সৌমিতা রায় চৌধুরী
“আমি যামিনী, তুমি শশী হে / ভাতিছো গগনও মাঝে।” অথবা “আমি ময়রা ভোলা, হরুর চেলা বাগবাজারে রই।” কবিয়াল অ্যান্টনির ভূমিকায় উত্তমকুমার আর বিপরীতে তনুজা। ভোলা ময়রার ভূমিকায় অসিতবরণ। রূপালী পর্দায় এই দৃশ্যগুলির স্বাদ গ্রহণ করেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ১৯৬৭ সালে কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির জীবনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত এই চলচ্চিত্র শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত হয়।
কবিগান লোকসংগীতের এক অনন্য ধারা। কবি ঈশ্বর গুপ্ত ১৮৫৪ সালে তাঁর সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় কবিগান সংগ্রহ আরম্ভ করেছিলেন। সেই হিসেবে ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে গোঁজলা গুইকে কবিগানের আদি কবিয়াল বলা যেতে পারে।
এইসময় লোকসংস্কৃতিতে ঝুমুর গান অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। এছাড়া কীর্তন আঙ্গিকের গানও শ্রুতিমধুর ছিল। উভয়ের সংমিশ্রণে স্থানীয় স্বভাবজাত কবিরা দলগতভাবে ধারাক্রম অনুসরণ করে ছড়া বা গান পরিবেশন করতেন। উত্তরবঙ্গের ঝুমুর দলগুলো বিরহ, খেউড়, সখী সংবাদ, লহড় দলগতভাবে পরিবেশন করতেন। পরবর্তীকালে কবিগানে এই সকল অধ্যায় যুক্ত হয়। কবিগান মূলত সংকর শ্রেণির গান।
গৌড় চন্দ্রিকা (মহড়া, ছড়া, পাঁচালী) পয়ার ছন্দে গাওয়া হত। এরপর স্থায়ী সঞ্চারী অন্তরা এবং লহড় কবিগানের বিভিন্ন স্তর। ভবানী বিষয়ক অংশে সরস্বতী বন্দনা ও বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা করা হয়। শাস্ত্র এবং উপনিষদকে উপজীব্য করে কবিগান এগিয়ে চলে।
ডঃ সুকুমার সেন এবং ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় কবিগানের চারটি পর্যায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র পাল কবিগানের গায়কী পর্যায়কে ছয়টি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করেছেন।
গোঁজলা গুইয়ের শিষ্য রঘুনাথ দাস (১৭২৫-১৭৯০) কবিগানের সুরের ধারাকে শাস্ত্রীয় গানের আদর্শে সাজানোর চেষ্টা করেছিলেন। এই ধরনের বিন্যাসকে দাঁড়া কবিগান বলা হয়। দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাঙালির গান’ গ্রন্থে ছ’টি দীর্ঘ কবিগানের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা রঘুনাথ দাসের দুই শিষ্য বাসু রায় ও নৃসিংহ রায়ের কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ১৭৩০ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। এই সময়ের আরেকজন বিখ্যাত কবিয়াল ছিলেন লালু নন্দলাল।
রঘুনাথ দাসের অপর এক শিষ্য হর ঠাকুর ১৭৪৯ থেকে ১৮২৪ সালের মধ্যে কলকাতায় কবিগানকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি কবি গানগুলিকে কয়েকটি তুকে ভাগ করেছিলেন। সেগুলি হলো মহড়া, চিতেন, অন্তরা, পরচিতেন। মহড়া অংশে গানের অবতারণা করা হত। যেমন –
“কই বিপিনবিহারী বিনোদ আমার এলে না
মনেতে করিতে সে বিধুবয়ান, সখি,
এ পাপ প্রাণ, ধৈরজ না মানে,
প্রবোধি কেমনে তা বল না”।।
পরের চিতেন অংশটিকে মহড়ার সম্প্রসারণ বলা যেতে পারে। যেমন –
“সই, হেরি ধারাপথ থাকয়ে যেমত,
তৃষিত চাতক জনাব।
আমি সেই মতো হয়ে, আছি পথ চেয়ে,
মানসে করি সেরূপ ভাবনা”।।
একটু বড় গানে এই দুটি তুকের পর যুক্ত হত অন্তরা। অন্তরা অংশে থাকত আত্মকথন, স্বগোতক্তি ও সখী জ্ঞাপন। যেমন –
“হায়, কী হবে সজনি, যায় যে রজনি,
কেন চক্রপাণি এখনো।।
না এলো এ কুঞ্জে, কোথা সুখ ভুঞ্জে,
রহিল না জানি কারণে”।।
অন্তরার পরে যুক্ত হত পরচিতেন। পরচিতেন প্রকৃতপক্ষে চিতেনেরই সম্প্রসারিত অংশ। যেমন –
“বিগলিত পত্রে, চমকিত চিত্তে,
হতেছে স্থির মানে না।।
যেন এল এল হরি, হেন জ্ঞান করি,
না এল মুরারি, পাই যাতনা”।।
এই ধারার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য কবিয়াল ছিলেন নিত্যানন্দ বৈরাগী (১৭৫১-১৮২১)। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভবানী বণিক। কবি বিহারীলাল দাস গীতি কবিতার প্রচলন করেন। পরবর্তী যুগে আখড়াই, হাফ আখড়াই, পাঁচালী ও ঢপের গানের আবির্ভাব ঘটে। এর মধ্যে দিয়েই নিধু বাবুর টপ্পা বাংলা সংগীত জগতে প্রবেশ করে। কবি মুকুন্দ দাসের কবিগান বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে জোয়ার এনেছিল।
রঘুনাথ দাস সৃষ্ট দাঁড় কবিগান অনেকটা পাতানো। অর্থাৎ কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে কবিগানের পালাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। এই চলনকে বলা হত বাঁধুটি। পরবর্তীকালে রাম বসু (১৭৮৬-১৮২৮) কবিয়ালদের শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের জন্য তাৎক্ষণিক প্রশ্নোত্তরের পর্যায় কবিগানের মধ্যে রেখেছিলেন। এই ধারায় প্রত্যুৎপন্নমতি সম্পন্ন অনেক প্রতিভাধর কবিয়ালকে সামনের সারিতে দেখা গিয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির মতো স্বনামধন্য কবিয়ালরা। এইসময় যজ্ঞেশ্বরী দাসী নামে একজন মহিলা কবি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভোলা ময়রার প্রতিভা নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন, “বাংলাদেশের সমাজকে সজীব রাখার জন্য রামগোপাল ঘোষের ন্যায় বক্তা, হুতুম পেঁচার ন্যায় লেখক এবং ভোলা ময়রার ন্যায় কবি ওয়ালার প্রাদুর্ভাব আবশ্যক”। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কবি’ উপন্যাসে কবিয়ালদের কথা বলেছেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কবিগানের একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং লেখক ছিলেন।
কবিগান দলগতভাবে গাওয়া হত। মূল কবিয়াল ছাড়াও দোহাররা মূল কবিয়ালকে গান করতে সাহায্য করতেন। একটি দলে একাধিক কবিয়াল থাকতেন এবং তাদের সঙ্গে বাদক থাকতেন। এইসময় কিছু কবি ছিলেন যারা অন্যদের জন্য গান লিখে দিতেন। তাদের বলা হত বাঁধনদার। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি নিজেও গান রচনা করতেন। তাঁর বাঁধনদার ছিলেন গোরক্ষনাথ। সেই সময় কৃষ্ণমোহন ভট্টাচার্য, গদাধর মুখোপাধ্যায় এবং ঠাকুরদাস চক্রবর্তী বাঁধনদার হিসেবে ক্ষ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তী সময় রমেশ শীল (১৮৭৭-১৯৬৭), রাজেন্দ্রনাথ সরকার (১৮৯২-১৯৭৪), বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী (১৯০৩-১৯৮৫) এবং গুমানী দেওয়ান পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে কবিগানের ধারাকে অব্যাহত রাখেন। উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে কলকাতায় কবিগানের গুরুত্ব অনেকটাই কমে যায়।
বর্তমানে প্রায় তিনশোরও বেশি শিল্পী কবিগানের ধারাকে বহন করে চলেছেন। কথা হচ্ছিল কবিয়াল গণেশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। বর্তমান সময়ে কবিগানের ধারা সম্পর্কে তিনি জানালেন পূর্ববঙ্গীয় ও পশ্চিমবঙ্গীয় দুটি ধারায় কবিগানের চর্চা চলছে। অঞ্চলভেদে সময়ের তারতম্যে কবিগান তার চরিত্র বদলেছে। ঢাকা চট্টগ্রামে হরিচরণ আচার্য, রমেশ শীল প্রমুখরা আঞ্চলিক ভাবে সময় উপযোগী করে ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে কবিগান পরিবেশন করেন। যশোর, খুলনা এবং বরিশালে ভিন্ন ধারায় কবিগান পরিবেশিত হয়। আবার মতুয়া সম্প্রদায় প্রভাবিত একটি কবিগানের ধারা আছে। এদের গায়কীশৈলীও আলাদা। পূর্ববঙ্গে কবিগানের শিল্পীদের সরকার বলা হয়। বাঁকুড়ার শিল্পী গণেশ ভট্টাচার্য ১৯৯২ সালে ‘যামিনী রামকিঙ্কর কবিগান ট্রুপ’ শুরু করেন। সমগ্র ভারতবর্ষে কবিগানের দল নিয়ে তিনি অনুষ্ঠান করছেন। তিনি জানালেন, পালা কেন্দ্রিক কবিগানের বিষয়বস্তু থাকে। কখনো বা ধর্ম-অধর্ম, নারী-পুরুষ, ভগবান বিজ্ঞান, একাল সেকাল।
বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন, বাঁকুড়া সংহতি মিলন উৎসব, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। কলকাতায় আনন্দলোক তাঁকে সালাম বেঙ্গল পুরস্কারে ভূষিত করেছে। সামাজিক সচেতনতার জন্য অফিসার্স চয়েস তাঁকে প্রীতি সম্মান প্রদান করেছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থা বং কানেক্ট তাঁকে কৃতি বাঙালি হিসেবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান করেছে।
কবিগান বঙ্গ লোকসংগীত জগতের একটি বিশেষ ধারা। মূলত বিতর্কধর্মী এই কবিগান বঙ্গ সংস্কৃতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে এবং করছে। এখনও কবিয়ালরা তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়বস্তু ভিত্তিক গান রচনা করেন এবং জনগণকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি এই বিশেষ ধারাকে বহন করে নিয়ে চলেছেন।