কৌশিকরঞ্জন খাঁ

কবিতা সরেন বহু প্রাচীনকালের লুকোনো হাসি হেসে বলেছিল – ‘গুলি’। আমার দেওরের বিয়ে আছে সামনে। তখন হাঁড়িয়া তৈরি হবে। আত্মীয় স্বজন আসবে। হাঁড়িয়া তৈরি করতে এই গুলি লাগে।

     রোদে শুকোতে দেওয়া ছোট ছোট মার্বেলের মতো গুলিগুলো দেখতে দেখতে অনিমেষ বলে – ঘোর গ্রামের হাটে এগুলো বিক্রি হতে দেখেছি। হজমিগুলির মতো দেখতে। আগেও তোমাদের উঠোনে দেখেছি। আজই জানলাম।

     সাঁওতাল  পরিবারের গ্র্যাজুয়েট বউমা হাঁড়িয়ার প্রসঙ্গে লজ্জা পায়। কিন্তু অনিমেষ বছরের পর বছর দেখেছে পরব বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে কবিতার শাশুড়ি চানমনি দিব্বি তার স্বামী সহ অন্যান্যদের মাটির বারান্দায় নারকেলের মালায় হাঁড়িয়া পরিবেশন করছে। বহু আগে একবার চেম্বারে ঢুকতে গিয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কবিতাদের বাড়ি সংলগ্ন প্রাইমারি স্কুলের মাঠটার এদিকে সেদিকে বহু মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। দেখে মনে হয়েছিল কোন ঘটনায় একসাথে সবাই মারা গেছে। তার চেম্বারের অ্যাসিস্ট্যান্ট  অনিন্দ্য বলেছিল – গায়ে রোদ লাগছে। একটু পরেই সবাই উঠে যাবে।

     গাঁয়ের মধ্যে জোর গুজব এবারের পঞ্চায়েত ভোটের ক্যান্ডিডেট হচ্ছে কবিতা সরেন। শোনা যাচ্ছে শাসক বিরোধী দুই শিবিরেই কবিতাকে নিয়ে দড়ি টানাটানির খেলা চলছে। শিক্ষিত হাসমুখো করিৎকর্মা বউ কবিতা দাঁড়ালে কোনও দলকেই আর ভাবতে হবে না। ইলেকশন জেতা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

     চেম্বারের বারান্দায় দাঁড়ালে কবিতা সরেনদের বাড়িটা খোলা ক্যানভাস হয়ে ওঠে অনিমেষের কাছে। এক সময় সে খুবই ছবি আঁকতো। হয়তো হোমিওপ্যাথ ডাক্তার না হলে সে আর্টিস্টই হতো। তার পছন্দের সাবজেক্ট ছিল আদিবাসী জীবন। তাদের ‘মোশান’ গুলোকে ছবিতে ফুটিয়ে তোলাই ছিল তার সাধনা। তাদের ফিগার ড্রইং করতে গিয়ে দেখেছে আদিবাসীদের জীবনের প্রভাব তাদের শরীরী ভাষায় ফুটে ওঠে। শক্ত ছাদের হাত পা। কোমড় বেরিয়ে থাকে সামনের অংশ ঈষৎ ঝুঁকে থাকে। মাঠে ঘাটে কাজ করতে গিয়ে তাদের শরীরটাও সামনে ঝুঁকে যায়। তা যেন বংশপরম্পরায় অর্জিত শরীরী বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।

     কাজের সূত্রে বেশ কয়েকবছর হলো সে আদিবাসী জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। একটা ছবির মতো কবিতাদের পরিবারের লোকজনের চলাফেরা কাজকর্ম সবই ছবির মতো লাগে। কবিতার শাশুড়ীর তৈরি  ছোট ছোট মার্বেলের মতো গোল গোল গুলি পলিথিনের উপরে বিছিয়ে রোদে শুকোতে দেওয়া। বাড়ির ন্যাংটো বাচ্চাগুলো মাটির উঠোনে গায়ে মাটি মেখে ঘুরছে ফিরছে। তার বড়ো জা নীলিমা সর্ষের তেল গোরুর বাটে লাগিয়ে দুধ দুইছে। বালতি ফেনায় ভরে উঠছে। চোঁ চাঁ শব্দটা পর্যন্ত অনিমেষের চেম্বারের বারান্দায় চলে আসছে। কালচে রঙের ছোট বাছুরটাকে একটু পরেই ছেড়ে দেওয়া হবে। সেটা তখন বাকি দুধটুকু খেয়ে ফেলবে।

     গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রোজেক্টের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসালয়ে যেতে আসতে অনিমেষ বুঝতে পারে পঞ্চায়েত ভোটের দিন কাছে এসে পড়েছে। এ বাড়ি ও বাড়ির আনাচে-কানাচেতে পতাকা ঝুলছে। দেয়ালগুলো দখল হয়েছে। প্রার্থী ঠিক না হওয়ায় নামের জায়গা ফাঁকা রয়েছে। বাদবাকি সবটুকু লেখার কাজ সেরে রাখা হয়েছে। এই দেওয়ালগুলোয় দেখা যাবে কবিতার নাম। সরেন বাড়ির ছোটবউ এ গাঁয়ের মাথা হয়ে উঠবে। হয়তো তার সেই লাজুক হাসিটা আর থাকবে না। তার হাসিতেও মিশে যাবে রাজনীতি আর ক্ষমতার রসায়ন।

     পরক্ষণেই নিজের মনেই মাথা নাড়ে অনিমেষ। সবাই সমান হয়না। সবাই বদলে যায় না।  কবিতা সরেনকে তো মহুয়া বনের মেয়ে মনে হয় অনিমেষের। আসলে ওর হাসিতেই লেগে থাকে মহুয়া ফুল। সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে কেমন এক তোলপাড় করা বিকেলবেলার কথা মনে হয়। রাস্তার পাশে ভাঁটফুলগুলো কি বদলায়! বছরের একই সময়ে একই ভাবে হেসে ওঠে। কবিতা বদলে গেলে পৃথিবীর সব সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে। পৃথিবীটাই মিথ্যা হয়ে যাবে। 

     আজ বছর দশেক ধরে দেখছে  সেদিনের নতুন বিয়ে হওয়া সরেন বাড়ির বউ কবিতা পাকা সংসারী হয়ে উঠেছে। দুই হাতে সংসার সামলাচ্ছে, জমির ধান কাটছে। মাড়াই করছে। বস্তার মুখ সেলাই করে করে বারান্দার চকির উপর ডাই করছে। তার সেল্ফ হেল্প গ্রুপের  মিড ডে মিলের রান্নার পালা এলে সমস্ত স্কুলে একটা আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেতে দেখেছে অনিমেষ। কবিতার হাতের রান্নার মতো রান্না নাকি গোটা গ্রামের কেউ জানেনা। 

     মাটির দেওয়ালে উঁচু অংশে ছুড়ে ছুড়ে ঘুঁটে দিচ্ছিল কবিতা। অব্যর্থ লক্ষ্যে গিয়ে ঘুঁটেগুলো পরপর দেওয়ালে এঁটে বসছিল। কোনওটার গায়ের উপর কোনওটা উঠে বসছে না। মুগ্ধের মতো অনিমেষ সেই দিকে তাকিয়ে ছিল। কবিতার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হয়তো বুঝতে পারছিল কোনও পুরুষের মনোযোগের খবর। পেছন ফিরে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার সে লক্ষ্যভেদ করতে থাকে। মনোযোগের কোনও তারতম্য হয়না। আড়ষ্টতা ব্যাপারটাই তার মধ্যে নেই। নিজের কাছে সবসময়ই স্পষ্ট কবিতা।

     অনিমেষ একটু সতর্ক হয়ে সেখান থেকে সরে  হাঁটাহাঁটি করে। গ্রাম সমাজের খোলামেলা পরিবেশেও একটা সততা থাকে। পুকুরঘাটের দিকে সচরাচর পুরুষরা তাকায় না। অনিমেষের চোখে নিজের মুগ্ধতার জরিপ এই মেয়ে দেখে ফেলেছে বহু আগেই। আপত্তিকর কিছু মনে হয়নি। মাঠভরা ধান দেখে সেও মুগ্ধ হয়। গাঁয়ে ঢুকতেই যে পুকুরটা চোখে পড়ে আশ্বিন মাসে তার পার ঘিরে সাদা কাশফুল ফুটে উঠলেও কবিতা মুগ্ধ হয়।

     কবিতার বউভাতের দিন গাঁয়ের একটি বাচ্চা  ছেলের পা উঠোনে রাখা ভ্যানরিকশায় চেনে আটকে গিয়েছিল। সে সময় কেউ তাল পাচ্ছিল না পা টা বের করার। নতুন বউ কবিতা ছুটে এসে নিচের চেনের উপর দাঁড়িয়ে গিয়ে চেনটা ছিঁড়ে দেয়। বাচ্চাটার পায়ের ক্ষত মিলিয়ে যাওয়ার বহু আগেই গ্রাম সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সে। তারপর এতটা দিনে হাসিমুখ নিয়ে সবার সামনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কবিতা সবার কাছে আপন হয়ে উঠেছে। তাই কবিতাই এখন দাবার ঘোড়া। তাকে দাঁড় করাতে পারলে জেতা নিশ্চিত। 

     সুশীল সরেন সহজে ঘাড় পাততে চায় না। বলে – আমার বৌমা এসব ভোটের ঝামেলায় কেন জড়াবে? পরিবারের সমস্ত কাজকর্ম তো ওঁকেই দেখতে হয়। আমরা ওসব পার্টি বাজির মধ্যে নেই। হাতে ছোট তকলি নিয়ে দড়ি পাকিয়ে চলে। যেন ওটাই তার একমাত্র কাজ। বাকি সব রসাতলে যাক।

     অনিমেষ সহজ সাবলীল কবিতাকে আবার চেয়ে দেখে। কখন যেন ঘুঁটে দেওয়া শেষ করে ভাসুরের ছেলেকে থালায় ভাত মাখিয়ে খাওয়াতে বসে গেছে। এই মেয়ে রাজনীতির আঙ্গিনায় লড়বে – এটা ভাবতেও কেমন যেন বেমানান লাগে। কবিতা বার কয়েক বিভিন্ন কাজের মধ্যে অনিমেষের দিকে তাকায়। অদ্ভুত সেই চাউনি। কেবল কৌতূহল! আর কোনও বক্তব্য নেই।

     চেম্বারে আসতে গিয়ে দূর থেকে প্রথম চোখে পড়ে রাস্তা জোরা ফ্লেক্স। কবিতার হাসি মুখ। অনিমেষ দীর্ঘসময় কবিতাকে দেখতে দেখতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে চোখে স্পষ্ট ভাবে ধরা না গেলেও একটা ধারনা থেকেই কবিতার মুখটা বুঝে নেয়। যত এগোতে থাকে তার ধারণা ভাঙতে থাকে। কাছে এসে দেখে যাকে এতক্ষণ কবিতা মনে করছিল সে অন্য কেউ, কবিতা নয়।  সুশীল সরেনের ছেলের বউ কিভাবে রাতারাতি বদলে গেল? যত রাস্তা দিয়ে এগোতে থাকে তত চোখে পড়ে দেওয়াল জুড়ে অন্যান্য নাম। কবিতা সরেনের নামনিশানা নেই।

     অনিমেষ কৌতুহল সরিয়ে চেম্বারে ঢোকে। কম্পাউন্ডে ঢুকেই সুশীল সরেনের সাথে দেখা হয়। সকাল থেকে বেঁধে রাখা গোরু–ছাগলগুলোকে অনিমেষ এলেই সরিয়ে নিয়ে যায়। মনে হয় আগের রাতের নেশা কাটেনি। দম মেরে আছে। আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবেনা ভেবে অনিমেষ কিছু বলে না। সুশীল সরেন থমকে দাঁড়িয়ে বলে – ডাক্তারবাবু বৌমা তো নিজেই ভোটে দাঁড়ালো না। আমি কিছু বলিনি। ওরা এসে খুব চাপাচাপি করেছিল। বৌমার এক কথা ‘না’।

     অনিমেষ এক মূহুর্ত কিছু একটা চিন্তা করে নিয়ে বলে – হ্যা। রাস্তায় ফ্লেক্স দেখলাম। দেওয়ালে দেওয়ালে নাম দেখলাম। যা শুনেছিলাম তা যে ঘটেনি, তখনই বুঝলাম। 

     সুশীল কিছুটা সমর্থন মিশিয়ে বলে – যে দাঁড়াবে তার পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার। আমি তো ভোটে লড়তে নাই করে ছিলাম। আমরা গেরস্থ মানুষ। ভোটে দাঁড়ানো আমাদের পরিবারের জন্য নয়।

     দুপুরে চেম্বারের কাছের ট্যাপ থেকে খাওয়ার জল নিতে আসে কবিতা। স্নান সেরে বেরিয়েছে। মাজা গায়ের রঙের একটা চমক তার কপালের সিঁদুরের ফোটায় গিয়ে জমা হয়েছে। তাতে তার মুখটা আরো বলিষ্ঠ ও সুন্দর হয়ে উঠেছে। চেম্বারের ভেতরটা বাইরে থেকে অন্ধকার লাগে, দরজার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকানোর মধ্যে কিছু বলার ইচ্ছে টের পেয়ে অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে আসে।

— সবাই খুব ধরেছিল, দাঁড়ালাম না ডাক্তারবাবু।

— হ্যা। শুনলাম তো। তোমাকে তো তিনটি দলেই ভোটে চাইছিল! দাঁড়ালে না কেন?

— তা ছিল। সারাজীবন রাজনীতি করলাম না! সংসার আর চাষবাস নিয়ে থাকা। মতের মিল হলো কি হলো না, না দেখেই সবাই জোর করছিল।

— গ্রামের মানুষ তো তোমাকে ভালোবাসে! অনেকের জন্য অনেক কিছু করো। 

— সে সব মানুষকে করতেই হয়। ভোটে দাঁড়ালেও করতে হয় না দাঁড়ালেও করতে হয়। ভোটে জিতে কি সবার জন্য নিজের ইচ্ছেয় করা যায়? এ এসে বাঁধা দিবে, ও এসে বাঁধা দিবে। সে এসে বলবে ‘ওরা আমাদের পার্টির লোক না, ওদের ওখানে যাওয়া আসা চলবে না।’

     অনিমেষের বহুদিন আগের এক বৃষ্টির দিনের কথা পলকেই মনে হয়। এই গ্রামে তখন রাস্তাটা পাকা হয়নি। মাটি এতটাই পিছল যে পা ফেলতে ভয় হতো। গভীর দুর্যোগে সালামৎ এর বউ রুবিনার প্রসব বেদনা উঠেছিল। অ্যাম্বুলেন্স গ্রামের রাস্তায় ঢুকতে না পেরে বড়ো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। পা দিলেই গোড়ালি সহ হাঁটুর নিচ পর্যন্ত গেঁথে যাচ্ছিল। কবিতা কি নিদারুণ দক্ষতায় রুবিনার গায়ে পলিথিন পেঁচিয়ে পিচ্ছিল কাদামাটি পেরিয়ে মাইল খানেক হেঁটে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিল। সেই দুর্যোগে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গ্রামের আশাকর্মী সরকারি পুরষ্কার পেয়েছিল। সেই পুরষ্কারের আসল হকদার ছিল কবিতা একথা অনিমেষ কেন, গ্রামের সমস্ত মানুষ, এমনকি আশাকর্মী লতা টপ্পও বিশ্বাস করে।

     অনিমেষের নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া দেখে কবিতা বলে, না দাঁড়িয়ে কি ভুল করলাম ডাক্তারবাবু?

     অনিমেষ হেসে বলে, আরে না, না! আমি অন্য কথা ভাবছিলাম। সে তুমি যা ভালো বুঝেছ করেছ। তবে একটা কথাই বলবো – আজকাল রাজনীতি রক্ষা করার লোকেরই অভাব।

     কবিতাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। বুদ্ধিমতি বহু দেখা সাঁওতাল তরুণীটিকে এই প্রথম অপরিচিত মনে হলো অনিমেষের। যে এতদিন মুগ্ধতায় ছেয়ে দিত, আজ যেন ভোটের লড়াইয়ে না নেমেও তাকে একটা লড়াইয়ে নামা মোরগ মনে হচ্ছে। পায়ে চাকু বাঁধা ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার আগের মূহুর্তের মোরগ।

     কবিতা অ্যালুমিনিয়ামের কলসিটা কাঁখে নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে বলে — গতবার ভোটে তো গ্রামের মানুষ ভোটই দিতে পারেনি। 

     ভোটের উত্তাপে গ্রামের মানুষ ক্রমশ অলস হয়। পার্টির নির্বাচনী কার্যালয় গুলোতে ভিড়। মানুষের ন্যূনতম কাজ বাদে শুধুই গসিপ। এ পর্যন্ত সচারাচর গ্রামের কোনও বিষয়ে অনিমেষ জড়ায়নি। রোগী দেখা আর বাড়ি ফেরা। এখন ওষুধ নিতে এসে কত লোকের কত কথাই শোনে। যে দলের যে সমর্থক, প্রত্যেকের জিতে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা শুনতে হয়।

     শনিবার গাঁয়ের পাশে হাট বসে। সস্তায় টাটকা সব্জি নিতে বাড়ি ফেরার পথে একবার হাঁটে ঢোকে অনিমেষ। হাটের পাশে পথসভা হচ্ছে। দূর থেকে বক্তব্য ভেসে আসছে। পঞ্চায়েত ইলেকশন এলে জেলা স্তরের নেতারা বক্তব্য দিতে আসে।  মানুষের ভিড় জমেছে। জায়গাটা ঘিরে রয়েছে। একটু এগিয়ে দেখতে গিয়েও আর যায় না – ‘ডাক্তারবাবু অমুকদের মিটিংয়ে গেছিল’ বলে গাঁয়ে খবর হয়ে যাবে।

     কবিতার শাশুড়ি চানমনি ‘গুলি’ নিয়ে বসেছে এক কোনে। সঙ্গে কিছু কাঁচালঙ্কা, কলার থোর। পাশে ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে বসেছে কবিতা কুজুর। চানমনি হিসেব বোঝে না তাই ক্যাশিয়ার হয়েছে কবিতা।

     অনিমেষ ফিরতে ফিরতে ভাবে — এই মেয়েরই ভোটে দাঁড়ানোর কথা ছিল! আজ হাঁটে দোকান সাজিয়ে মাটিতে বসে আছে।

     ভোটের দিন চেম্বারে বসে বসে সামনের রাস্তাটায় তাকিয়ে থাকে অনিমেষ। আজ গাঁয়ের মানুষ ভোটে ব্যস্ত কেউ সম্ভবতঃ চেম্বার মুখো হবে না। দলে দলে বুথে যাচ্ছে। কবিতা এসে চেম্বারের সামনে দাঁড়ায়। অনিমেষ কবিতাকে দেখে বাইরে বেরিয়ে আসে। কবিতা হেসে হেসে ফিসফিস করে বলে — সেদিন যে গুলি গুলো উঠোনে শুকোতে দেখেছিলেন, সেগুলো কাজে আসলো।

     ‘কেমন’ – অনিমেষ বিস্ময়ে বলে।

— প্রচুর হাঁড়িয়া তৈরি করে রেখেছিলাম। একেবারে শক্ত হাঁড়িয়া। বাইরে থেকে লোক জমা করেছিল আজকে হাঙ্গামা বাঁধাবে বলে। ভুতকড়ির মাঠের পাশে গিয়ে দেখেন, একটারও ওঠার ক্ষমতা নেই। সব আলের উপরে শুয়ে আছে মরার মতো। 

     দুপুর এগারোটা বাজতে না বাজতে কয়েকটা অপরিচিত বাইক রাস্তা দিয়ে হইহল্লা করতে করতে ঢোকে। অনিমেষ চেম্বারের ভিতরেই থাকে। এবার একটা হুজ্জতি বাঁধবে।

     বুথের সীমানায় ঘেঁষতে পারেনি। কবিতা ও গ্রামের কিছু মেয়ে বউ বাড়ির পেছনের পুকুরঘাটে বাসন মাজছিল, স্নান করছিল। সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কবিতা পুকুরের আঠালো পঁচা পাঁক তুলে তাদের মুখে অব্যর্থ লক্ষ্যে ঘুঁটে দিয়েছে। একেকটা মাটির তাল একেবারে ঘুঁটের মতো থ্যাপ করে মুখে চেপে বসেছে। কেউ কেউ অতর্কিত হানায় বাইক সহ রাস্তায় পড়েছে।

     অনিমেষ চেম্বার থেকে দেখতে পায় বাইকগুলো যে পথে এসেছিল সে পথে ভেগে পালিয়ে যাচ্ছে। কবিতা কুজুর ও তার সঙ্গীরা বাসনকোসন নিয়ে তাড়া করেছে। হাঁটুর কাছে কাপড়। আঁচল কোমরে পেঁচানো। হাতে পায়ে কাদামাটি। যেন একেকটি  চলমান মাটির মূর্তি। অনিমেষের বহুদিন আগে শান্তিনিকেতনে দেখা রামকিঙ্করের হাতে গড়া ভার্স্কযের মতো মনে হয়। সাদামাটা আদিবাসী জীবন। সরল বিশ্বাসের মধ্যে আজও বিরসা ভগবান জেগে ওঠে। অন্যায় দেখলে আজও হুলের ডাক দেয়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *