তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
অধ্যায়: দশ
আমরা ধনপতি আর গণপতিকে নিয়ে পড়েছিলাম। মানুষে মানুষে পাল্টাপাল্টি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বোঝার জন্য। অনেকদিন ধরে দেখে গেলাম দু’জনকে। বুঝতে পারছিলাম না কে কার মধ্যে গিয়ে ঢুকবে। তখনও পর্যন্ত দ্বিমুখী অভিযানে ব্যস্ত ছিলাম আমরা। এক তো এই মানুষে মানুষে পাল্টাপাল্টি হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলির অনুসন্ধান আর দুই, পৃথিবীতে ঠিক মানুষ খুঁজে বার করা। দ্বিতীয় অভিযানের আবার পদ্ধতিগত ভিন্নতা ছিল। তা-ও দু’রকম। হয় কাউকে বেছে নিয়ে ঠিক মানুষ মনে করে এগিয়ে চলা আর নয়তো তাকে ঠিক মানুষ নয় ভেবে এগোনো। বেশ কিছুদিন ঘোরাঘুরি হয়ে গেল, ঠিক মানুষ দেখতে পেলাম না একজনকেও।
অভিযান চলার সময় রিক্ত একদিন আমাকে বলল,
‘একটা কথা বলতে পারিস তোর কাছে আমি লুকিয়ে গেছি। তোর অনেক আগে থেকেই আমি মানুষ দেখে যাচ্ছি। আজ অব্দি একজনকেও দেখে মনে হয়নি সে ঠিক মানুষ। সোজা কথায়, আমি আজ পর্যন্ত কোন ঠিক মানুষের খোঁজ পাইনি।’
তাহলে কেন এই পণ্ডশ্রম করে মরছি? আমার একটু রাগই হল। সব জেনেও রিক্ত আমাকে নিয়ে কেন খোঁজাখুঁজি করছে? সেই প্রশ্নটাই রাখলাম তার জন্য,
‘তাহলে ঠিক মানুষ খোঁজার চেষ্টা করছি কেন?’
গলায় আমার উষ্ণতা ছিল। রিক্তর একটা বড় গুণ হল, সে পারতে মেজাজ হারায় না। এই কারণেই পর্যবেক্ষক হিসেবে তার দক্ষতা এত বেশি। একটু উদাসীন ভঙ্গিতে সে জানাল,
‘কেন করছি ? আশায়। যদি ঠিক মানুষ পেয়ে যাই কোনদিন।’
‘বললি তো, কেউই ঠিক মানুষ নয়?’
‘কোথায় বললাম ? বললাম, আমি যাদের দেখেছি আজ পর্যন্ত তাদের কেউই ঠিক মানুষ নয়। সেই প্রমাণ পাইনি।’
‘তার মানেই তো কেউ ঠিক মানুষ নয়।’
‘আরে পাগল ! আমি যাদের দেখেছি তাদের কথা বললাম। পৃথিবীতে কোটি কোটি লোক। আমি কতজনকে দেখেছি? হাজারখানেকও হবে কিনা সন্দেহ। এই ক’জনকে দেখলেই কি কোটি কোটি মানুষকে দেখা হয়ে যাবে?’
‘তাহলে তুই কী বলতে চাস?’
‘বলতে চাই এই যে আমি আজ পর্যন্ত কোন ঠিক মানুষের সন্ধান পাইনি। কেউ থার্টি বা ফোর্টি বা ফিফটি পার্সেন্ট মানুষ। আমি ম্যাক্সিমাম সেভেন্টি পার্সেন্ট পর্যন্ত মানুষ দেখতে পেয়েছি বলতে পারি। কিন্তু হান্ড্রেড পার্সেন্ট মানুষ এমন কাউকে দেখতে পাইনি। তার মানে কি সে নেই? একশ’বার আছে। সেই আশাতেই তো খোঁজা। নিশ্চয় তাকে দেখতে পেয়ে যাব কোনদিন।’
‘না-ও পেতে পারি কোনদিন।’
ভেঙে পড়া গলা আমার। রিক্তর গলাও এমনই শোনাল।
‘হ্যাঁ, না পেতেই পারি। আমাদের জীবন আর কত লম্বা ? পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ। ক’জনকে আর দেখতে পাব জীবনে ? সবাই এভাবে আমাদেরই মত মানুষ খুঁজে যায়। কেউ পায়, কেউ পায় না।’
রিক্ত উদাসীন হয়ে গেল। কিছুটা আবেগমথিতও বটে। আমরা একটু সময়ের জন্য চুপ করে গেলাম। কেউ বোধহয় কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারপর রিক্তই নীরবতা ভাঙল, উজ্জীবিত ভঙ্গিতে।
‘তাই বলে ঠিক মানুষ পাওয়ার সন্ধান কি ছেড়ে দেব? কক্ষনো নয়। দ্যাখ্, কোটি কোটি সূর্যের কোটি কোটি গ্রহ। প্রাণ আছে এমন একটি গ্রহের কথাই আমরা জানি। আমাদের এই পৃথিবী। মহাবিশ্বের আর কোথাও প্রাণ আছে কিনা আমাদের জানা নেই। এতদিন খুঁজেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাই বলে কি খোঁজা বন্ধ হয়ে যাবে? নাকি বলব, পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও প্রাণ নেই, প্রাণি নেই? অনেকটা ঠিক এমনই। এক-দু’শ বা এক-দু’হাজার মানুষকে দেখেই কি বলে দেব, ঠিক মানুষ নেই বা তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না? কোটি কোটি মানুষ তো দেখার বাইরে থেকে গেছে। মনে রাখিস, উৎসাহ হারাতে নেই। উৎসাহ হারিয়ে যাওয়ার মানেই মরে যাওয়া।’
এত উৎসাহের কথা শুনেও আমি কিন্তু উৎসাহ খুঁজে পেলাম না। জোর করে বললেই কি উৎসাহ পাওয়া যায়? মনমরা হয়ে মুখভার করে রইলাম। উৎসাহ কোথায়? কোন্ অজানা গ্রহে তার বসবাস? হতাশ বিশ্বের হতাশ বাসিন্দা আমি। আমি কেন, আমরা সবাই। আমরা যারা ঠিক মানুষের সন্ধানে ঘুরে মরছি। কে না ঘুরছে? কেউ বুঝে ঘুরছে, কেউ না-বুঝে। ঠিক মানুষের দেখা সত্যিই কি পায় কেউ? না কি জীবন চলে যায় খুঁজতে খুঁজতেই? আমার ভেবে অবাক লাগল। কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ঠিক মানুষের এতই অভাব? রিক্ত বলছে, আশা না হারাতে। আমি সত্যি কোন আশা দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার মধ্যে এই যে এত অসুখ-বিসুখ, সেসব তো আশা হারিয়ে ফেলারই ফলশ্রুতি। আমি নিজে তো ঠিক মানুষ নই, নিঃসন্দেহে, ঠিক মানুষ কাউকে পেলামও না কোনদিন। আপাতত ঠিক মানুষ খোঁজার অভিযান স্থগিত রেখে অন্য অভিযানটাতেই মনোযোগ দিলাম। মানুষে মানুষে পাল্টাপাল্টি চলে কিভাবে সেই প্রক্রিয়া দেখার অভিযান।
ধনপতি আর গণপতি আমাদের দেখার বিষয়। তাদের কাজকর্ম। এই দু’জনের মধ্যে একটা পাল্টাপাল্টি ঘটবে বলে বিশ্বাস করে রিক্ত। প্রশ্ন হল, এরা ঠিক মানুষ কিনা। সেটা অবশ্য এখন দেখার বিষয় নয়। তবুও আমি কৌতুহলটা দমন করতে পারলাম না। রিক্ত বলল,
‘ধনপতি আর গণপতি কতটা মানুষ সেটা আপাতত ভুলে থাকাই ভাল। আগে দেখা যাক তাদের মধ্যে কিভাবে পাল্টাপাল্টি ঘটে। একটা কথা তোকে জানিয়ে রাখা ভাল, ঠিক মানুষেরা কখনও নিজেকে পাল্টাতে চাইবে না। তাদের দরকার নেই। এজন্যই যদি দেখিস কেউ নিজেদের পাল্টে নিতে চাইছে তাহলে বুঝবি সে অবশ্যই ঠিক মানুষ হবে না। তারাই নিজেকে পাল্টাতে চায় যারা নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।’
আমি প্রশ্ন করলাম,
‘গণপতি নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট নয় এটা স্পষ্ট। কিন্তু ধনপতির মধ্যে তো নিজের ওপর কোন হতাশা দেখলাম না। সে অন্য কাউকে পছন্দ করে কিনা তাও বোঝা গেল না। নিজেকে পাল্টে সে অন্য কারোও মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নেবে এমন ইচ্ছে তো দেখা যায়নি তার ক্ষেত্রে।’
আমাকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে রিক্ত জানাল,
‘তবুও ধনপতি ঠিক মানুষ হতে পারে না। তাকে দেখে বোঝা গেছে। একটু অপেক্ষা করলে তুইও সেটা নিজের চোখে দেখতে পাবি।’
‘কিন্তু ধনপতি নিজেকে পাল্টে অন্য কারো মধ্যে যেতে চায় কি?’
‘সেটা হয়তো এখনই স্পষ্ট নয়। তবে ধনপতির মত লোকেরা কখনোও নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না।’
ধনপতি কী করে রাতের বেলা নিজের বাড়িতে? দিনে সে বাড়ির বাইরে কাটায় প্রায় সবসময়। কত কাজ তার। যে সময়টা দিনে বাড়িতে থাকে নানা লোক তাকে ঘিরে রাখে। একেবারে একা সে নিজের মত কিছুটা সময় পায় একমাত্র রাতে। রিক্তর বিশ্বাস, ধনপতি আসলে কেমন তা জানতে হলে রাতেই তাকে দেখা উচিত। তার জন্য গণপতিকে দেখলেই চলে। সে সবসময় তাকিয়ে আছে ধনপতির দিকে। দেখে আর হাহাকার করে, রাগ ও হিংসেতে জ্বলতে থাকে। ওই জ্বালাটাই সার, লাভের লাভ হয় না কিছুই। একটা লোকের অত বিত্তবৈভব থাকবে কেন? জগতের এ কেমন বিচার? যার থাকবে কেবলই থাকবে, যার কিছু নেই তো কিছুই নেই। চেষ্টা কি সে কিছু কম করে নাকি? কম কষ্ট সহ্য করে নাকি দিনের পর দিন? তবুও কেন সে পায় না কিছুই? আর দেখ ধনপতি, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে কী মজায় ফুরফুর করে উড়ে বেড়াচ্ছে সবসময়। সে কেন অনায়াসে এত এত সৌভাগ্যের অধিকার পাবে? পারলে ধনপতির সম্পদ সে জোর করে কেড়ে নিত। তার এখন প্রায়ই মনে হয়, ওই ধনপতিটা আছে বলেই সে কিছু পাচ্ছে না। ধনপতি সব কেড়ে নিয়ে নিচ্ছে, তার ভাগ্যের যা যা ছিল। যদি ওই আপদটা না থাকত তাহলে সে তার প্রাপ্য থেকে এভাবে বঞ্চিত হত না।
ধনপতির বাড়িটার কত চাকচিক্য। বাড়ির সামনে বাগান, পিছনে বাগান। কতরকমের ফুল-ফলের গাছ। ওই বাগানে বসে দলবল নিয়ে লোকটা মনের সুখে গালগল্প করে, চা-কফি খায়। শীতকালে মরশুমি ফুলের বাহারে বাগান রঙিন হয়ে ওঠে। কত কত পাখির আনাগোনা হতে থাকে। কেবল একটা লোকের এত সুখ হবে কেন ? এ ঘোরতর অন্যায়। তার হুকুম তামিল করার জন্য পঞ্চাশটা লোক হাজির সবসময়। ঠাকুর, চাকর, ড্রাইভার, মালি, গার্ড—- কতরকমের কাজের লোক। মোসাহেবও আছে অগুন্তি। লোকটা কপাল করে এসেছিল বটে। না চাইতেই সব হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে। সবাই তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে কী বলে তা শোনার জন্য। তার জন্য কিছু করতে পারলে সবাই নিজেকে ধন্য মনে করে। কী হ্যাংলামি লোকগুলির তার নজরে পড়ার বাসনায়!
আবার একটা অন্য দিকও দেখতে পায় গণপতি। দেখে নিজে সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য। এই যে লোকগুলি, যারা ধনপতির হুকুম তামিল করার জন্য মুখিয়ে থাকে তারা কি তাকে মন থেকে ভালবাসে? সবাই তাকে টাকার জন্য তোয়াজ করে, প্রতিপত্তি আছে বলে সামনে বিরুদ্ধ কথা বলে না একটাও। পিছনে বা আড়ালে দেখগে এই লোকগুলোই তার মুণ্ডুপাত করে। এই যে চাকরবাকররা সদাসর্বদা তার সামনে নিজেদের হাজির রেখে ‘জো হুজুর’ করে বেড়াচ্ছে, তাদের এটাই কি আসল রূপ? হতেই পারে না। খেয়াল রাখলেই দেখতে পাবে এইসব কাজের লোকরা ধনপতির আড়ালে নিজেদের মধ্যে যখন থাকছে তখন মনের সুখে গালাগালি করছে। তারই মত ওই লোকগুলিও চায় ধনপতির ক্ষতি হোক, সে খুব বেকায়দায় পড়ুক বা শিক্ষা পাক। তবে তারা হয়তো লোকটা মরে যাক চায় না, মরে গেলে যেহেতু তাদের চাকরি যাবে, রোজগার বন্ধ হবে। কিন্তু গণপতির সেসব দায় নেই। ধনপতির ক্ষতি হলে তো বটেই, সে যদি মরেও যায় তার খুব শান্তি।
শান্তি সে সত্যিই পায় এইসব ভাবনা থেকে। সারাদিনের বিদ্বেষ আর আক্রোশ তার জুড়িয়ে যায় যখন ভাবে ওইসব ভাড়া করা লোকরা নিশ্চয় তাকে মন থেকে ভালবাসে না। কেউ না কেউ তাকে অপছন্দ করবেই করবে। সে চেষ্টায় থাকে তাদের কারো সঙ্গে যদি তার কোন যোগাযোগ ঘটে। সুযোগ পায় না। এজন্য তার রাগ আরও বেড়ে যায়। সবাইকে যেন ব্যাটা ক্রীতদাস করে রেখেছে। এ কেমন অন্যায়, তার কাজ করবে বলে বাইরের কারো সঙ্গে কথাও বলতে পারবে না? মগের মুল্লুক আর কাকে বলে ! টাকা আছে বলে এত দেমাক?
তার রাগ হয়, হিংসে হয়, আবার শান্তি খুঁজে পাওয়ার কথাও ভাবে। কিন্তু সত্যিটা কি তাতে ভোলা যায়? সত্যিকথা হল, বিত্তবৈভবের মালিক ধনপতি যে কোন আনন্দ আর আরাম ইচ্ছে হলেই পেয়ে যেতে পারে। তার জীবনে কেবলই আমোদ আর প্রমোদের ঘনঘটা। সম্পদশালী হওয়ার কী আনন্দ তা নিজের চোখে প্রায়ই দেখে গণপতি। দেখে রাতের বেলা, যখন চারদিক নীরব হয়ে যায়।
কিন্তু কিভাবে দেখে? রাত্তিরে কি ধনপতির বাড়িতে সে ঢোকার অনুমতি পায়? রাতে কি বাড়ির গেটে পাহারা থাকে না? একদমই তা নয়। পাহারা বরং আরও জোরদার হয় রাতে। একজনের জায়গায় দু’জন পাহারাওলা থাকে। তবুও গণপতি ভিতরে ঢুকে যায় এবং চলে যেতে পারে যেখানে সে যেতে চায়। অগম্য থাকে না কোন জায়গাই। এমন নয় যে রাত হলে ধনপতি জামাই-আদর করে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। মুখোমুখি দেখা হলেও যে তাকে কোনদিন দেখে না, কোনদিন জানার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি সে কে, রাতে তাকে নেমন্তন্ন করে বাড়িতে যেতে বলবে এই ভাবনা একেবারেই অবান্তর। তবুও ধনপতি রাতে কী করে বা কিভাবে কাটায় সময় তা গণপতি জানে।
রোজ রাতেই ন’টা থেকে দশটার মধ্যে খেয়ে নেয় গণপতি। কী আর খাবে সে? অধিকাংশ দিনই পোড়া খানকতক রুটি আর একটু আলু বা কুমড়ো ভাজা। খেতে খেতে সে ভাবে ধনপতির কথা। ধনপতি নিশ্চয় এখন রাজ্যের যত সুখাদ্য সব ইচ্ছেমত খাচ্ছে। কী কী খাবার হতে পারে তা সে জানেও না সব। ধনপতির মত বড়লোকরা রাতে কী সুখাদ্য খায় তার ধারণা সে করতে পারে না। ভাবতে ভাবতে তার রাগ হতে থাকে, প্রবল হতাশারও শিকার হয় সে। রাগ আর হতাশা তার মধ্যে বিদ্বেষ আর হিংসে বাড়িয়ে দিতে থাকে। বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে একসময় তার গায়ের রঙ একেবারেই হলুদ হয়ে যায়। আর সে গুটিয়ে যেতে থাকে। তার হাত-পা-মাথা সবই গুটিয়ে যায় এবং সমগ্র শরীরটাও ছোট হয়ে আসে। ক্রমশ তার চেহারাতেও পরিবর্তন দেখা দেয়। শেষপর্যন্ত সে হলদে রঙের একটা পোকা হয়ে যায়, এমন এক পোকা যে উড়তে পারে।
উড়তে উড়তে পাঁচিল টপকে সে ঢুকে যায় ধনপতির প্রাসাদোপম বাড়িতে। পাহারাদাররা তাকে দেখতে পায় না। সে উড়তে উড়তেই গিয়ে হাজির হয় ধনপতির খাস কামরায়, শোবার ঘরের বাইরে। বিশাল বারান্দায় বিভিন্ন গাছপালা, চেয়ার-টেবিল সাজানো অপরূপ ভঙ্গিমায়। কাচে ঢাকা বিশাল বিশাল জানলা। একটার বন্ধ পাল্লার কাচের ওপর বসে সে। ভিতরটা স্পষ্ট দেখা যায়। সে দেখে রাজকীয় সুসজ্জিত শোবার ঘরে একটা সোফার ওপর আরাম করে বসে আছে ধনপতি। আরামে তার চোখ বোজা, পা-গুলি গুটিয়ে রেখেছে। মানুষের কত সুখ, কত আরাম, যে দেখবে এখন ধনপতিকে সে তা মর্মে মর্মে বুঝতে পারবে। কত বড় শোওয়ার ঘর আর কত বিচিত্র আসবাবপত্র সেখানে। বিছানাটা নরম তুলতুলে। কী বিচিত্র তার সজ্জা আর কতটাই না বড়! নাঃ, লোকটার মানুষ হয়ে জন্মানো সার্থক। গণপতি ভাবল, সে যেমন বাড়িতে থাকে আর রাতে যেভাবে ঘুমোয় তাতে তার এই যেমন এখন পোকা হয়ে আছে তেমন পোকা হয়ে থাকাই মানায়।
তারপর ধনপতি পাখা মেলল, কারণ সে একটা পাখি হয়ে গেছে। আশ্চর্য সুন্দর এক পাখি। তার ডানায় অপূর্ব কারুকাজ, গায়ে হাজারখানা রঙ। এত সুন্দর পাখি গণপতি জীবনে দেখেনি, জগতে আছে বলে জানতও না। এমন অপূর্ব পাখি নিশ্চয় স্বর্গেই থাকে। সেই পাখি সোফার ওপর দু’দণ্ড বিশ্রাম নিয়ে পাখনা মেলে মন্থরভাবে উড়তে লাগল সারা ঘর জুড়ে। সে উড়ছে আর আলোর ফুলঝুরি ঝরছে। কী অপরূপ ছন্দ ওড়ার! দেখলে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। কেবল কি হিংসে করলেই চলে? লোকটার সৌভাগ্যটার কথাও তো বিবেচনা করতে হবে। নাহলে এমন সুন্দর পাখি হয়ে এমন আরামে উড়তে পারে কি? সে কি পারবে ওইরকম পাখি হতে? তার কপালে পোকা হয়ে থাকাই লেখা আছে। হিংসে করে কী হবে?
তবে একটা বিষয় তাকে খানিকটা ধাঁধায় ফেলে দিল। পাখিটা মনের আনন্দে ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বারবার গিয়ে এ-দেয়ালে ও-দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। খামোখা ধাক্কা খাবে কেন, সে তো ঘরের দেয়ালগুলি দেখতে পাচ্ছে? প্রত্যেকবার দেয়ালে ধাক্কা খাওয়ার সময় পাখিটাকে দেখে কেমন একটু অসহায় বলে মনে হচ্ছিল, যেন সে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুক্তি পেতে চায়, পারছে না দেয়ালগুলি বাধা হয়ে থাকায়। এমনটা কেন হবে? এত বিত্তবৈভব যার, এত প্রভাব-প্রতিপত্তি যার আয়ত্তে সে তো যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। সে কেন মরতে অসহায় হতে যাবে? গণপতি ব্যাপারটাকে তার দেখার ভুল বলে ধরে নিল।
দেখারই ভুল হবে। বিদ্বেষ আর হিংসে তার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। রোজই রাতে ধনপতিকে শোওয়ার ঘরে এরকম বিভিন্ন অপরূপ রূপে আবিষ্কার করে গণপতি, রোজই তার সুখ দেখে, আরাম দেখে, আর সঙ্গে কী যেন একটা লুকোনো অস্বস্তি টের পায়। সেটা নিজের বিভ্রম বলেই ভাবে সে।
মোদ্দা কথা হল, ধনপতির মত এমন এক বিশাল মাপের লোক তার পাড়াতে একেবারে তার পাশের বাড়িতে থাকার জন্য তার কোন উপকারই হচ্ছে না। এই কি প্রতিবেশীর ব্যবহার? হতে পারে লোকটা বড়লোক, থাকতে পারে তার প্রতিপত্তি, কিন্তু সে মানুষ হওয়ার যোগ্য নয়। এমন লোকের পৃথিবীতে থেকে কী লাভ যে অন্যের উপকারে লাগবে না? গণপতি সারাদিনই এসব কথা ভাবে আর দেখে ধনপতির কত সুখ, কত খাতির-যত্ন। দেখে আর দাপাদাপি করে। তার আক্রোশ আর বিদ্বেষ বাড়তেই থাকে। লোকটা তার পাড়াতে তার পাশের বাড়িতে না থাকলে এত অশান্তি হত না। অবজ্ঞা আর অবহেলা এভাবে সহ্য করতে হত না তাকে। নিজেকে এত ক্ষুদ্র, এত তুচ্ছ ভেবে সারাদিন এতটা মনোকষ্ট পেত না।
পাঁচটা-ছ’টা গাড়ি লোকটার। কী জৌলুষ সবক’টা গাড়ির! বিদেশি গাড়িই হবে নিশ্চয়। তার চোখের সামনে দিয়ে নিত্য হুঁশ-হাশ বেরিয়ে যায়। সে জুলজুল করে দেখে আর ধুলো খায়। রাগে তার হাড়পিত্তি জ্বলতে থাকে। কী বেয়াক্কেলে স্বার্থপর লোক! তাকে ডেকে গাড়িতে চড়াবে তো দূরের কথা, কোনদিন গাড়ি থামিয়ে একটু কথাও বলে না। অ্যায়সা অভদ্র আর ইতর!
দিনের পর দিন এভাবে অপমানের জ্বালা ভোগ করে গণপতি আর ভিতরে ভিতরে আক্রোশ তার বাড়তেই থাকে। সে মনপ্রাণ দিয়ে কামনা করে, ধনপতির বড় কোন বিপদ হোক। এই ইচ্ছে বলশালী হতে শুরু করে। সে তারপর একদিন ভাবে, ধনপতি মরলে সে সবচেয়ে বেশি শান্তি পাবে। জীবনে তার সবচেয়ে আনন্দের দিনটা হবে ধনপতির মৃত্যুদিন। আর সে বিশ্বাস করতে শুরু করে, যারা ধনপতির বাড়িতে থেকে কাজকর্ম করছে, সেইসব কাজের লোকরাও নিশ্চয় তাদের মনিবকে পছন্দ করতে পারে না। তাদের কারো না কারো সঙ্গে সে ভাব জমাবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। প্রথমটায় পাত্তা না পেলেও সে দমে যায় না। ধনপতির তিনটে-চারটে ড্রাইভার, চারটে-পাঁচটা চাকর, পাঁচটা-ছ’টা পাহারাদার। আর আছে সেক্রেটারি, ঠাকুর, মালি ইত্যাদি কত কত লোক। এদের একজনের সঙ্গেও সে ভাব জমাতে পারবে না?
একান্তভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেলে অনেক ইচ্ছেই পূর্ণ হয়। ধনপতির অনেক কাজের লোকের মধ্যে অন্তত দু’জন ড্রাইভার, তিনজন চাকর, এমনকি একজন পাহারাওলার সঙ্গেও তার আলাপ হয়ে গেল। সেক্রেটারি ধরনের একটা লোকের সঙ্গেও ভাব জমল তার। সে যা ভেবেছিল তা খুব একটা ভুল নয়। এরা কেউই ধনপতিকে অন্তর থেকে ভালবাসে না। তাকে ভয় পায়, সমীহ করে, ওই পর্যন্ত। সামনে সবাই বিনয়ের অবতার। পিছনে অনেকের মধ্যেই সে ক্ষোভ আর অভিযোগ দেখতে পেল। বিশেষ করে ঘুনু নামের এক ড্রাইভার আর খোচাই নামের এক চাকর তো দেখা গেল ধনপতির ওপর বেজায় খাপ্পা। গণপতি দেখল, ঘুনু আর খোচাই তাদের মনিবকে এতটাই অপছন্দ করে যে সবসময় চায় তাদের মনিব বেকায়দায় পড়ে নাকাল হোক।
কিন্তু এটা সত্যিকথা, অপছন্দ করলেও মনিব মরে যাক এটা কেউ ভাবে না। ঘুনু আর খোচাইও নয়। অমঙ্গল কামনা করলেও ধনপতির মৃত্যুকামনা করে না কেউ। গণপতির সঙ্গে এখানটাতেই তাদের তফাৎ। তা না করুক, ঘুনু আর খোচাই দু’জনের সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগল। তাদের সঙ্গে সুযোগ পেলেই ধনপতির বাপান্ত করে ভিতরে বেশ শান্তি পাওয়া যায়। এই ঘুনু আর খোচাই, দু’জনের মধ্যে কে বেশি খাপ্পা তাদের মনিবের ওপর? ঘুনু দু’-দু’বার দরকারে টাকা চেয়ে পায়নি। টাকা তো দেয়ই নি ধনপতি, উল্টে তাকে যথেষ্ট অপমান করে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার হুমকি দিয়েছিল। মাইনেটা ভাল বলে ঘুনু মুখ বুজে সব সহ্য করে আসছে। খোচাই ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিল। মেয়েটার শরীর খারাপ বলে ফিরতে দু’টো দিন দেরি করে ফেলেছিল। তাকে প্রায় তাড়িয়ে দিতে যাচ্ছিল ধনপতি। হাতে-পায়ে ধরেও রেহাই পাচ্ছিল না সে। মনিবের প্রিয়পাত্র হেবো ওকালতি করায় চাকরিটা রক্ষা পেয়েছে।
গণপতি ঠিক এমনটাই ভেবেছিল। দেখলেই বোঝা যায়, ধনপতি লোকটা মোটেই সুবিধের নয়। তার বিত্তবৈভব আছে, প্রভাব-প্রতিপত্তিও রয়েছে, কিন্তু মনটাই নেই। সে নিজেকে ছাড়া কাউকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। এমন লোক থেকে সমাজের কোন্ উপকার হয়? রাস্তায় ঘোরা একটা কুকুরও বিনা মাইনেতে পাহারা দেয়, ধনপতির মত লোক সেইরকম কোন কাজও করে না। এসব লোকের মৃত্যু হওয়ায় উচিত। তার কাজের লোকরা তার মৃত্যু চাইবে না, কিন্তু গণপতির তাদের মত দায় নেই।
তারপর একদিন সকালবেলা দেখা গেল ধনপতি তার শোওয়ার ঘরে মরে পড়ে আছে। রাতে কেউ তাকে খুন করেছে। জমাটবাঁধা রক্তের ওপর পড়েছিল মৃতদেহটা। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)