিরাট মাকড়সা স্থল না পেয়ে কাঁপছে। আর পশ্চিমের দেওয়ালটা নিঃশব্দে সরে যাচ্ছে আরও পশ্চিমের দিকে। দক্ষিণের দুয়ারটা আরো দক্ষিণে। বুঝলাম, পাশের রাজ্যের অতিরিক্ত জায়গাগুলো আমরা আমাদের ভাগে পেয়ে যাচ্ছি। 

      সুখে ভাসতে ভাসতে একটা জমি থেকে উঠে আসা ধান পাকা ঘরের পথ চিনে যায়। আকাশমণি আর কৃষ্ণচুড়া গাছের বাজার তলে তলে ঢেউ তোলে। যেসব কাক ততদিনে মারা গেছে, তারা নিশ্চই কিছু ছানা রেখে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত বুঝে গেছে আমার সুখের সময়ে তারা বেকার শোক আনতে চায়।

    আমি আমার এই নিরবচ্ছিন্ন সুখে কোনোরকম ক্লান্তি বোধ করলাম না। প্রতিদিন বিকেলের পর থেকে রাত্রি – যেকোনো একটা মুহূর্তে পেন্টিংটার সামনে দাঁড়াই। হাতজোড় করে কৃষ্ণের কথা শোনার চেষ্টা করি। কৃষ্ণের বলার ভাষা বুঝতে পারি না, অথচ নিজের ভেতর স্পষ্ট অনুভব করি, তিনি বলছেন –

 “তুমি দীর্ঘদিন এমন সুখী থাকবে। মানুষ কমে এলে পৃথিবী বাড়তে থাকে যে…” 

     অথচ এই কয়েক মাসে শুধু আমার নয়, বিপিন কমল সবার খামার – সবার দুয়ার বেড়েছে। এমনকি সেই নিরীহ লোকটাও এখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার নিজের ভাগের অনেক দূরের সীমানায় তাকিয়ে থাকে। সমস্যা এখানেই। একা আমার নয়, সবার পৃথিবী বেড়েছে। আমি আলাদা করে কারও চেয়ে বড় হতে পারিনি। যারা আমাদের এতকিছু দিয়ে গেল – মাঝে মাঝে তাদের উদ্দেশে বলতে ইচ্ছে হত, তোমরা আমাকে – শুধু আমাকেই গাদা গাদা বীজ দিয়ে গেলে না কেন? 

      বিপিনকে বলে দিতাম, বীজের নিজস্ব মায়া প্রবল, তাই তারা সেইসব জায়গা ছেড়ে এখানে আমাদের কাছে আসেনি। আর এদিকে আমি একা, বীজ আর ফলন!

বুঝলাম, এতদিন আমি ভাগ্যজোরে আর কৃষ্ণজোরে সুখ পেয়ে এসেছি। এখন আমাকে চেষ্টা করে এই সুখের সিলসিলা চালিয়ে যেতে হবে। 

   লেখালেখিতে এখন আর তেমন সুখ পাই না। যা কিছু দেখি, যেটুকু ভাবি – তা দিয়ে গল্প লেখা যায় না। খুব মোটা দাগের ভাবনা আর সম্পত্তির বহর শব্দগুলোকে চেপে দেয়। সুখের কথা এই যে, ডাকতে ডাকতে যেসব কাক এখনও আমার ঘরের চক্কর কাটে, তারা মরে পড়ে যায় ঘরের সামনেই কিংবা দূর খামারে। 

      এদিকে বিপিন আর কমল যাদের আমি আমার ঘর থেকেই চোখে চোখে রাখতে পারি, আজকাল কেমন গোঁ হয়ে থাকে। হতে পারে, তারাও হয়ত আমার মতই ভাবছে। আমি আরো অনেক জায়গা, আরো অবাধ সুখ পেতে কেবল অপেক্ষা করতে পারি কিন্তু ওরা যদি সেই পায়ে পায়ে ঠেকে যাওয়া অস্ত্রগুলো হাতে তুলে নেয়! 

     এখন আমি দিনে অনেকবার কৃষ্ণের সামনে অর্জুন হয়ে বসে থাকি। যদি বিপিনের ঘরটা না থাকত, যদি বিপিনরা না থাকে! এমনকি ওর মেয়েটাও! উত্তরাধিকার না থাকলে আমি – বিপিনের একমাত্র প্রতিবেশী, সবকিছু দখল নিতাম। পাশাপাশি রাজ্যগুলোর মতন আমাদের এখানেও যদি সবকিছু শেষ হয়ে যেত! মুখে জল পাওয়ার ভাগ্যটুকু না পেয়ে কমল এমনকি সেই নিরীহ লোকটাও যদি রাতারাতি ভ্যানিশ হয়ে যেত! আমার খাবার জোগাড় ঠিক হয়ে যাবে, বিপিনও যদি এরকম…! পরিবারের সবার পেছনে বিপিনের মেয়েটা! আমি রাতদিন জেগে তার গোঙানি কান্না শুনছি আর শুধু অপেক্ষা করছি। আমি অন্তত আমার নিজের এতকিছু কোনোভাবেই অন্য একজনকে ভোগ করতে দিতে পারি না। আদর্শের জায়গা থেকে আমি কি ঠিক নেই! এই সবকিছু এমনকি আমার এত বই লেখালেখি বা আমার হাত ধরে পাওয়া বর্ধিত সম্পত্তি – এই সবকিছুর ভেতরে তো আমার বাবার বীজ আছে! 

   বিপিনের মেয়েটাকে আমি নিশ্চই ভালবাসতাম। কিন্তু কয়েক বছর পরেও যে আমার সুখ আমার সঙ্গেই থাকবে – তার কী নিশ্চয়তা? তখন হয়ত আমার ঘরের সবটুকু ছেয়ে যাবে কালো কালো কাকের ছায়ায়! দিনের প্রতিটা মুহূর্ত তাদের চিৎকারে আমার একটার পর একটা সুখ খসে যাবে! 

    ভাবের ঘোর যখন কাটল, দেখি, খামার আর গোটা দুয়ার ভিজে লবালব হয়ে গেছে। বিপিন তো আমার ভাবনাতেই ছিল, ও কি বৃষ্টি দেখেছে!

– বিপিন… বিপিন…

বিপিন সাড়া দিল না। বিপিনের বউ, মা, ছেলে – কেউ না। এমনকি মেয়েটাকে কোলের সুরে ডাকতে সে গলে জল হয়ে তার মায়ের দুধের সঙ্গে মিশে গেল। ওরা সবাই এদিকেই তাকিয়ে আছে – আমার দিকে। আমার ঘরের দিকে। নিশ্চই অনেক সময় ধরে বৃষ্টি হয়েছিল – ঠান্ডা বাতাস – দুপুর গড়িয়ে গেল। ওরা তো জানে, আমি সেই কবে থেকে এখানে ওদের মুখেই দাঁড়িয়ে আছি, অথচ আজ একবারও খেতে ডাকল না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *