সুদীপ ঘোষাল

শিশুসাহিত্যিক  উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

শিশুসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার। বিখ্যাত  গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন তাঁর অমর সৃষ্টি।  তার লেখা অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য টুনটুনির বই, ছোটদের মহাভারত, সাতমার পালোয়ান, গল্পমালা, ছেলেদের মহাভারত, ছেলেদের রামায়ন, কুঁজো আর ভূত, বাঘ খেকো শিয়ালের ছানা, লাল পরি নীল পরি প্রভৃতি। এ ছাড়া তার রচিত ছোট ছোট অসংখ্য গল্প নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র করা হয়েছে। 

আমার পছন্দের লেখকের সম্বন্ধে কিছু বলার আগে তাঁর পরিবারের পরিবেশের উপর কিছুটা আলোকপাত করতে ইচ্ছে হয়।নানা প্রতিকূলতার মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এমন ভূমি তৈরি করেছিলেন যে ভূমিতে পরপর তৈরি হয়েছে নানান সাহিত্যিক। তখনকার দিনে ছাপাখানা অত সহজ ছিলনা। উপেন্দ্রকিশোর নানা বাধা অতিক্রম করে এই ছাপাখানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন এবং তিনি নিজের হাতেই প্রচ্ছদ নির্মাণ এবং এর যাবতীয় ছবি আঁকা সবকিছু নিজের হাতেই করতেন । একটা চারা গাছ রোপন করে তাকে যত্ন করে তার যোগ্য মাটিতে তাকে সার দিয়ে বড় করতে হয় তবেই সে বড় হয় এবং ফল-ফুল প্রদান করে। তেমনি একটি সন্তান সুন্দর পরিবেশে সুন্দর পরিবারে জন্মগ্রহণ করে যদি যথোপযুক্ত মাধ্যমে মানুষ হয় সে পৃথিবীতে আপন স্থান করে নেয় স্বমহিমায়।এমনই একটা যোগ্য পরিবার রায় পরিবার, যেখানে সন্তানদের মানুষ হবার মতো বিখ্যাত পরিবেশ এবং তাদের সেই লড়াকু মনোভাব ও বিদ্যমান। প্রসিদ্ধ  শিশুসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, বাংলা মুদ্রণশিল্পের অন্যতম রূপকার, ১৮৬৩ সালের ১০ই মে  ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে উপেন্দ্রকিশোর জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার আট সন্তানের মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল কামদারঞ্জন। পাঁচ বছর বয়সের সময় তাঁর পিতা কালীনাথ রায় ওরফে শ্যামসুন্দর মুন্সীর কাছ থেকে নিকট আত্মীয় ময়মনসিংহের জমিদার হরিকিশোর চৌধুরী তাঁকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। সুপন্ডিত জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। স্কুল জীবনেই তিনি চিত্রাঙ্কনে দক্ষতা অর্জন করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুকাল অধ্যয়নের পর কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ১৮৮৪ সালে সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন এবং প্রখ্যাত সমাজসেবী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা বিধুমুখীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কোনো বাধা কোনো বিপত্তি উপেন্দ্রকিশোরের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। সকল বাধাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তিনি এগিয়ে চলেছেন সদর্পে। পরিবারকে তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যেখানে যে কোন সন্তান জন্ম নিলে সে বড় হবেই এমন একটা পরিবেশ গড়ে তোলা একজনের পক্ষে কতটা কঠিন সে যে করেছে সেই জানে। 

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯৩৮) ছিলেন বাংলা শিশু সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য শিল্পী এবং তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি “সন্দেশ” পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং তাঁর বিভিন্ন শিশুতোষ রচনা বাংলা শিশু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

তার আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো, ছেলেদের রামায়ণ

এই বইটি রামায়ণ মহাখ্যানের একটি সহজবোধ্য রূপ, যা শিশুদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।ছেলেদের মহাভারত 

মহাভারতের মূল কাহিনীকে সহজ করে, ছোটদের উপযোগী করে তুলে ধরা হয়েছে এই বইটিতে।

সেকালের কথা 

এটি একটি ঐতিহাসিক কল্পনানির্ভর গল্প, যা ছোটদের জন্য বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দিতে সাহায্য করে।

মহাভারতের গল্প 

মহাভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও চরিত্র নিয়ে রচিত গল্প।

টুনটুনির বই 

এটি একটি মজাদার এবং শিক্ষামূলক গল্প, যা শিশুদের জন্য খুবই আকর্ষণীয়।

ছোট্ট রামায়ণ 

রামায়ণের মূল ঘটনাগুলিকে আরও ছোট করে, শিশুদের জন্য উপযোগী করে লেখা হয়েছে এই বইটিতে।

সন্দেশ 

তিনি এই শিশুতোষ মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করতেন, যা আজও বাংলা শিশু সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও মানবিকতার মাধ্যমে বাংলা শিশু সাহিত্যকে নতুন রূপে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর লেখার মধ্যে শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক ও আনন্দদায়ক বিষয়গুলি সুন্দরভাবে মিশ্রিত হয়েছে। 

এই স্বনামধন্য  শিশুসাহিত্যিককে  আপামর ভারতবাসী চিরকাল মনে রাখবেন, এই আশা রাখতেই পারি। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *