সুদীপ ঘোষাল

কবি চন্ডিদাস ও তাঁর পরিচয়

কেতুগ্রামে যেখানে চন্ডীদাস বাস করতেন সেই স্থানটি চন্ডীভিটে নামে লোকমুখে প্রচারিত।

চোদ্দপুরুষের ভিটে বাঙালির মনে অমলিন এক বিষয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মায়ার চাদরের নকশিকাঁথা, জনম জনমের মরমী ভালোবাসা।

কেতুগ্রামের বাহুলক্ষী সতীপীঠের পুরোহিত কালক্রমে নানুরে চলে যান কয়েক বৎসরের জন্য। তারপর আবার ফিরে আসেন কেতুগ্রামে।

বিদ্যাপতির সমসাময়িক একজন শ্রেষ্ঠ  কবি চণ্ডীদাস। চৈতন্যপূর্বযুগে বিদ্যাপতির সমসাময়িক  একজন শ্রেষ্ঠ রাধাকৃষ্ণ-পদাবলি রচয়িতা কবি চণ্ডীদাস । যিনি বাংলা ভাষায় প্রথম পদাবলি সাহিত্য রচনা করেন। চণ্ডীদাস জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন । চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে কারন – চণ্ডীদাস নামধারী অন্তত চারজন কবি ছিলেন বলে সাহিত্যের ঐতিহাসিকগণ সমস্যায় পড়েছেন যার প্রকৃত সমাধান এখনও হয়নি ।

নানুরে  যে  এক  চণ্ডীদাস  বাস  করতেন  তা  তিনি  নিজেই  লিখে  গেছেন – 

নানুরের মাঠে গ্রামের পাশে  বাসুলী  আছ’য়ে  যথা।

  তাহার  আদেশে        কহে  চণ্ডীদাস 

      সুখ  যে  পাইবে  কোথা।।

        লেখক    বিনয়  ঘোষ  লিখেছেন,  “চণ্ডীদাস,  অর্থাৎ  দ্বিজ  চণ্ডীদাস  কোন  ধারাবাহিক  কৃষ্ণলীলার  বই  কিছু  রচনা করেন  নি।  তিনি  রচনা  করেছেন  সুমধুর  সুললিত  গীতিকাব্যের  মালা,  যা স্বপ্নভঙ্গ-নির্ঝরের  উচ্ছ্বসিত  ধারার  মতন  বাঙালীর  মনপ্রাণ  উদ্বেল  করে  তুলেছে।  বাংলার  গীতিকাব্যের  লীলায়িত  ধারার  যিনি  অন্যতম  প্রবর্তক,  বাংলার  অমর  পদাবলীর  স্রষ্টা  সেই  চণ্ডীদাসের  কথা  আমরা  বলছি।  এই  চণ্ডীদাস  বীরভূম  জেলার  নানুরেরই  অধিবাসী  ছিলেন  বলে  আমার  মনে  হয়।  চণ্ডীদাস-নানুর  তাঁরই  লীলাক্ষেত্র।”     

            পদাবলী  স্রষ্টা  যে  এককালে  এই  নানুরে  বসবাস  করেছিলেন  এ  বিষয়ে  পন্ডিতেরা  এখন  একমত। চণ্ডীদাসের  রজকিনী  প্রেম  কাহিনী,  চণ্ডীদাসের  সাধন-ভজন  কাহিনী  ও  চণ্ডীদাসের  মৃত্যু  কাহিনী  ইত্যাদি  সম্বন্ধে  অনেক  প্রবাদ-কিংবদন্তি  প্রচলিত  আছে  নানুর  ও  কীর্ণাহারে।  

 চণ্ডীদাস প্রাক-চৈতন্যযুগের কবি (পঞ্চদশ শতাব্দী) বীরভূম জেলার অন্তর্গত নান্নুর গ্রামে (সম্ভবত ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে) তাঁর জন্ম হয়। তিনি বাশুলি বা চণ্ডীর উপাসক ছিলেন। চণ্ডীদাস ‘রামী’ নামে এক রজক কন্যাকে সাধনসঙ্গিনীরূপে গ্রহণ করেন। পূর্বরাগ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস। চণ্ডীদাস সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন – ‘চণ্ডীদাস সহজ ভাষায় সহজ ভাবের কবি—এই গুণে তিনি বঙ্গীয় প্রাচীন কবিদের মধ্যে প্রধান কবি’। তাঁর মতে  চণ্ডীদাস ‘দুঃখের কবি’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়– চণ্ডীদাস একছত্র লিখে পাঠককে দশছত্র লিখিয়ে নেন।

 বঙ্কিমচন্দ্র চণ্ডীদাস সম্পর্কে বলেছিলেন – ‘সায়াহ্ন সমীরণের দীর্ঘশ্বাস’।মহাপ্রভু যে  চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদন করতেন তার প্রমাণ পাই কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত  ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে । সেখানে বলা হয়েছে—

 “চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটকগীতি

 কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ ।

স্বরূপ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রিদিনে

গায় শুনে পরমানন্দ ।।”

চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য হলেন জ্ঞানদাস। চণ্ডীদাস সম্পর্কে সর্বপ্রথম বিস্তৃত আলোচনা করেন — রামগতি ন্যায়রত্ন।

 চণ্ডীদাস গ্রামবাংলার কবি। পাণ্ডিত্যবর্জিত সহজসরল ভাষায় তিনি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদ রচনা করেন। অন্যদিকে বিদ্যাপতি নাগরিক কবি পণ্ডিত। তাই তাঁর রচনায় বাকবৈদগ্ধ ও মণ্ডলকলার বৈচিত্র্য আছে।

 রবীন্দ্রনাথের মতে  বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডীদাস দুঃখের কবি’ । চণ্ডীদাস গভীর এবং ব্যাকুল, বিদ্যাপতি নবীন এবং মধুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *