তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
অধ্যায় : চোদ্দ
দাড়িটাড়ি কমিয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে নিলাম। গোঁফটাও কমিয়ে ফেললাম এই কারণে যে নিজে নিজে গোঁফ ঠিকঠাক রাখা খুব ধৈর্য আর পরিশ্রমের কাজ। হামেশাই দেখি বাঁদিকের আর ডানদিকের গোঁফ কমবেশি রোগা-মোটা হয়ে যেতেই থাকে। দু’ধারের গোঁফের সরুত্ব বা মোটাত্ব কিছুতেই সমান করা যায় না। আয়নায় দেখলে এক ধারের গোঁফকে অন্য ধারের তুলনায় কম মোটা বা কম সরু মনে হয় সবসময়। এই রোগ কিছুতেই সারে না। এর উপযোক্ত নিদান হল দু’ধারের গোঁফকেই কমিয়ে দেওয়া। তাই করি আজকাল।
এর আগে জানিয়েছি যে বাড়িতে থাকলে হনুমানত্ব ভর করে আমাকে। সেটা করেই থাকে। তার জন্য এখন আর বিশেষ সমস্যা হয় না। হনুমানটাকে আগে অন্য কেউ ভেবে মুশকিলে পড়ে যেতাম। হনুমানটা আসলে আমি বোঝার পর হনুমানাইটিস রোগটা আর ঝামেলা করে না। তাছাড়া আমার দৈনন্দিন কাজকর্মের সঙ্গে আমাকে ভর করে থাকা হনুমানের কোন বিরোধ নেই, সে শুধু আমি যে কাজ করতে চাই সেটা তার মত করে করিয়ে নেয়। আমি দাড়ি কাটব না স্নান করব সেটা আমার সিদ্ধান্ত, কিভাবে করব সেখানে সে নিজের মতামত ব্যক্ত করে। তাছাড়া দেখেছি, সে যে কাজ করতে দেয় না সেটা আমার পক্ষে করা সম্ভবও হয় না। এখন বুঝতে পারি, হনুমানটা আমার চেয়ে অনেক বেশি প্র্যাকটিক্যাল। হনুমানাইটিস রোগকে তাই আশীর্বাদই মনে হয়।
জামাজুতো পরে ফিটফাট হয়ে সেজেগুজে বাড়ি থেকে বার হলাম। কসমোপলিটান বিল্ডিঙে যাওয়ার কথা ছিল। ওখানে একটা এনজিও-র অফিসে দেখা করা বিশেষ দরকার। সকালে গেলেও হবে না, দুপুরের পর গেলেও নয়। কে এক উদ্ভিন্নবাবু বলে লোক আছে, তার হাতে অনেক ক্ষমতা। তার সঙ্গেই দেখা করতে হবে আমাকে তার সময় অনুযায়ী। তো আমি অফিসে পৌঁছে গেলাম বেলা বারোটার মধ্যেই।
ঝাঁ চকচকে অফিস। লবিটা বেশ বড় আর সুসজ্জিত। স্লিপ ধরিয়ে সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। লবির খানিকটা দূরেই দেখলাম সেই উদ্ভিন্নবাবুর চেম্বার। অফিসের লোকরা যাতায়াত করছিল। বুকে নেমকার্ড আর বিশেষ ইউনিফর্ম সবার গায়ে। বাইরের অনেক লোককেও দেখতে পেলাম। কিন্তু অফিসের কিছু কিছু লোক কেন আমার দিকে বিশেষ নজরে তাকাচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না। এদের অফিসে আমি আগে কখনও আসিনি, কারো সঙ্গে দেখাও হয়নি কোনদিন। তবু কেন ঐরকম অদ্ভুত দৃষ্টি ? অস্বস্তি হলেও চুপচাপ বসেই রইলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক পড়ল আমার। ঢুকলাম চেম্বারে। বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপ্রান্তে ঘোরানো চেয়ারে কোট-টাই পড়া নীলাম্বরমার্কা চেহারার উদ্ভিন্নবাবু বসে আছে। আমাকে দেখেই লোকটা মহা উত্তেজিত হয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল,
‘তুমি আবার এসে হাজির হয়েছ? তোমাকে বহুবার বলেছি যা ফয়সালা হওয়ার কোর্টে হবে। তবু কেন আবার এসেছ? কোন্ সাহসে?’
আমি কেমন হকচকিযে গেলাম। জন্মে দেখা হয়নি লোকটার সঙ্গে, এসব কী বলছে ! সেই কথাটা বলতে গিয়ে দেখি বলে বসলাম অন্য কথা।
‘তুমি আমার টাকাটা দাওনি কেন? টাকা না দিলে ঘানি ঘুরিয়ে ছাড়ব।’
এসব কী কথা বলছি নিজেই বুঝলাম না। উদ্ভিন্ন আরও খেপে গেল। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে হম্বিতম্বি করে বলল,
‘গেট আউট। দেব না টাকা। যা পারবে কর। বেরিয়ে যাও বলছি।’
‘তোমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ব, বলে গেলাম।’
সমান তালে কে যেন আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিল কথাগুলি। উদ্ভিন্ন রাগে লাফাতে লাফাতে বলল,
‘আই সে, গেট আউট। যাবে, নাকি সিকিউরিটি ডাকব?’
ঘরে আরও দু’-তিনজন লোক ছিল। হৈ চৈ শুনে আরও কয়েকজন চেম্বারে এসে হাজির হয়েছে। সবাই মিলে উদ্ভিন্নকে শান্ত করতে চাইছে। তাদের কেউ কেউ আমাকে এসে নরম গলায় বলল,
‘ম্যাডাম, প্লিজ, এখান থেকে চলে যান।’
যা রে বাবা, ম্যাডাম বলছে কেন আমাকে? যাই হোক, চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম। নিজের ওপর নিজেরই নিয়ন্ত্রণ নেই। নিজেকেই নিজে বুঝতে পারছি না। বাইরে এলাম পর অফিসের লোকরা আবার আমাকে বলল,
‘আপনি চলে গেলেই ভাল হয় ম্যাডাম, প্লিজ। সাহেব খুব রেগে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা আপনার জন্যও ভাল হচ্ছে না।’
একের পর এক লোক এসে আমাকে ম্যাডাম-ম্যাডাম বলে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল। তাদের কথা শুনে বুঝলাম, আমাকে সবাই উদ্ভিন্নর বউ বলে ভাবছে যার সঙ্গে ডিভোর্সের মামলা চলছে লোকটার। অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে দরজার কাচে নিজেকে দেখে নিজেই চমকে গেলাম। সত্যিই আমি এক মহিলা হয়ে বসে আছি।
এ আবার কী বেয়াক্কেলে বিপদ? বাড়ি থেকে তো বেরিয়েছিলাম আমি হিসেবেই, নিখাদ পুরুষ। হঠাৎ মহিলা হতে গেলাম কেন? তাও হয়ে গেলাম কিনা ওই উদ্ভিন্নর বউ! পুরুষ থেকে এভাবে নিজের অজান্তে মহিলা হয়ে যাওয়ার জন্য আমি কোনমতেই দায়ী নই। কেবল গোঁফদাড়ি কামিয়েছিলাম। তার জন্য পুরুষ থেকে মহিলা হয়ে যাব? সে তো প্রায় রোজই কামাই। গোঁফদাড়ি কামালেই যদি মহিলা হয়ে যাই তো ভাল হাঙ্গামা!
রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ঘোরলাগা অবস্থা। কে চালাচ্ছে কে বলাচ্ছে কিছুই জানি না। এখন মহিলা না পুরুষ কী হিসেবে আছি তাও পরিষ্কার ছিল না নিজের কাছে। ভয় পাব না ভিরমি খাব তাও মাথায় ঢুকছিল না। তবে আমি আসলে কে সেই বোধটা দেখলাম বজায় আছে। সব লোকরা কি এমন দুর্দশায় পড়ে?
কিছুক্ষণ পর কোথাও গিয়ে একটা হাজির হলাম। রাস্তাতেই আছি, ফুটপাথ ধরে চলছি। বড় রাস্তা নিঃসন্দেহে, গাড়িটাড়ি যাচ্ছিল পুরোদমে। তবে খুব যে বেশি লোকজন ছিল এমন নয়। দোকানপাটও খুব একটা খোলা নেই। আজ কী বার কে জানে? সব এমন ফাঁকা-ফাঁকা কেন? কোথায় এসে গেলাম? কে আমাকে চালাচ্ছে তার মর্জিমত? যা বলছি তাও নিজের ইচ্ছেতে নয়। এইযে যেখানে খুশি চলে যাওয়া, যা-তা কথা বলে ফেলা, এসবই তো আমার সমস্যা ইদানীং।
রাস্তার ধারে একটা পার্ক রয়েছে দেখলাম। যেতে যেতে দেয়ালের গায়ে একটা পোস্টার সাঁটা রয়েছে দেখতে পেলাম। সেই পোস্টারে মধ্যবয়স্ক গোলগাল এক ব্যক্তির আবক্ষ ছবি। তলায় বড় বড় করে লেখা, ‘দুলাল দাসকে দেখতে পেলেই ধরিয়ে দিন’। সাদাকালো পোস্টার, কারা দিয়েছে বোঝা গেল না। দুলাল দাস লোকটাকে ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে জনগণকে, লোকটা নিশ্চয় কিছু গর্হিত কাজ করেছে। যেতে যেতে এমন পোস্টার আরও কয়েকটা দেখা গেল। কৌতূহল জাগলেও কাউকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম না। আবার কোন্ বিপদে জড়িয়ে যাই ভয়ে।
কিন্তু আমি না চাইলেও বিপদ আমাকে নিস্তার দেয় না। পার্কটা ছাড়িয়ে খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পরই হঠাৎ কয়েকজন লোক আমাকে ঘিরে ধরল। দেখে মনে হল তারা স্থানীয় বাসিন্দা। লোকগুলি আমাকে ঘিরে ধরে সোল্লাসে ‘পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে’ চিৎকার করতে লাগল। আমি তখনও জানি না কী পাওয়া গেছে। কয়েকজন এসে শক্ত করে আমার হাত পাকড়ে ধরল। একজন বলল,
‘খুব তো চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে চাঁদ। সেই ধরা পড়তেই হল। চল, এবার দেখি কে তোমাকে বাঁচায়।’
আমার কী করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। তবে কিছু একটা প্রতিবাদ করা দরকার ছিল। জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল কেন আমাকে এসে ধরছে তারা। অবশ্য চুপ করে থাকলাম না আমি, বললাম কিছু। তবে যা বললাম তা বলব বলে ভাবিনি। কেউ আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিল,
‘মা কালীর দিব্যি, আমি কিছু জানতাম না। গোপেনদা আমাকে যা বলেছিল তাই করেছি। আমাকে মিছিমিছি ধরছ কেন তোমরা? গোপনদাকে ধর।’
আমি নিজেই জানি না গোপেনদাটা কে। লোকগুলি বলল,
‘এতগুলো লোককে পথে বসিয়ে এখন গোপেনদার দোহাই দিচ্ছ? চল, আজ তোমার ব্যবস্থা হবে, তারপর অন্য কথা।’
সবাই মিলে আমাকে পাকড়ে ধরে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছিল। চেঁচামেচি করে বলছিল তারা,
‘দুলাল ধরা পড়েছে।’
এবার বুঝলাম, আমি দুলাল দাস হয়ে বসে আছি। সেই পলাতক দুলাল দাস, যার পোস্টার পড়েছে রাস্তায়। ছিলাম তো এক মহিলা, সেই উদ্ভিন্নর বউ, সেভাবেও থাকা তো মন্দ ছিল না। মরতে দুলাল হয়ে গেলাম কেন বা কখন? এই যে আমার ঘন ঘন চেহারা পরিবর্তনের রোগ, এ তো আমাকে প্রতিকূল পরিবেশ থেকে রক্ষা করে বলেই জানতাম। এখন দেখছি, রোগটা বিপদে ফেলে দিচ্ছে। অবশ্য আগেও যে বিপদে ফেলেনি এমন নয়, তবে যথাসময়ে চেহারা পাল্টিয়ে বিপদ থেকে আবার বাঁচিয়েও দিয়েছে। কিন্তু গোড়া থেকেই ঝামেলায় পড়ব এমন কোন বিপজ্জনক চেহারা পেতে অভ্যস্ত ছিলাম না এতদিন। এবার অন্যরকম অভিজ্ঞতা হচ্ছে। বাড়িতে থাকলে হনুমান হয়ে থাকছি আর বাইরে গেলেই এমন সব চেহারা পেয়ে যাচ্ছি যা আক্রমণের শিকার হতে পারে। এমন হতে থাকলে খুবই মুশকিল। গণধোলাই খেয়ে কখন না পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটে! এখন তেমনই এক অবস্থায় পড়েছি। এখান থেকে উদ্ধার পাব কোন্ বুদ্ধিতে?
লোকগুলি আমাকে টানতে টানতে আর গলা ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে চলল কোথাও। হৈ চৈ করছিল সবাই। দেখতে দেখতে লোকজন আরও জুটে যেতে লাগল। সব মারমূখী জনতা। বোঝা যাচ্ছিল, এই দুলাল দাস লোকটা এদের সবারই কিছু না কিছু ক্ষতি করেছে। এদেরকে বোঝাব কী করে যে আমি সত্যিই দুলাল দাস নই। চেহারাটা হয়ে গেছে তার মত। আসলে এটা আমার একটা অসুখ। কিন্তু মুশকিল হল, আমি দুলাল দাস নই, এ কথাটা বলতেও পারছিলাম না। কে যেন আমাকে দিয়ে এমনসব কথা বলিয়ে নিচ্ছিল যা বোধহয় আসল দুলাল দাসই বলত। আমি আমার নিজের কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ফলটা হল মারাত্মক। একেতেই দেখতে হয়ে গেছি দুলাল দাস, কথাগুলিও বলছিলাম তার মত, লোকরা আমাকে আর অন্য কেউ কিনা ভাবতে গেলই না। তেমন ভাবার অবশ্য কোন সুযোগও ছিল না তাদের, দোষ দিয়ে লাভ নেই। জলজ্যান্ত দুলাল দাস হয়ে বসে আছি যে আমি!
আমাকে সবাই নিয়ে গেল একটা ক্লাবঘরে। সেখানে নিয়ে গিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধল। প্রচুর জমায়েত হতে লাগল। উত্তেজিত কথাবার্তা সবার।
‘কালুদা, শিবুদাকে খবর দে।’
‘বাড়িতে লোক গেছে। এসে পড়বে এখনই।’
‘ততক্ষণ ব্যাটাকে বেঁধে রাখ্।’
‘আমরা সবাই থাকব এখানেই। নজর রাখতে হবে, যেন পালাতে না পারে।’
কিছুক্ষণ পরই কালুদা আর শিবুদা এসে হাজির। ক্লাবঘর ইতিমধ্যেই লোকে লোকারণ্য। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হল। আত্মপক্ষ সমর্থন করে কোন কথা বললেই চোখ রাঙানি আর হুমকি। তাদের পছন্দসই কথা বলতে হচ্ছিল বাধ্য হয়ে। এটুকুই বুঝতে পারলাম যে আমি কোন এক চিটফান্ডের নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রচুর টাকা তুলেছি। তারপর সে চিটফাণ্ডে লালবাতি জ্বলতেই আমি পালিয়ে আছি। লোকের টাকা মেরে চিটফান্ড লাটে উঠে গেছে, কোর্টে কেস চলছে। যারা টাকা দিয়েছে তারা কেউ মামলা না মিটলে কিছুই ফেরত পাবে না। এখন তাই সব রাগ আমার ওপর, মানে দুলাল দাসের ওপর। আমি মরতে দুলাল দাস হলাম কেন গড নোজ।
ঘন্টাখানেক ধরে আমাকে জেরা করা হল। কেউ কেউ উত্তম-মধ্যম দিতে যাচ্ছিল, কালুদা আর শিবুদা সামলাল। টাকা যে আমি কাউকে মিটিয়ে দিতে পারব না এটা স্পষ্ট হয়ে গেল সবার কাছে।
‘এখন এটাকে নিয়ে কী করব ?’
এই প্রশ্নটাই মুখ্য হয়ে উঠল তাদের। একদল বলল,
‘ব্যাটাকে ছেড়ে দাও আমাদের হাতে। ওর ব্যবস্থা আমরাই করব।’
অন্য আরেকদল বলল,
‘পুলিশের হাতে তুলে দাও। জেলে গিয়ে ঘানি টানুক।’
আলোচনার পর ঠিক হল, আপাতত আমাকে অর্থাৎ দুলাল দাসকে ক্লাবঘরেই আটকে রাখা হবে। পুলিশের হাতে দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবটা সবাই মেনে নিল, তবে তার আগে পাড়ার কাউন্সিলর হরিবোল গোঁসাইকে ডেকে এনে আমার আরেকদফা বিচার চলবে।
আমাকে দরজাবন্ধ ক্লাবঘরে আটকে রেখে চলে গেল সবাই। হাত যেমন পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল তেমনই রইল। কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম যে বাইরে থেকেও সতর্ক নজর রাখা হবে যাতে পালিয়ে না যাই। খিদে পেয়েছিল, তেষ্টাও। লোকগুলো কালুদা আর শিবুদার কথামত এক বোতল জল আর দু’টো রুটি খেতে দিল। হাউ-হাউ করে তাই খেয়ে নিলাম। সবাই তারপর দরজাবন্ধ অন্ধকার ক্লাবঘরে আমাকে বেঁধে রেখে চলে গেল। ব্যাপারটা মোটেই আমার জন্য রমণীয় বা নান্দনিক নয়। এখন মুক্তির কী উপায়?
নানারকম চেহারা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা দেখছি বিপদই ডেকে আনছে। এরকম হতে থাকলে দুর্দশার অন্ত থাকবে না। ইচ্ছে হোক বা না হোক, পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। কোন্ ফর্মুলা মেনে কখন কী বা কে হয়ে যাব তার কোন আন্দাজও পাচ্ছিলাম না। পেলে নাহয় চেষ্টা করে দেখতাম নিজেকে অন্য কিছু হওয়া থেকে আটকানো যায় কিনা। ঘরে থাকলে হনুমানাইটিস আর বাইরে গেলে এনিথিংগাইসিস, এমনই প্রবল রোগের শিকার হয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত।
বিকেল হওয়ার একটু আগেই লোকরা সবাই দল বেঁধে আবার ক্লাবঘরে এসে হাজির। কালুদা, শিবুদা ও ক্লাবের অন্য সব সদস্যরা। সঙ্গে নিয়ে এল তারা স্থানীয় কাউন্সিলর হরিবোল গোঁসাইকে। এলাকার লোকজনও এল অনেকেই। সবার গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম আমি।
‘খোল্, দরজাটা খুলে দে।’
‘ক্লাবের ভিতরেই বসা যাক, কী বল হরিবোলদা ?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভিতরেই বসো। আপনারা ভিড় করবেন না।’
দরজা খুলে গেল। হুমড়ি খেয়ে ঢুকতে চাইল সবাই ভিতরে। তারপরই একটা সমবেত আর্তনাদ শুনতে পেলাম,
‘পালিয়েছে, পালিয়েছে। দুলাল ভেগেছে।’
‘বলিস কী! পালাল কী করে?’
‘বেঁধে রেখে যাওয়া হয়েছিল ব্যাটাকে। ক্লাবের দরজাও তো বন্ধ ছিল।’
‘এ তো ভোজবাজি। গেল কোথায় ব্যাটা?’
মহা শোরগোল শুরু হল। আমি নিজেও ব্যোমকে গেছি। জলজ্যান্ত দড়িবাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি সবার সামনে, অথচ সবাই নেই বলছে কেন? এমন নেই হয়ে যাওয়া তো ভাল লক্ষণ নয়। ব্যাপারটা যদিও আমার অনুকূল তবুও প্রতিবাদ না করে পারলাম না। লোকগুলো কেন আমাকে দেখেও দেখতে পাচ্ছে না? চি-চি করে জানাতে গেলাম,
‘পালাই নি। এইতো আমি।’
কিন্তু নিজের গলার আওয়াজ নিজের কানেই কেমন বিজাতীয় শোনাল। স্পষ্ট মনে হল, আমার মুখ দিয়ে যে কথাগুলি বার হল সেগুলি কোন মানুষের ভাষা নয়। লোকরা সবাই হৈ হৈ করে উঠল,
‘আরে, আরে! কুকুরটাকে এখানে বেঁধে রাখল কে? তাড়িয়ে দে, তাড়িয়ে দে।’
ব্যাপারটা তখন বুঝতে পারলাম। মোক্ষম সময়ে আমার চেহারাটা পাল্টে একটা কুকুর হয়ে গেছে। অর্থাৎ দুলাল দাস, মানে আমি এখন একটা কুকুর। সবাই আমার বাঁধন খুলে দিয়ে দূর্-দূর্ করে তাড়িয়ে দিল। ছাড়া পেয়েই আমি লেজ তুলে লম্বা এক দৌড়। যাওয়ার আগে শুনলাম হরিবোল গোঁসাই সবাইকে বকাবকি করছে,
‘তোদের আক্কেল বলিহারি। একটা কুত্তা ধরে বলছিস দুলাল দাসকে ধরেছিস। তোদের হলোটা কী? মানুষ আর কুকুর চিনিস না? প্রোমোটার ঝান্ডু শর্মার সঙ্গে অ্যাপো ছিল। তোদের জন্য মিটিংটা ক্যানসেল করতে হল। কী বিশাল ক্ষতি হয়ে গেল তোদের আইডিয়া আছে?’
আমি আর দাঁড়ালাম না। খোলা রাস্তা ধরে ছুট লাগলাম। ত্রিসীমানাতে আর কেউ থাকে? অনেকটা দূর হেঁটে যাওয়ার পর ফুটপাথে দাঁড়িয়ে জিভ বার করে শ্বাস নিতে লাগলাম। যা ফাঁড়া কাটল, বাপ্ রে বাপ্! জিভটা অবশ্য নিজের ইচ্ছেতেই বার করেছিলাম, কারণ তখনও মাথায় একথাটা ঘুরছিল যে আমি একটা কুকুর। অতএব এতটা ছোটার পর আমার জিভ বার করাই উচিত।
রাস্তা ধরে প্রচুর গাড়িঘোড়া যাতায়াত করছিল। ফুটপাথের এক নিরাপদ কোণায় দাঁড়িয়ে জিভ বার করে হাঁপাতে হাঁপাতে দেখছিলাম সব। সামনেই ছিল জঞ্জালভর্তি কর্পোরেশনের এক ভ্যাট। কুকুর হিসেবে আমার ওই ভ্যাটে গিয়ে আবর্জনা হাটকানো উপযুক্ত কাজ। যাব কি যাব না ভাবলাম দু’দণ্ড। জঞ্জাল ঘাঁটার কথা মনে হতেই কেমন গা গুলিয়ে উঠল। এটা তো কুকুরসুলভ প্রবৃত্তি নয়? কেন এমন হচ্ছে ভাবছিলাম, হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়াল একটা পুলিশের গাড়ি। বেশ ক’জন পুলিশ নেমে এল চোখের পলকে। তারা সবাই বন্দুক উঁচিয়ে ঘিরে ধরল আমাকে। রিভলবার হাতে এক অফিসার এসে হাঁক দিল,
‘হ্যান্ডস্ আপ।’
এ আবার কোন্ নতুন বিপদ? পুলিশরা কেন একটা কুকুরকে পাকড়াও করতে যাবে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, একটা কুকুর হাত তুলবে কী করে! বলতে গেলাম সেই কথা, বলতে গিয়েও থেমে গেলাম এই কারণে যে কুকুরের ভাষায় যা বলব তা তো এই পুলিশগুলি বুঝবে না। অতএব কিছু না বলে নিজে কুকুর হওয়া সত্বেও সামনের দু’টো পা তুলতে চেষ্টা করলাম হ্যান্ডস্ আপ হওয়ার জন্য। এবং দেখলাম, দিব্বি দু’ পা তুলে ফেলতে পারছি। তখন বুঝলাম, কোন্ ম্যাজিকে আমার সামনের পা দু’টো হাত হয়ে গেছে। পুলিশরা ছুটে এসে আমার দু’হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিল। পুলিশ অফিসারটা রিভলবার কোমরে গুঁজে মোবাইল ফোনে কাউকে বলছিল,
‘হ্যাঁ স্যার, হুজ্জুতি মোল্লাকে এইমাত্র হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেছি। না স্যার, ব্যাটা বাধা দেয়নি। ওর কাছে ডেঞ্জারাস কোন ওয়েপনও নেই।’
আমি ততক্ষণে অবাক হতেও ভুলে গেছি। কেবল এটুকুই বুঝলাম যে কুকুর থেকে আমি কোন একসময় আবার মানুষ হয়ে বসে আছি। আর ছাপোষা কোন মানুষ নয়, ক্রিমিনাল-টিমিনাল জাতীয় কিছু। পুলিশগুলো আমাকে টেনেহিঁচড়ে ভ্যানে তুলল। গাড়ি ছুটল নিশ্চয় কোন থানার উদ্দেশ্যে। সারা রাস্তায় পুলিশগুলোর কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম যে হুজ্জুতি মোল্লা এক ভয়ানক সন্ত্রাসবাদী। বেশ কিছু খুন-জখম আর সন্ত্রাসমূলক কাজকর্ম করে চলেছে সে বিগত কয়েক বছর ধরে। তাকে ধরার জন্য মরীয়া হয়ে গিয়েছিল পুলিশ। আমি এখন হয়ে গেছি সন্ত্ৰাসবাদী সেই হুজ্জুতি মোল্লা।
এইযে আমার চেহারা পাল্টে যাওয়ার বদভ্যাস, এতো দেখছি বিপদেই ফেলে দিচ্ছে আমাকে। খামোখা কেন আমাকে দাগি সন্ত্রাসবাদী বানিয়ে পুলিশের খপ্পরে ফেলে দিল? একটু আগে বানিয়ে দিয়েছিল টাকা মেরে দেওয়া দুলাল দাস। অবশ্য সেই বিপদ থেকে উদ্ধারও ঘটেছিল অন্য এক চেহারার দৌলতে। এখন এই সন্ত্রাসবাদী হুজ্জুতি মোল্লা পুলিশের খপ্পর থেকে বাঁচবে কিভাবে?
আমাকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যাওয়া হল। কড়া পাহারায় রেখে একের পর এক জিজ্ঞাসাবাদ চলতে লাগল। ছবি তোলা হল প্রচুর। বাঘা বাঘা অফিসাররা পড়ল আমাকে নিয়ে। যতই জিজ্ঞাসা করা হোক না কেন কে যেন আমাকে দিয়ে বলিয়ে গেল,
‘আমি দশকর্মা সাঁপুই। তেঁতুলগাছায় বাড়ি। আনাজপাতি বেচে খাই। আমার তিন ছেলে, এক মেয়ে আর এক ইস্তিরি হুজুর। হুজ্জুতি মোল্লাকে বাপের জন্মে চিনি না।’
পুলিশের হেফাজতে থাকতে হল দু’দিন। তৃতীয়দিনে এক ডাকসাইটে অফিসার কয়েকজন কনস্টেবলকে সঙ্গে করে এল আমার কাছে। বলল,
‘ছেড়ে দাও ওকে। ও সত্যিই দশকর্মা সাঁপুই। খোঁজ নিয়ে দেখেছি। থাকে তেঁতুলগাছাতেই। সবজি বেচে সংসার চালায়। একে ধরে আনল হুজ্জুতি মোল্লা বলে। অকর্মার ঢেকি সবক’টা। ছেড়ে দাও বেচারাকে।’
অতএব আমি মুক্তি পেলাম।
প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas magazine
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)