সৌমিতা রায় চৌধুরী
প্রাচীন লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ঝুমুর। সুর, তাল, বাদ্য, ছন্দ এবং নৃত্য বৈচিত্রে ঝুমুর শিল্পের পরিধি প্রসারিত। ভারতীয় জনজাতির জীবন ও তার ধারাবাহিক বিকাশকে যথার্থ জানতে হলে ভারতীয় লোকসংস্কৃতির শিকড় সম্বন্ধে জানতে হবে।
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে ভারতের মিশ্র ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছিল।
১) খাঁটি দ্রাবিড়িয় ভাষার কাছাকাছি ভারতীয় জনগোষ্ঠীর ভাষা হলো ওঁড়াও জনগোষ্ঠীর ভাষা।
২) খাঁটি অস্ট্রিক ভাষার কাছাকাছি ভারতীয় জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল সাঁওতাল ও মুণ্ডা সম্প্রদায়ের ভাষা।
৩) দ্রাবিড়িয় ও অস্ট্রিক ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল আদি প্রাকৃত ভাষা।
সাঁওতাল, মুণ্ডা এবং ওঁড়াও সম্প্রদায়ের লোকসংস্কৃতি ছিল ঝুমুর। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগনা সিংভূম ও ধানবাদ। বিহারের রাঁচি, হাজারিবাগ, পালামৌ, গিরিডি, বোকারো। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ, সুন্দরগড়, সম্বলপুর এবং বাংলাদেশের রংপুর ও আরো কয়েকটি জেলায় লোকসংস্কৃতি হিসেবে ঝুমুরের প্রাধান্য ছিল।
ঝুমুর গানে উচ্চগ্রাম থেকে নিম্নগ্রামে অবতরণ করা হতো। তাল থেকে মাত্রার গুরুত্ব বেশি। সম থেকে শুরু না করে ফাঁক থেকে গান শুরু হয়। সমঝদারের আসর ও নাচের আসর — এই দুই জায়গায় ঝুমুর গাওয়া হতো। ঝুমুরের বৈচিত্র প্রচুর। সমঝদারের আসরে যে বৈঠকি ঝুমুর গাওয়া হতো সেখানে একজন গায়ক হারমোনিয়াম ও পাখোয়াজ সহযোগে ঝুমুর গান গাইত। ছুট ঝুমুরে নাচ, গান ও বাজন থাকে। পালা ঝুমুরে একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গান গাওয়া হতো। দরবারি ঝুমুরেও নাচ, গান এবং বাদ্যযন্ত্রের প্রাধান্য ছিল। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের পরে অর্থাৎ চৈতন্য পরবর্তী সময় ঝুমুর গানে কীর্তন ও ভক্তিযুক্ত ঝুমুরের সূচনা হয়। এই সময়ে পৌরাণিক কাহিনিকাহিনি ও বৈষ্ণব দর্শন ঝুমুর গানে স্থান পায়। লৌকিক ঝুমুরের উদ্ভবও এই সময়ই ঘটে।
টুসু, ভাদু, করম-জাওয়া ইত্যাদি লোকবন্দনা ঝুমুর গানে স্থান করে নেয়। দরবারি ঝুমুরে কৃষ্ণ লীলা, পুরাণ, দেহতত্ত্ব, পয়ার বা ত্রিপদী ছন্দে পরিবেশিত হতো। টাঁড়, উধোয়া, ডমকচ ঝুমুর গানগুলোর মধ্যে সুর বৈচিত্র ছিল না। এগুলো আকস্মিক আবেগে রচিত হতো।
পরবর্তীকালে বাউল অঙ্গের ঝুমুর, কীর্তনছোঁয়া ঝুমুর পরিশিলীত ভাষায় রচিত হতো। টাঁড় ঝুমুরের দুটি রূপ। মাঠে ঘাটে কাজের আনন্দে ধামসা, মাদল সহযোগে ঝুমুর নৃত্য পরিবেশিত হতো। আর শৃঙ্গার ধর্মী টাঁড় ঝুমুরে আদিবাসী নারীপুরুষের দেহতত্ত্ব নিয়ে ঝুমুর গান পরিবেশিত হতো। পাতাশালিয়া ঝুমুরে উৎসবকে কেন্দ্র করে ঝুমুর গান গাওয়া হতো। সাধারণত বিবাহ, অন্নপ্রাশন, নবান্নে এই গান গাওয়া হতো। গাহা ঝুমুরে বৈষ্ণব ভাব যুক্ত হয়।
পরবর্তীকালে বৈঠকী ঝুমুর বা দরবারি ঝুমুর জাঁকজমক করে আসর বসিয়ে পদকর্তাদের নাম সহ দলবদ্ধ ভাবে গাওয়া হতো। এমন একটি গান হলো —
“কার গরভে কৃষ্ণ দশ মাস রইল
হরি হায়রে
কার দুধ পিয়ে বড় ভেলায় যমুনা তীরে
বাঁশিয়া বাজায় ধীরে ধীরে”।
অপেক্ষাকৃত চটুল রসের গান সহযোগে নাচনীশালীয়া ঝুমুরকে নিষিদ্ধ খেমটি ঝুমুর বলে। পুরুলিয়া অঞ্চলে সারিবদ্ধভাবে নাচের সূত্রে ঝুমুর নাচকে বলা হয় পাতা নাচ। এইরূপ একটি গানের রঙ্গ-তামাসার অঙ্গ —
“লালগড়ের লাল মাটি
মাদল বানাব হে
এসো বেহাই ধর মাদল
বেয়ানকে নাচাব হে”।
পুরুলিয়া অঞ্চলে কঠোর অনুশীলন ও চরম ধৈর্যের সাথে রণপা নাচের ঝুমুর পরিবেশিত হয়। ঝুমুর গানে সুর গুলির মধ্যে অন্যতম হলো ডহরওয়া, বেঁগাড়ি, পাটিয়ামেধা, ঝুমরা, ঝুমটা, একডাঁড়িয়া, নাগপুরিয়া, তামাড়িয়া, শিখারিয়া, পাঁচপরগনিয়া মুদিয়ারি ইত্যাদি।
ঝুমুরে ছন্দের ব্যবহার বেশি। ছয় মাত্রার দ্রুত দাদরার মতো বিশেষ ধরনের ছন্দের তালকে ঝুমুর বলা হয় যা উত্তর ভারতীয় দাদরার মতো নয়।
ঝুমুর লোকসংগীত নৃত্যের ক্ষেত্র অতি বিস্তৃত ও সভ্যতার বিবর্তনের সাথে জড়িত। আদিম জনজাতি মানুষের সার্বিক জীবনযুদ্ধ এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গে ঝুমুর লোকসংস্কৃতি একাত্ম। ভাষার বিবর্তন, সুরের বিবর্তন, বিষয় বৈচিত্র, ধামসা-মাদল, বাঁশির মতো বাদ্যযন্ত্রের সাহচর্যে নৃত্যশৈলীর কৃতিত্বে ঝুমুর লোকসংস্কৃতি আজও চর্চার বিষয়।