তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

অধ্যায়: ছয়    

কিছু কিছু লোক কঠিন প্রকৃতির। তারা হাসলেও কেউ ভরসা পায় না , ভাবে এই হয়তো ধমক-ধামক শুরু করবে। সাধারণ মানুষ তাদের ভয় পায়, সমঝে চলে। ভালমুখে কথা বললেও সবাই অকারণে ঘাবড়ে যায়। তাদের নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই। মানুষ তাদের তুষ্ট করার চেষ্টায় সবসময় ব্যস্ত থাকে। পান থেকে চুন খসলে তারা তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে বসতে পারে। আর যদি তাদের হাতে ক্ষমতা থাকে তো আরও বিপদ। কখন যে কী করবে কেজানে !

বলতে যাচ্ছি হামবড়াই ঘপাৎ সম্পর্কে দু’-চার কথা। উনি ওইরকম লোক। কঠিন-কঠিন চেহারা, রসকসহীন, কথাও বলেন পিলে চমকে দেওয়া গলার আওয়াজে। আবার হাতেও আছে প্রবল ক্ষমতা। পলিটিক্সের লোক। দেশের এক মান্যগণ্য নেতা এবং মাথা। তিনি চললে খবর তৈরি হয়, তিনি বলতে থাকলে অন্যেরা থেমে যায়। এমনই তাঁর দাপট। অবশ্য সত্যিসত্যিই তিনি কিছুই করেন না, যদিও সবাই মনে করে যা হচ্ছে সেসব তাঁরই ইচ্ছানুযায়ী। বলেন তিনি সদাসর্বদা অনেক কিছু করবেন এবং তারপরই কিছু না করলেও লোকেরা ভাবে যা বলেছিলেন করবেন বাস্তবে সবই করা হয়ে গেছে। তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে সবাই—- জনসাধারণ, সংবাদমাধ্যম, স্বপক্ষ ও বিপক্ষের নেতা-নেত্রী। তিনি কী করবেন বা কী বলবেন এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। তবে যেমন বললাম, তাঁকে কিছু করতে হয় না, সবই তাঁর ইচ্ছেমত হয়ে যায়। তিনি এক পা চললেই লোকেরা ভাবে অনেক দূর চলে যাবেন, তাঁর মুখ থেকে একটি বাক্য বার হলেই সবাই মনে করে সমস্ত কথা শোনা হয়ে যাবে। 

আমরা হামবড়াই ঘপাৎ-এর সঙ্গে থাকতে শুরু করলাম কয়েক দিন। তিনি কী করেন, কোথায় যান, কাদের সঙ্গে কী বলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সবসময় তাঁকে ঘিরে রাখে জনমণ্ডলী। তিনি যেখানে, জনসমাগমও সেখানে। আবার উল্টো ব্যাপারটাও সত্যি হতে পারে—- জনসমাবেশ থাকলেই তাঁর উপস্থিতি দেখা যাবে। তিনি সবসময় ঘুরে বেড়ান, দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। যেখানে যান সঙ্গে থাকে অনুগামী দল। দেশে নানারকম সংকট দেখা যায়, নানা পরিস্থিতি তৈরি হয়। তিনি কী বলেন সেসব ক্ষেত্রে সেদিকে নজর রাখে সবাই। তাঁকে হরদম বিভিন্ন মিটিং-মিছিল আর জনসভাতে হাজির থাকতে দেখা যায়। রোজই একাধিক সাংবাদিক সম্মেলন রয়েছে তার ওপর। দেশে নীতি-নির্ধারণে তিনিই মূল ব্যক্তি। তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা, তাঁর জনসভাতে তিল ধরণের জায়গা থাকে না। তিনি যা বলেন স্পষ্ট বলেন, কে কী ভাবল তোয়াক্কা করেন না। তাঁর রুক্ষ-কঠিন পরিচয় থাকলেও লোকেরা ভরসা পায়। এটাও ঠিক কথা যে মুখে যতই হুমকি দেন না কেন আজ পর্যন্ত এমন কোন পদক্ষেপ তিনি করেননি যাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, যাতে জনসাধারণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরে। জনসমর্থন বজায় রাখার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর, নিজে কখনও এমন কাজ করেন না যাতে কোন যৌক্তিকতা নেই বা যা আখেরে বুমেরাং হতে পারে। দলীয় লোকদেরও কঠিন শাসনে রাখেন যাতে জনসমর্থন কোনক্রমে ক্ষুণ্ণ না হয়। 

রিক্ত বলল,

‘হামবড়াই ঘপাতের দাপট দেখেছিস ? এইরকম লোকেদের মুশকিল কী জানিস, কেউ এদের কব্জা করতে পারে না। এদের জীবনযাপন পছন্দ করে বহু বহু লোক। হাজার হাজার অনুগামী চায় হামবড়াই ঘপাৎ হতে, তারা তার মধ্যে ঢুকে বসবাস করতেও চায়। অনেকেই পারে, অনেকেই পারে না। যারা হামবড়াইকে আশ্রয় করতে পেরেছে তারা তার পছন্দ অনুযায়ী চলতে চাইছে বলে নিজেদের প্রকাশ ঘটাতে পারছে না। আসলে হামবড়াই খুব কড়া ধাতের লোক, তেমন সবল ইচ্ছে যদি অন্যের না থাকে সে নিজের ইচ্ছে দিয়ে হামবড়াইকে চালাতে পারবে না। এসব ক্ষেত্রে আমরা জানতে পারব না কত কত লোক হামবড়াইয়ের মধ্যে ঢুকে বসে আছে।’

মানুষে মানুষে পাল্টাপাল্টি কিভাবে ঘটে এই নিয়ে আমরা অভিযান শুরু করেছিলাম। সূচনাটা হয়েছিল এভাবেই। হামবড়াই ঘপাতের সঙ্গে নানা জনসভা আর মিটিং-মিছিলে ঘুরতে লাগলাম। তাঁর বিভিন্ন সাংবাদিক সম্মেলনও আমাদের দ্রষ্টব্য তালিকার মধ্যে থাকল। দেখছিলাম রোজ কিভাবে হাজার হাজার লোক তাঁকে আশ্রয় করছে, তাঁর মধ্যে নিজেদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আকাঙ্খিত জীবনযাপন চালাচ্ছে। তারা সবাই তাঁর পছন্দকেই মেনে নিচ্ছে, নিজেদের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে আগ্রহী নয় কেউ। এজন্যই হামবড়াইয়ের আচরণে কোন পরিবর্তন ঘটছে না। তাঁর সবল ব্যক্তিত্ব তাঁর মধ্যে আশ্রয় নেওয়া লোকগুলিকে গ্রাস করে ফেলছিল। রিক্ত জানাল, 

‘আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যের মধ্যে ঢুকে পড়া লোকরা যার মধ্যে ঢুকল তার মতোই বাঁচতে চায়। নিজেকে নিয়ে ক্লান্ত বলেই কেউ অন্যের মধ্যে ঢোকে। তাই নিজের চরিত্র সে মনে রাখতে চায় না।’

‘তাহলে কেউ কারো মধ্যে ঢুকল কিনা জানব কিভাবে ?’

‘সেক্ষেত্রে অন্যের মধ্যে ঢুকে সে নিজের ইচ্ছে বা চরিত্রের বিশেষ কিছু বিষয় প্রকাশ করতে চাইবে। তখনই বোঝা যাবে কে কার মধ্যে ঢুকল।’

হামবড়াই ঘপাতের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে এক জনসভাতে আমরা একদিন ভূপতির খোঁজ পেলাম। এক ছাপোষা মানুষ, আর দশজনের মত। বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার। সকালে উঠে নিয়ম করে বাজারে যায়, মাছের ঝোল আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে অফিসে দৌড়োয়। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে তার কাজের শেষ নেই। বউ বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখে , ফেসবুক করে, মোবাইলে আড্ডা মারে। ভূপতি চা-টা বানায়। কাচুমাচু মুখ করে টিভির সামনে বসে। ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা আর হৈ-হুল্লোড় করে। সে শাসন করতে সাহস পায় না। 

সমস্যা হল এটাই যে ভূপতি বড় বেশি গোবেচারা। তার ধারণাই নেই, ব্যক্তিত্ব ব্যাপারটা কী। সে ঠিকঠাক কথা বলতে পারে না, সবসময় ভয়ে-ভয়ে থাকে। ঘরে-বাইরে কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। পাত্তা না দিলেও চলত, কারণ পাত্তা দিলে আবার অন্য মুশকিল, মতামত দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে। সেই প্রশ্ন এলে সে গলা শুকিয়ে মরেই যাবে। কেউ পাত্তা দেয় না বলে সে সেই বিপদ থেকে বেঁচে আছে। কিন্তু তাতেও কি সম্পূর্ণ রেহাই পায় ? পাত্তা দেয় না ঠিকই, লোকরা হরদম তার পিছনে লাগে। এই পিছনে লাগাটা বাইরে একরকম, ঘরে অন্যরকম। হাড়মাস কালি হয়ে যায় তার লোকের উপদ্রবে। মুখে প্রকাশ করে না ঠিক, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে রাগে জ্বলতে থাকে। অফিসের লোকেরা, চেনাপরিচিত ও বন্ধুবান্ধবরা তাকে নিয়ে মজা করে, সে বোকার মত হাসে। সেই হাসি দেখেও ঠাট্টাতামাশার অন্ত নেই। বাড়িতে উঠতে-বসতে বউয়ের বকুনি, ছেলেমেয়েরাও তাকে একেবারেই গ্রাহ্য করে না। নিজেকে মানুষ বলে মনে হয়না ভূপতির। এর চেয়ে রাস্তার কুকুর-বেড়ালগুলিরও মর্যাদা আছে। জগতে নিজের কোন ভূমিকা রয়েছে, ভাবতে পারে না সে। আত্মসম্মান খুইয়ে কেউ এভাবে বাঁচে ? কখনও সে প্রতিবাদ জানবার সাহস পায় না। 

আবার তার মরতেও ভয় লাগে। নাহলে সে মাঝেমধ্যে ভাবে আত্মহত্যা করার কথা। হেনস্তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। কিন্তু মৃত্যুকেও তার বেজায় ভয়। আসলে তার জীবনে এই ভয়টাই প্রধান শত্রু। নিজের ওপরই তার রাগ হয়, নিজের এমন ভীতু চরিত্রের জন্য। আর রাগ হয় বিশ্বসংসারের ওপর। যখন বাইরের লোকজন তাকে নিয়ে ঠাট্টাইয়ার্কি মারে আর খেপায়, ঘরে বউ কারণে-অকারণে ধমকায় আর খাটায় আর নাস্তানাবুদ করে, ছেলেমেয়েরা কথা শোনে না তখন সে বাইরে ভালমানুষি হাসি বজায় রাখলেও ভিতরে রাগে-আক্রোশে জ্বলেপুড়ে যায়। কেউ দেখতে পায়না গোপনে কী পরিমাণ দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে। কেবল সে নিজেই বোঝে নিজের নিষ্ফল আক্রোশ। আর সে মনে মনে বলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে, 

‘দাঁড়া, কোনদিন যদি তোদের বাগে পাই তো ঘাড় মটকে দেব সব ক’টার। আমাকে নিয়ে মজা ! তোদের একদিন এমন শিক্ষা দেব যে নাকাল হয়ে যাবি।’

কেউ শুনতে পায় না তার ভিতরে থাকা রাগের এই আস্ফালন, কতটা যন্ত্রণা থেকে এই রাগের জন্ম বুঝতে চেষ্টা করে না কেউ। সবাই মনে করে ভূপতি এইরকমই, তার গণ্ডারের চামড়া। সে বোধবুদ্ধিহীন এক জীব। তাকে যতই বকো, যতই মারো কিছুতেই কিছু তাপ-উত্তাপ নেই তার।

ভূপতি বরাবরই হামবড়াই ঘপাৎকে পছন্দ করে। তার এক্কেবারে বিপরীত মেরুর লোক। সে ভীরু, মিনমিনে। হামবড়াই ঘপাৎ ঠিক তার উল্টো, দাপুটে আর সাহসী। সেদিন জনসভাতে তাঁকে দেখে ভূপতি আরও মোহিত। জীবনে প্রথম চাক্ষুষ দেখা। হামবড়াই ঘপাতের বলিষ্ঠ বাচনভঙ্গি, দৃঢ়তা ও কাঠিন্য তার ভেজা প্রাণে আগুন ধরিয়ে দিল। বাঁচতে হলে এমনভাবেই বাঁচা উচিত। নিজের এই ন্যুব্জ-কুব্জ জীবনটাতে আবার তার ঘেন্না ধরে গেল। সে ভাবল, যেভাবেই হোক সে হামবড়াই ঘপাৎ হয়েই বাকি জীবন কাটাবে। 

যেমন ভাবা তেমন কাজ। ভূপতি নিজেকে হামবড়াই ঘপাতের মধ্যে প্রবেশ করাবার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করে দিল। লম্বা লাইন। হাজার হাজার লোক নিজেকে পাল্টে হয়ে যেতে চায় হামবড়াই ঘপাৎ। প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা আর ধাক্কাধাক্কি। ভূপতি এমনিতেই ভীতু প্রকৃতির। এত প্রতিযোগিতা সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু জীবনে এই প্রথম সে মরীয়া হয়ে গেল। কিছুতেই সে লাইন ছাড়ল না, কামড় খেয়ে লেগে রইল। আর সেদিনই গভীর রাতে কোন এক সুযোগে গোটা ভূপতি নিজেকে পাল্টে হয়ে গেল হামবড়াই ঘপাৎ। আসল ভূপতি এখন হয়ে থাকল নকল ভূপতি, অর্থাৎ ভূপতি এখন এক দ্বৈত সত্ত্বা। কেউ অবশ্য তা টের পেল না।

‘এবার কেমন কাণ্ড ঘটবে দ্যাখ্।’

রিক্তর কথা শুনে আমি উৎসুক হলাম। জানতে চাইলাম।

‘কী কাণ্ড ঘটবে ?’

‘দেখতে থাক। দেখলেই বুঝবি।’

‘হামবড়াইয়ের মধ্যে ভূপতি ঢুকে গেল। এটাইতো বড় কাণ্ড। অন্য আর কী ঘটবে ?’

‘ভূপতি যে হামবড়াইয়ের মধ্যে ঢুকে গেল এটা মামুলি ব্যাপার। এমন তো কত লোকই ঢুকছে। ঢোকাটা তেমন কিছু নয়। ঢোকার পর কী ঘটে সেটাই কাণ্ড।’

‘কিন্তু ভূপতি ঢুকল বলেই কাণ্ড ঘটবে বলছিস কেন ? অন্যরাও তো দেখছি ঢুকে চলেছে। তাদের বেলায় কাণ্ড ঘটছে না কেন ?’

‘আসলে ভূপতির চরিত্রটা অন্যদের চেয়ে আলাদা। সে চিরকাল মুখ বুজে মার খেয়ে এসেছে। এইরকম লোকরা যদি কোনক্রমে নিজেদের প্রকাশ করার কোন সুযোগ পায় তো কিষ্কিন্ধা কাণ্ড ঘটে যায়। তাই বলছি। দ্যাখ্ না, নিজেই দেখতে পাবি।’  

দু’টো দিন নিরুপদ্রবে কেটে গেল। এমন কোন ঘটনাই ঘটল না যাকে কাণ্ড বলা যেতে পারে। একটু একটু হতাশ হতে শুরু করেছিলাম। তৃতীয় দিন এল সেই শক্তিশেল বাণ। হামবড়াই ঘপাৎ ঘোষণা করলেন, দেশের সমস্ত পুরুষদের মাথার চুল এক ইঞ্চির বেশি লম্বা রাখা যাবে না। ঘোষণাটা একেবারে আইন হয়ে গেল। হুলুস্থুলুস কাণ্ড শুরু হল দেশজুড়ে। অধিকাংশ লোকই চুলওয়ালা। মাথার চুল যদি এক ইঞ্চির বেশি বড় না রাখা যায় তো মহা যন্ত্রণা। শুরু হয়ে গেল দিনরাত স্কেল আর ফিতে নিয়ে চুল মাপামাপি আর সেই সঙ্গে ঘন ঘন চুল কাটাকাটি। আইনে পরিষ্কার বলা হল, কারো মাথায় যদি এক ইঞ্চির চেয়ে লম্বা চুল একটিও পাওয়া যায় তো তাকে পাগলাগারদে পুরে দেওয়া হবে। প্রথমে মনে হয়েছিল, আইনটা বুঝি কথার কথা। পাত্তা না দিলেও চলবে। তারপর শুরু হল ধরপাকড়। এক ইঞ্চির বেশি লম্বা চুলওয়ালা লোকেদের সত্যিসত্যি ধরে পাগলাগারদে ঢুকিয়ে দেওয়া হতে লাগল। তখন সবার টনক নড়ল। এই ফরমান জারি হতে দেখে টাকমাথা লোকেরা বেশ খুশি হয়েছিল, কারণ চুলওয়ালা লোকেদের ওপর তাদের বেজায় রাগ। তারা নিজেদের মধ্যে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলতে লাগল, কেমন জব্দ। তবে তাদের এই খুশি দেড়দিনের। চুলওয়ালা লোকেদের জন্য বিধান দেওয়ার দেড়দিনের মাথায় হামবড়াই ঘপাৎ আবার আরেক আইন চালু করে জানালেন, টাকওয়ালা লোকেদের পুরো টাক জুড়ে কালো মার্কার কালি দিয়ে ‘টাক আছে’ কথাগুলি পরিষ্কার লিখে রাখতে হবে। এটুকু হলেও রক্ষে ছিল, এর সঙ্গে যে লেজুড়টুকু জুড়ে দেওয়া হল সেটা আরও ঝামেলার। বলা হল, টাকওয়ালা লোকেদের যে সত্যিই টাক আছে এই মর্মে ডাক্তারের কাছ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট জোগাড় করে সঙ্গে রাখতে হবে সর্বসময়। তারপর থেকে টাকওয়ালা লোকদেরও শান্তি উধাও হয়ে গেল হয়রানির ঠ্যালায়। 

রিক্ত বলল,

‘দ্যাখ্ কেমন একুশে আইন চালু হচ্ছে একের পর এক।’

‘হামবড়াই ঘপাৎ করছে কী এসব ? তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল ?’

আমি বেশ উদ্বেগের সঙ্গে মনের ভাব প্রকাশ করলাম। রিক্ত মুচকি হাসল আর বলল,

‘এবার কাণ্ড ঘটছে কিনা বল্ ?’

‘ঘটছে।’ আমি স্বীকার করলাম এবং একইসঙ্গে প্রশ্নও রাখলাম, ‘কিন্তু কেন ?’

‘আগে দ্যাখ্ আরও কী ঘটে। কেন-টা তুই নিজেই বুঝতে পারবি।’

এর পরের আইন জারি হল দেশের সমস্ত গোঁফওয়ালা লোকেদের জন্য। হামবড়াই ঘপাৎ এক আদেশে জানালেন, যাদের গোঁফ গজাবে তাদের অবশ্যই গোঁফ রাখতে হবে এবং গোঁফের মোট আয়তন হতে হবে সাড়ে তিন বর্গ সেন্টিমিটার। আরও বলা হল যে বাঁদিকের গোঁফের তুলনায় ডানদিকের গোঁফ সবসময় এক সেন্টিমিটারের কম ছোট রাখা চলবে না। 

গোঁফওয়ালা লোকেদের তুমুল হয়রানি শুরু হল। চব্বিশঘন্টা চলল কেবল গোঁফ মাপামাপি আর কাটাকাটি। ইতিমধ্যে আরেক আইন ঘোষণা করা হল দাড়িওয়ালা লোকেদের জন্য। বলা হল, কোন লোক দাড়ি কাটতে পারবে না। কেউ দাড়ি কাটলেই মোটা অংকের জরিমানা। দাড়ি কাটা অবৈধ বলে জানানো হল। এর পাশাপাশি নির্দেশ দেওয়া হল, প্রত্যেকে তার একেকটি দাড়ি এক ইঞ্চি লম্বা হওয়ার পর একটি করে গিঁট দেবে। সারাদিন ধরে দাড়িওয়ালা লোকেদের স্কেল দিয়ে মেপে মেপে এক ইঞ্চি করে লম্বা দাড়িগুলিকে গিঁট দিতে দিতে সময় কাটতে লাগল। 

এই সমস্ত আইন কেবলই পুরুষদের জন্য। মহিলারা কি বাদ গেল ? একদমই নয়। হামবড়াই ঘপাৎকে এদিক থেকে বিচার করে সমদর্শী লোক বলা উচিত। তাঁর একুশে আইনের কোপ কেবল পুরুষদেরই কাঁপিয়ে দিল না, মহিলারাও ত্রাহি-ত্রাহি করতে লাগল। হামবড়াই ঘপাৎ মহিলাদের জন্য একগুচ্ছ আইন চালু করলেন, একের পর এক। প্রথম নিয়মটি মেয়েদের চুল নিয়ে। বলা হল, জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোন মহিলা একবারের জন্যও তার চুল কাটতে পারবে না। এই পর্যন্ত শুনলে মনে হবে নিয়মটার মধ্যে তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। মেয়েরা চুল যদি না কাটতে পারে তো তা বড় হতে থাকবে, আর এমনিতেও মেয়েদের লম্বা লম্বা চুল হওয়া তেমন কিছু অশোভন নয়। কিন্তু এই আইনের পরবর্তী নির্দেশটাই বিপজ্জনক। তাতে বলা হল, কোন মহিলাই তার চুল পিঠের দিকে রাখতে পারবে না। সবাইকে চুল মুখের দিকে রাখতে হবে এবং তাতে মুখ যদি ঢেকে যায় তো যাক। মহিলাদের চুল লম্বা হয়ে ঝুলবে সামনের দিকে, পিছনদিকে নয়। 

দ্বিতীয় আরেকটি আইন জারি হল মহিলাদের পোশাক নিয়ে। হামবড়াই ঘপাৎ পরিষ্কার জানালেন, সমস্ত মহিলাকে এমন পোশাক পরতে হবে যার পিছনে দু’ফুট লম্বা একটি লেজ থাকবে। ছোটবড় সব বয়সী মেয়েদের জন্য লেজওয়ালা পোশাক পরা বাধ্যতামূলক হয়ে গেল। ঘরে অথবা বাইরে মহিলারা প্যান্ট অথবা শাড়ি যাই পরুক না কেন তাতে দু’ফুট লম্বা লেজ থাকতেই হবে। এই লেজ লুকিয়ে রাখার কোন চেষ্টা করা চলবে না। পোশাকের মধ্যে লেজটা এমনভাবে থাকবে যাতে সবাই স্পষ্ট সেটা দেখতে পায়। 

মহিলাদের টিভি দেখা নিয়েও একটি অনবদ্য আইন জারি করলেন হামবড়াই ঘপাৎ। আইনে বলা হল, কোন মহিলা টিভিতে সিরিয়াল বা সিনেমা জাতীয় কিছু দেখতে চাইলে তাকে তা দাঁড়িয়ে দেখতে হবে। বসে দেখা চলবে না। ঘরে বা বাইরে এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটবে না কোথাও। আর যদি খেলা বা খবরজাতীয় কিছু দেখতে চায় কেউ তো তাকে টিভির সামনে ক্রমাগত হাঁটাহাঁটি করতে হবে। 

আমি বললাম,

‘জনতা এবার হামবড়াই ঘপাৎকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। যা চটছে লোকজন ! এ তো অকারণে সুস্থ শরীর ব্যস্ত করে তোলা।’

আমার মতামত শুনে রিক্ত প্রশ্ন রাখল,

‘এবার তাহলে তুই মানবি যে কিছু একটা কাণ্ড অবশ্যই ঘটছে ?’

‘হ্যাঁ, ঘটছে। সে তো বললাম আগেই।’

সত্যিটা স্বীকার করলাম আবারও নির্দ্বিধায়। পরক্ষণেই প্রশ্ন তুললাম,

‘কিন্তু হামবড়াই ঘপাৎ কেন করছে এসব ?’

‘তোকে কে বলল, হামবড়াই ঘপাৎ করছে কাজগুলো ?’

‘তাই তো দেখছি। দেশের সমস্ত আইনকানুন, নিয়মনীতি সব তো তার কথা অনুযায়ীই ঠিক হচ্ছে। এইযে এতসব নিয়মকানুন সে তো দেখলাম সে-ই চালু করল।’

রিক্ত চুপ করে শুনল আমার কথা। তারপর বলল,

‘একটা কথা জানবি, পৃথিবীতে কেউ কোন কাজ নিজে বা নিজের ইচ্ছেতে করে না। দেখে আমাদের মনে হবে, কেউ কোন একটা কাজ বুঝি নিজেই ভেবেচিন্তে করছে। কিন্তু তার পিছনে সবসময় অন্য গল্প থাকে। আমরা সবাই কাজ করি অন্যের ইচ্ছেমত। আমরা কেউ কোন কাজ নিজে করি না, আড়াল থেকে কেউ করায়।’

‘তাহলে যে একুশে আইনগুলি হামবড়াই ঘপাৎ চালু করছে দেশজুড়ে সেগুলো সে নিজের খেয়াল-খুশিমত চালু করছে না বলতে চাস ?’

‘একদম তাই। হামবড়াই ঘপাৎ যেমন লোক, সে কিছুতেই চাইবে না তার জনপ্রিয়তা নষ্ট হোক। জনসমর্থন তার মূলধন। জনতাকে সে অকারণে খেপিয়ে দেবে কেন ?’

‘কিন্তু একুশে আইনগুলো তো তাকেই দেখছি চাপিয়ে দিতে ?’

”যা দেখছিস তা ঠিকই, তবে ওটা ওপর-ওপর দেখা। এর পিছনে অন্য গল্প আছে।’

‘কী গল্প ?’

‘গল্পটা হল এই যে কাজগুলো হামবড়াই ঘপাৎ নিজে করছে না, যদিও সবাই দেখছে তাকেই কাজগুলো করতে। আসলে তাকে দিয়ে কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে অন্য কেউ।’

‘কে সেই অন্য লোকটা ?’

‘সে ভূপতি। দু’দিন আগে সে ঢুকেছে হামবড়াই ঘপাতের মধ্যে। এই যে একুশে আইন চালু করে পুরুষ ও মহিলাদের নাজেহাল করা পদে পদে, এটা আসলে নিজের মধ্যে ভূপতি যে আক্রোশ গোপন রেখেছিল দিনের পর দিন, তারই প্রকাশ। হামবড়াই ঘপাতের মত কোন ক্ষমতাবান লোকের মধ্যে তাই সে আশ্রয় নিয়েছে, যাতে তার মাধ্যমে সবাইকে সে মনের মত শিক্ষা দিতে পারে। অন্যদিকে মজাটা দ্যাখ্, সে যে লোকগুলিকে নাজেহাল করছে সেটা কিন্তু কেউ টের পাচ্ছে না। সব দোষ গিয়ে চাপছে হামবড়াই ঘপাতের ঘাড়ে।’ 

আমি শুনে প্রথমটায় তাজ্জব বনে গেলেও একটু সামলে নিয়ে চুপ করে ভাবতে লাগলাম। মনে হল, কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। হামবড়াই ঘপাৎকে দেখে ইদানীং কেমন বদলে যাওয়া লোক বলে ঠাহর হচ্ছিল। খানিকটা তলিয়ে চিন্তা করে বুঝলাম, সত্যিই হামবড়াই ঘপাতের চালচলনে আজকাল যেন ভুপতিরই প্রচ্ছন্ন প্রতিফলন বেশি মাত্রায়। রিক্ত বলল,

‘ভূপতি বিশ্বসংসারে সমস্ত লোকের ওপর বিরক্ত। ঘরের লোকদেরও সে পছন্দ করে না। সুযোগ পেলেই সে সবাইকে শিক্ষা দিতে চায়। নিজের তার সেই ক্ষমতা নেই। হামবড়াই ঘপাতের মধ্যে ঢুকে সে এখন নিজের অপূর্ণ সাধ মেটাচ্ছে। যারা তাকে নিয়ে মজা করেছে এতদিন, তারা কেউ তার একুশে আইনের হাত থেকে রেহাই পাবে না। আসলে ভূপতি সংসারের কোন মানুষকে ভাল ভাবতে পারে না। সে সবাইকে দুর্জন ভাবে। সে তাই হামবড়াই ঘপাৎকে দিয়ে এমন সব কাজ করাচ্ছে যাতে জগতের সব লোকের চূড়ান্ত ভোগান্তি হয়। হামবড়াই ঘপাৎকে আশ্রয় করে ভূপতি নিজের অসুস্থ বাসনার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। আর হামবড়াই ঘপাতের এইসব সৃষ্টিছাড়া একুশে আইন চালু করা দেখে আমরা বুঝতে পারছি যে ভূপতি তার মধ্যে ঢুকে বসে আছে।’

এটাই ছিল আমাদের প্রথম অভিযানের বিবরণ, যেখানে আমরা দেখেছিলাম কেউ কিভাবে অন্যের মধ্যে জাঁকিয়ে বসে নিজের প্রকাশ ঘটায়। 

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *