তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
অধ্যায় : বারো
কী যেন একটা উড়ে আসছিল, অনেকটা ওপর দিয়ে। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখতে হচ্ছিল। তেমন গা করিনি। আকাশটা কতকিছু উড়ে যাওয়ার জন্য খোলা পড়েই আছে, সেই কোন্ জন্ম থেকে। যেটা উড়ে যাচ্ছিল প্রথমটায় ভাবলাম, প্লেন-টেন হবে কিছু। তারপর খেয়াল হল, আওয়াজ করছে না তো। তাহলে প্লেন হবে না। কোন পাখি হবে নিশ্চয়। অত উঁচুতে উড়ছে যখন চিল কিংবা বাজে হবে। শকুন হলেও হতে পারে। ওড়াউড়ি নিয়ে অহেতুক এত মাথা ঘামানোর কী দরকার ? ভেবে ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাইলাম। তখনই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল যা ঘটবে বলে ভাবিনি।
উড়ে আসছিল যে জিনিসটা ক্রমশ সেটা কাছাকাছি হতে লাগল। বড় বড় তার পাখনা, সপাটে ঝাপটা মারছিল একসঙ্গে। উড়তে উড়তে এসে পড়ল আমারই মাথার ওপর। তারপর চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসতে লাগল। মাটির ওপর আমার একেবারে সামনে নেমে এসে দাঁড়াল। তখন বুঝলাম, ও হল ঢোলগোবিন্দ। হাড়িয়াপট্টিতে থাকে, ঝোলাগুড় তৈরির কারখানা আছে। তিন মেয়ে আর এক ছেলের বাপ। মেয়ে তিনটি একই স্কুলে একই ক্লাশে পড়ে এবং একই রিকশায় যাতায়াত করে, যদিও তাদের বয়স এক নয়। তার ধান্দা ছিল ছেলেটিকেও একই স্কুলে মেয়েদের সঙ্গে একই ক্লাশে ভর্তি করে দিয়ে একই রিকশায় যাতায়াতের জন্য তুলে দেওয়ার। উদ্দেশ্য সফল হয়নি মেয়েদের স্কুলের বড় দিদিমনি রাজি না হওয়ায় এবং গজু রিকশাওয়ালা বেঁকে বসায়। তিন-তিনটে মেয়েকে একসঙ্গে রিকশায় চাপিয়ে নিয়ে যেতে বেচারা তার সিটে বসে প্যাডেল মারতে পারে না, আবার দিনে দু’বার করে রিকশার তিন চাকায় হ্যান্ডপাম্প দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাওয়া ভরতে ভরতে সে এমনিতেই নাজেহাল, তার ওপর চার নম্বর সওয়ারি চাপলে তার ছিদ্দতের শেষ থাকবে না। তাকে তখন রিকশা টানার জন্য তার সঙ্গে আর একটা হেলপার রাখতে হবে যা খরচে কুলোবে না। আর বড় দিদিমনি জানাল, মেয়েদের স্কুলে ছেলে ভর্তি করলে অন্য সব ছেলেরা দল বেঁধে ভর্তি হতে এলে সে কাউকে ফেরাতে পারবে না আর এই চক্করে তার মেয়েদের স্কুল একসময় ছেলেদের স্কুল হয়ে গেলে মহাবিপদ। স্বভাবতই তখন ছেলে টিচাররাও আসতে শুরু করলে মেয়ে টিচারদের চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। এইসব যুক্তি ঢোলগোবিন্দের পছন্দ হয়নি, না হলেও তাকে মেনে নিতে হয়েছিল। সে প্রায়ই আমার কাছে এসে সখেদে জানাত, তার ঝোলাগুড় তৈরির কারখানাতে আর তেমন রমরমা নেই। ঝোলাগুড় বিক্রি করে আজকাল তত মুনাফা হচ্ছে না, ঝোলাগুড়ের ব্যবসাটা ক্রমশ ঝুলে যাচ্ছে। লোকেরা আর ঝোলাগুড় খেতে চায় না। পাঁউরুটির সঙ্গে ঝোলাগুড় আর তেমন রোচে না লোকের মুখে। বাটার এসে গেছে, আর কী সব জ্যাম-জেলি-চীজ-মেয়োনিজ ইত্যাদি আজব উপাদান। এসব দুঃখের কথা হরহামেশা শোনায় সে আমাকে। আমিও বেশ দরদ দিয়ে শুনি। ঢোলগোবিন্দ তার দুঃখের কথা আমার কাছে বলে বেশ তৃপ্তি পায়। অবশ্য যতটা গলা শুকায় ততটা দুর্দশা নয় তার। বেশ ঝানু ব্যবসায়ী। টাকাপয়সাও কম নেই। কাউকে দেবে না একপয়সা, লোকের মাথায় হাত বুলিয়ে আদায় করতে ওস্তাদ। সবাই তাই বলে। আমারও মনে হতো, লোকের কথা খুব একটা অবিশ্বাস করার মত নয়। সেই ঢোলগোবিন্দ উড়তে শিখল কবে ? কবেই বা তার আবার পাখনা গজাল ?
ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম আমার বাড়ির সামনে। অলস পায়ে। বিশেষ কোন কাজকর্ম ছিল না। ঢোলগোবিন্দ উড়ে এসে সামনে দাঁড়ানোতে হাঁটা বন্ধ হয়ে গেল। বেশ উৎসুক হয়ে পড়লাম। এমনিতে তার সঙ্গে হাটে-বাজারে, রাস্তায়-ঘাটে দেখা হয়। তার কারখানাতেও গেছি কয়েকবার। স্বাভাবিক ছিল চলাফেরা। ওড়াউড়ি করতে দেখিনি কোনদিন। হঠাৎ সে কী মতলবে হাঁটাচলা বাদ দিয়ে উড়ে বেড়াতে শুরু করল জানার বেশ আগ্রহ হল।
অবতরণের পর সে ঝেড়েঝুড়ে পাখাগুলি গুটিয়ে রাখল। তেমন কোন পরিবর্তন দেখতে পেলাম না তার মধ্যে, কেবল পিঠে ওই একজোড়া ডানা গজিয়েছে। তাতে চোখমুখ, চলন-বলন কিছুই পাল্টে যায়নি। মানুষটা আমার মনে হল যেমন ছিল তেমনই আছে। ডানা গজালে কারো কি চরিত্র পাল্টে যায়? জানা ছিল না। লোকেরা বলে, পিঁপড়েদের ডানা গজালে তারা মরবে বলে ধরে নেওয়া হয়। সেই নিয়ম মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি?
আমার দিকে তাকিয়ে ঢোলগোবিন্দ একগাল হাসল। তারপর বিশেষ কোন ভূমিকা না করে জানাল,
‘আপনার বাড়িতে থাকব। ওইজন্যই আসা। দেখি চলুন, কোন্ ঘরটায় থাকলে আমার সুবিধে বেশি দেখে নিতে হবে। এ তো আর এক-দু’দিনের মামলা নয়। বরাবরও থেকে যেতে পারি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। আমি আবার যেমন-তেমন থাকতে পারি না। পছন্দসই না হলে আমার থাকাটা মুশকিল।’
শুনে আমার পিত্তথলিতে আলোড়ন উঠল। বলে কী লোকটা? নিজে মরছি হাজারটা সমস্যায়। একগাদা অসুখ-বিসুখ ঘিরে রেখেছে আমাকে। ভুগে ভুগে হতাশ। তার ওপর, ঠিক মানুষ খুঁজে পাচ্ছি না একজনও। এই আবহাওয়ায় কেউ আমার বাড়িতে এসে থাকার আবদার করবে মানতে পারি? একদমই না। প্রবল আপত্তি ছিল ভিতরে। লোকটাকে তখনই আমার পত্রপাঠ বিদেয় করার কথা। রুক্ষভাবে বিদেয় করা উচিত ছিল। পরিবর্তে বিনয়ের গলায় বললাম,
‘থাকবেন সে আমার সৌভাগ্য। তবে আমি থাকি বাড়িতে কষ্টেসৃষ্টে। আপনার পক্ষে এমন পরিবেশে থাকা সম্ভব কিনা ভাবছি।’
অনিচ্ছাটা ঘুরিয়ে প্রকাশ করলাম। ওই যে কী যেন একটা নেই আমার মধ্যে তার জন্যই যত বিপত্তি। সোজাকথাটা সোজাভাবে বলতে পারি না। ঢোলগোবিন্দ আমল দিল না আমার কথায়। অনুমতির পরোয়া না করেই বাড়ির ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলল,
‘উপায় নেই। যেমনই পরিবেশ হোক আমাকে থাকতে হবে। মানিয়ে নেব, ভাবতে হবে না আপনাকে।’
লোকটা ঢুকে গেল বাড়িতে। আমি তাকে আটকাবে কী, ঘরদোর দেখাতে লাগলাম। তার পছন্দ হলে যেন বর্তে যাব। দেখে দেখে সে নাক সিঁটকায় আর আমাকে কথা শোনায় ঘরদোর অগোছালো করে রাখার জন্য। আমি অপরাধীর মত মুখ করে ঘুরি তার পিছন পিছন। দেখেশুনে সে আমার শোবার ঘরটাকেই নিজের জন্য বাছাই করে নিল।
একেই বলে উড়ে এসে জুড়ে বসা। আমার নিজের বাড়ির নিজের শোবার ঘর, সেখান থেকে নিজেই উৎখাত। ঢোলগোবিন্দ জাঁকিয়ে বসে নানা ফরমায়েশ দেয় আর আমি তটস্থ থাকি তার জন্য। ভিতরে অদম্য ইচ্ছে দাপাদাপি করে, ঘাড় ধরে আপদটাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেই হয়। কিন্তু তেমন করতে পারলে তো হয়েই যেত। ওই জোরটাই তো খুঁজে পাই না। কিছুর যে একটা অভাব আছে তা তো পদে পদে বুঝতে পারি।
আমার তখনই সাবধান হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। জগতে উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকের কি অভাব ? সবাই সুযোগ পেলেই উড়তে চায়। উড়ে বেড়ানো সব মানুষের একটা সুপ্ত বাসনা। উড়তে পারলেই হল, সব ঝামেলা ভুলে থাকা যায়। সংসারে আবদ্ধ হয়ে থাকার অবসাদ থেকে মুক্তি। ডানা মেলতে চায় তাই সবাই। আকাশটা পরিষ্কার। উড়ে বেড়াতে জানলে ট্রাফিক জ্যামের হাঙ্গামা নেই। যত খুশি উড়ে বেড়াও, কেউ তোমাকে খোঁচাবে না। তবে একনাগাড়ে উড়ে বেড়াতে বেশিক্ষণ ভাল লাগবে না। সারাজীবন কেউ কি উড়ে বেড়ায়? পাখিরাও নয়। তারাও একসময় কোথাও গিয়ে বসে। মানুষের ক্ষেত্রেও ঘটে তেমনটাই। উড়ে বেড়ানো মানুষের মনের গোপন বাসনা আর জুড়ে বসা তার স্বভাব।
ব্যাপারটা জানতাম না, ক্রমে তা বুঝতে পারলাম। দিন কয়েক পরই আবার উড়ে এল আরেকজন। আমি তখন বাড়ির উঠোনে আগাছা পরিষ্কার করছিলাম, ঢোলগোবিন্দের হুকুম মেনে। সে বলেছিল, ঘরে আগাছা থাকলে কেউ দেখতে পায় না বলে তত ক্ষতি নেই, কিন্তু বাইরে আগাছা রাখা চলবে না। সেই নির্দেশ মেনে কাজ করছিলাম। তখনই আমার সামনে উড়ে এসে হাজির হল নিত্যহরি। তাকে দেখতাম ভ্যান চালিয়ে হরেকমাল বিক্রি করে। সে আবার কেন উড়তে গেল? প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার অবকাশ পেলাম না। তার আগেই সে নিজের মনোগত বাসনা জানিয়ে বলল যে আমার বাড়িতে থাকবে বলে এসেছে। বলে আর অপেক্ষা করল না, সোজা ঢুকে গেল বাড়ির ভিতর। একটা ঘর দখল করে জুড়ে বসল।
তারপর একটা অকথ্য অবস্থায় পড়তে হল আমাকে। ঢোলগোবিন্দ আর নিত্যহরি কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। প্রত্যেকেই আমার ওপর হম্বিতম্বি করে আর বলে অন্যজনকে ভাগিয়ে দিতে। দুই আপদের ঝামেলা মেটাতে মেটাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। উড়ে এসে জুড়ে বসলো তো তাতেই সন্তুষ্ট থাক, অত বায়নাক্কা কেন? দুটোকেই ঘাড়ধাক্কা মেরে বার করে দেওয়ার কথা মনে একাধিকবার এলেও সাহসে কুলোত না।
এখানেই যদি বিষয়টার ইতি ঘটতো তো কথা ছিল। ক্রমশ পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠল। দুর্বাদল, সত্যসাধন, শিউশরণ, ভূকৈলাশ, শিবপ্রসাদ এবং এমন অনেকে এক এক করে উড়ে এসে জুড়ে বসতে লাগল আমার বাড়িতে। তাদের কেউ হকার, কেউ হাবিলদার, কেউ চানাওয়ালা, কেউবা কোল্ড স্টোরেজের মালিক। আমি কাউকেই আটকাতে পারলাম না। আমার বাড়িটা ভেটরেখানা হয়ে গেল। আমার নিজেরই থাকার জায়গা নেই। সিঁড়ির তলায় থাকছিলাম কোনক্রমে, তাও এসে কেড়ে নিল বাড়ির দালাল ভজন সাউ। সারা বাড়ি সর্বক্ষণ গমগম করে লোকের ভিড়ে। নানারকম লোক সবাই। ভিন্ন ভিন্ন রুচিপছন্দ তাদের। তারা প্রত্যেকেই চায়, বাড়িটা হোক তার যেমন চাই। আমার বাড়ি অথচ আমারই কোন ভূমিকা নেই। তারা কেউ পাত্তাও দেয় না আমাকে। কারো সঙ্গেই কারো দেখি মতের মিল হয় না। এই নিয়ে সারাদিন অশান্তি চলতেই থাকে। সবার মধ্যে কেবল একটাই মিল, তারা সব উড়ে এসে জুড়ে বসা লোক। বীতশ্রদ্ধ হয়ে শেষে আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। বাড়ির দখল গেল। কে যে এখন বাড়ির মালিক কে জানে। এই মালিকানা নিয়েও নিশ্চয় তাদের মধ্যে ঝগড়া চলল।
বাড়িতে আর জায়গা নেই, রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াই। ঘুরতে ঘুরতে মাথায় এল, আমিই বা ওড়ার চেষ্টা করি না কেন। উড়তে জানলে চিন্তা নেই, কোন একটা জায়গায় একদিন ঠিক জুড়ে বসতে পারব। এই ভাবনাটা মাথায় আসার পরই আমি বেশ শান্তি পেলাম। ওড়া খুব একটা কঠিন কাজ নয়, সবাই পারলে আমিও পারব। সবাই যে ওড়ে এখন আর তাতে সন্দেহ নেই। জুড়ে বসে কি? সে পরে ভাবা যাবে। আগে তো উড়ি।
ওড়ার অনেক রকমফের আছে। সবাই সবরকমের ওড়া আয়ত্ত করতে পারে এমন নয়। কেবল উড়ে যাওয়াটাও নিঃসন্দেহে জটিল কাজ, তবে চেষ্টা করলে না পারার কোন কারণ নেই। এই যে দিনরাত উড়ে এসে জুড়ে বসছে লোকেরা, তাদের বেশির ভাগই সাধারণ নিয়মে ওড়ে। বৈচিত্র্য রয়েছে কম ক্ষেত্রেই। সেসব ওড়ার কায়দা জানে যারা সবাই ওস্তাদ লোক। তারা উড়ে কেবল স্থানান্তরেই যায় না, কেবল পাত্র পরিবর্তন করে না, কালকেও অতিক্রম করে যেতে পারে। আমার পক্ষে কি অতটা সম্ভব ?
এইসব ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতেই সময় চলে যাচ্ছিল। তখনও জানিনা উড়তে পারি কি পারি না। ওড়ার চেষ্টা করিনি আগে কোনদিন। টালবাহানা ছেড়ে সেই চেষ্টাটাই করা উচিত। বাড়ির পিছনে খোলা মাঠ, সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। মানুষ কিভাবে ওড়ে ? প্লেন যেভাবে অনেকটা দৌড়ে আকাশে ওঠে সেভাবে, নাকি এটা সাইকেল চালানো শেখার মত এক প্রক্রিয়া ? জিজ্ঞেস করব এমন কাউকে খুঁজে পেলাম না। আমার বাড়িতে জুড়ে বসা লোকগুলিকে অবশ্য জিজ্ঞেস করা যেত, কিন্তু তাদের ওপর এত বিরক্ত ছিলাম যে সামনাসামনি হওয়ার ইচ্ছে হল না। ওড়াটা কি শিখতে হয়, নাকি এমনি এমনিই হয়ে যায়? মাঠে কেন এসে হাজির হলাম তারও উত্তর পাচ্ছিলাম না। দুম করে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়েও সাহস পাচ্ছিলাম না। বেমক্কা পড়ে গিয়ে যদি হাত-পা-কোমর ভেঙে বসি?
আগডুম-বাগডুম ভেবে খোলামাঠে পায়চারি করছিলাম। হঠাৎ দেখি, হাঁটছি ঠিকই কিন্তু পা-গুলি নিশ্চল আছে। তারপর অবাক হয়ে দেখলাম, হাঁটছিলাম যে মাঠটায় সেটা তো নেই। আমার সামনে যে চারপাশ তার কোন সীমানা দেখা যাচ্ছে না। পাশ দিয়ে একটা-দু’টো মেঘ হুঁশ-হাঁশ উড়ে বেরিয়ে গেল। মাঠে আছি, হাতের নাগালে মেঘ থাকবে কেন? ভুতুড়ে ব্যাপার মনে হল। হতবাক হয়ে তদন্ত করতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। ও হরি, আমি তো উড়ে বসে আছি! ব্যাপারটা কিভাবে ঘটল মাথায় ঠেকল না। হাঁটাচলা করছিলাম তো মাঠে। কিভাবে কখন আকাশে উড়ে গেলাম? দেখি কী, ডানাও গজিয়ে গেছে দু’-দু’টো। এতকিছু যে ঘটে গেল নিজেই বুঝতে পারিনি। কিভাবে আকাশে উড়তে পারব, ওই নিয়েই তো ভেবে ভেবে পাগল হয়ে মরছিলাম। ওড়ার কোন চেষ্টাই করিনি। অথচ দেখছি, দিব্যি আকাশে উড়ে বসে আছি। তখন বুঝলাম, আকাশে ওড়ার জন্য চেষ্টার প্রয়োজন হয় না, ইচ্ছেটাই আসল। আকাশে উড়ব, এই ইচ্ছে প্রকাশ করলেই যে কেউ উড়ে যেতে পারে। তার জন্য রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব বা হরিদাস পাল, কোনোটাই হওয়ার দরকার নেই।
এত সহজে যখন উড়তে পারছি, উড়েই বেড়ানো যাক। মনের আনন্দে ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে ইচ্ছেমত ওড়াউড়ি করলাম। ওপর থেকে নিচে কয়েকবার গোঁত্তা খেয়ে নেমে আবার ওপরেই উঠে গেলাম। জগতের অবস্থান থেকে আমি অনেক ওপরে, নিচে পড়ে আছে মানুষের পৃথিবী ও তার সভ্যতা। এখান থেকে আমি সহজেই সব দেখে নিতে পারি। তার জন্য পয়সা দিতে বা টিকেট কাটতে হবে না। কেউ বলতেও পারবে না যে আমি কোন বেআইনি কাজ করছি, কারণ পৃথিবীর কোন দেশের সংবিধানে ডানাগজানো কোন জীবের, সে মানুষ হোক বা পাখি, আকাশে ওড়াউড়ির ব্যাপারে একটি কথাও বলা নেই। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জও এ-ব্যাপারে নীরব। আকাশে ওড়াটা যেকোন ডানাযুক্ত জীবেরই একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। মৌলিক অধিকার, জন্মসূত্রে পাওয়া। নাক-কান-মুখ-হাত-পায়ের মত ব্যাপার। কোন জীব হাত-পা চালিয়ে হাঁটাচলা করবে তাতে কার কী বলার থাকতে পারে ? যদি না সে কাউকে থাপ্পড় বা ল্যাং মারে। মানুষ মুখে কথা বললেও তো কারো কিছু আপত্তি করার থাকে না, যদি না সে কাউকে গালাগালি করে। তেমনি ডানাযুক্ত মানুষ উড়ে বেড়ালে আপত্তি জানাবার কোন সুযোগ নেই, সে উড়ে এসে জুড়ে বসলেও নয়।
ওপরে উঠলে সবকিছুই পরিষ্কার দেখা যায়। বাড়ি-ঘর, অফিস-আদালত, কলকারখানা, স্কুল-কলেজ। কী কোথায় আছে, কিভাবে আছে এবং কে কোথায় আছে, কিভাবে আছে। মানুষের গোটা সভ্যতার ও জীবনযাপন প্রক্রিয়ার সামগ্রিক একটা চিত্র গোচরে আসে। খুঁটিনাটি সবই বোঝা সম্ভব হয়। পাশাপাশি থাকলে এসব কিছুই জানা যায় না—- মানুষ কিভাবে চলছে বা কী করছে। ওপরে উঠে উড়তে উড়তে আমি দেখছিলাম এক অজানা জগৎকে। এই জগৎ এতদিন কাছ থেকে দেখে কিছুই বুঝতে পারতাম না। মানুষের স্বভাব যে এমন কে জানত? তার অভ্যাসও অবাক করল আমাকে। জানা ছিল না, মানুষ এভাবে বাঁচে।
মানুষের প্রত্যেকটি বাড়িতেই দেখলাম, পারিবারিক সদস্যরা ছাড়াও উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকরা রাজত্ব করছে। কোন কোন বাড়িতে সবই উড়ে এসে জুড়ে বসা লোক। তারপর মনে হল, কোন বাড়িতেই বুঝি মূল লোকরা নেই। আদৌ কোথাও আসল লোকরা থাকে কিনা সন্দেহ হতে লাগল। আমার চোখের সামনে বিভিন্ন বাড়িতে উড়ে এসে জুড়ে বসতে দেখলাম দলে দলে লোককে। কোন বাড়িতে আর মূল লোকরা থাকার কোন উপায় রইল না। এমনকি, বাড়িগুলিকেও উড়ে এসে জুড়ে বসতে দেখলাম নানা জায়গায়। জগৎজুড়ে এই খেলাই চলতে লাগল পুরোদমে। ভাগ্যিস উড়তে শুরু করলাম! নাহলে এইযে কাণ্ড চলছে তার কিছুই জানতে পারতাম না।
উড়তে উড়তে গোটা পৃথিবী জুড়ে চক্কর মারতে লাগলাম। নিচে শুয়ে আছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট। মানুষের চলাচল অব্যাহত এবং পুরোটাই ওড়াউড়ি। মানুষ যে এত ওড়ে ধারণাই ছিল না। নিজেই কেবল ওড়ে না, পারলে বাড়িঘরও সঙ্গে নিয়ে যায়। এইসব বিচিত্র বিষয় দেখতে দেখতে উড়ে যাচ্ছিলাম। পৃথিবীর কোথায় না মানুষ আছে? মানুষের বাড়িঘরও সর্বত্র। তাই মানুষের ওড়াউড়ির খেলা চলছে সারা পৃথিবী জুড়েই। একসময় আমি আবিষ্কার করলাম, আমার মধ্যে আরও বিশেষ ক্ষমতা এসে গেছে। উড়ে আমি কেবল স্থানান্তরেই নয়, কালান্তরেও যেতে পারছি। অর্থাৎ এখন আমি উড়তে পারছি স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে। যেসব মানুষ উড়ে বেড়াচ্ছে তাদের সবারই এই বিশেষ ক্ষমতা আছে কিনা জানিনা, কিন্তু আমার যে আছে তাতে কোন সন্দেহ রইল না। এক স্থান থেকে অন্য স্থানের পাশাপাশি এক যুগ থেকে অন্য যুগেও আমি উড়ে যেতে পারছিলাম। অতীত আর ভবিষ্যৎ কিছুই আমার অগম্য থাকল না। এই বিশেষ ক্ষমতা অর্জন করার পর মানুষের কাজকর্ম এবং স্বভাবচরিত্র আরও বিচিত্রভাবে ধরা পড়তে লাগল। সোজাসাপটা জগৎটার মধ্যে যে এত রহস্য লুকিয়ে আছে অনুমানই করতে পারিনি।
উড়ে উড়ে সেই কোন্ কোন্ আদিযুগে চলে যেতে লাগলাম। এই যে এত এত ঘরবাড়ি, কোনোটারই কোথাও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সেই আদিম যুগ থেকেই উড়তে শিখল মানুষ। উড়তে শিখল না বলে বলা উচিত উড়তে পারল। তারপর তার ঘরবাড়ি তৈরি করার উদ্যোগ নজরে এল। বর্তমান কালের মানুষের প্রত্যেকটি বাড়িতে হানা দিয়ে দেখতে পেলাম যে এখন যারা বাসিন্দা একসময় তারা কেউই এখানে কোনটিতেই ছিল না। প্রত্যেকটি বাড়ি ধরে পিছিয়ে যেতে যেতে দেখলাম, এখন যারা সেখানকার বাসিন্দা তারা কোন একসময় উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। প্রত্যেকটি বাড়িতেই উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষের দল। কোন বাড়িতেই কোন বাসিন্দা আদি ও অকৃত্রিম বা স্থায়ী নয়। এই তো গেল রহস্যের একটা দিক, এর অন্য দিকও আছে। যে বাড়িতে উড়ে এসে জুড়ে বসল যে লোক সে আগের বাসিন্দাকে তো উৎখাত করে দিলই আবার লড়াই করতে লাগল সেই বাড়ি চিরকাল নিজের অধিকারে রাখার জন্য। গলা চরিয়ে দুনিয়াসুদ্ধ সবাইকে বলতে লাগল যে তার উড়ে এসে জুড়ে বসা বাড়িটির সে অকৃত্রিম বাসিন্দা। মজা হল এই যে পরে একসময় আবার কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসে তাকেও উৎখাত করে দিল। সেই নতুন বাসিন্দার কার্যকলাপও একইরকম এবং তারও ভবিষ্যৎ প্রাক্তন উৎখাত ব্যক্তিরই মত, তাকেও আবার উৎখাত হতে হল নতুন আরেক উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকের উৎপাতে। সময়ের বাঁকাচোরা গলিপথ ধরে উড়ে যেতে যেতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখলাম বারবার। একই ঘটনা, একই নিয়ম। কোন বৈচিত্র্য নেই।
আমার ফেলে আসা বাড়িটাকে দেখার শখ চাপল। ওই বাড়িতে উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকেদের ভিড়টা কেমন। সবাই মিলে আমার বাড়িটাকে দখল করে নিয়েছিল। আমি নিজেই আর থাকার জায়গা না পেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে উড়ে বেড়াচ্ছি। গিয়ে দেখি, বাড়িটাতে লোকজনের হট্টগোল। সবাই উড়ে এসে জুড়ে বসা লোক। এবার সময় ধরে উড়তে লাগলাম। একসময় গিয়ে দেখতে পেলাম, ওই বাড়িটা আসলে আমার বাড়ি নয়। আমিও ওখানে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলাম। তার মানে, আমারও উড়ে এসে জুড়ে বসার ক্ষমতা বা অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু নিজের এই ইতিহাসটা নিজের কেন মনে ছিল না? জুড়ে বসা তো পরের কথা, আমি উড়তে পারি সেটাই তো কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত অজানা ছিল। উড়তে উড়তে ভাবতে লাগলাম। ভাবতে ভাবতে আর শুয়ে থাকা পৃথিবীটার বাড়িঘরে মানুষের কাজকর্ম দেখতে দেখতে উত্তরটা মাথায় এল একসময়। আসলে এই যে জগৎময় উড়ে এসে জুড়ে বসা চলছে তার সব যে মানুষ সজ্ঞানে করছে এমন নয়। মানুষের স্বভাব উড়ে এসে জুড়ে বসা। সেই স্বভাবের বশে মানুষ নিজেরই অজান্তে এতসব কাণ্ডকীর্তি করে চলেছে। আবার সবসময় যে না জেনে উড়ে এসে জুড়ে বসছে এমন নয়। তবে জেনেই হোক বা না জেনেই হোক, মানুষরা অবিরাম উড়ে এসে জুড়ে বসছে তার স্বভাবধর্ম অনুযায়ী।
এখন আমি কী করব ? প্রচুর সত্য উদ্ঘাটন হল, অনেক রহস্য জানা গেল। তাতে হেরফের ঘটল না কিছুই। সব যেমন চলার তেমনই চলতে থাকবে। পরিবর্তন কোথাও ঘটবে না তেমন। আর যদি ঘটে তাহলে মানুষের সভ্যতাটাই পাল্টে যাবে এবং সেদিন বোধহয় মানুষও থাকবে না। ওইসব যা ঘটার ঘটবে, সেসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে এখন লাভ নেই। আমি কী করব সেটাই আসল মাথাব্যথা। একটানা কি উড়তেই থাকব? সেটা কি সম্ভব, না উচিত?
আমার মধ্যেও উড়ে এসে জুড়ে বসার স্বভাব রয়েছে। ইতিহাসে সেই প্রমাণ দেখতেও পেয়েছি। নিজের অজান্তেই অতীতে কোন একসময় উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলাম। যদি অতীতে সেই ঘটনা ঘটে থাকে আবার তা ঘটবে না কেন? পার্থক্যটা হল এই যে অতীতে ঘটেছিল ব্যাপারটা আমার অজান্তে আর এখন যদি ঘটে তা ঘটবে আমার সজ্ঞানে। প্রত্যেকটি মানুষকে দেখে এটা এখন আমার কাছে পরিষ্কার যে সারাজীবন ধরে সে অনবরত উড়ে এসে জুড়ে বসার সঙ্গে যুক্ত থাকে, সজ্ঞানে হোক বা অজ্ঞানে, এবং এই ঘটনা তার জীবনে সব অবস্থায় ও অবস্থানে সে মোকাবিলা করে।
উড়তে পারছি যখন আমাকেও এবার কোথাও গিয়ে জুড়ে বসতে হবে। আজীবন যে জুড়ে বসে থাকব কোথাও তা কিন্তু নয়। আবার একসময় উড়ে যাব, আবার কোথাও গিয়ে জুড়ে বসব। জীবন এভাবেই চলে। তারপর বুঝলাম, এভাবে যা চলে তাকেই জীবন বলা হয়। ব্যাপারটা কেমন গোলমাল পাকিয়ে যাওয়ায় আমি আর বেশি না ভেবে মাটির কাছাকাছি উড়ে যেতে লাগলাম।
এবার আমি জুড়ে বসার একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নেব। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)