শীর্ষেন্দু দত্ত
বৃষ্টিটা হটাতই ঝমঝমিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল ইমাম বক্স লেনের গলিতে। ফোটা ফোটা করে জড়ো হওয়া ভরা দুপুরের ভাত ঘুমটা মায়ের ভোগে চলে গেল রবিয়ার। বৃষ্টিটা এই দুপুরে ওর মতোই বিন বুলায়ে মেহমান। শ্যাওলা ধরা সেকেলে-হাড়কেলানে বাড়িটার রোয়াকে ঘুমটা সবেমাত্র আধা ঘন্টা এগিয়েছিল। বিরক্ত রবিয়া হুটপাট দৌড়ে ধুকে গেল উল্টোদিকের ঠেকে। সাথে কাল্লু। রবিয়ার টেনিয়া,একটা ঝা চকচকে পুঁচকে কুকুর।
এখন দুপুর। তাই মালের ঠেকে ভিড় নেই। ঠেক মালিক রাম অবতার বিড়ি টানছিল। রবিয়া কাল্লুকে ঢুকতে দেখল,কিছু বলল না। এ তল্লাটে রবিয়াকে ঘাটায় না কেউ। বহুত বদমাস ছেলে, দূর থেকে আধলা ছুড়ে পালাবে। আরো অনেক কিছু পারে ও। একবার পিংকীর এক মাড়োয়ারি বাবু ওকে রেন্ডিকা আওলাদ বলেছিল। রবিয়া পরদিন ছাদ থেকে লোকটার মাথায় এক পলিব্যাগ কুত্তার গু ছুড়ে মেরেছিল। আর ওর সারা দিনরাতের সঙ্গী কাল্লুটাও বহুত খচ্চড় আছে। যাকে তাকে দৌড় করিয়ে দেয়।
এরপরেও কেউ পিছনে লাগলে ওর রবিনা মৌসি চলে আসবে। রবিনা আগ্রাওয়ালি,নন্দরাণী ফ্ল্যাটের হাইরেটেড বেশ্যা। ওর নিজেকেও আসতে হয়না। পট্টির দু চারটে লাতখোরকেইসারা করলেই মেশিন ঠেকিয়ে দেবে।
রবিয়ার খাওয়াদাওয়া সব রবিনার কাছে। তবে ঘরে থাকতে দেয়না। তাতে কি! সোনাগাছিতে রকের কমতি আছে নাকি! খুব দরকার না হলে সেও মৌসির সামনে যায়না। তবে মৌসির ফুল অর্ডার আছে ফ্ল্যাটের লাগোয়া দোকানপত্তরে। রবিয়া যা চায় যেন দিয়ে দেওয়া হয়,পয়সা নিয়ে ভাবতে হবে না।
রবিয়ার মা ছিল বক্সের মেয়েছেলে। সে আর রবিনা এক গ্রামের ছিল। তাই দুজনে সই পাতিয়েছিল। ও মরেছিল দুনম্বরী রোগে। একটা জাহাজীর দেওয়া। যখন মায়ের লাস্ট সিন চলছিল তখন রবিনা ওর মাকে কথা দিয়েছিল। “ তু মাত সোচ বহেন,তুয়ার বেটা আবসে হামার ভি বেটা,উসকো কভি কোই দিককত হোনে নেহি দেগি…”
মহল্লার লোক বলে রবিনার স্পনসরেই রবিয়ার এত বাড়। তবে অনেক বাঁদড়ামো সত্বেও পট্টির লোকজন ওকে স্নেহই করে। যতই হোক ওর জন্ম তো এখানেই। এখানকারই ভুমিপুত্র ও। মা হারা,বেশ্যাপট্টির লাওয়ারিশ। এর বেশি আর কি হবে!
রবিয়ার এখন বয়স বছর বারো। চার পাঁচ বছর আগে মা মরেছে ওর। বাপতো তারও আগে এনকাউন্টারে। তোলাবাজ ছিল। অবশ্যি সত্যিই যদি বাপ হয়!
রবিয়া কোনো কোন দিন সব কিছু থেকে বোর হয়ে মহল্লা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। আনমনে হেঁটে চলে সে। সঙ্গী কাল্লু। হাঁটতে হাঁটতে গিরিশ পার্কে। পার্কের ভিতর একটা গাছতলায় চুপটি করে বসে থাকে। মায়ের কথা আবছা মনে পড়ে। কতো আদর করত! মা মরে যাবার পর সেভাবে আর কেউ ওকে আদর করেনি। কাল্লু মাঝে মাঝে ওর ওর গা হাত পা চেটে দেয় কেবল। তখন বেশ লাগে। পার্কে ওর বয়সী কতগুলো ছেলেমেয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে। ওরা সব ভদ্দরলোকের ছেলেমেয়ে। রবিয়া ওদের দিকে চেয়ে থাকে চুপচাপ। ওদের জামাকাপড় রবিয়ার মতো নোংড়া লাতখোরিয়া নয়। পরিস্কার জামাকাপড়, চুল নখ সব সুন্দর করে কাটা,গায়ের চামড়া রোদ্দুরে ঝলক মারছে। কিছুই ওর মত নয়। রবিয়ার বড় বড় উস্কোখুস্কো চুল,দাঁতে পোকা,মুখ নানা রকম আচঁড়-দাগ।
রবিয়া এখন সব বোঝে। ওরা সব ভাল বাড়ির ছেলেমেয়ে। খ এর ছেলে নয়। ওদের মা-বাবা সওব আছে। ওদের মায়েরা ওদের খাইয়ে দেয়,চুল আঁচড়ে দেয়, বেড়াতে নিয়ে যায়, আর কতো কি করে দেয়!
রবিয়া বুঝতে পারেনা তার কেন সোনাগাছিতে জন্ম হল! কেনই বা ওর মা-বাপ খরচা হয়ে গেল! যখন এসব হল তখন তো ও ছোট ! কোনো খচড়ামি তো করেনি! কাউকে মারেওনি বা কাউকে খিস্তিও করেনি! তাহলে এমন কেন হল! অনেক ভেবেও সে এসব বুঝে উঠতে পারেনা। সে কেবল এইটুকু বোঝে,যেটা সে পায়নি, সেটা তাকে ছিনিয়ে নিতে হবে।
রবিয়ার চোখ চকচকিয়ে উঠল ছেলেমেয়েগুলোর ব্যাডমিন্টন র্যাকেটের দিকে চেয়ে। ওদের মধ্যে যে ছেলেটা সবচেয়ে ছোট সে একটু দূরে মুততে যেতেই রবিয়া ওকে ধাক্কা মেরে র্যাকেটটা ছিনিয়ে নিল। ছেলেটা কেঁদে উঠল। বাকিগুলো ‘চোর চোর’ বলে ওকে ধাওয়া করল। রবিয়া সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরে ছুটতে লাগল সোনাগাছির দিকে। পাশে দৌড়াচ্ছে কাল্লু। কিন্তু ওদের কেউ ধরতে পারল না। মিনি বাসের জানালা দিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে ওদের দেখে চেঁচিয়ে উঠল,”মাম্মী,দেখো ফ্যান্টম আর ওর নেকড়েটা যাচ্ছে…”
বিডন স্ট্রিটের মোড়ে মাতাল কেরানী ল্যাম্পপোস্ট ধরে ব্যালেন্স করতে করতে অবাক চোখে ওদের দেখে বলে উঠল,”শাল্লা,যুধিষ্টির যাচ্ছেরে! সাথে শেষ সঙ্গী কুকুরটাও! জয় বাবা ধম্মোপুত্তুর, তোমার সগগো যাত্রা সফল হোক…”
…এরপর রবিয়া আরো অনেক কিছু করবে। করতে করতে সে বড় হয়ে উঠবে। তারপর হয়ত একদিন ও মারা যাবে ওর বাপের মতোই এনকাউন্টারে। তখন ওর ছেলেটাও এরকম ভাবে বেড়ে উঠবে মহল্লাতে। তারপর সেটাও শালা একদিন ভিত্তার হয়ে যাবে! এই সিরিয়ালে কোনো লাস্ট সিন নেই। উলটে আমার পেনের কালি খতম হয়ে যাবে, কিংবা পাঠকের ধৈর্য্য …