তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
অধ্যায় : চার
আমার অসুখগুলির কথা বলছিলাম। আর সেই কারণে কী কী বিপদ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
একটি-দু’টি নয়, নানারকম উদ্ভট অসুখের শিকার হয়েছি আমি। নাম জানিনা কোনটারই। লক্ষ্মণ দেখে বুঝি। একেবারে মাল্টিপল ডিজিজ সিনড্রোম। কার কথা ছেড়ে কার কথা বলি ? সবগুলোর কথাই বলা উচিত। আবার ভাবি, এত এত অসুখের ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে কার ভাল লাগে ? তবুও কয়েকটির কথা তো বলতেই হয়। বিশেষ করে, যেগুলি খুব বেশি ভোগাচ্ছে অহোরাত্র।
আমার ঘন ঘন রঙ পাল্টে যাচ্ছে। এই অসুখটা প্রথম দেখা গিয়েছিল আমার মধ্যে। তারপর এতদিনে এর প্রকোপ কিছুমাত্র কমেনি। বেড়েছে কিনা বলতে পারব না। অসুখটা বেশ কাবু করে রেখেছে আমাকে। যখন-তখন এর ধাক্কায় আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। অপদস্থও হতে হয় যথেষ্ট। রঙ পাল্টে যাওয়ার ব্যাপারটা কি ভাল ? গায়ের রঙের কথাই ধরা যাক। বাড়ি থেকে বার হওয়ার সময় দেখলাম রঙটা কালো, বাড়ি ফেরার পর দেখি লালরঙা হয়ে গেছি। ব্যাপারটা বোঝাতে পারলাম কি? মনে হচ্ছে, এটুকু শুনে কেউ বুঝতে পারছে না এই রঙ পাল্টে যাওয়ার মধ্যে কী বিপদ থাকতে পারে। বরং অনেকেই ভাববে, এতে তো বেশ মজাই আছে। একটা কথা বলে রাখছি, রঙ পাল্টানো মানে গায়ের রঙই হবে তা না-ও হতে পারে। তবে কেবল গায়ের রঙের কথা ভাবলেও ব্যাপারটা বিশেষ সুবিধের নয়। এই আমার রঙ হলুদ, দেখতে দেখতে রঙ পাল্টে আমি সবুজ হয়ে গেলাম। এক-আধবার এমন ঘটলে মজা পেলেও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এমন ব্যাপার যদি ঘটতেই থাকে এক নাগাড়ে ? আর এই রঙ পাল্টে যাওয়া যদি আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়ে যায় ? মনে করি, ব্যাপারটা আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘটছে না। আমি যখন-তখন স্বেচ্ছায় নিজের রঙ পাল্টে ফেলতে পারছি। যদি তাই হয় তো সেটাও কি সুখের কথা ? আমি কি আমাকে সুস্থ বলে দাবি করতে পারি ? মুশকিল হল এই যে আমার রঙ পাল্টানোটা স্বেচ্ছায় না অনিচ্ছায় ঘটছে সেটাই আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কেবল দেখছি রঙ পাল্টে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে কিভাবে যাচ্ছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। রঙ পাল্টে যাচ্ছে, এটুকুই জানি। আর এই অশান্তির কোন শেষ নেই। কী অশান্তি তা সব না বললে বোঝা যাবে না।
এটা এক ঘোরতর বিপদ, আমার জন্য। এই রঙ পাল্টে যাওয়াটা। আমাকে এভাবে রঙ পাল্টাতে দেখে সবাই অবাক হয়, আবার ভ্রূ কোঁচকায়। আমার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কেউ কেউ। প্রশ্ন তো রয়েছে আমার নিজের মধ্যেও। এটা কি কোন প্রাণির স্বাভাবিক ধর্ম ? এই ঘন ঘন রঙ পাল্টিয়ে যাওয়া ? যদি অন্যদেরও দেখি ঘন ঘন রঙ পাল্টায় তো আশ্বস্ত হতে পারি। তাহলে সব মানুষকে দেখে যেতে হয়। ক্রমাগত দেখলে বোঝা যাবে, রঙ পাল্টানোর ব্যাপারটা অন্যদের ক্ষেত্রেও ঘটছে কিনা। সেটা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। যদি দেখি অন্যদের মধ্যেও রঙ পাল্টানোর অভ্যেসটা রয়েছে তাতে কি আমার বিপদ কাটবে ?
প্রথম প্রথম আমি বুঝতেই পারিনি যে আমার ঘন ঘন রঙ পাল্টিয়ে যাচ্ছে। নানাজনের মুখে অভিযোগটা শুনতাম, বিশ্বাস করতাম না। তারপর একদিন বুঝতে পারলাম যে অভিযোগটা মিথ্যে নয়। নিজের রঙ পাল্টানোর বহর দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। নিজের ওপর নিজে নজর রাখতে লাগলাম। সবাই এভাবে নিজেকে দেখে কি ? দেখুক না দেখুক আমার কিছু যায়-আসে না। আমি নিজের কথাটাই বলছি। নিজেকে গভীর পর্যবেক্ষণে রেখে বুঝতে পারলাম যে আমি রঙ পাল্টাই। এই কাজটাতে আমার অসম্ভব দক্ষতা। ব্যাপারটা আবিষ্কার করার পর খুশি হব না দুঃখ পাব বুঝতে পারলাম না। এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন। নিজেকে নিজে গবেষণা করে। আর এখন আমি নিশ্চিত যে এটা আমার একটা অসুখ।
আরও কিছু অসুখের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছিল আমার মধ্যে। মাথা ঘামাতে লাগলাম। এক এক করে সবগুলি অসুখের চরিত্র বোঝা গেল। এদের কেমন চেহারা সে সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার।
একটা অসুখ হল, আমি যা-তা কথা বলে ফেলছি। অধিকাংশ সময় দেখা যাচ্ছে, যা বলতে চাইছি তা বলা হল না, যা বলার কথা ভাবছি না তা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। মনে আমার কী আছে লোকেরা তা দেখে না, মুখে যেটা বলছি সেটাই ধর্তব্য হয়ে যায়। মুখ দিয়ে যদি ভাল কথা বার হয় তো ভাল, আর মন্দ কথা বার হলে হয়রানির একশেষ। মুশকিল হল এই যে একবার খারাপ কথা বলে ফেললে তা আর পাল্টানো যায় না। পঞ্চাশটা ভাল কথা বললে লোকেরা শোনে না, কিন্তু একটা মন্দ কথা বললেই সবাই ঠিক শুনে নেয়। একবার খারাপ কী বললাম সেটাই লোকে মনে রাখে, হাজারটা ভাল কথা বললেও তাকে ঢাকা যায় না। উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলার অসুখটা খুবই ভোগাচ্ছে আমাকে। মনে হয়, এর চেয়ে কথা বলতে না পারা ভাল ছিল। যেসব প্রাণি কথা বলতে পারে না তারা এদিক থেকে বেশ নিরাপদ। আমি নিজেও জানি না কেন মুখ থেকে এমন সব কথা বেরিয়ে যায় যা কাউকে চটিয়ে দেবে। অন্যকে চটিয়ে দেওয়ার মত কথা বলে আমার কিছু লাভ হয় কিনা তাও বুঝি না। কেবল যে অন্যকে চটিয়ে দেওয়ার কথা বলি এমন নয়, মুখ থেকে তেমন কথাও বেরিয়ে আসে যা অস্বাভাবিক, যা কোন অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, কোন বিপর্যয় ঘটাতে পারে। না, এসব কথা বলে আমার কোন উপকার হয় না। তাহলে কেন বলি ? আমার নিজেরই তা বোধগম্য নয়। আসলে এটাই তো অসুখ।
প্রায় এমনই আরেকটা অসুখ হল, আমি যা নয় তা খেয়ে ফেলছি। খাওয়ার জিনিস নির্দিষ্ট। মানুষ স্বাদ বুঝে খায়। সেভাবেই খাদ্যাভ্যাস তৈরি হতে থাকে। কিন্তু এমন যদি হয়, কেউ হাতের কাছে যা পাচ্ছে বাছবিচার না করে খেয়ে ফেলছে ? রাক্ষসরা শুনেছি এমন করে থাকে। তাদের নামটা এজন্যই, আর ওই নাম তাকেই দেওয়া যার তেমন স্বভাব। আমাকে কি রাক্ষস বলা যেতে পারে ? আসলে যেমন আমার খাওয়ার প্রকৃতি তাতে রাক্ষস বললেও কিছু বাকি থেকে যায়। রাক্ষসের খাবারে পরিমাণগত দিকটা বিবেচ্য। আমার খাওয়াতে পরিমাণের ব্যাপারটা প্রধান নয়। এমন সব বিষয় আমার খাদ্য তালিকাতে চলে আসছে যে নিজেই দেখে চমকে যাচ্ছি। কী না খাচ্ছি আমি ? নিজের এবং অন্যের ভবিষ্যৎ, বর্তমান, সুখস্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি কোনকিছুই বাদ পড়ছে না। এমনসব জিনিস আমি অক্লেশে খেয়ে ফেলছি যাতে দেশের ও দশের বারোটা বেজে যায়। মানুষ সর্বভুক প্রাণি। সেই হিসেবে সে যা খুশি খেতে পারে। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু খাবার নয় এমন কিছু, ধরাছোঁওয়া যায় না এমন কিছু খেতে পারা যায় বলে শুনিনি। আমি তো সেই বিচারে মানুষও হতে পারছি না। রাক্ষসও নই, মানুষও নই, আমি তাহলে কোন্ আজব বস্তু ? নিজেকেই তো নিজে চিনে নিতে পারছি না।
অন্য একটা অসুখও আমাকে খুব ভোগাচ্ছে, আর তা হল আমি যেখানে-সেখানে চলে যাচ্ছি। অনেকেই এটাকে অসুখ বলবে কিনা সন্দেহ আছে, তবে আমি মনে করি, এটাও আমার একটা অসুখ। রাতে ঘুমোলাম আমার বাড়িতে, সকালে ঘুম ভাঙলে দেখলাম আছি মাধববাবুর বাড়িতে, এটা কি খুব সুখের ? যাচ্ছি দিল্লিতে, পৌঁছোবার পর দেখা গেল জায়গাটা মুম্বাই, ব্যাপারটা মোটেই সুবিধের হবে না। অথবা এমন ঘটনাও ঘটতে দেখেছি যে কোথাও যেতে না চাইলেও চলে যাচ্ছি। যাওয়ার কথা হয়তো ভাবছিও না, তবুও দেখছি, যেখানে থাকার কথা সেখানে থাকছি না। উপস্থিতি নিয়ে সবসময় একটা বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে। এতে লোকের কাছে আমার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠছে। আমি কে, কখন কোথায় থাকব সেটা যেমন কেউ বুঝতে পারছে না তেমনি আমিও অনিশ্চয়তায় ভুগছি। নিজেকে আজব আজব সময়ে এমন সব আজব আজব জায়গায় হাজির থাকতে দেখছি যে আমি যেমন চমকে যাচ্ছি সংশ্লিষ্ট লোকেরাও বেসামাল হয়ে পড়ছে। এসব কি মানুষের কাজ ? মানুষের মত দেখতে কেউ যদি এমন অমানুষিক কাণ্ড করতে থাকে তো তাকে তার অসুখ বলাটা কি অন্যায় হবে ? আসলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না যে এসব কাজ একান্তই আমার অনিচ্ছাকৃত। এই কারণে আমার বিপদ অন্যকে বুঝিয়ে উঠতে পারছি না।
এই যে অসুখটার কথা বললাম, যেখানে-সেখানে চলে যাওয়ার অসুখ, এর আনুষঙ্গিক একটা উপসর্গও আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। হতেও পারে এটা সম্পূর্ণ অন্য একটা অসুখ। চুলচেরা বিচার করে বলতে পারব না, এটার সঙ্গে আগে বলা অসুখটার কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু’টোর উপসর্গে মিল পাওয়া যেতেও পারে। সেসব তুলনা-টুলনার ব্যাপার পরে হবে, আগে অসুখটার কথা বলা যাক। আমি যখন-তখন অনুপস্থিত হয়ে যাচ্ছি। এই আমি আছি, এই আমি নেই। একদল লোকের সঙ্গে বসে হয়তো জমিয়ে গল্পগুজব করছি, হঠাৎ সবার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলাম। ভৌতিক কাণ্ড বলেই ভাববে সবাই। তারপর ওইসব লোকেরা যদি আমাকে আবার দেখতে পায় ? পরিস্থিতিটা আমার এবং তাদের জন্য খুব একটা উল্লাসের হবে কি ? এটাকেও অনেকেই অসুখ বলে মানতে নারাজ হলেও হতে পারে, কিন্তু এর জন্য ভুগতে তো হচ্ছে আমাকেই। কেন এটা অসুখ হবে না ?
নিজের ওপর আস্থা না থাকলে যা হয়, ওপরে বলা রোগগুলি তারই উদাহরণ। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না বলেই কখন কী করে ফেলব নিজেও জানিনা। এটাও একটা অসুখ, যা-তা করে ফেলছি যখন-তখন। তাই কিছু করতে গেলে ভাবনা-চিন্তা দরকার, মানুষ ভেবেচিন্তেই কাজ করে। পরিণামের কথা খেয়াল না রেখে কাজ করে কে ? কিন্তু এমন রোগ হয়েছে আমার যে দুমদাম উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলছি। তাতে হামেশাই নানারকম গণ্ডগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এমন সব ঝামেলা পাকিয়ে যায় যে মনে হয় আর বাঁচার উপায় নেই। যা-তা কাজ করে ফেলার কথা বললে শেষ হওয়ার নয়। অকারণে হয়তো কাউকে মেরে বসলাম, হয়তো করোও ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলাম—- এমনই সব সৃষ্টিছাড়া কাজকর্ম। কেন করছি কোন ব্যাখ্যা নেই। কাজগুলি করে কোন আনন্দও পাই না, দুঃখ হয় এমনও নয়। করে ফেলি কোন এক অজ্ঞাত কিছুর তাড়নায়। এটা অবশ্যই একটা অসুখ, কারণ আমি আমাকে এসব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি না এবং অস্বাভাবিক আচরণের শিকার হই।
এগুলি সব আমার ছোটখাটো খুচরো অসুখ, একটি-দু’টি ছাড়া। এদের মধ্যে জবরদস্ত অসুখ হল ঘন ঘন রঙ পাল্টানোর ব্যাপারটা। অন্য অসুখগুলি আমাকে ভোগায়, কিন্তু তত বড় আকারে নয়। সবচেয়ে বড় কথা যে অসুখগুলির মধ্যে পারস্পরিক একটা সম্পর্কও রয়েছে। হামেশাই দেখি, একটার সঙ্গে আরেকটা কোন না কোনভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেললাম বা বলে ফেললাম তো লোকেরা রেগে যায় আর তখন আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি। এতে আমার উপকারই হয়। লোকেরা আর আমার নাগাল পায় না। কিন্তু মুশকিল হল এই যে সবসময় সবকিছু আমার ইচ্ছেমত ঘটবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। অনেকসময় দেখেছি, বেকায়দায় পড়লেও আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারছি না। আবার অন্যক্ষেত্রে হয়তো এমনসময় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি যে আরও বেশি সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তবুও বলব, এইসমস্ত অসুখগুলো তুলনামূলকভাবে কম প্রবল যতটা না রঙ পাল্টানোর অসুখটা। পরে নাহয় এর কথা বিশদে বলা যাবে। তার আগে বরং এর মত বা এর চেয়েও জবরদস্ত আরেকটা অসুখের কথা বলি। বৈচিত্রে আর প্রাবল্যে এই অসুখটাও কিছু কম যায় না।
আমার ঘন ঘন চেহারা পাল্টে যাচ্ছে।
এই ঘন ঘন চেহারা পাল্টে যাওয়ার ব্যাপারটার মধ্যে যে কত রকমফের রয়েছে তা না বললে বোঝা যাবে না। প্রথমেই বলা যাক লিঙ্গভিত্তিক চেহারা পাল্টানোর কথা। হয়তো আমি বাড়ি থেকে বার হলাম গোঁফদাড়িওয়ালা পুরুষ, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি সুস্থভাবে, হাঁটতে হাঁটতেই একসময় বুঝতে পারলাম যে আমি মহিলা হয়ে গেছি। মহিলা মানে নিখাদ মহিলা। এ যে কী বিপর্যয় তা বলে বোঝাতে পারব না। পুরুষ থেকে মহিলায় রূপান্তর তো ঘটে গেল হঠাৎ, নাম-ধামের কী হবে ? তো মহিলা হয়ে গেলাম তো মহিলা হয়েই যদি থাকতাম তাহলেও কিছু একটা ব্যবস্থা করা যেত। আবার দেখি, মহিলা থেকে কোন একসময় পুরুষে রূপান্তর ঘটে গেছে। কখনো আবার মাঝামাঝি অবস্থাতেও থেকে যাই। লোকেরা আমাকে নিয়ে মজা করবে কী, কাণ্ড দেখে চমকে চমকে যায়। আমিও খাবি খেতে থাকি। নিজেই বুঝতে পারি না কখন ছেলে হব আর কখন মেয়ে হব, কখন বা দু’টোর মাঝামাঝি অবস্থায় থেকে যাব, আর ছেলে বা মেয়ে যা-ই হই না কেন হলেও ওই অবস্থায় কতক্ষণ থেকে যাব। ছেলে থেকে মেয়ে বা মেয়ে থেকে ছেলে বা তাদের মাঝামাঝি চেহারায় আমার রূপান্তর যখন-তখন ঘটে যাচ্ছে। একেবারেই বেসামাল অবস্থা। কোনকিছুই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। এমনও ঘটনা ঘটছে যে ঘন্টায় ঘন্টায় লিঙ্গভিত্তিক রূপান্তর হয়ে চলেছে। আমি নিজেও নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছি না আমি কে, ছেলে না মেয়ে নাকি তাদের মাঝামাঝি কোনও একজন। এটা যে কোন্ চরিত্রের অসুখ কেউ বলতেও পারছে না।
ঘন ঘন চেহারা পাল্টানোর এইতো গেল এক অবস্থা। এর অন্য প্রকারভেদও আছে। একটা হল বয়সভিত্তিক চেহারা পাল্টানো। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে গোলমেলে। মনে করি, আমি একজন যুবক, হঠাৎ দেখি হয়ে গেছি পাঁচ বছরের এক বাচ্চা, বা তারও চেয়ে ছোট সদ্যোজাত এক শিশু। তা এভাবে কমবয়সী হয়ে যাওয়াটা মন্দ নয়। অনেকেই ভাববে আশীর্বাদ। কিন্তু এর যে উল্টো দিকটাও আছে ? নিজেরই অজান্তে হঠাৎ আবার দেখি কখন চেহারা পাল্টে হয়ে গেছি আশি বছরের এক বৃদ্ধ। যখন-তখন এভাবেই বয়স পাল্টাতে থাকে আমার। এই আমি বৃদ্ধ তো পরক্ষণেই যুবক, যুবক থেকে আবার হয়ে গেলাম প্রৌঢ় বা বালক বা বাচ্চা, আবার হয়তো বৃদ্ধ। কখন কী হবে কোন ঠিকঠিকানা থাকে না। ব্যাপারটা আমার হাতে নেই। মুশকিল হল, আসলে আমি যুবক না শিশু নাকি বৃদ্ধ তা নিজেই জানি না। আবার এই বয়সভিত্তিক চেহারা পাল্টানোর সঙ্গে জুড়ে যায় লিঙ্গভিত্তিক রূপান্তর। তখন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। শুরু করলাম হয়তো নব্বই বছরের বৃদ্ধ থেকে, ঝটাস করে হয়ে গেলাম এক যুবতী, সেখান থেকে চেহারা পাল্টে হলাম হয়তো এক কিশোর, তারপর আবার হয়ে গেলাম হয়তো এক প্রৌঢ়া মহিলা বা একটি বাচ্চা মেয়ে। এইসব পরিবর্তন যদি গোপনে ঘটত তা-ও নাহয় কথা ছিল, জনসমক্ষে ঘটে যায় বলেই হয়রানির একশেষ। সবার চোখের সামনে যদি আমি কখনো ছেলে কখনো মেয়ে, কখনো শিশু কখনো বৃদ্ধ হয়ে যেতে থাকি তো ব্যাপারটা কেমন হবে অনুমান করা খুব একটা কঠিন নয়।
চেহারা পাল্টানোর এই রোগটা আমাকে এমন পেয়ে বসেছে যে কোথায় গিয়ে থামবে কেজানে ! এর দু’টো প্রকারভেদের কথা বললাম। অন্যরকম প্রকাশও আছে। একেবারে সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার। বলে কাউকে বিশ্বাস করানো শক্ত। আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম না যদি নিজেই না শিকার হতাম। মানুষ হিসেবেই আমি কেবল চেহারা পাল্টাই না, চেহারা পাল্টে অন্য প্রাণিও হয়ে যাই।
জানি সবাই বলবে, আজগুবি ব্যাপার। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি ঘটছে। হামেশাই আমি হাতি, ঘোড়া, কুকুর, জিরাফ, সাপ, হনুমান হয়ে যাচ্ছি। আমার এই মানুষের চেহারাটা বেমালুম পাল্টে যায় যখন-তখন। মনে করি, গরু হয়ে গেলাম। দেখে তখন কেউ বুঝবে না কোনকালে আমি মানুষ ছিলাম। গরু হলাম তো আগাগোড়া গরুই হয়ে গেলাম, মানুষের ‘ম’-ও থাকবে না চেহারাতে। আচরণটাও হবে গরুর মতোই। গরুর মত ঘাস খাব, জাবর কাটব, ‘হাম্বা-হাম্বা’ ডাকব। এভাবে যেকোন প্রাণি হয়ে যেতে পারি যখন-তখন। এই হয়তো বাঘ হয়ে গেলাম, দু’-চারটে পশু শিকার করে খেলাম, তারপরই দেখা গেল গণ্ডার হয়ে গেছি। তখন আবার বাঘের আচরণ ভুলে গণ্ডারের মত কাজকর্ম শুরু করে দেব। কেন, কখন, কিভাবে মানুষের চেহারা থেকে অন্য কী হব নিজেও জানিনা। পাল্টে যেতে পারি যেকোন জন্তু-জানোয়ারের চেহারাতেই, কোন বাছ-বিচার নেই। এখানে আমার পছন্দ কাজ করে কিনা পরিষ্কার নয়। এই হয়তো মানুষ থেকে হাতি হয়ে গেলাম, পরক্ষণেই চেহারা পাল্টে ইঁদুর বা মাছ। মাছেরও আবার নানা ধরন আছে। যে কোন রকম মাছই হতে পারি—- রুই, কাতলা, কই, বোয়াল, ইলিশ ইত্যাদি। মাছ হওয়ার একটাই মুশকিল, জল চাই। তো এদিক থেকে আমার এই চেহারা পাল্টানোর রোগটা বেশ সমজদার। কোন ডাঙার প্রাণি থেকে মাছ-টাছ জলচর প্রাণি হওয়ার সময় সে বুঝে বুঝে কাজ করে। কখনও আমাকে সমস্যায় ফেলে না। মাছ বা হাঙড় যাই হোক না কেন, হওয়ার সময় হিসেব করে দেখে নেয় কাছাকাছি পুকুর, খালবিল আছে কিনা। হঠাৎ মরুভূমির মাঝখানে উট হয়ে গেল ইলিশ মাছ, এমন ঘটনা কোনদিনও ঘটেনি। তেমন ঘটনা ঘটলে কি আর এই বিবরণ লেখার সুযোগ পেতাম ? তাই বলছি, চেহারা পাল্টানোর ব্যাপারটা যতই বেয়াক্কেলে হোক না কেন, তার মধ্যে কিছু হলেও একটা কাণ্ডজ্ঞান আছে।
মানুষের চেহারা পাল্টে আমার কেবল নানারকম জীবজন্তু হয়ে যায়, এমন নয়। অন্য কিছুও হতে পারে। যেমন, মাছ বললাম এক্ষুনি। এছাড়া ব্যাঙ, কেঁচো, পোকামাকড়, কী না হতে পারি ! হয়েছিও এমন অনেক কিছু। মাছি হয়েছি, মশা হয়েছি, আরও কতসব কীটপতঙ্গ। চেহারা পাল্টানোর চক্করে আমি নাজেহাল। কী হইনি বলা শক্ত। পাখিও হয়েছি কতরকম—- কাক, শালিক, বাজ, শকুন, চড়ুই। কিসের থেকে কখন কোন্ চেহারা পাব বোঝা মুশকিল।
মানুষের চেহারা পাল্টে অন্য প্রাণি বা জীবজন্তু হয়ে যাওয়ার সঙ্গে আবার লিঙ্গ বা বয়সভিত্তিক ব্যাপারটাও যুক্ত হতে পারে। হলাম হয়তো মানুষ থেকে একটা ছাগল, সেখান থেকে একটা কুমিরের ছানা, তারপরই হয়তো হয়ে গেলাম একটা ময়ূরী। আমার চেহারা পাল্টানোর এত বৈচিত্র্য আর ঘনঘটার বহর ভাবলে বা দেখলে নিজেরই মাথা ঘুরে যায়, অন্যের কথা কী আর বলব !
এভাবেই আমার চেহারা ঘন ঘন পাল্টে যাচ্ছে। এর পিছনে কী কারণ বা কোন নিয়মকানুন আছে কিনা জানিনা। রহস্যটা রহস্যই। তবে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক এবং অবশ্যই একটা রোগ। মানুষের চেহারা পাল্টে পাল্টে সাপ-ব্যাঙ অথবা ইঁদুর-বাঁদর হয়ে যাওয়া কি ভাল ? মানুষ কখনো পুরুষ কখনো মহিলা হয়ে যাবে, এটাও স্বস্তির কথা নয়। আমাকে দেখে বোঝা যাবে না আমি কখন বৃদ্ধ থাকব বা কখন বাচ্চা হব, এমন ব্যাপারও কেউ পছন্দ করবে না। এই চেহারা পাল্টে যাওয়ার অসুখটা সব শান্তি কেড়ে নিয়েছে। আমার মধ্যে জন্ম দিয়েছে বিপুলায়তন এক নৈরাশ্য। ঘন ঘন রঙ পাল্টে যাওয়ার মতোই এর চরিত্র, বা তার চেয়েও বোধহয় বেশি ভয়ঙ্কর। আবার এই দু’টো রোগের মধ্যে যোগসূত্র আছে। ঘন ঘন চেহারা পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে বা আগেপরে ঘন ঘন রঙও পাল্টাতে থাকে।
মানুষ হয়ে বাঁচার আনন্দটাই আমার হারিয়ে গেছে। এতসব রোগের কারণে। মানুষ যদি মানুষই থাকে, সরল সাদাসিধে মানুষ, তার মত সুখ আর কোথায় আছে ? ঘন ঘন আমার রঙ পাল্টে যাবে এটা মোটেই ভাল কথা নয়। আমার খাদ্যাখাদ্য গরমিল হয়ে যাবে, কী করব না করব তার কোন ঠিক থাকবে না, বিচরণক্ষেত্র অনিশ্চিত হবে—- এর কোনটাই আমাকে শান্তি দিতে পারে না। আমি মানুষটা হঠাৎ অন্য কোন পোকামাকড়, জীবজন্তু হতে যাব কেন? যদি পরিস্থিতি আমাকে তেমন কিছু হতে বাধ্য করে তো তার চেয়ে বড় কোন অসুখ আর কী হতে পারে ?
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)