সৌমিতা রায় চৌধুরী
টিভির চ্যানেল সার্ফ করতে করতে একটি গানের অনুষ্ঠানে নজর পড়তেই থমকে গেলাম। দেখতে পেলাম রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটির বিপুল আর মোনালিকে। কোচবিহার থেকে এসে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করত ওরা। কলেজ ফেস্টে ওদের গান প্রথম থেকেই ওদের জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ক্লাসমেট হওয়ার সুবাদে আমরাও বিশেষ সুরের খালি গলায় ওদের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি অনেকবার। ওদের জগৎ ছিল গানে ভরা। সে গান একটু অন্যরকম। চোখের সামনে ভেসে উঠল আরও অনেক গল্প। যোগাযোগ করে জানতে পারলাম ওদের সম্প্রদায়ের গান নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রচুর অনুষ্ঠান করে বিপুল আর মোনালি। রাজবংশী জাতিভুক্ত ওরা।
“তিস্তা নদীর উথালপাথাল, কার বা চলে নাও” — বিপুলের গলায় এই গানে মাটির টান স্পষ্ট। উত্তরবঙ্গের খরস্রোতা নদী তিস্তা এই গানে ধরা দিয়েছে। প্রকৃতিই ভাওয়াইয়া গানের মূল বিষয়বস্তু। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, রংপুর, অসমের গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ি জেলা এই পাহাড়ি মাটির গানের জন্মভূমি। রাজবংশী, কোচ, মেচ, রাভা, খেন, যুগী ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মানুষের লোকগান হলো ভাওয়াইয়া। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ গানের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ পায় ভাওয়াইয়া গানে। মনের ভাব প্রকাশ পায় বলেই এই গানের নাম ভাওয়াইয়া। অন্যমতে ‘ভাওয়া’ শব্দের অর্থ গোচারণ ভূমি। বাও, বাউ-এর অর্থ বাতাস। মরা নদীর চড়ে মহিষের গাড়ির চালক চড়াই উতড়াই পথ অতিক্রম করতে গিয়ে যে ভাষায় মনের ভাবকে গানে প্রকাশ করে তাকে বলে ভাওয়াইয়া।
কর্মের টানে ঘর সংসার ছেড়ে দীর্ঘদিন কঠিন কর্মে ব্রতী মানুষের ঘরে ফেরার টান, প্রিয়জনকে ছেড়ে দীর্ঘদিন দূরে থাকার বিরহ এই গানের মূল বিষয়বস্তু। ভাওয়াইয়া গানে প্রধানত কাহারবা ও দাদরা তাল ব্যবহৃত হয়। টানা সুর ভাওয়াইয়া গানের বৈশিষ্ট্য। মাঝি মাল্লারা স্রোতের টানে নৌকা ভাসিয়ে টানা সুরে হাল চালায়। আবার মহিষের গাড়ির গাড়োয়ান যে গান ধরে তাতে কণ্ঠের এবং সুরের ভাঙন ঘটে।
‘দরিয়া’ ভাওয়াইয়া অঙ্গের একটি বিশেষ শাখা। করুণ রসের গানে মানুষের মানসিক এবং শারীরিক কষ্টের আর্তি ফুটে ওঠে। আবার সতাল দরিয়া বেশ কাব্যিক। উত্তরবঙ্গের সুন্দর প্রকৃতির বর্ণনা এবং স্থানীয় মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক এই গানের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত হয়। ক্ষীরোল দরিয়ার গানে চটুল প্রেমের অভিব্যক্তি ব্যক্ত হয়। চিতান দরিয়ার গানে অন্তরা থেকে সুর ক্রমশ চড়তে থাকে উচ্চ লয়ে। সোয়ার দরিয়ার গান হলো মহিষের পিঠে চড়ে চলমান অবস্থায় গাওয়া। একে মৈষাল বন্ধুর গানও বলা হয়। দ্রুত লয়ের ভাওয়াইয়াকে চলন্তি দরিয়া বলে।
‘চটকা’ ভাওয়াইয়া গানের একটি বিশেষ শাখা। খ্যামটা অঙ্গের চটকা গানে খ্যামটা গানের চটুলতা পাওয়া যায়। ঝুমুর চটকাতে ঝুমুর তাল বাজানো হয়। এই তাল অবশ্য ঝুমুর গানের মতো দোলায়মান নয়, তবে দ্রুত দাদরার মতো। তাল হীন ভাওয়াইয়া গানকে বৈতালিক চটকা বলে।
ভাওয়াইয়া গানের মূল বাদ্যযন্ত্রটি হলো দোতারা। মন্দিরা যন্ত্রটিকেও মাঝে মাঝে সঙ্গত করা হয়। কোনো কোনো গানে বাঁশিও ব্যবহার করা হয়।
কিংবদন্তি কণ্ঠ শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমেদ ১৯০১ সালে কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভাওয়াইয়া গানকে প্রথম বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে “ও কি গাড়িয়াল ভাই”, “তোর্সা নদীর উথালপাথাল — কার বা চলে নাও”, “প্রেম না জানে রসিক কালাচাঁদ”। আব্বাসউদ্দীন কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। তাঁকে ভাওয়াইয়া সম্রাট বলেও অভিহিত করা হয়।
প্রতিমা বড়ুয়া পাণ্ডে অসমের গোয়ালপাড়ার জনপ্রিয় লোকসংগীত শিল্পী। ১৯৮৮ সালে সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার এবং ১৯৯১ সালে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত হন। জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত এই শিল্পী ভাওয়াইয়া গানের সম্রাজ্ঞী হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁর দুটি বিখ্যাত গান হলো “হস্তির কন্যা” ও “মাহুত বন্ধু রে”।
ভাওয়াইয়া গানের শিল্পীরা বর্তমানে এই গান নিয়ে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। দোতারা ও মন্দিরা বাদ্যযন্ত্র দুটিকে নিয়ে নানান গবেষণা চলছে। কিছু কিছু সরকারি সাহায্য ও লোক উৎসবের মাধ্যমে ভাওয়াইয়া তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। বিপুল-মোনালিরা আজও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় লোকগান ভাওয়াইয়াকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছাতে। নদী মাতৃক বঙ্গে মাটির সুরই খাঁটি সুর।