তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
অধ্যায়: পনের
ঘটনাটা নিয়ে হৈ-হৈ কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। পুলিশ, মিডিয়া এবং সাধারণ লোক তো আছেই। ব্যাপারটা জানাজানি হতেই ধনপতির বাড়ির সামনে লোকে-লোকারণ্য। বলা নেই কওয়া নেই অত্তোবড় লোকটা বেমক্কা খুন হতে যাবে কেন? যে-সে লোক হলে কথা ছিল, এ হল ধনপতি। শহরের এক নামজাদা ধনী ব্যক্তি। সবাই বলে, এত টাকার মালিক সে যে তার সম্পত্তির হিসেব করতে একশ’ জন লোকের একশ’ দিন লেগে যাবে। ওটা যদিও কথার কথা, খুব একটা যে মিথ্যে তা-ও নয়। এমন একজন মানুষ হঠাৎ খুন হয়ে গেলে শোরগোল পড়বে না?
পুলিশের বড়কর্তা, মেজকর্তা, ছোটকর্তা থেকে শুরু করে গোটা বাহিনী এসে হাজির। ফাঁকতালে পলিটিক্যাল নেতারাও এসে গেল, কী থেকে প্রচার হয়ে যাবে বলা তো যায় না। সাধারণ মানুষ এল জন্মসূত্রে পাওয়া কৌতূহল মেটাতে। তাছাড়া প্রত্যেকেরই একটা নিজস্ব সমাবেশ আছে, সেখানে প্রত্যেকেই নিজেকে জাহির করতে চায়। মিডিয়ার লোকরা ক্যামেরা-মাইক নিয়ে জড়ো হওয়া জনতা, পথচলতি মানুষ, পাড়ার বাসিন্দা, ধনপতির কাজের লোক, পুলিশ, নেতা থেকে শুরু করে হেন কাউকে বাদ দিল না মতামত জানাতে। কয়েকটা চ্যানেলের সাংবাদিক আবার রাস্তার কুকুর-বেড়ালদের দেখাল ক্যামেরায়, দু’-একজন তো তাদের মুখের কাছে মাইকও নিয়ে গেল। আর কিছু না পেয়ে দু’টো চ্যানেলের লোক অন্য চ্যানেলের লোকদের সাক্ষাৎকার নিতে লাগল।
ধনপতির বাড়ির কাজের লোকের সংখ্যা কম নয়। সেক্রেটারি, রাঁধুনি, ড্রাইভার, চাকর, পাহারাদার, মালি ইত্যাদি মিলিয়ে পনেরজন তো হবেই। কেউ পাকাপাকিভাবে ওখানেই থাকে আউটহাউসে বা চাকরবাকরদের ঘরে, কেউ কেউ বাইরে থেকে আসে। তার ড্রাইভারের সংখ্যাই তিন, চাকরবাকর অন্তত চার-পাঁচজন। বডিগার্ড ও পাহারাদার মিলিয়ে আরও পাঁচ-ছ’জন মানুষ। এছাড়াও রয়েছে এমন অনেক মানুষ যারা তার ব্যবসা ও অফিসের সঙ্গে যুক্ত। আর আছে বন্ধুবান্ধব ও চেনাজানা লোক। সবাইকে পুলিশ ধরল। অনেককে তুলে নিয়ে গেল থানায়, বাকিদের যখন-তখন হয়রানি করতে লাগল।
তদন্ত চলল জোরকদমে। মূল সন্দেহের তালিকায় রইল দু’জন ড্রাইভার, তিনজন চাকর, একজন পাহারাদার ও একজন আধা সেক্রেটারি। ধনপতির প্রিয়পাত্র হেবোর বয়ান অনুযায়ী এই সন্দেহ। এদের প্রত্যেকেই তাদের মালিকের ওপর রুষ্ট ছিল। বিশেষ করে ড্রাইভার ঘুনু আর চাকর খোচাই। আধা সেক্রেটারি বুচুন নস্করও এদের দলে পড়ে। বুচুনকে উঠতে-বসতে ধনপতি গালাগাল করত, নাকি সে কোন কাজই নিখুঁতভাবে করতে পারত না। বিগত তিন বছরে সাতবার তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। সে একটু মাথামোটা আবার রগচটা। নাকি সে মনিবের মুখে মুখে তর্কও করেছিল। বরখাস্ত করেও তাকে আবার কাজে ডেকে নিত ধনপতি। হেবোর বয়ান অনুযায়ী, বুচুনকে দিনে একবার অন্তত গালমন্দ না করে তার মনিব নাকি আরাম পেত না। আসলে কেউ কেউ আছে যে অন্য লোককে বকাবকি ও অপদস্থ করে আনন্দ পায়। ধনপতি আর বুচুনের সম্পর্কটা ছিল কিছুটা সেইরকম। বুচুনকে বকাবকি করে ধনপতি মজা পেত। মালিকের ওপর বুচুনের স্বাভাবিক কারণেই আক্রোশ জমেছিল। দিনের পর দিন একটা লোক কারণে-অকারণে কাউকে অপমান করে গেলে কতদিন তা সহ্য হয়? প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠবে না? একদিন তা খুনের কারণও হতে পারে। কেবল হেবো নয়, অন্য কাজের লোকেদের জেরা করেও মোটামুটি একই তথ্য পাওয়া গেল। এদের মধ্যে হেবো যে মালিকের সর্বাধিক প্রিয়পাত্র ছিল একথাও একবাক্যে জানাল সবাই। তবুও হেবোকে পুলিশ মুক্তি দিল না। যতদিন না রহস্য সমাধান হয় হেবো পুলিশের হেফাজতেই রইল।
খুন নিয়ে তদন্ত চলতে লাগল জোরকদমে। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের লোকরা আর গোয়েন্দা অফিসাররা প্রচুর তথ্যপ্রমাণ পেয়ে গেল হাতে। খুনের অস্ত্রটারও সন্ধান মিলল, খুনী সেটা ধনপতির বাড়ির পিছনদিকের বাগানে একটা বিলিতি ঝাউগাছের গোড়ায় পুঁতে রেখেছিল। পুলিশ কুকুর খুঁজে খুঁজে উদ্ধার করল সেটা। ধনপতির শোবার ঘরের আলমারি ভাঙা ছিল, সেটা খুনীরই কাজ। খোঁজখবর করে জানা গেল যে সেই আলমারিতে কয়েক লক্ষ টাকা আর মূল্যবান কিছু জিনিসপত্র ছিল। সেসব হাওয়া। খুনের মোটিভ ওটাই বলে মনে হল প্রাথমিক তদন্তে। তবে প্রধান প্রশ্ন হল, খুনী ভিতরের কেউ নাকি বাইরের লোক।
চাকর-বাকরদের নাগাড়ে জেরা করে বেশিদূর এগোনো যাচ্ছিল না। কয়েক লক্ষ টাকা আর মূল্যবান কিছু জিনিসপত্র খোওয়া গেলেও এসবের জন্য কেউ ধনপতিকে খুন করবে এটা কেমন যেন বেমানান। ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেল, খুনের সময়টা রাট দু’টো থেকে তিনটের মধ্যে। পাহারাদার থেকে অন্য সব চাকর-বাকরদের নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল যে অত রাতে বাইরে থেকে কেউ বাড়ির ভিতরে আসেনি। আরও বিশদে তদন্ত করার পর পুলিশ ব্যাপারটাতে নব্বই শতাংশ নিশ্চিত হতে পারল। তবুও দশ শতাংশ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হল না যে খুনী বাইরে থেকে এসেছিল। সেই দশ ভাগ সম্ভাবনা নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল। কাজের লোকদের বয়ানও মিলিয়ে দেখা হতে লাগল, একজনের সঙ্গে আরেকজনের। সযত্নে যাচাই করা হচ্ছিল বিভিন্নজনের দেওয়া বয়ানগুলির সঙ্গতি ও অসঙ্গতি।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের রকমফের আছে। ব্যাপারটা অল্পবিস্তর জানে সবাই। সন্দেহভাজনদের ওপর নানা প্রক্রিয়ায় মানসিক চাপ তৈরি করা হয়। খুব মনের জোর থাকলেও আনকোরা অনেকেই সেই চাপের সামনে ভেঙে পড়ে। আচ্ছা-আচ্ছা অপরাধীও কাবু হয়ে যায়। যদিও মানবাধিকার কর্মীরা সবসময় সজাগ এবং মিডিয়া নিজেদের জনপ্রিয়তার স্বার্থে শ্যেনদৃষ্টি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তবুও পুলিশ সুযোগ পেলেই শারীরিক নিগ্রহের আশ্রয় নেয়। সম্ভাব্য অপরাধীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে এমন আতঙ্কের পরিবেশে ফেলা হয় যে শেষপর্যন্ত অনেকেই তাতে বিপর্যস্ত হয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে ফেলে। এমনও দেখা যায় যে অনেকে আসল অপরাধী না হওয়া সত্বেও পুলিশি অত্যাচারের চাপে নিজেকে অপরাধী বলে স্বীকার করে পরিত্রাণ পেতে চায়।
ধনপতি খুনের কেসে পুলিশ নব্বই শতাংশ নিশ্চিত ছিল যে খুনী বাড়িরই কেউ, চাকর-বাকর বা কাজের লোক। যারা চব্বিশঘন্টা বাড়িতে থাকে তাদেরই কোন একজন। দশ শতাংশ সন্দেহ ছিল বাইরের লোকের ওপর, তাদের মধ্যে সারাদিন কাজ করে যারা রাতে চলে যায় তারাও আছে। তদন্ত যত এগোল তত বাইরের এসব লোকরা বাদ চলে যেতে লাগল। একসময় পুলিশের গোয়েন্দারা এবিষয়ে একমত হল যে খুনী বাড়ির ভিতরেরই কেউ, চব্বিশঘন্টা যে ধনপতির বাড়িতে থাকে। কাজের লোক বা চাকর-বাকরদের কেউ একজন। কিন্তু কে ?
দু’দিন পর ঘটনাটা আরেক নতুন মোড় নিল। বাড়ির পিছনদিকে বাগানের এক ঝোপে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল রক্তমাখা শার্ট-প্যান্ট আর একটা ব্যাগভর্তি কয়েক লক্ষ টাকা। প্রথমেই কেন এসব উদ্ধার হয়নি? পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য খুনী কাজটা করেছিল বেশ বুদ্ধি খাটিয়ে। নিশ্চয় স্নানটান করে কোন জোরালো পারফিউম ব্যবহার করেছিল যাতে পুলিশ কুকুর বিভ্রান্ত হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য প্রাথমিকভাবে সফল হলেও শেষপর্যন্ত বেকার হয়ে গেল। পুলিশ সহজেই জামাপ্যান্টের মালিককে খুঁজে পেল। সে আর কেউ নয়, ধনপতির আধা সেক্রেটারি বুচুন নস্কর।
মোটিভ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে হল না। মনিবের ওপর বুচুনের কতটা রাগ ছিল সেটা কাজের লোকরা জানিয়েছিল সবাই। এখন এই রক্তমাখা পোশাক পাওয়ার পরও তারা সবাই বলল যে নিত্যদিন কারণে-অকারণে ধনপতির কাছে অপদস্থ হয়ে বুচুন আড়ালে এসে রাগে আর আক্রোশে ফুঁসত। এমনিতেই সে খানিকটা বোকা আর রগচটা। ধনপতি ওইজন্যই তাকে গালাগাল করত, বোধহয় মজাও পেত। অন্য কাজের লোকদের সঙ্গেও খিটিমিটি লেগেই থাকত বুচুনের। তার বোকাটে স্বভাব আর রগচটা চরিত্রের জন্য সবাই তাকে খেপাত এবং সে-ও হয়-নয় কথায় খেপে যেত। খেপে গেলে যা-তা বলে গালাগাল করত আর শাসাত। এমনকি ধনপতিকেও সে এক-দু’বার শাসিয়েছিল দেখে নেবে বলে। সেটা যে বেশিদিন আগের ঘটনা এমন নয়। তাকে চাকরি থেকে প্রায়ই বরখাস্ত করত ধনপতি, আবার নিজেই ডেকে কাজে বহাল করত। এসব কারণে রাগ তো তার থাকতেই পারে। তার জন্য খুন করে বসবে? ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ের নয় কি? কাজের লোকরা সবাই এটাও জানাল যে যতই রগচটা হোক বুচুন, রেগে গেলে যতই শাসাক, রাগ পড়ে গেলেই সে ভালমানুষ। রেগে গিয়ে হম্বিতম্বি করলেও ভয়ঙ্কর কোন কাণ্ড করেনি কখনও। সে ঠাণ্ডা মাথায় মনিবকে ওভাবে খুন করবে ভাবলে একটু অবাস্তবই লাগে।
তবুও তাকে নিয়েই পড়ল পুলিশ। মোটিভ তো কিছু হলেও একটা আছে। তার চেয়ে বড়কথা, রক্তমাখা জামাপ্যান্ট। অবশ্য পোশাক যে তার একথা বুচুন অস্বীকার করল না। কিন্তু সঙ্গে এটাও বলল যে ওই পোশাক খুনের দু’দিন আগে চুরি হয়ে গিয়েছিল তার ঘর থেকে। তার প্রমাণ কী? বুচুন জানাল যে তার পোশাক চুরি যাওয়ার কথা সে হেবো এবং অন্য কয়েকজনকে জানিয়েছিল। হেবো আর অন্যরা জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে ব্যাপারটা সত্যি বলে মেনে নিল। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে চুরি যাওয়ার কথাটা তার মিথ্যে রটনা? নিজের মতলব হাসিল করার জন্য সে পরিকল্পনা মাফিক ব্যাপারটা রটিয়েছিল? সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া না গেলেও একটা জায়গায় খটকা থেকে গেল। এমনিতে রক্তমাখা পোশাকের গায়ে বা টাকার ব্যাগে বিশেষ কিছু আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। খুনের অস্ত্রটাতেও আঙুলের ছাপ ছিল না। এ থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে খুনী দস্তানা ব্যবহার করেছিল। সেই দস্তানা খুঁজে পাওয়া গেল না। জামাপ্যান্ট বুচুনের হলেও খুনী যে সে-ই তার কিছু অকাট্য প্রমাণ মিলল না। তাছাড়া বুচুনকে শত চাপ দিয়েও স্বীকার করানো গেল না খুনের ব্যাপারটা। অন্য একটা বিষয়ও তাকে অনেকটাই বাঁচিয়ে দিল। ঘটনার দিন রাতে সে যে তার ঘরে ছিল একথা জোর দিয়ে জানাল এমন দু’জন কাজের লোক যারা রাতে একসঙ্গে থাকে।
তাহলে খুনটা করল কে? বুচুনকে নিয়ে নিশ্চিত হতে পারল না পুলিশ। কিন্তু বাড়িরই কোন কাজের লোক যে ব্যাপারটা ঘটিয়েছে তাতে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ রইল না। কিন্তু কে? যে-ই হোক সে বেশ বুদ্ধি রাখে। প্রমাণ বা সূত্র লোপাটের সবরকম চেষ্টাই করেছে সে। বুচুনের জামাকাপড় চুরি করে সেইটা পরে খুন করেছে। হাতে আবার দস্তানা লাগিয়েছিল। ধনপতির শোবার ঘরে ও অন্যত্র সি সি টিভি ক্যামেরা লাগানো ছিল। খুন করার আগে সেসব অকেজো করে দিয়েছিল সে। তারপর খুনের অস্ত্র, একটা মাংস কাটার বড় ছুরি। সেটা সে বাড়ির রান্নাঘর থেকে সরায়নি। নিশ্চয় এই উদ্দেশ্যে যাতে কেউ সন্দেহ না করে যে খুনটা করেছে বাড়ির কোন লোক। অথবা এমনই কোন কারণে।
শেষপর্যন্ত আশার আলো দেখাল খুনের অস্ত্র সেই ছুরি। মাংস কাটার এতবড় ছুরি সচরাচর কেউ কেনে না। খোঁজখবর চালিয়ে পুলিশ কাছাকাছি এক বাজারে গিয়ে এমন একটা দোকান পেল যারা লোকাল মেড ছুরি-কাঁচিও বিক্রি করে। ছুরিটা দোকানের লোক দেখেই বলল যে ওটা তাদের দোকান থেকে কেউ একজন কিনেছিল খুনের অন্তত পাঁচদিন আগে। ধনপতির বাড়ির কাজের লোকদের ছবি দেখাল পুলিশ। দোকানের লোক একজনকে শনাক্ত করল ছুরির ক্রেতা হিসেবে। পাশাপাশি আরও একটা সূত্র পাওয়া গেল। ধনপতির বাড়িতে ইলেকট্রনিক্সের যত সরঞ্জাম আছে তার অধিকাংশেরই এএমসি করা হয়েছে দু’-তিনটি নামকরা সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে। এছাড়াও স্থানীয় কিছু টেকনিশিয়ান রয়েছে যাদের মাঝেমধ্যেই টুকটাক কাজের জন্য ডেকে আনা হয়। সবাইকে জেরা করল পুলিশ। ধনপতির বাড়ির কাজের লোকরা কে কে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে সেই খবর পাওয়া গেল সহজেই। এদের মধ্যে একজন স্থানীয় টেকনিশিয়ান জানাল বিশেষ এক তথ্য। তাকে দরকারে ডেকে নিয়ে যায় ধনপতির বাড়ির যে কাজের লোক সে খুনের ঘটনার চার-পাঁচদিন আগে সি সি টিভি সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিয়েছিল জিজ্ঞেস করে করে। সেই লোকটা কে? ওই টেকনিশিয়ান ছবি দেখে যাকে নির্দিষ্ট করল তাকেই ছুরির ক্রেতা হিসেবে শনাক্ত করেছিল ছুরির দোকানের লোক। দু’জন একই ব্যক্তি। সে ধনপতির এক ড্রাইভার ঘুনু। কাজে গাফিলতির জন্য মনিব তাকে কিছুদিন আগে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল। অপমানও করেছিল বিস্তর। হাতেপায়ে ধরে চাকরি বাঁচিয়েছিল সে। তবে তাকে এমন প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিল যে আর কোনদিনও গর্হিত আচরণ করতে পারবে না। সেই থেকে সে মনিবের ওপর হাড়ে হাড়ে চটা ছিল। ধনপতিকে দু’চক্ষে দেখতে না পারলেও সে ভিতরের এই বিরাগ ঘনিষ্ঠ দু’একজন ছাড়া কারো কাছেই প্রকাশ করত না। মোটিভও পরিষ্কার অনেকটাই।
ঘুনুকে নিয়ে পড়ল পুলিশ। ছুরির দোকানের লোক আর টেকনিশিয়ানকে হাজির করা হল। তাদের দেখে ঘাবড়ে গেল সে। অনেক চেষ্টা করল নিজেকে বাঁচাবার জন্য। কিন্তু ক্রমশ সে জড়িয়ে যেতে লাগল। নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার কোন তথ্যই পেশ করতে পারল না। একের পর এক অসঙ্গতি দেখা গেল তার কথায়। এবেলা এই বয়ান দেয় তো ওবেলা অন্য। পুলিশ একের পর এক তথ্য নিয়ে এল তার বিরুদ্ধে। কোনটারই সদুত্তর দিতে পারল না সে। তারপর একসময় নিজের দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হল। কিন্তু ভাঙে তবু মচকায় না। সবকিছু মেনে নেওয়ার বারো ঘণ্টার মধ্যেই সে আবার অন্য কথা বলল। দোষ যে অস্বীকার করল এমন নয়, আবার পুরোপুরি স্বীকারও করল না। সব মিলিয়ে তার বক্তব্য ধন্দে ফেলে দেওয়ার মত। সে জানাল, খুনটা সে করেছে সত্যি কিন্তু নিজের ইচ্ছেতে করেনি। কেউ তাকে চালিয়েছে, খুন করার কথাটা মাথায় ঢুকিয়েছে। সে মনিবের ওপর রুষ্ট ছিল ঠিক কথা কিন্তু খুন করার কথা ভাবেনি কোনদিন। সে খুন করবে কেন বুঝতে পারেনি, খুন করার পরও বোঝেনি কেন কাজটা করেছে। কেউ তাকে প্ররোচনা দিয়েছে, তার মাথার মধ্যে ঢুকে ক্রমাগত খুন করার ইচ্ছেটা জাগিয়ে দিয়েছে। কে সে? প্রশ্নটার কোন সদুত্তর পাওয়া গেল না তার কাছে। কেউ যদি তাকে খুন করার জন্য প্ররোচনা দিয়ে থাকে তো তার নামটা বলা উচিত। সেটা সে বলতে পারলো না কিছুতেই। জেরা করলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতে লাগল। তবে এই কথাটা সে বারবার বলে গেল যে খুন করলেও সে নিজের ইচ্ছেতে করেনি, কেউ তার মাথার মধ্যে ঢুকে ইচ্ছেটা জাগিয়ে তুলেছে। একথা সব অপরাধীই বলে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য। খুন বা অপরাধ তো মানুষের অসুস্থ ইচ্ছেরই প্রতিফলন। জন্ম থেকে কেউ খুনি বা অপরাধী নয়। তবুও মানুষ খুন করে, অপরাধ করে। সে যদি বলে তার মাথায় ইচ্ছেটা জেগেছিল অন্যের প্ররোচনায় তো সেই অন্য লোকটার কথা বলতে হবে, তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণও দেওয়ার দায় রয়েছে। নাহলে অপরাধ যে করেছে সে-ই অভিযুক্ত। তার মাথায় জেগে ওঠা অপরাধের ইচ্ছেটা তার নিজের বলেই ধরে নেওয়া হবে। অতএব ঘুনুকেই খুনি বলে আদালতে তোলা হল। অকাট্য প্রমাণ সব তার বিরুদ্ধে।
রিক্তর সঙ্গে কথা হল আমার। সে জানাল,
‘ঘুনু কিন্তু সত্যি কথাই বলছে। খুনটা সে করেছে ঠিক, কিন্তু প্রকৃত অপরাধী সে নয়। তাকে দিয়ে খুনটা করানো হয়েছে। আসল অপরাধী কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে। সে ঘনুকে তার নিজের ইচ্ছেমত চালিয়েছে।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তাহলে ঘুনু তার নামটা বলছে না কেন ?’
‘বলবে কী করে? ঘুনু তাকে চিনলেও জানে না যে তার মধ্যে খুনের ইচ্ছে সেই লোকটাই জাগিয়ে তুলেছে। সে প্রত্যক্ষভাবে ঘুনুকে কোনদিনও বলেনি ধনপতিকে খুন করার কথা। ঘুনুর অজান্তে তার মধ্যে ঢুকে ঘনুকে দিয়ে নিজের ইচ্ছে হাসিল করেছে।’
‘তুই জানিস তার নাম ?’
আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে রিক্ত এক মুহুর্তও দেরি করল না। সে বলল,
‘নিশ্চয়। তুই বুঝতে পারছিস না? লোকটা গণপতি। সে কার মধ্যে গিয়ে ঢুকবে, কী করবে ভাবছিলি না? ধনপতি ছিল তার জীবনের প্রধান অশান্তি। তার প্রবল আক্রোশ ছিল লোকটার ওপর। সে দিনরাত ধনপতির অমঙ্গল কামনা করত। ধনপতি ছিল তার চক্ষুশূল, লোকটাকে সে হিংসে করত যদিও তার জীবনযাপন ও ঐশ্বর্য এবং সৌভাগ্য সে নিজে পেতে চাইত প্রবলভাবে। না পেয়ে তার মধ্যে এমন অসুস্থ ইচ্ছে জেগে উঠেছিল যে ধনপতির মৃত্যু কামনা করত দিনরাত।’
‘কিন্তু নিজের ইচ্ছেপূরণের জন্য ঘুনুকেই সে বাছাই করল কেন ?’
‘কেবল ঘুনুকেই সে বাছাই করেনি। চেষ্টা চালিয়েছিল আরও কয়েকজনকে দিয়ে। দিনের পর দিন ধৈর্য ধরে ভাব জমিয়েছিল ধনপতির কয়েকজন কাজের লোকের সঙ্গে। ঘুনু ছাড়াও আছে চাকর খোচাই, সেক্রেটারি বুচুন এবং আরও কয়েকজন। এদের মধ্যে যারা ধনপতিকে অপছন্দ করে তাদের সঙ্গেই সে হৃদ্যতা বাড়িয়ে গেছে। সবাইকে নিয়ে পরীক্ষা করেছে অজান্তে তাদের মধ্যে ঢুকে। নিজের অসুস্থ ইচ্ছেটা তাদের মধ্যে চালান করে দিতে চেয়েছে। খোচাই, বুচুন ও অন্য দু’একজনকে কায়দা করতে পারলেও মনিবকে খুন করার ইচ্ছেটা জাগিয়ে তুলতে পারেনি। চেষ্টা করে গেছে দিনের পর দিন। কখনও এর মধ্যে ঢুকেছে, কখনও তার মধ্যে। তারা তার ইচ্ছেতে প্রভাবিত হয়েছে, সে যেমন চেয়েছে চলেছে, কিন্তু ধনপতিকে খুন করার চিন্তাটা তাদের মাথাতে সে কিছুতেই ঢোকাতে পারেনি। একমাত্র ঘুনু সাড়া দিয়েছিল তার এই অসুস্থ ইচ্ছেতে। ঘুনুর মধ্যে মালিকের ওপর আগে থেকে জমে থাকা আক্রোশ সে প্রবল করে তুলতে পেরেছিল। ঘুনুকে রাতে-দিনে আশ্রয় করে সে নিজের ইচ্ছে তার মাথায় চালান করেছে এবং ঘুনু শেষপর্যন্ত ভাবতে পেরেছে যে ধনপতিকে খুন করলে তার অপমানের জ্বালা মিটবে, প্রচুর টাকা চুরি করে বড়লোক হয়ে যাবে।’
রিক্ত থামতে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘কিভাবে খুন করা হবে বা কখন, এসব প্ল্যান কার ?’
‘এটা বলা মুশকিল। প্ল্যানটা ঘুনুরও হতে পারে আবার গণপতিও তার মধ্যে ঢুকে তাকে প্ল্যানটা ভাবাতে পারে। দুজনে মিলে প্ল্যানটা বানিয়েছিল সেটাও সম্ভব। তবে গণপতির আসল লক্ষ্য ছিল ধনপতির মৃত্যু, সেটা কিভাবে হবে তার জন্য তাকে না ভাবলেও চলত। ধনপতি যেভাবেই হোক মরবে এবং সে নিজে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে, এটাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল। সে যাকে দিয়ে ধনপতিকে মারতে বাধ্য করবে সেই লোকটা ধনপতিকে কিভাবে মারবে সেটা তার দেখার বিষয় নয়। যেভাবে হোক মারলেই হল। মারতে গিয়ে লোকটা ধরা পড়লে চলবে না, সেটাও তার ভাবনার বিষয়, কিন্তু ধনপতিকে মারার পর লোকটা ধরা পড়ল কি পড়ল না তাতে তার কোন উৎসাহ নেই। সে কেবল সযত্নে খেয়াল রাখবে গোটা ঘটনায় যাতে কোনভাবেই তাকে না কেউ সন্দেহ করে।’
আমি চিন্তিতভাবে সায় দিলাম। রিক্ত হালকা গলায় যোগ করল,
‘করার কোন প্রশ্নও নেই। ব্যাপারটা এমনই অবাস্তব যে কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না ঘুনুকে দিয়ে কে খুন করিয়েছে, আড়াল থেকে কে কলকাঠি নেড়েছে।’
আমার গলায় বিহ্বলতা। রিক্ত জবাব দিল জোরের সঙ্গে,
‘এক্কেবারে তাই। যাদের তুই দেখছিস অপরাধী, যাদের বিচার হয় এবং শাস্তি পায় তারা আসলে নিমিত্তমাত্র। আড়াল থেকে তাদের অজান্তে কেউ বা কয়েকজন তাদের দিয়ে কাজটা করায় তাদের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে।’
প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas magazine
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)
