গৌতম বিশ্বাস
” গুড় নেবা, গুড়? ভালো গুড় আছে। ঝোলা গুড়। পাটালি গুড়। খেজুর রসের খাঁটি গুড়। নেবা নাকি? “
এমনি করেই হাঁক ছেড়ে ডাকতে ডাকতে গাঁয়ের পথ দিয়ে হেটে যায় সুবল গাছি। এ গাঁয়ের পরে ও গাঁ। ও গাঁয়ের পরে সে গাঁ। তারও পরে নিশ্চিন্দিপুরের হাট। সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে সেখানে। আশপাশের না হলেও দশ গাঁয়ের মানুষ ভীড় করে সেখানে। ভীড় করে বেচাকেনা করে। লবনডাঙার মাঠের ভেতর দিয়ে রাস্তা। রাস্তাটা নিশ্চিন্দিপুরে ঢুকে খানিক বাঁক নিতেই হাট। গাঁয়ের হাট বলে কথা। সারা বছর মরশুমি সবজির ঘ্রাণে হাটের বাতাস মাখামাখি। তবে শীতকাল এলে সেই ঘ্রাণকে ছাপিয়ে ওঠে খেঁজুর গুড়ের ঘ্রাণ। আশেপাশে খেঁজুর গাছের অভাব নেই। অভাব নেই গাছিরও। তেমনই একজন গাছি সুবল। সারা সপ্তার জমানো গুড় সে শুক্রবারের হাটে এনে বিক্রি করে। শুধু কি আর হাটে? হাটে আসার পথেও হাঁক ছাড়তে ছাড়তে আসে সে। বিক্রি তাতে মন্দ হয় না। কেউ শ্বশুরবাড়ি যাবে, কারও বাড়ি মেয়ে জামাই এসেছে, কারও খেঁজুরের গাছই নেই অথচ গুড় খাওয়ার শখ – তারা হাঁক শুনে ডাক দেয়,” দাঁড়াও গাছি, দাঁড়াও, গুড় নেবো।”
উঠোনের মাঝখানে গিয়ে মাথা থেকে ঝাঁকা নামায় সুবল। ঝুড়িতে সাজানো সারি সারি পাটালি গুড়। প্লাসটিকের বয়ামে ঝোলা গুড়। ঝুড়ির ওপর থেকে কাপড়ের ঢাকা সরিয়ে মাছি তাড়ায় সুবল। তারপর বলে,” নেও, কোনডা নেবা নেও। এক্কেবারে খাঁটি গুড়। কুনো ভেজাল নাই। “
গুড় দেখতে দেখতে ডাক দিয়ে থামানো লোকটি বলে,” তা গাছি গুড় কি সবই তোমার নিজের হাতে বানানো? “
হালকা করে হাসে সুবল,” তা আর কেডা বানাবে বাবু। কেডা আছে আমার? সোংসারে মানুষ তো আমি একা। “
” তা আর কতদিন একা একা থাকবা?এবার একটা বিয়ে করো। একা মানুষ এত খাটনি শরীরে সয়? “
” কপাল বাবু, কপাল। মানুষ কি আর আমি একা ছিলাম? বৌ ছেল। এট্টা মা ছেল। বাপ তো ছোডবেলায় মরলো। তারপর মাও মরলো। বউও থাকলো না বেশিদিন। সেও চল্যে গেল আমারে ছেড়্যে।”
” সে বিয়ে করতে পারলো আর তুমি পারলে না?”
” সপ মানুষ কি সমান হয় বাবু? এক মন কতজনারে দেওয়া যায় কন তো? কম তো আর আমি ভালোবাসতাম না তারে। “
” তাও সে চলে গেল? “
” গেল।”
” তুমি আটকালে না? “
” কি কইরে আটকাবো? আমি কি আর জানতাম যে তলে তলে এই? “
” এতোটুকু টের পাওনি তুমি? “
” কি কইরে পাবো? সারাদিন তো আমার বাইরে বাইরেই কাটতো। এ গাছ ও গাছ কইরেই দিন পার হতো আমার। বাড়ি ফিরতাম তাও খানিক রাতে। সেই সুযোগেই তো সে – “
বলতে বলতে থেমে যায় সুবল। তার তখন মনে পড়ে যায় সেইসব দিন। সেই বৌ। সেই বাড়িঘর। সুবল কতো ভালোবাসতো তাকে। গুড় বেচে হাট থেকে কতবার কতকিছু কিনে এনে দিত। চুলের ফিতে। পায়ের আলতা। মাথার তেল। হাতের চুড়ি। গায়ের কাপড়। কত কি কিনে আনতো সুবল। এনে হাতে দিয়ে বলতো,” নেও দেহি।”
নিতে নিতে বৌ বলতো,” ইডা আবার আনল্যে ক্যান? শুদুমুদু ট্যাকা খরচ, না? “
হাসতো সুবল, ” শুদুমুদু? কেডা কইছে শুদুমুদু? আমার বৌ সাজবে, তাই আনিছি। শুদুমুদু হবে ক্যান?”
বৌ কপডট রাগের ভান করতো,” ক্যান? না সাজলি বুঝি ভালো দ্যাহায় না আমারে?”
” কেডা কইছে ভালো দ্যাহায় না? খুব ভালো দ্যাহায়। “
এমন করে কত কথাই হতো বৌয়ের সাথে তার খদ্দেরের সাথে কথা বলতে বলতে সে সব মনে পড়ে গেলে বুকের ভেতর থেকে বড়ো এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সুবলের। সুবল তখন আকাশ দ্যাখে। আকাশের পাখি পাখি দ্যাখে। মেঘ দ্যাখে। রোদ দ্যাখে। গাছের ছায়া দ্যাখে।
সুবলকে চুপ করে যেতে দেখে ডেকে দাঁড় করানো খদ্দের বলে, ” কী হল গাছি? কী ভাবো?”
ফের একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সুবল। পুরনো কথা ভাবি বাবু।”
খদ্দের বলে, ” কী হবে পুরোনো কথা ভেবে? তার চেয়ে নতুন কথা ভাবো। নতুন দিনের কথা ভাবো। নতুন মানুষের কথা ভাবো। “
তা দিন কতক হলো নতুন কথাই ভাবতে শুরু করেছে সুবল। আর যত সে নতুন কথা ভাবছে ততই সামনে এসে ভেসে উঠছে শ্যামালতার মুখ। হরিণডাঙার নাদু ঢালির বিধবা বৌ শ্যামলতা। নাদু মারা গেছে বছর চারেক হল।শ্যামালতার এখন একার সংসার। একটা শরীর।একটাই তার পেট। কত আর খরচ তার। সে হাঁস-মুরগি পোষে। ছাগল পোষে। একটা গাই পোষে। গোবর কুড়িয়ে ঘুটে দেয়। ফি শুক্রবার হাট থেকে ফেরার পথে একবার করে শ্যামালতার বাড়িতে যায় সুবল। শ্যামলতা হয়তো তখন মাটির দাওয়ায় খেঁজুর পাতার ছেঁড়া ফাটা মাদুরে পা ছড়িয়ে বসে মাঠ থেকে তুলে আনা শাকপাতা একটা একটা করে বাছছে।
উঠোনে পা রেখেই হাঁক দেয় সুবল,” কই গো, বাড়িত্ আছো নেকি?”
ঘাড় ঘুরিয়ে সুবলের দিকে তাকাতে তাকাতে শ্যামালতা বলে,” বয়াস তো এমুন কিছু হয় নাই। এর মধ্যি চোখ দু’ডো গেছে?”
” না, চোখ যাবে ক্যান?”
” তাহলি দেকতি পাচ্ছো না বস্যে আছি।”
” তা তো পাচ্ছিই।”
“তাহলি জিগাও ক্যান?”
” জিগাতি ভালো লাগে, তাই। “
এবার আলতো করে হাসে শ্যামালতা। বলে,” তুমি গাছি রসের মানুষ। “
হাসে সুবলও। বলে,” হঃ, আমি তো রসেরই মানুষ। গাছ কাটি। রস নামাই। আমি রসের মানুষ না হলেি আর কেডা রসের মানুষ?”
” আসো, বসো।”
ছড়িয়ে রাখা পা দু’টো খানিক গুটিয়ে নেয় শ্যামালতা। সুবল তার মুখোমুখি বসে। বলে,” এক গেলাস জল দেও দেহি। গলাডা শুকায়ে গেল। “
শাক রেখে উঠে পড়ে শ্যামালতা। কল চেপে জল এনে সুবলকে দেয়। খেয়ে তৃপ্তির আওয়াজ তোলে সুবল। শ্যামালতা জিজ্ঞেস করে,” কি হলো গাছি?”
সুবল বলে,” পরানডা য্যান জুড়োয়ে গেল।”
শ্যামালতা বলে, ” তা তো যাবেই। মেইয়ে মানষের দেওয়া জল। তা গাছি এট্টা কথা কই তুমারে?”
” কও।”
” দিন তো অনেক হল। ইবার এট্টা বে’ করো।একা একা ইভাবে আর কদ্দিন থাকপা?”
শ্যামালতার মুখের দিকে তাকায় সুবল। বলে,” তুমিও তো একা। তুমি বে’ করো না ক্যান?”
আচমকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শ্যামালতা। বলে,” বে ‘ তো কত্তিই চাই। কিন্তুক কেডা বে’ করবে আমারে? একে আমি বাঁজা মানুষ। তারপর বেধবা। “
কি একটা যেন বলতে গিয়েও তখন বলতে পারে না সুবল। কিন্তু না, এবার সে বলেই ফেলবে কথাটা। শ্যামালতা যখনই বলবে, ” কেডা বে’ করবে আমারে ” তখনই সুবল বলবে,” ক্যান, আমি। আমি তুমারে বে ‘ করবো। “
তখন কি বলবে শ্যামালতা? হয়তো বলবে,” কিন্তুক – “
” আবার কিন্তুক কী?”
” মানষে কী ক’বে?”
” মানষের আমরা খাই না পরি?”
” তবু – “
” মানষের কথা ভেব্যে ভেব্যেই তো জেবনডা গেল। জেবনের বাকি দিন গুলোন না হয় নিজির কথাই ভাবি।”
” গাছি – “
” কও।”
” সাধ কিন্তুক আমারও হয়। ফের সোংসার গড়তি ইচ্ছে হয়। নতুন কইরে সাজাতি ইচ্ছে হয় ঘরবাড়ি। নতুন মানষের সাথে কাটাতি ইচ্ছে হয় বাকি দিনগুলোন। কিন্তুক – “
” আবার কিন্তুক কী?”
” আমি যে বাঁজা মানুষ।”
” তাতে কী? সপ সুখ সবার ভাগ্যে থায়ে না। আমার না হয় – “
নির্ঘাত তখন সুবলের হাতখানি ধরে ফেলবে শ্যামালতা। তার চোখ গড়িয়ে নামবল তীব্র সুখের কান্নারা। হয়তো সুবলের কোলে মাথা রেখে বলবে,” চলো গাছি, আজই আমারে নে’ চলো।”
ঘরের দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে পিঠটাকে হেলান দিয়ে বসে এসবই ভাবছিলো সুবল। কিন্তু না, আর বসে থাকতে পারলো না সে। গুড়ের ঝাঁকা মাথায় নিয়ক বেরিয়ে পড়লো। দাওয়া থেকে উঠোন। উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় উঠে পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলো সুবল। পারলে আজই শ্যামালতাকে বাড়িতে নিয়ে আসবে।।
ভালো লাগলো!