সুদীপ ঘোষাল

রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর বহুমুখী প্রতিভার সন্ধান

রবীন্দ্রনাথের সন্তান হওয়াটা রথীন্দ্রনাথের জন্য সৌভাগ্যের বলেই মনে করা হয়। পিতার চলাফেরা,পরিবেশ,কথাবার্তা সব ছেলের মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। আর এখানেই ভিত গড়ে গেছে পুত্রের অচিরেই। তবে অনেকেই বলবেন প্রতিভা না থাকলে শুধু পরিবেশ দিয়ে কি হবে। আবার শুধু প্রতিভা থাকলেও পরিবেশ অনুকুল না হলে বড় হওয়া কঠিন। সেই সূত্রে তাঁর ভাগ্য খুবই ভাল।

রথীন্দ্রনাথের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। তার প্রাথমিক শিক্ষা শান্তিনিকেতনে। পরে আমেরিকা কৃষিবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য যান। ১৯০৯ সালে কৃষিবিজ্ঞানে বি.এস. হয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং পিতার সঙ্গে শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনে কৃষি ও শিল্পের উন্নতিসাধনে যত্নবান হন। ১৯১০ সালে রথীন্দ্রনাথ শেষেন্দ্রভূষণ ও বিনোদিনী দেবীর বিধবা কন্যা প্রতিমা দেবীকে বিবাহ করেন।এই বিবাহই ছিল ঠাকুর পরিবারের প্রথম বিধবা বিবাহ। 

আবার একথাও সত্য যে তাঁকে ৭৩ বছরের জীবনের প্রায় ৫৩ বছর জগৎবিখ্যাত পিতার বিশাল ব্যক্তিত্বের চাপ বহন করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন সুখের ছিল না তাই পুত্রকে প্রথাগত কোনো বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে বাড়িতে শিক্ষাদানে কোনো কার্পণ্য করেননি। শিলাইদহে কয়েকজন শিক্ষক রেখেছিলেন, ইংরেজির ভিত্তি মজবুত করার জন্য লরেন্স নামক একজন ইংরেজকে নিযুক্ত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে রথীন্দ্রনাথকে বাংলা পড়াতেন। এর বাইরে পালি, জার্মান ও সংস্কৃত ভাষা শেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন। 

বস্তুত পিতৃভক্তিতে ত্যাগে ও সৌজন্যপ্রকাশে রথীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তিত্ব বিরল । চিরজীবনই তিনি তাঁর পিতার স্বপ্নকে রূপায়িত করতে বা তাঁর জন্য `কাজের মানুষ’ হয়ে উঠতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন । প্রথম জীবনে তাঁর অধীত কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষা পূর্ববাংলার পৈতৃক জমিদারির কাজে লাগাতে না-লাগাতে পিতার আহ্বানে সে-কাজ ছেড়ে শান্তিনিকেতনের কাজে যোগদান করতে হয় । পরে দ্বিতীয়বার যখন তাঁরা আমেরিকায় যান, তখনও তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রীর অধ্যয়নের কাজ অসমাপ্ত রেখে পিতার সঙ্গে ইউরোপে চলে যেতে হয় । শেষের ক’টি বছর ছাড়া সুদীর্ঘকাল তিনি বিনা পারিশ্রমিকে শান্তিনিকেতনের সেবা করেছেন । এই মানুষটির যথার্থ মূল্যায়ন হয়ত হয়নি । যথাযোগ্য মর্যাদাও তিনি পাননি । পুত্রের এই দিকটার কথা অপর লোক হয়ত বোঝেনি । কিন্তু স্নেহশীল পিতা অবশ্যই তা মর্মে অনুভব করেছিলেন ।

রথীন্দ্রনাথ চাইলে অনেক কিছুই হতে পারতেন। হতে পারতেন সাহিত্যিক। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই নির্মেদ, প্রাঞ্জল, সাবলীল ও সুললিত গদ্য লেখার দক্ষতা তাঁর ছিল। ‘পিতৃস্মৃতি’ এবং স্মৃতিমুখর ‘On the Edges of Time’-তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পদ্যও তিনি কিছু রচনা করেছিলেন। রান্নায় অসম্ভব পটু ছিলেন। শান্তিনেকতনে আসা বিদেশি অতিথি-অভ্যাগতদের জন্য নিজের হাতে জ্যাম-জেলি তৈরি করতেন। প্রয়োজন পড়লে রান্না করতেন বিভিন্ন ধরনের স্বাদু পদ। সুগন্ধি পাউডার এবং ভালো সেন্ট তৈরি করতে পারতেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রদের একজন। ভালো করে সংস্কৃত শিক্ষা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। অত্যন্ত সুন্দর ও প্রাঞ্জল বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’। চামড়ার ওপর সুন্দর নকশা করতে পারতেন। আর জানতেন বাটিকের কাজ। শান্তিনিকেতনে এই দুইয়েরই প্রবর্তন হয় তাঁর হাত ধরে। তিনি ছিলেন অসাধারণ এক দারুশিল্পী। নানা রঙের কাঠ সংগ্রহ করে, সেইসব কাঠের নিজস্ব রঙ অক্ষুন্ন রেখে খোদাই করে কত না অসামান্য শিল্পকর্ম করেছেন তিনি। আসবাবের অভিনব সব নকশা তৈরি করেছেন। বলতেন, ‘জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের; কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের।’ প্রথাগতশিক্ষায় স্থপতি না-হয়েও শান্তিনিকেতনের অজস্র বাড়ির নকশা তৈরি করেছেন। যন্ত্রসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। ছবি আঁকতে পারতেন। বিভিন্ন ফুলের ছবি আঁকায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তারপরও তিনি কৃষিবিজ্ঞানী হলেন রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেপূরণের জন্য।

কুস্তি ও জুজুৎসু শিখেয়েছেন। সাহিত্যবোধ জাগ্রত করার জন্য সহায়তা নিয়েছেন মোহিতচন্দ্র সেন ও সতীশচন্দ্র রায়ের। ভারতবর্ষে সে সময় কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার পথিকৃৎদের একজন রথীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ এই শিক্ষাগ্রহণের জন্য তাঁকে পাঠিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যামব্রিজেও গবেষণা করেছেন ২ বছর । পিএইচডি শেষ করার আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সাথে নিয়ে আসেন। শেষ করা হয়নি।

কৃষিবিজ্ঞান গবেষণা ও সম্প্রসারণে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একটি অনবদ্য ভূমিকা ছিল। ১৩৩১ বঙ্গাব্দে ‘ভারতী’ পত্রিকার ৪৮ বর্ষের চৈত্র সংখ্যায় ‘বৈজ্ঞানিক কৃষিকার্য’ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন সরলাদেবী। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে কৃষিচিন্তা নানানভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাঁর ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসের উদ্যানভাবনা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথও খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে জটিল কৃষি বিষয় সরল বাংলা ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। ভালো বিজ্ঞান জানা না থাকলে একাজ সুসম্পন্ন করা যায় না।

রথীন্দ্রনাথ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিদ্যা পড়ে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও পুত্রবন্ধু সন্তোষ মজুমদারকেও বিদেশে কৃষিবিদ্যা ও গোপালন বিদ্যাশিক্ষার জন্য প্রেরণ করেন। রবীন্দ্রনাথের নানান কর্মে তাঁর কৃষিভাবনা, পল্লীভাবনা এবং বাংলার কৃষিজীবী মানুষের প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। ১৮৯৯ সালে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে ও অর্থে শিলাইদহে নতুন জাতের ধান চাষ শুরু হয়েছিল; হয়েছিল আমেরিকান ভুট্টা, নৈনিতাল আলুর চাষ; পাটনাই মটর, আখ, কপি ও রেশম চাষের প্রচেষ্টাও। কুঠিবাড়ীর চারপাশের জমিকে কেন্দ্র করে প্রজাদের মধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলেন তিনি। পতিসরে কৃষকদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ করে দিতে কৃষি ব্যাঙ্ক স্থাপন করলেন। গঠিত হল তাঁত শিক্ষার কেন্দ্র। গ্রামীণ মানুষকে নিয়ে তাদের নিজেদের দ্বারা পল্লী উন্নয়নের চেষ্টা শুরু হল, হল গ্রাম পুনর্গঠনের কাজ। শক্ত এঁটেল মাটি ট্রাক্টর দিয়ে চাষের বন্দোবস্ত করা হল, কৃষি ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হল, ধর্মগোলা তৈরি হল। অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টিজনিত ক্ষয়ক্ষতি হলে খাজনা মুকুবের ব্যবস্থা হল। নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা পতিসরের ব্যাঙ্কে রেখে মূলধনের সমস্যা খানিকটা মেটানোর ব্যবস্থা করলেন। শাহাজাদপুরের গোপালকদের তিনি উন্নত জাতের গাভী ও চারণভূমি দান করেন। রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতন প্রকল্পেও গ্রামীণ কৃষি উন্নয়ন একটি সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, ‘আজ শুধু একলা চাষীর চাষ করিবার দিন নাই, আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে, বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হইবে’ (রবীন্দ্রনাথ, ‘ভূমিলক্ষ্মী’)। এই রবীন্দ্রনাথই কৃষি ও গ্রামবিকাশের কাজে ছেলের অর্জিত বিদ্যার সহায়তা নিয়েছিলেন।

রথীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণের বাগান সাজিয়েছেন অসংখ্য শ্রীময়ী গাছ, ফুল, লতাপাতা দিয়ে। উদ্যানরচনা যে বিজ্ঞানচর্চার অন্তর্গত একটি শিল্প সাধনা, তা পরবর্তী ভারতীয় কৃষিবিদেরা উপলব্ধি করতে পারলেন রথীন্দ্রের দেখানো পথে। রথী ফুল আঁকতেন ভাল। ফুল বাগান রচনার ইচ্ছে যে ছোটোবেলায় ফুলের ছবি আঁকার মধ্যেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিল, তা পিতাই আমাদের জানিয়েছেন, ফুল আঁকায় ছেলের কাছে হার মানতে হল।

১৯১০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রথীন্দ্রনাথকে বিয়ের পিঁড়িতে বসান। পাত্রী ঠাকুর বাড়ির আত্মীয়, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নি প্রতিমা দেবী। তিনি ছিলেন বিধবা, রথীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে। প্রতিমা দেবীর পূর্বের স্বামী নীলনাথ মুখোপাধ্যায় সাঁতার শিখতে গিয়ে গঙ্গায় ডুবে মারা যান। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিয়ের আগেই পরলোকগমন করেন বলে বিধবা প্রতীমার সাথে রথীন্দ্রনাথের বিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিল । কেননা তিনি বিধবার সাথে বিয়ের ঘোরবিরোধী ছিলেন। রথীন্দ্রনাথের বিয়ের সময় রবীন্দ্রনাথই ছিলেন পরিবারের কর্তা। এ কারণে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল। রথীন্দ্রনাথ এই বিয়েতে কতটা সন্তুষ্ট ছিলেন সে বিষয় বিয়ের সময় কিছু জানা না গেলেও ৩০ বছর পর রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর বোঝা গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে বড় ধরণের কোনো দাম্পত্যকলহ দেখা দেয়নি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শিথিল হতে থাকে। প্রতিমা দেবী সবসময় রথীন্দ্রনাথের প্রতি অনুগত ছিলেন, তবে রথীন্দ্রনাথ তা ছিলেন না।

রথীন্দ্রনাথের বোনদের সংসার সুখের হয়নি, পিতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে সে বেদনা বইতে হয়েছে। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন ছেলের সংসারে না হয়, রবীন্দ্রনাথ সে সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। ১৯১০ সালের মে মাসের ২ তারিখ, অর্থাৎ রথীন্দ্রনাথের বিয়ের ৪ মাসের মধ্যে রথীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে প্রতিমাকে ‘ কেবল গৃহিণী এবং ভোগের সঙ্গিনী ‘ হিসেবে না দেখে তাঁর ‘ চিত্তকে জাগিয়ে তোলার’ জন্য তিনি উপদেশ দেন।

বিশ্বভারতী পরিচালনায় তিনিই রবীন্দ্রনাথকে সহায়তা করেন। ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে তিনি তার প্রথম উপাচার্য হন। কারুশিল্প, উদ্যানরচনা ও উদ্ভিদের উৎকর্ষবিধানে তার বিশেষ দক্ষতা ছিলেন। শেষজীবনে চিত্রাঙ্কণও করেছেন।

তার রচিত গ্রন্থগুলি হল: প্রাণতত্ত্ব (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), অভিব্যক্তি (১৩৫২ বঙ্গাব্দ)। অশ্বঘোষ রচিত বুদ্ধচরিত গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ, অন দি এজেস অফ টাইম (১৯৫৮)।পিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে লেখেন পিতৃস্মৃতি।

উপসংহারে শেষ বয়সের কাজ আর মৃত্যু সম্পর্কে নাই বা লিখলাম। শুধু মনে হয় যোগ্য পিতার সুযোগ্য পুত্র পিতার মতই মানব মনে অমর হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *