কাজী লাবন্য 

অফিসে আজ স্যারের জন্মদিন পালন করা হলো। লাঞ্চের পর থেকেই সবাই কাজ থেকে কিছুটা সরে এসে জন্মদিনের আয়োজনে মন দিয়েছিল। সেমিনার রুমের বড় টেবিলটা খাবার দাবার, উপহার সামগ্রী, ফুল এবং কেক দিয়ে ভরে উঠেছিল। সবাই উসখুস করছিল স্যারকে কে বলবে, কে ডেকে নিয়ে আসবে এই রুমে। একজন প্রস্তাব করল, আর বাকি সবাই সমর্থন করল যে, শারমিন সুলতানা সোমা যাবে স্যারকে ডাকতে। সত্যি বলতে স্যার সোমাকে স্নেহের চোখে দেখেন। অবশ্য কাজের বেলায় তিনি সাংঘাতিক কঠিন একজন মানুষ। এসব স্নেহ মায়ার কোনো স্থান সেখানে নেই।
কেকের উপর কি লেখা হবে এনিয়ে বলাবলির সময় সবাই সোমার দিকে তাকিয়ে রইলে সে বলেছিল সংখ্যা লেখার দরকার নেই, স্যারের মন খারাপ হতে পারে। অন্য অফিসাররাও সোমার মতামতে সায় দিয়েছিল। তাই কেবলই লেখা হয়েছিল ‘শুভ জন্মদিন’। তবে রসিক একজন  মুখটা সিরিয়াস করে বলে,
-আচ্ছা, আচ্ছা কানাকে কানা বা খোঁড়াকে খোঁড়া বলার মত কি বুড়োকে বুড়ো বলা যাবে না! সবাই হেসে ফেলে। একে একে এসে জড়ো হয় সেমিনার টেবিলের চারপাশে। আনন্দিত সোমা যায় স্যারকে ডাকতে।

কাজ পাগল এবং নিষ্ঠাবান মানুষ এ, এম, আনিসুর রহমান এসব জন্মদিন উদযাপন করা টরা খুব একটা পছন্দ করেন না। না করলেও বাড়িতে, অফিসে সকলের ভালোবাসার এসব অত্যাচার তিনি মুখ বুজে  কিংবা হাসি হাসি মুখে সহ্য করেন। সবার সাথে তাল মেলাতে চেষ্টা করেন। তিনি এসবে সময়ের অপচয় মনে করেন। বিশেষত রাশি রাশি উপহার সামগ্রী দেখলে তাঁর মন বিবমিষায় ভরে যায়। হতে পারে, কোনো কোনো মানুষদের জীবনবোধ, সৌন্দর্যবোধ কিংবা আনন্দবোধ থাকে না।  তাঁদের জীবন আবর্তিত হয় অফিসকে ঘিরে, কাজকে ঘিরে। 
তিনি ভোগবাদী মানুষ নন। তবুও এই এত বছরের জীবনে ব্যক্রিগত সঞ্চয় অনেক। কাপড় চোপড় থেকে গাড়ি, বাড়ি, ঘড়ি, ফোনসেট সবই এত প্রতুল যে তাঁর নিজের কাছে কেমন অস্বস্তি লাগে। একটা মানুষের কত লাগে! এতসব ছাড়াও তো দিব্য চলে যায়। খুব সাধারণ পরিবারের সন্তান তিনি। যথেষ্ট লড়াই সংগ্রামের জীবন তাঁর। তবে তিনি সফলভাবে শেষ করতে চলেছেন বলে মনে করেন। পুত্র কন্যারা হাইলি কোয়ালিফাইড। তারা নিজ নিজ জায়গায় সাফল্যের সাথে জীবন কাটাচ্ছে। তাঁর স্ত্রী একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রন্সিপাল। কিছু কিছু রোগ ব্যধি থাকলেও তিনি এখনো অতটা অচল হয়ে পড়েননি। জীবনের সবদিক গুছিয়ে নিতে পেরেছেন কাজেই তিনি নেশ নির্ভার একজন মানুষ। তাঁর হিসেবানুযায়ী জীবনের একেবারে শেষ সীমায় তিনি পৌঁছে গেছেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা, ভাইয়েরা এমন বয়সের বেশ আগেই চলে গেছেন।  কাজেই যে কোনো মুহূর্তে তাঁর ডাক আসবে এবং সে ডাকের জন্য তিনি প্রস্তুত। তবে, কাজের মধ্যে থেকেই যেন জীবনের ছুটি নিয়ে অনন্তের পথে পাড়ি দিতে পারেন এটাই তাঁর সর্বশেষ চাওয়া। এভাবেই তিনি নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রস্তুত রাখেন। কবরের জন্য তিনি জায়গা কিনে রেখেছেন, শেষকৃত্যের জন্য অর্থের ব্যবস্থাও করে রেখেছেন। 
এও ঠিক তিনি মৃত্যুকে ভয় পান না। বরং সাহসের সাথেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন। তিনি ভাবেন আদিম এক রহস্যের নাম মৃত্যু, তবে সেটি অমোঘ, অজেয়, অনিবার্য। কারো কাছে সে চুড়ান্ত চুড়ান্ত আতংক আবার কারো কাছে ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’।  

 
অফিসে নানা ধরনের ম্যাগাজিন আসে, দেশ থেকে আরম্ভ করে রিডারস ডাইজেস্ট, বিশ্বখ্যাত নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন সহ নানা জার্নাল আসে। ছুটির সময় সেগুলো প্রতিদিন ড্রাইভার গুছিয়ে বাসায় নিয়ে আসে। 

আনিসুর রহমানের রুটিন লাইফ। রাতের হালকা খাবারের পর সামান্য পড়াশোনা করে হাতের কাছের রিডিং ল্যাম্পটা নিভিয়ে চোখ বন্ধ করেন। আধাঘন্টা আগে নেওয়া লো ডোজের ট্রাংকুলাইজারের প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়েন। এই বয়সে ঘুমটা খুব জরুরি। স্বাস্থ্যবিধির সবগুলো ধাপ তিনি সচেতনভাবে মেনে চলেন। পরিমিত খাবার, হাঁটা, চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করতে করতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
আজ নিয়মে কিছুটা ব্যাতিক্রম হয়েছে। বাসায়ও জন্মদিনের ছোটখাটো আয়োজনে অংশ নিতে হয়েছে। বিছানায় আসতে দেরি হওয়াতে তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধ করেন। অফিস থেকে আনা, নতুন জার্নালটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেন। এটি একটি বিখ্যাত জার্নাল। তেমন কিছু না থাকলে তিনি একটু চোখ বুলিয়ে রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। জার্নালটা হাত থেকে নামানোর আগে একটি আর্টিকেলে তাঁর চোখ আটকে যায়। তিনি পড়তে শুরু করেন। শুরু করার পর মন দিয়ে তিনি সেটা পড়েন এবং হাত থেকে নামাতে গিয়ে আবার পড়েন। জার্নালটি তিনি আলাদা করে রেখে দিলেন।  তিনি জানতেও পারলেন না, আর্টিকেলটা কিভাবে তাঁর মনোজগতে সূক্ষ্ম প্রভাব ফেলতে শুরু করল, আর্টিকেলটা তাঁর ভাবনার জগতে অনুপ্রবেশ করে তাঁর দীর্ঘ জীবনের সংকল্পে ঘুণপোকা হয়ে গেঁথে রইল।  





সোমার দুটি সন্তান। প্রথমটি মেয়ে, পরেরটি ছেলে। ছেলে হবার এক বছরের মাথায় আবিষ্কৃত হয়, ছেলে সুস্থ স্বাভাবিক নয়। সে মানসিক প্রতিবন্ধী। কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই। দেবশিশুর মত এক শিশু। শরীরের তুলনায় সামান্য বড় মাথায় একরাশ ঘন কালো চুল,  খাড়া নাক, উজ্জ্বল বড় বড় দুটি চোখ, ধনুকের মত বাঁকা আঁখি পল্লব।  আর হাসি! একেই বলে আনপ্যারালাল হাসি।
ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় এক লড়াই, এক সংগ্রাম। এক ডাঃ থেকে আরেক ডাঃ, এরপর দেশ থেকে বিদেশ। একদেশ থেকে আরেক দেশ। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। কত বছর যায়! কিভাবে যায়! সোমা জানে, আবার জানে না। সময়, সংসার, জীবন সব গুলিয়ে যায়। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সমস্ত জাগতিক জগত।
এরমধ্যে সোমা তার ইউনাইটেড ন্যাশনস ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন্স ইমার্জেন্সি ফান্ড (ইউনিসেফ) এর হ্যান্ডসাম সেলারির চাকরিটাও ছেড়ে দেয়। অনোন্যপায় হয়েই তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
চাকরি ছাড়ার সময় নানা ধরনের তর্ক, বিতর্ক, যুক্তি অতঃপর ঝগড়াঝাঁটি শেষে সোমার হাজবেন্ড বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। সোমার কিছু বলার থাকে না। বলার মতো নুন্যতম ইচ্ছেটাও তার থাকে না। তবে সোমার হাজবেন্ড দয়া করে বলে,
-তোমাদের ভরণ পোষণের জন্য আমি মাসিক একটা বরাদ্দ রাখব। তখনো সে চুপ করে থাকে।

একসময় চিকিৎসকদের আর তেমন কিছু করার থাকে না। এবার  সোমা নিজে আরো শক্তভাবে হাল ধরে। একমাত্র সে জানে তার ছেলে ভেতরে ভেতরে বুদ্ধি রাখে। কেবল সেই বুদ্ধির কোনো প্রয়োগ সে করতে পারে না এবং শিখতেও পারে না। বহু স্পিচ থেরাপির পরও সে মুখ দিয়ে কথা বলতে পারে না। অথচ সে কানে শোনে। ডাকলে তাকায়, কাছে আসে। কিন্তু ভাষা আসে না। মাঝে মাঝেই সে অসম্ভব রেগে যায়। কেমন জান্তব এক ধরনের গোঙানি শোনা যায়। সে যে মা বোনের মত স্বাভাবিক নয় এটা সে বুঝতে পারে এবং তখন অসম্ভব ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। সন্তানের কষ্ট বোঝার জন্য, তার সাথে আরো অধিক একাত্ম হবার বাসনায় সোমা দিন কয়েক টানা মুখে কসটেপ লাগিয়ে রাখল।

সোমা হাতের ইশারায়, চোখের ইশারায়, ছেলের কানের কাছে ফিসফিস করে, ধীরলয়ে একটি/ দুটি শব্দ বলে বলে ছেলেকে একটু একটু করে শেখাতে শুরু করল। ছোট্ট একটা জিনিস শিখতে তার তিনদিন থেকে সপ্তাহ, মাস চলে যেতে লাগল তবে স্বস্তির বিষয় যে বিষয়গুলো সে ধরতে পারে। কিন্তু সেটার গতি এতটাই ধীর যে কোনো মানুষের পক্ষে তা এগিয়ে নেওয়াটা ভীষণ দুরহ। তারপরও সোমা এগুতে থাকে, এক অসাধ্য সাধন করার পথে এগিয়ে যেতে থাকে সে।  
কয়েকবছর পরে গুলশানে এক স্কুলের খোঁজ পায় সে। বহু কষ্টে সেখানে ছেলেকে ভর্তি করায়,  সোমার ভাই বোনেরা অর্থনৈতিক দিকটা শেয়ার করে। এভাবেই দিন এগুতে থাকে। মানে থামতে থামতে থেমে যায় না।
এই পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ ছোট্ট একটা স্বপ্ন ডিজার্ভ করে, একটুখানি এমপ্যাথি ডিজার্ভ করে। একজন মা জানে তার প্রতিবন্ধী সন্তানটিও করে। এই পৃথিবীর আলো বাতাস, জল বা জোছনায় সবার সমান অধিকার আছে। সুস্থ, সক্ষম মানুষটার যেমন পাখির কলকাকলি শোনার অধিকার আছে,  কম সক্ষম মানুষটারও তেমন এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পাওয়ার অধিকার আছে। তাদেরও এক টুকরো মেঘের ছায়া পাওয়ার অধিকার আছে! সেই ছায়া দিতে পারার ক্ষমতা বা চেষ্টা পৃথিবীতে কেবল মাদের না সকলেরই থাকা উচিত। 

 
স্কুলে আসার পর সোমা বোঝে সে একা নয়। তার মতো কত মা বাবা এখানে অসহায় হয়ে বসে থাকে। একদিন এখানেই একজন মায়ের সাথে দেখা হয়, পরিচয় হয়। দিনদিন সে পরিচয় আরো গাঢ় হয়। স্পেশাল চাহিদা সম্পন্ন সন্তানের  জন্য উদ্বেগ, উৎকন্ঠা বিনিময়ে তারা পরস্পর আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠে। যদিও ওনার লড়াই কেবল ছেলেকেই নিয়ে। ওনার পাশে আছেন স্বামী, বাবা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সাপোর্ট।
একদিন এই জিনি আপাই তার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। পরিচয়টি আস্তে ধীরে বিকশিত হতে থাকে। আসলে দুঃখ কষ্ট মানুষকে এক কাতারে কাতারবদ্ধ করতে পারে। ধীরে ধীরে জিনি আপার বাবা মা সোমার কাহিনী জানতে পারেন। এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক দেশের একজন নামকরা বিখ্যাত ব্যক্তি। তার একাধিক বড় বড় প্রজেক্ট আছে। জিনি এবং ওর মায়ের অনুরোধ ও পরামর্শে তিনি সোমার জন্য কিছু করার কথা ভাবেন, সোমার চমৎকার একটি কাজের ব্যাকগ্রাউন্ড তো আছেই।  

অতঃপর তিনি সোমাকে একটি কাজ দেন। জীবনের একদিকের দরজা বন্ধ হলে অন্যদিকের কোনো না কোনো দরজা খুলে যায় এ বড় সত্যি। এতদিন এত যুদ্ধ, লড়াই, সংগ্রামে সোমার চোখে ধুধু চর পড়েছিল, কখনও বর্ষেনি কিন্তু এদিন সে সত্যিই শ্রাবণের ধারার মতো অশ্রুজলে ভাসতে থাকে। এই বয়স্ক কোমল মনের মানুষটিকে সোমার বাবার মতো মত হয়। মনে হয় অনন্তে হারিয়ে যাওয়া বাবা এনার রূপ ধরে ফিরে এসেছেন।
কৃতজ্ঞতা জানানোর কোনো ভাষা সে সত্যি হারিয়ে ফেলে। নাটক সিনেমায় এমন একজন উদ্ধারকারী থাকেন, সেটি যে সোমার বাস্তব জীবনে ঘটবে সে কখনো কল্পনাও করেনি। জগতের আনন্দযজ্ঞে ওর কোনো নিমন্ত্রণ নেই এটা মেনে নিয়ে সে কুত্তা বিলাইয়ের জীবন কাটিয়ে যাচ্ছিল।
এরপর সোমার জীবনটা অনেকটা সহজ হয়ে আসে। ছেলে স্কুলে ভালো রেসপন্স করা শুরু করে। মেয়েও স্কুল পাশ করে কলেজে উঠে যায়। বাসায় একজন দিনরাতের খালাকে রাখা হয়। এতদিনে সোমার মনে হয় হ্যাঁ এটিও একটি মনুষ্য জীবন।

শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা নিজ নিয়মে ঘুরে ঘুরে আসা যাওয়া করে। মেয়ে ভার্সিটিতে চান্স পায়। ছেলের স্কুল শেষের দিকে চলে আসে। স্কুলে সব গার্জেনরা একটা সমস্যার কথা আলোচনা করতে থাকে। স্কুল শেষ হলে বাচ্চারা আর কোথায় পড়বে? এটা নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা এবং দুর্ভাবনা শুরু হয়। কিছুদিন আগেই জিনি আপা তার ছেলেকে নিয়ে আমেরিকা চলে গেছেন।
স্কুলের সমস্যার সমাধানেও এগিয়ে আসেন জিনি আপার বাবা, সোমার স্যার। তিনি এই স্কুলটি একজন যথাযোগ্য মানুষের নজরে নিয়ে আসেন। একজন বিশ্বখ্যাত মনোবিজ্ঞানী। যিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন, যিনি মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।
অটিজম বা অটিস্টিক আমাদের দেশের খুব পরিচিত একটি বুদ্ধি বিকাশ জনিত সমস্যা। যেটাকে আগে আমরা পাগল বা প্রতিবন্ধী হিসেবে জানতাম। তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, অটিজম কোনো জিন-পরির আসর না, বা পাপের বিষয় নয়, এটি স্রেফ একটি মানসিক অবস্থা। সঠিকভাবে চিকিৎসা করলে এর প্রতিকার সম্ভব। অটিজম নিয়ে কাজ করার জন্য সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নামের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এই স্কুলটিও সেই সেবা প্রতিষ্ঠানের আওতায় এনে তিনি এটিকে আরো উন্নত এবং কলেজে উন্নীত করেন।
দুঃসময় যেমন হিমালয় পাহারসম কাঁধে বসে, সাঁড়াশি হয়ে টুঁটি চেপে ধরে আবার সুসময় এসে তা থেকে একটু একটু করে মুক্তি এনে দেয়। প্রয়োজন কেবল সেই টুঁটি চাপা সময়টাকে পার করা, যা বলা যতটা সহজ করা ততোধিক কঠিন। অত ধৈর্য, অত সহিষ্ণুতা, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের শক্তি ক’জন মানুষের থাকে! নিজের সবরকম চাহিদা, স্বার্থ, আরাম, বিশ্রাম সম্পুর্ণরূপে ত্যাগ করে এক ঘোর লাগা তপস্যায় সোমা সফল হয়েছে। 
সোমা পেরেছে।
সোমার কন্যা আজ স্বামীর সাথে কানাডা প্রবাসী আর পুত্র শাহজালাল বিমান বন্দরে ওর উপযুক্ত একটি জবে কর্মরত।


পৃথিবীতে যত নেশা আছে, সর্বশ্রেষ্ঠ নেশা হচ্ছে মানুষের ‘বেঁচে থাকার নেশা’।
‘গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে’। 

প্রতিদিন ঘুম ভেঙে আজন্মের বুড়ো সুর্যটাকে দেখাই তো এক অলৌকিক সুখকর ব্যাপার। চারপাশে এই যে এত এত আকর্ষণ, এত এত মনোহরণ, অপার মুগ্ধতা হীরককুচির মতো ছড়িয়ে থাকে, যে অস্তালোকের যাত্রী হবার জন্য প্রস্তুত একমাত্র সেই বোঝে এসব ছেড়ে যাওয়া কতটা অবিশ্বাস্য বেদনার! বাঁচার কোনো বিকল্প নেই। সকলেই বাঁচতে চায়।
তবে বাঁচাটা চৌষট্টি খোপে। সাদাকালোর খেলায়। চক্রবুহ্যে নাভিশ্বাস, তবুও বাঁচার নেশা অনুপম।

এ এম আনিসুর রহমান পনের’শ কোটি টাকার নতুন আরেকটি প্রজেক্ট হাতে পেতে যাচ্ছেন বলে বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছেন। হয়ত দু একদিনের মধ্যেই উর্ধতন চেয়ার থেকে ফোন চলে আসবে, তখন চুক্তিপত্রে সই সাবুদ করতে হবে।
এই বিশাল কাজটি তিনি সম্পন্ন করতে চান। না অর্থকড়ির জন্য নয়। সে ব্যাপারে তিনি নির্মোহ হতে পেরেছেন। প্রকৃতপক্ষে সেসবের আর প্রয়োজনও নেই। তবে তিনি সুখ্যাতির মোহ বা নেশাটা ছাড়তে পারেননি। ভিক্টরি স্ট্যান্ড, নিউজপেপার, টিভিস্ক্রিন, গণমাধ্যম, হাততালির নেশা তিনি বর্জন করতে পারেননি। তিনি আরো কিছুকাল বাঁচতে চান। বাঁচা কারো হাতে নয় জেনেই তিনি বাঁচার চেষ্টাটা আরো প্রবলভাবে করতে চান।
   
তিনি জার্নালের ওই আর্টিকেলটির সত্যতার ব্যাপারে ভালোভাবে খোঁজ খবর নিয়েছেন। এটি কাজ করার পসিবিলিটির পার্সেনটেজ বেশ হাই। আজকাল তাঁর চোখে অফুরান জীবন তৃষ্ণা।


সোমার আজ শরীরটা খুব একটা জুতসই লাগছে না। অবশ্য শরীরের চেয়ে মনের ভারটাই বেশি। ক’মাস আগে সে কিছু সমস্যা অনুভব করে। প্রথমে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরে এক চিকিৎসক বন্ধুর সাথে কথা বলে দুর্ভাবনামুক্ত হয়েছে। অবশ্য নিজেও বুঝতে পারছিল যে ওর মেনোপজের সময় সমাগত। বুঝতে পেরে সে চমকে উঠেছিল, নিজের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক কষ্টে বেদনায় সে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। খুব স্বাভাবিক আর প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর সোমা কী কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভেবেছিল ওর জীবন এমন হবে! অনেকদিন পর সে নিজের জন্য, কেবল নিজের জন্য এক অনির্বান হাহাকারে বাচ্চা মেয়ের মত হাউমাউ করে কেঁদেছিল অনেকটা সময় ধরে।

সোমার আজ ছুটি। কিন্তু রোহানের ছুটি নেই, ওর দুদিন ছুটি থাকে সপ্তাহের মাঝে। বহুকাল পরে সোমা আজ একটি সিনেমা দেখতে বসেছে। কলিগরা এটির নাম বলাবলি করছিল খুব।  
এমন সময় সোমার মোবাইল ফোনে স্যারের কল আসে।
-কেমন আছ সোমা?
-জি স্যার ভালো আছি।
-রোহান তো কাজে তাই না? আমি তোমার বাসার পথে।
কন্ঠের ঘৃণা আড়াল করে সোমা কিছু বলতে যায়, অস্ফুস্ট একটা শব্দ করে কি করে না তার আগেই ফোন নিশ্চুপ হয়ে যায়…
দিশেহারা অনুভূতিতে ওর মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এতদিনের চেনা জগতটা আবার যেন অচেনা লাগতে শুরু করে।

সপ্তাহখানিক আগে স্যার একটি জার্নাল দিয়ে বলেছিলেন, সোমা পেজ মার্ক দিয়ে রেখেছি, আর্টিকেলটা পড়ে নিও।
পৃথিবী বিখ্যাত কিছু ইউনিভার্সিটির গবেষণায় এসেছে যে বয়স্ক কোনো পুরুষ যদি তার চেয়ে জুনিয়র কোনো নারীর সাথে নিয়মিত হেলদি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাতে পারে তাহলে তার সুস্থতা এবং আয়ু বেড়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আবার কেউ কেউ দাবী করেছেন, যে সম্ভাবনা নয়, এটি এবসলুটলি কাজ করে। 

পেজ নাম্বারের ৭৮ সংখ্যাটি লালকালি দিয়ে মোটা দাগে গোল করা। এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে, হঠাত মনে হয়, সেদিন কেকের উপরে এভাবে সংখ্যাটা লেখা দরকার ছিল।

তবে দরকারি কাজটি সোমা ল্যাপটপে সেরে রেখেছে গতরাতেই। 

জার্নাল দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, সোমাকে টেক্সট করেছিলেন- এই ছোট্ট প্রতিদানটুকু তিনি চান। সেই ক্ষণে কি থমকে গিয়েছিল সময়, থমকে গিয়েছিল সোমার শ্বাস, এমনকি রোহানের একুরিয়ামের মাছগুলি ভুলে গিয়েছিল সাঁতার।  

টেক্সটের শেষে যোগ করেছিলেন- 
‘পুণ্য কর দহন দানে’। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *